মালয়েশিয়ার ডায়রীঃ
৭ জুলাই ২০১৩ সাল, রবিবার। ভোর
৫টায় ব্যাংকক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা চারজন একসাথে প্রবেশ করি। মালয়েশিয়ান
এয়ারলাইনের কাউন্টারে বর্ডিং পাশের জন্য লাইনে দাড়াই। সামনে মহিলা অফিসার আমাদেরকে
বললেন কুয়ালালামপুরে হোটেল বুকিং ছাড়া তিনি বোর্ডিং পাস দিবেন না। জিন্নুন এবং
রাসেল ইন্টারনেটে হোটেল বুকিংয়ের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু কোনমতেই সম্ভব হচ্ছেনা।
আমি ও খোকন দাঁড়ানো। হঠাৎ অফিসার আমাকে ডেকে নিয়ে আমাদের পাসপোর্ট দুটি আবার
পরীক্ষা করেন। আমাদের পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা দেখে সাথে কত ডলার আছে জানতে চায়।
আমার পকেটে থাকা প্রায় তিনহাজার মার্কিন ডলার তাকে দেখাই। এভাবে উড়োজাহাজ উড্ডোয়নের পূর্ব মূহূর্তে
আমাদেরকে বর্ডিং পাস প্রদান করে। এখানে এই বিড়ম্বনার জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের
কর্মকর্তাকে দোষ দেবার কিছু নেই। আমাদের দেশের দালালরা অসংখ্য মানুষকে অবৈধভাবে
সেখানে নিয়ে যায়, সে কারনে আমাদের মত বৈধ যাত্রিরাও শেষ পর্যন্ত ভোগান্তির শিকার
হন।
সকাল ৭টায় উড়ে কুয়ালালামপুরের
দিকে যাত্রা করি। বিমান থাইসাগরের উপর দিয়ে মালয় উপদ্বীপের উপকূল বরাবর উড়তে
ত্থাকে। নিচে কখনও থাই সমুদ্র কখনও মালয়ের পর্বতমালা নজরে পড়ে। সকাল ৯টা ৪৫মিনিটে
আমাদের উড়ালযান কুয়ালালামপুরের মাটি স্পর্শ করে। এই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনেও আমরা
বেশ বিড়ম্বনায় পড়ি। এখানে জিন্নুন ও আমাকে ইজি রিলিজ করলেও আমাদের দুইজন সাথি খোকন
ও রাসেলকে প্রায় একঘন্টা পরীক্ষা করে এন্ট্রি দেয়। প্লেন থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের
ভিতর দীর্ঘ্যপথ হাঁটতে হয়। দুইবার চলন্ত বেল্ট চড়েও সামনে এগিয়ে যাই। বিমানবন্দরের
ভিতর কাচঘেরা কাঠামোর ভিতর বৃক্ষশোভিত টিলা সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটি
প্লেটফরমে গিয়ে মিনিট্রেন চড়ে আর মানুষের সাথে আমরা বিমানবন্দর হতে বেরিয়ে আসি। এই
মিনিট্রেনে বসে এই বিশাল বিমানবন্দরে অসংখ্য বিমান উঠানামা করতে দেখি। এই
বিমানবন্দরে একদিকে প্রেন অবতরন করে এবং অন্যদিকে ভিন্নপথে অবতরন করে।
বিমানবন্দর হতে বেরিয়ে সিরিয়ালে
আসা একটি লালক্যাবে কুয়ালালামপুর শহরের বুকিতবিনতাং এলাকায় যাই। এয়ারপোর্ট হতে
আঁটলেনের এক সুপ্রশথ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্থা দিয়ে আমাদের কারটি অগ্রসর হয়।
দু’দিকে সবুজ পাহাড় এবং চোখ জুড়ানো পামবন। সারি সারি পাম গাছগুলো যেন আমাদের দেশের
অনুচ্চ সুন্দর পরিপুষ্ট তালগাছ। সড়কটি কোথায়ও উঁচু কোথায়ও নিচু ঢেউয়ের মত এগিয়ে
গেছে। আসলে মালয়েশিয়া একটি পার্বত্যদেশ, এখানে সমতলভূমি খুব একটা নেই।
কুয়ালালামপুর শহরে ডুকার আগে রিসোর্টের মত পাহাড় ঘেরা জনপদ চোখে পড়ে। ঢালুছাদ ও
টাইলস বসানো বাড়িগুলো খুব মনোরম। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে পামবাগান পেরিয়ে কুয়ালালামপুর
শহরে আসতে আমাদের প্রায় দেড়ঘন্টা লেগে যায়। সারাটা রাস্থাই জনশূন্য এবং পাহাড় ও
পামবাগানে সুরভীত।
কুয়ালালামপুর প্রবেশ করে কারটি
উঁচুনিচু পাহাড় পেরিয়ে বুকিতবিনতাং এলাকায় আসে। একটি তামিল রেস্টহাউস আমরা ভাড়া
করি। বারান্দায় ফ্লাওয়ার বক্সে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। এই রেস্টহাউসের সামনে পাহাড়
এবং পিছনে বেয়ে বেয়ে নেমে নিচু উপত্যকা, যা অনেকটা আমাদের রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি
শহরের মত। এই রেস্টহাউসের কর্নদার একজন কালো তামিল যুবতী। মোঠাসোঠা এই মহিলা আগেই
ভাড়া চেয়ে নেই। মনোরম এই পাহাড়ি এলাকার রাস্থায় কিছু যুবক জটলা করে আড্ডা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের মত এখানে নিশ্চয় অনেক অলস মানুষ আছেন, যা সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডে
নেই। কুয়ালালামপুরে লোকভীড় কম, রাস্থাঘাট প্রশস্থ, ঘন বৃক্ষরাজির ছিন্নপাতা এদিক
ওদিক কিছুটা ছিটিয়ে রয়েছে। নগরে কোন কোলাহল কিংবা যানজট নেই। রেস্টহাউসের
ব্যবস্থাপক যুবতীকে দেখি একটি তামিল ভাষায় লিখিত পত্রিকা পড়ছেন। এই যুবতী আমাকে
বললেন তার পিতামহ ভারতের তামিলনাড়ু হতে বৃটিশ শাসনামলে মালয়েশিয়া আসেন। তিন
প্রজন্ম ধরে তারা নিজেদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সযতনে লালন করে মালয়েশিয়ায় বসবাস
করছেন।
কুয়ালালামপুরে সর্বত্র অনেক
বাংলাদেশী পাকিস্তানী ও ভারতীয় খাবার হোটেল রয়েছে। এইসব হোটেল পরিচালনা করছেন অনেক
বাংলাদেশী তরুণ। এশহরের রাস্থায় হাটলে অনেক বাংলাদেশীর দেখা মেলে। জীবিকার ধান্ধায়
বাংলাদেশের মানুষ সারাটা মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
ঐদিন দুপুরে আমরা কুয়ালালামপুর
শহর ঘুরতে বের হই। কুয়ালালামপুরে নীল ও লাল দুই ধরনের ট্যাক্সিক্যাব চলাচল করে।
নীলে ভাড়া বেশী, লালে কম। আমরা লালক্যাব ভাড়া করি। চালক একজন চীনা, তার নাম সী কে।
আমরা তাকে উপহার দিলে তিনি খুব খুশী হন। সহজ সরল এই ভদ্রলোকের মোবাইল নং
০১৬৯০৯৯০৯৯ তিনি একটি কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন আর কোনদিন মালয়েশিয়া সফর করলে তাকে
যেন আমরা কল করি। তিনি আমাদেরকে তামিল চালকদের গাড়িতে উঠতে বারন করে হাতদিয়ে
এমনভাবে গলাকাটার অভিনয় করেন যেন ওদের গাড়িতে উঠলে আমাদের গলাকেটে খুনকরে সবকিছু
লোটপাট করে নিয়ে যাবে। কিন্তু আসলে তিনি বড় কষ্টকরে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যা বুঝাতে
চাইছেন তাহল তামিল চালকরা ঠগ, ওরা ধান্ধাবাজি করে অধিক ভাড়া নিয়ে যাবে। সীকের
অহংকার তিনি একজন চীনা, তিনি সৎ, তামিল চালকরা তার মত সাচ্চা আদমি নয়।
সীকে আমাদেরকে মহাতির মোহাম্মদ
নির্মিত অপরূপ সুন্দর শহর পুত্রজায়ায় নিয়ে যান। পুত্রজায়া এক স্বর্গশহর। কুয়ালালামপুর
হতে একঘন্টা ঝড়বেগে গাড়ি চড়ে আমরা পুত্রজায়ায় যাই। অনন্যসুন্দর নদী ও লেক
পরিবেষ্টিত পাহাড়ি শহর এই পুত্রজায়া। বিশ্বের সেরা সেরা নগরবিদ এবং স্থাপত্য
শিল্পীরা এই আধুনিক শহর ডিজাইন করেন। তারা নদী ও লেক, পাহাড় ও উপত্যকা, বনভূমি ও
প্রকৃতির এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটান এই আধুনিক নগরে। ঝলমলে এক স্টিলের সেতু অতিক্রম
করে পুত্রজায়ায় প্রবেশ করতে হয়। সীকে সেতুর উপর কার থামান। নদীর টলটলে জলে বসন্ত
বাতাসে তরঙ্গমালা তৈরি করছে, এই তরঙ্গমালায় সূর্যরশ্মি পরে সোনার মত ঝিলমিল করছে।
সামনে বড় লেক, ঝুলন্ত সেতুর স্টিলের আলো প্রতিফলিত হয়ে দূরে ছিটকে পড়ছে। সেতুর
মাঝখানে বট বনসাই যতনে বসানো। একটি দুটি নয়, অনেকগুলো
বনসাই।
পুত্রজায়া এক স্বপ্নকল্প শহর। বড়
বড় রাস্থা, দুপাশে সাজানো বাগান। পরিকল্পিত ঝাউগাছ কোথায়ও বর্গাকার, কোথায়ও
ডিম্বাকার। লেকের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপমালাকে পরিনত করা হয়েছে সুন্দর সুন্দর
বাগিচায়। পুত্রজায়া নিরবতার শহর, এখানে সব সময় বিরাজ করে এক সুনসান নিরবতা।
আমরা পুত্রজায়া জামে মসজিদে যাই।
মসজিদের সুউচ্চ মিনার আমার দেখা দিল্লীর ঐতিহাসিক কুতুবমিনারকে উতরে যাবে। মসজিদের
দুইদিকে কৃত্রিম লেক। বাহিরে অজু করে শাহী মসজিদে ডুকে দু’রাকাত দাকিয়াতুল মসজিদ
নফল নামাজ পড়ি। এই মসজিদের সৌন্দর্য্য ও বিশালতা আমাদেরকে বিস্মিত করে। মসজিদের
বামদিকে পর্দাঘেরা মহিলাদের এবাদত স্থল। নানা ধর্ম ও বর্নের লোকজন মসজিদে ঢুকে
মুসলিম স্থাপত্য দেখছেন। অবাক হই, যখন দেখি চীন জাপানী হাফপ্যান্ট পরিহিত মেয়েরা
পাশে রাখা বোরকা পরে সারাটা মসজিদ ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বের হয়েই বোরকা ফেলে আগের
বেশে চলে যাচ্ছে।
পুত্রজায়া- সারাটা শহর যেন
আর্কিড, ফুল, বনসাই ও বৃক্ষশোভিত স্বর্গউদ্যান। মসজিদ হতে বের হয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে
নেমে লেকের জলসমতলের বাগানে যাই। এই বাগানে আছে দোকান, কফিসপ, হোটেল ইত্যাদি। আমরা
একটি হোটেলে ডুকি। এখানে অনেক বিদেশী ও মালয়ী তরুণ তরুনীরা চা-আড্ডা দিচ্ছেন।
জায়গাটা এত আকর্ষনীয় যে ফটো তুলার জায়গার অভাব নেই।
মসজিদের কাছে লেকে ভেসে আছে একটি
পাহাড়, সেই উঁচু পাহাড়ে রাজকীয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। নানা জাতের ফুলে ফুলে ভবনটি
সুসজ্জিত। আমরা প্রেসিডেন্ট হাউসের সিঁড়িতে বসি। আমাদের মত এত প্রহরার কড়াকড়ি
এখানে নেই। প্রেসিডেন্ট ভবনের বাগানে আমরা ফটো তুলি ও ভিডিও করি। মালয়েশিয়া
সরকারের সব সরকারী অফিস আদালত এবং আমলাদের বাসস্থান পুত্রজায়ায়। এখানে রয়েছে
প্রেসিডেন্ট হাউস, মজলিশ ভবন (জাতীয় সংসদ), সচিবালয়, সুলতান ভবন ইত্যাদি। এশহরে
রয়েছে বিভিন্ন দেশের এমব্যাসি, যা এই শহরটিকে মালয়েশিয়ার কুটনৈতিক পাড়ায় পরিনত
করেছে।
চালক সিকে গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে
পুত্রজায়ার একটি বাগান লেকে নিয়ে যান। এই অপরূপ স্থানে আমরা মৃদুমন্দ বসন্তি
হাওয়ার পরশ উপভোগ করি। এদিকে সন্ধ্যা গনিয়ে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের
নাতিষীতুষ্ণ মোলায়েম রোদ। মালয়েশিয়া একই অঞ্চলে অবস্থিত সিঙ্গাপুরের মত চিরবসন্তের
দেশ। এখানে সব সময় আমাদের দেশের মার্চ মাসের আবহাওয়া বিরাজ করে। বারমাসই প্রতিদিন
একটু আধটু বৃষ্টি হয়। এখানে ঋতু একটাই- আর তা হল বসন্তকাল।
সিকে ড্রাইভারকে আমাদের পছন্দ
হয়। গাড়ি তার নিজের, তাই ভাড়া স্বল্প। তার সাথে আমাদের কথা হল, পরদিন তিনি সারাটা
কুয়ালামপুর ঘুরে দেখাবেন এবং বিকেলে গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে আমাদেরকে ফেলে আসবেন। গ্যান্টিং
হাইল্যান্ড হতে আমরা ফিরব রাতে শহরবাসে। খরচ কমাতেই এমন পরিকল্পনা।
৮ জুলাই ২০১৩ সাল সোমবার। সকাল
বেলায় চালক সিকে নির্ধারিত স্থানে এসে ফোন করলেন। আমরা চারজন তার কারে বসি।
প্রথমেই নিয়ে আসেন কুয়ালালামপুর টাওয়ার তথা কে.এল টাওয়ারে। ইহা অনেকটা সিঙ্গাপুর
টাওয়ারের মত। তবে এই টাওয়ারের ভূমি সমতলে রয়েছে মালয়েশিয়া ভিলেজ হেরিটেজ। এখানে যেমন
উচ্চ তেমন প্রশস্ত একটি বৃক্ষের সাথে মোলাকাত করি, সমরূপ বৃক্ষ বাংলাদেশের কোথায়ও
দেখি নাই। কে.এল টাওয়ারের আরোহনের ভাড়া অত্যাধিক, তাই আমরা টাওয়ারের চূড়ায় উঠা হতে
বিরত রই।
এবার আমাদের সামনা সামনি হয়
বিশ্ববিখ্যাত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। টাওয়ার দুটি এতই উঁচু যে শীর্ষের স্থম্ব দুটি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘমালা উড়ে যাচ্ছে। এই টাওয়ারে আরোহন করে চারপাশে মেঘের উড়া উড়ি
উপভোগ করা যায়। মেঘের ফোটা তৈরি হয়ে নিচের দিকে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসার দৃশ্যও দেখা
যায়। এই টাওয়ারের নিচদিকে কয়েকতলা জুড়ে মার্কেট। এখানে বহু ভিনদেশি লোকজন বাজার
করতে আসেন। ২৫/৩০ তলা উপরে টাওয়ার দুটি একটি সেতুদ্বারা সংযুক্ত। দুবাইয়ের বুর্জ
আল খলিফা নির্মানের আগে এই টুইন টাওয়ারই ছিল এশিয়ার সর্বোচ্চ ভবন। আমরা পেট্রোনাস
টাওয়ার মার্কেটে প্রবেশ করি। একটি বিশ্ববিখ্যাত সোনা-হীরার দোকানে ডুকতে যাই। কিন্তু
এখানে ক্রেতার প্রবেশ সংখ্যা সীমাবদ্ধ। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীরা যে কয়জন লোক বের হয়
টিক তত জনকে ডুকতে দেয়। এই দোকানে ডুকার জন্য কিছুক্ষন লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে
ফিরে আসি।
পেট্রোনাস টাওয়ার হতে বেরুলে
চালক সীকে আমাদেরকে একটি লেকগার্ডেনে নিয়ে যান। পানির উপর নির্মিত ঝুলন্ত স্থাপনায়
বাতাস খেয়ে ও জল-গার্ডেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। এবার আমরা আসি
মালয়েশিয়ার প্রাচীন সুলতানী প্রাসাদে। ঐতিহাসিক রাজপ্রসাদটিকে এখন যাদুঘরে পরিনত
করা হয়েছে। একটি সুরম্য টিলার উপর রাজপ্রসাদটির অবস্থান। ভবনের ফটক খোলামাত্র
প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ফৌজি পোষাক সজ্জিত বল্লমধারী দুইজন মালয়ান প্রহরী আমাদেরকে
সালাম দেন। তাদের পরনে লাল চেক লুঙ্গি, চেক লম্বা জুব্বা ও মাথায় রঙ্গীন পাগড়ি।
আমরা তাদের সাথে ফটো তুলি। নিজেকে তখন একজন প্রাচীন মালয়ি অভিজাত মনে হচ্ছিল।
রাজপ্রসাদে ডুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এত চাকচিক্যময় ভবন আগে আর তেমন দেখিনি।
ভবনের দেয়ালে মালাক্কার প্রাচীন সুলতান সুলতানাদের ছবি এবং তাদের রাজত্বকালের বিবরণ
রয়েছে। ঘুরে ঘুরে সুলতানদের চিকিৎসা কক্ষ, দন্ত চিকিৎসা কক্ষ, ভি.আই.পি স্বাক্ষাৎ
কক্ষ, সাধারন দর্শন কক্ষ, ডাইনিং, কিচেন, বৈঠকখানা, পাঠাগার, গোসলখানা ইত্যাদি।
রাজপ্রসাদের বাথরুমে ডুকে দেখি
এযে এক বিরাট ভবন। এই বাথরুমে রয়েছে আলাদা আলাদা অনেক উপকক্ষ। উপকক্ষে ছড়িয়ে আছে
হাইকমোড, অজুখানা, গোসলখানা, পোশাক বদলখানা, এবং অঙ্গসজ্জাখানা। চিন্তাই করা যায়না
এসব প্রাচীন সুলতান সুলতানারা যে কি পরিমান আরাম আয়েশে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাদের
দিনগুলো উপভোগে উপভোগে কতটুকু যে পরিপূর্ন করে গেছেন। মালয় রাজপ্রসাদের বিদেশী
মেহমান আমরা বের হয়ে যাদুঘরের পরিদর্শন বহিতে সই করি। স্বাক্ষরের উপর লিখে দেই,
একজন বাংলাদেশী হিসাবে এই যাদুঘর দেখে আমি ধন্য হয়েছি। আমি মালয়েশিয়ার আরো উন্নতি
ও মঙ্গল কামনা করি। রাজপ্রসাদের চারপাশে রাজকীয় উদ্যান। রাজবাগানে ফটো তুলাতুলি
শেষ হলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রাজবাড়ির গেট পার হই।
এবার চালক সী কে আমাদেরকে একটি
চকলেট কারখানায় নিয়ে আসেন। এখানে ফ্রি চকলেট খেয়ে পছন্দানুযায়ী সদ্য তৈরি চকলেট
কিনি। মালয়েশিয়ার চকলেট বিখ্যাত এবং সারা বিশ্বে রপ্তানি হয়। আমরা চীনা গাড়িচালক
সী কের হাতে এক প্যাকেট চকলেট উপহার হিসাবে তুলে দেই। ভারী খুশী হন সীকে এবং কিছু
প্রতিদান দিতে উদগ্রীব হয়ে যান।
এবারে আমাদের গন্তব্য মেঘের
উপরের শহর গেন্টিং হাইল্যান্ড। মালয়েশিয়ার মসৃন আটলেনের রাস্থা দিয়ে প্রায় ১০০/১১০
কি.মি বেগে সিকের গাড়ি ধাবমান হয়। ছবির মত বনবনানী ঘেরা পাহাড়ি রাস্থা। এবার
শিলঙয়ের মত পাহাড়ের আঁকা-বাকা বাক বেয়ে গাড়ি উপরে উঠতে থাকে। কিছুক্ষন চলে খাড়া
পাহাড় বেয়ে উপর হতে উপরে ওঠার পালা। বাতাসের চাপ কমে কানে তালা লাগে এবং দুই কানের
পর্দা পটপট করতে থাকে। সিকের কারটি কুয়ালালামপুর হতে অন্ততঃ মাইল খানেক উপরে উঠে
আসে।
পাশে বসা চালক সিকে আমাকে গল্প
শুনান, তিনি জীবনে মাত্র একটি দেশ সফর করেছেন, আর তা হংকং। মানুষটার বয়স একচল্লিশ,
নিজের গাড়ি চালিয়ে বেশ টাকা জমিয়েছেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে সুখেই আছেন। তিনি
ইশারায় হংকঙয়ের যে বিবরন দেন তাতে মনে হল হংকং যে মালয়েশিয়ার চেয়ে আরো ডিজিটাল, আর
ফাস্ট তা বুঝাতে চাইছেন। তিনি তার কাছে থাকা ২০ হংকং ডলার আমাদেরকে বিতরন করে দেন।
আমার ভাগে পড়ে ৫ হংকং ডলার। কুয়ালালামপুরে পাওয়া চীনা গাড়িচালক সিকেকে আমার এতই ভাল
লাগে যে বাংলাদেশে এসেও তাকে আমি ভূলতে পারিনি।
আবার আমি গেন্টিং হাইল্যান্ডে
ফিরে আসি। সিকে আমাদেরকে এত উপরে নিয়ে এলেও এখনও দিল্লী হনযু দূরকা ওয়াস্ত। গেন্টিং
হাইল্যান্ডে যেতে হলে আর দেড়-দুই মাইল উপরে যেতে হবে। মেঘরাজ্যের অনেক উপরে
আরব্যরজনীর সেই স্বপ্ন শহর। গেন্টিং হাইল্যান্ডে যেতে হবে ক্যাবল কারে চড়ে।
স্টেশনে টিকেট কেটে আমরা ক্যাবল কারের অপেক্ষা করি। ২৫/৩০ জন যাত্রি নিয়ে ক্যাবলকার
বেয়ে নেমে আসছে একটার পর একটা কাচের চলন্ত কামরা। সারিবেধে একদিকে যাত্রিরা
নামছেন, অন্যদিকে উঠছেন। আমরা ঝুলন্ত কামরায় বসতেই এটি উপরে উঠতে শুরু করে। নিচে
আঁকাবাঁকা পাহাড় সারি বেঁধে বেঁধে যেন আকাশ ছুঁইতে ছুটেছে। সমান ফাঁক বহাল রেখে
অনেকগুলো কাচ-কামরা তার বেয়ে বেয়ে একদিকে নামছে অন্যদিকে উঠছে। চিকন তার যদি ছিঁড়ে
যায় ভাবলে প্রানটা ভয়ে শিউরে ওঠে। বেয়ে বেয়ে প্রায় দুই মাইল উপরে এসে গেন্টিং হাইল্যান্ড
স্টেশনে আমরা অবতরন করি।
গেন্টিং হাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার
একটি নামকরা ব্যবসা ও পর্যটন কেন্দ্র। সামনেই মালয়েশিয়ান চীনা নাগরিক ও ব্যবসায়ী
গেন্টিং সাহেবের এক বিশাল প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। তিনিই এই সুউচ্চে স্থাপিত আকাশ
নগরের জনক। গেন্টিং হাইল্যান্ডের নিরাপত্তায় রয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী দল। জায়গাটার
আবহাওয়া অদ্ভুদ, সবসময় মৃদু বৃষ্টিপাত হয়। এদিক ওদিক মেঘ ধুঁয়ার মত উড়াউড়ি করে।
কুয়ালালামপুর কিংবা পুত্রজায়ার উষ্ণগরম আবহাওয়া হতে রক্ষা পেতে একঘন্টা গাড়ি
চালিয়ে এখানে এসে গেলেই গ্রীষ্মের যন্ত্রনা শেষ, এক সুশীতল স্বর্গশহরে আপনি পৌছে
যাবেন।
গেন্টিং হাইল্যান্ডের গল্প যেন
কল্পলোকের গল্প। এখানকার ফুল, লতা পাতা, আর্কিড, বৃক্ষ সব যেন নবযৌবন নিয়ে সামনে
হাজির। জলীয় বাষ্প সারাক্ষন ভিজিয়ে দিচ্ছে চিরসবুজ ঘাস, গাছ ও লতা-পাতা। মৃদু
বৃষ্টিকনা এখানে সারাক্ষন শেয়াল তাড়ায়। এখনকার প্রকৃতির সব রঙ্গই নিখাদ, তাতে কোন
ধূলাবালির প্রলেপ নেই। সবুজ সবুজই, হলুদ হলুদই এবং লাল লালই।
গেন্টিং হাইল্যান্ডে রয়েছে নানান
ধরনের ব্যবসা ও বিনোদন। একটি বিশাল হাইফাই ক্যাসিনো ভবন। এই ক্যাসিনোকে কেন্দ্র
করে কয়েকটি ফাইভ স্টার রিসোর্ট ও হোটেল। আরামদায়ক শীতল বাতাসের এই নিরিবিলি মেঘের
দেশে রয়েছে বিশ্বমানের এম্যুজমেন্ট পার্ক এবং নয়নাবিরাম কুসুমবিথী।
আমি ও রাসেল জুতা খোলে খালিপায়ে
ক্যাসিনো হাউসে প্রবেশ করি। ভিতরে জুয়ার এক এলাহিকান্ড। পাঁচসাত হাজার লোক
কম্পিউটারে বসে বসে জুয়া খেলছেন। বড়দের সাথে আসা শিশুরাও খেলছে কম্পিউটার গেম। এখানে
২৪ ঘন্টা ৭ দিন অবিরাম জুয়াখেলা চলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজন বিভিন্ন পাচতারা
হোটেলে আস্তানা গেড়ে জুয়া খেলতে এসেছেন। সাথে করে নিয়ে এসেছেন বউ, পুত্র-কন্যা, আন্ডা-বাচ্চা
সব। এক ডিলে দুই পাখি শিকার। একে তো সপরিবারে দেশভ্রমণ, সেইসাথে মজার জুয়াখেলা। এই
ডাবল সুযোগ ছাড়ে কে? গেন্টিং হাইল্যান্ডের ক্যাসিনোতে নানান দেশের লোকজন, তবে
যেদিকে চোখ ফেরাই কেবল চীন, জাপান ও থাই চেহারার মানব-মানবী। একজন বাংলাদেশী
বললেন, এখানে জুয়ার আসরে লাভবান হন খুব কমই লোক। বেশীরভাগই সর্বশ্রান্ত হয়ে ফিরে
যান। তারপরও একটা বাজেট তারা খোয়াতে আসেন জুয়ার নেশায়। সরকার পান জুয়াকর,
ক্যাসিনোর মালিক পান কমিশন। তাই এই জুয়াখানা বারমাস জমজমাট থাকে।
গেন্টিং হাইল্যান্ডের জুয়াখানা
একটি আনন্দ-রাজ্য। এখানে ২৪ ঘন্টা ঝাড়বাতির আলো ঝলমল করে ও শীতল বাতাস বয়।
জুয়াখানার উপরে পাঁচতারা হোটেল, ফাস্টফুড ও নানাদেশি খাবার হোটেল, স্বয়ংক্রিয়
ওয়াসরুম ও টয়লেট।
ক্যাসিনোর কম্পিউটারে বড় বড়
স্কীনের সামনে বসে কেঊ বরশী দিয়ে মাছ মারছেন, কেউ বনের পাখি শিকার, বাঘ শিকার
করছেন। কেউ চরকি ঘুরাচ্ছেন, কেউবা তাসের দানে তুফান তুলছেন। সুন্দরবন ভ্রমণকালে
পতিতালয় কি জিনিস? কেবলমাত্র তা দেখে নিতে আমি ও খলিল সাহেব বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লীতে নৌকা
ভিড়াই। পতিতাঘাটের সিঁড়ি বেয়ে পারে উঠে মাত্র চারপাঁচ মিনিট অবস্থান করে এই
পাপপুরী হতে নৌকায় ফিরে আসি। ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ স্থান পতিতাপল্লী এভাবে অনেক
আগেই দেখা হয়। এবার ইসলামের আরেক নিষিদ্ধ স্থান জুয়ারাজ্য দেখা হল। আর সে
জুয়ারাজ্যের অবস্থান মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ায়।
জুয়াখানা হতে বেরিয়ে দেখি
সন্ধ্যা সমাগত। আমি ও জিন্নুন মেঘের সাথে লুকাচুরি খেলায় মেতে উঠি। মেঘের ঘন বাস্প
ছুটে এলে আমরা তাতে ডুকে পড়ি, মেঘের সাথে সাথে দৌড়াই। এই মেঘের বাস্পপ্রবাহ তখন
আমাদের শীতের ভোরের ঘন কুয়াশার কথা মনে করিয়ে দেয়। যতক্ষন আমরা গেন্টিং
হাইল্যান্ডে ছিলাম মনটা আনন্দে ফুরফুর করছিল- এযেন আরব্য উপন্যাসের যাদুর ঘোড়ায়
উড়ে মেঘের রাজ্যে বিচরন। সেদিন রাত ৯টায় বড় বাসে চড়ে আমরা কুয়ালামপুরের উদ্দেশ্যে
যাত্রা করি। কুয়ালামপুরের বহুতল বাস টার্মিনালের ভূগর্ব তলায় এসে বাস থামে। বেশ
মাথা খাটিয়ে জটিল বাস টার্মিনাল হতে আমরা বেরিয়ে আসি। বুকিতবিনতাং রেস্টহাউসে এসে
গভীর ঘুমে ঢলে পড়ি।
৯ জুলাই ২০১৩ সাল, মঙ্গলবার।
সকালের খাবার খেয়ে কুয়ালামপুরের একটি রাস্থা বরাবর হাঁটতে থাকি। রাস্থার একদিকে
ট্রেনের ঊড়াল পথ, অন্যপাশে ওবিসি ব্যাংক। ব্যাংকটি পরিদর্শনে ডুকে যাই। দুইজন
হাফপ্যান্ট পরা চীনা মেয়ে দরজার সামনে বসে আছে। I am a bank manager and came
from Bangladesh, I want to visit your bank বলতেই তারা আমাকে ভিতরে
নিয়ে যায়। ভিতরে অনেকগুলো এটিএম বুথ বসানো কিন্তু নগদ লেনদেনের কোন ক্যাশ কাউন্টার
নেই। কাস্টমাররা এটিএমের মাধ্যমে নিজেরাই সব লেনদেন সম্পন্ন করছেন।
ব্যাংকে এই দুই মেয়ে ছাড়া তেমন
কোন কর্মচারি নেই। বুফে খাবারের মত এখানে সেলফ সার্ভিস। এটিএম বুথে ডুকে
কাস্টমারগন নিজেরা নিজেদের সব ব্যাংকিং কাজ সম্পন্ন করে নিচ্ছেন। অফিসের লোকজনের
দরকার নেই, সব কাজ অটোমেটেড সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঋনবিভাগে আমাদের মত এত কাগজপত্রের
জটিলতা নেই। সেদিন বুঝলাম ডিজিটাল হতে আমাদের ব্যাংককে আর অনেক পথ পারি দিতে হবে।
তারপর আমরা একটি প্রাগৈতিহাসিক
পাহাড়ি বাটুগোহা পরিদর্শন করি। বাটুগোহার সামনে পাহাড়ের পাদদেশের মঞ্চে প্রায় পনের
ফুট প্রশস্ত পঞ্চাশ ফুট উচ্চ একটি বিশাল দেবমূর্তি রয়েছে। বাটুগোহার অবস্থান
কুয়ালালামপুরের সন্নিকটে। গুনেগুনে ১৭২টি সিড়ি বেয়ে আমরা গোহার সামনের খোলা চত্বরে
যাই। এই চত্বরে হকাররা পানি, চকলেট ও বিস্কুট বিক্রি করছেন। এই চত্বর হতে সামনে
এগিয়ে গিয়ে ৬/৭ সিড়ি নিচে নেমে শক্ত প্রাকৃতিক শিলার বাটুগোহায় প্রবেশ করি।
গোহাটির আয়তন অনুমানিক ১০০ফুট x ১০০ফুট। গোহার খাদময় পাতুরে ছাদে
প্রচুর পাখির বাসা, ভর দুপুরেও এখানে আধো আধো আলোছায়ার মায়া ছড়িয়ে আছে। এই গোহার
শেষপ্রান্তে গিয়ে ১৪/১৫টি সিড়িবেয়ে উপরে উঠে আরও বৃহদাকার আরেকটি গোহায় প্রবেশ
করি। এই গোহাটির আয়তন হবে অনুমানিক ১০০ফুট x ১৬০ফুট। এখানে
রয়েছে মালয়ীদের প্রাচীন হিন্দু মন্দির বা রথ। এরথে স্থাপিত আছে অসংখ্য ছোট ছোট
দেবদেবীর মূর্তি। এই গোহাটির উপরের ছাদে একটি বড় সুড়ঙ্গ। এই সুড়ংপথে দুপুরের ঝলমলে
রোদ এসে গোহাটিকে সুন্দর আলোয় ভরে দিচ্ছে। ছাদের এই সুড়ঙ্গ না থাকলে গোহাটি হত
ঘিসঘিসে অন্ধকার। প্রাচীন মালয়ীদের এই অপরূপ তীর্থস্থান দেখানোর জন্য বিধাতাকে
প্রানভরে ধন্যবাদ জানাই। সময় নেই, নামতে হবে তাই নেমে আসি। বাটুগোহার উচ্চতা দেখে
অনেকে সেখানে বেয়ে উঠতে সাহস পাননা এবং প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আশ্রয়স্থল এবং
তীর্থস্থান দেখার অভিঞ্জতা হতে চিরবঞ্চিত হন।
ড্রাইভার সিবা একজন ভারতীয়
তামিল। চীনা ড্রাইভার সীকের ইংরেজি ঞ্জান আকার ইঙ্গিতের মধ্যে সীমিত কিন্তু সিবা
ইংলিশ ভাল বুঝেন ও বলতে পারেন। তিনি আমাদেরকে মালয়েশিয়া প্রবেশের দিন কুয়ালালামপুর
বিমানবন্দর হতে বুকিতবিনতাং তামিল হোটেলে পৌছে দিয়েছিলেন। তিনি দেখতে অনেকটা আমার
চাচাতো ভাই পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী এম.আর.কুরেশী ওরফে মুরাদ ভাইয়ের মত, গায়ের
রঙ্গ কালো অথচ চেহারা মায়াবী। তার কন্ঠস্বর স্পষ্ট ভারতীয় এবং কেমন যেন আপন মনে
হচ্ছিলো। বিকাল ৫টায় তিনি আমাদেরকে মালয়েশিয়া ছাড়তে বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তার
ধারনা আমরা পুত্রজায়া দেখিনি। বিদেশী মেহমানরা তার দেশের অপরূপ সুন্দর শহর
পুত্রজায়া না দেখে ফিরে যাবে তা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তাই তিনি আমাদেরকে বিনে
খরচে পুত্রজায়া দেখিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। আবার পুত্রজায়া
দেখার আনন্দে আমরা নিরব থাকি, বলতে যাইনি পুত্রজায়া আমাদের দেখা হয়ে গেছে।
পুত্রজায়ার ভিতর ধীরগতিতে চক্কর মেরে তিনি একটি মহাসড়ক রিসোর্টে কার থামান। গাড়িতে
আমি সিবার বামপাশে বসে খুশগল্প করি। আমি লেখালেখি করি জেনে তার উৎসাহ বেড়ে যায়।
শোনান তার পারিবারিক কাহিনী- বউ তামিল গৃহবধু, পুত্র গ্র্যাজুয়েট এবং কন্যা
উচ্চশিক্ষারতা। সিবা বললেন, পিতামহের জন্মস্থান ভারতের তামিলনাড়ু কখনও যাইনি,
গিয়েছি একটিমাত্র দেশে তা পাশের দেশ সিঙ্গাপুর। আলাপে বুঝলাম সিবা কেবল তার দেশের
মালয় উপদ্বীপের খবর রাখেন। বোর্নিও দ্বীপে অবস্থিত মালয়েশিয়ার বিশাল এলাকা
সারাওয়াক সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই। একসময় আমি সিবার কাছে মালয়েশিয়ার চীনা,
মালয়ী এবং তামিলদের মধ্যে অন্তঃবিবাহ হয় কিনা জানতে চাই। তিনি জবাব দেন ‘It is
very very rare case’।
এবার সিবা তার জীবনের কাহিনী
বলেন। তার শৈশবে মালয়েশিয়া এত উন্নত ছিলনা। মানুষ ছিল গরীব ও শতধা বিভক্ত। তারা
সবসময় পরস্পর হানাহানি ও রক্তপাতে লিপ্ত ছিল। এমন সময় একজন মহান নেতা এলেন, যার
পূর্বপুরুষরা কয়েক প্রজন্ম আগে বাংলাদেশ হতে এসে মালয়ে বসতি স্থাপন করেন। যিনি শতধা
বিভক্ত মালয়েশিয়াবাসীকে একসুত্রে গেঁথে দেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, তামিল, চীনা,
মালয়ী সব তার নেতৃত্বে এক ছাতার ছায়ায় আশ্রয় নেয়। তিনি মালয়েশিয়াকে আজকের এই
উন্নতির স্বর্নশিখরে নিয়ে আসেন। সিবা বললেন, তিনি বিশ্বের একজন শ্রদ্ধাভাজন নেতা মাহাতির
মোহাম্মদ।
তামিল গাড়িচালক সিবা আমার মত
একজন নগন্য লেখককে অতিগুরুত্ব দিয়ে গল্প বলে যাচ্ছেন, আর আমি শুনছি ধ্যানভরে। তিনি
বলছেন- “Chinese people control economy and business. They are sincere and
industrious. Maloyan muslim people control politics and administration. But Tamil
hindus peoples are swimming in wine.”
চালক সিবা খুব সংক্ষেপে
মালয়েশিয়ার তিন জাতির বৈশিষ্ট বলে দেন এবং নিজ জাতির ব্যাপারে হতাশাই ব্যক্ত করেন।
সিবাকে বিদায় জানিয়ে
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ঢুকে প্লেনে উঠার অপেক্ষায় রই। রাত ৮টায় মালয়েশিয়ান
এয়ারলাইনের উড়ালযান সাড়ে তিনশত যাত্রি নিয়ে উড়াল দেয়। শতকরা নব্বই ভাগ যাত্রিই
বাংলাদেশী। প্লেনের ভিতর প্রচুর হৈ-চৈ হট্টগোল, যেন বাংলাদেশের কোন এক
গ্রাম্যবাজার। পাম তৈলে রান্না করা খাবার আসে। নতুন তেলের গন্ধ ভাল লাগেনি। তবুও
নতুনত্বের স্বাদ নিতে সব খাবার চেখে দেখি। রাত ১১টায় ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বের
হয়েই সিলেটের বাস ধরি। ঢাকায় থাকা যাবেনা, কারন পরদিনই পবিত্র রমজান। ঠান্ডা বাসে
চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে রাত পার করে কদমতলী নেমে চারজন পর্যটক নিজনিজ বাসায় চলে
যাই।
মালয়েশিয়ার আয়তন ১,২৭,০০০
বর্গমাইল, যা বাংলাদেশের চেয়ে ২.২৯ গুন বড়, অথচ দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ৩ কোটি। এই
তিনকোটি লোকের মধ্যে বিদেশীদের সংখ্যা ১৬% অর্থাৎ ৪৮ লক্ষ। বিদেশীদের মধ্যে সবচেয়ে
বড় আদমের দল বাংলাদেশী, যারা সংখ্যায় পনের লক্ষ। মালয়েশিয়ায় ভারত পাকিস্তান নেপাল
ও মিয়ানমারের লোকজনও রয়েছেন। মালয়েশিয়া আমাদের সোয়া দুইগুন বড় দেশ হলেও দেশটির
জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক কম, আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ১৯%। তাই জনপ্রতি সম্পদের
পরিমান আমাদের জনপ্রতি তুলনায় কয়েকগুন বেশী। মালয়েশিয়ার প্রধান ও বৃহৎ এলাকা মালয়
উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল। এই উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চল থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের অধিকারে
রয়েছে। মালয়েশিয়ার আরেক এলাকা বোর্নিও দ্বীপের উত্তারঞ্চল, যা সারাওয়াক নামে
পরিচিত। বোর্নিও দ্বীপ তিনটি দেশে বিভক্ত- ব্রুনাই, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।
আমরা সারাওয়াক, পেনাং কিংবা
লাংতুরাই যাবার সময় পাইনি। আমাদের সফর কেবল মালয় উপদ্বীপের কুয়ালালামপুরের আশপাশে
সীমাবদ্ধ ছিল।
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাতির
মোহাম্মদ সম্পর্কে খানিক আলোচনা করে এই সফরনামা সমাপ্ত করব। আধুনিক মালয়েশিয়ার
দিকে তাকালে দেখা যায় বিশাল বিশাল উঁচু কারুকার্য্যময় অট্টালিকা, দুনিয়ার সেরা বিপনীবিতান।
কি না আছে মালয়েশিয়ায়? অথচ খুব বেশী সময় নয় যখন আর দশটা উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে খুব
যে একটা এগিয়ে ছিল মালয়েশিয়া। একজন মাত্র মানুষের হাতে রূপকথার গল্পের মত মাহাথির
মোহাম্মদ পালটে দিলেন গোটা মালয়েশিয়াকে। ১৯৫৭ সালে বৃটিশ শাসন হতে মুক্ত হয়ে
মালয়েশিয়া ছিল দরিদ্রপীড়িত বৃক্ষমানবের দেশ। দারিদ্রের সঙ্গে ছিল নিরক্ষরতা। দেশের
প্রথম প্রধানমন্ত্রী দেশটিতে রোপন করেন ঐক্যের বীজ। তিনি যে ধারার সূচনা করেন তা
থেকে বিচ্যুত হননি তার উত্তরসূরী আব্দুর রাজ্জাক, টংকু ইসমাইল এবং ডাঃ মাহাথির বিন
মোহাম্মদ। শেষোক্ত জন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রূপকার হিসাবে পৃথিবীতে নন্দিত
এবং প্রশংসিত। তার হাত ধরে মালয়েশিয়া পৌঁছে গেছে উন্নত বিশ্বের তালিকায়। ডাঃ
মাহাথির মোহাম্মদকে বলা হয় এশিয়ার শ্রেষ্টতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আধুনিক
মালয়েশিয়ার রূপকার এবং মুসলিম বিশ্বের বিবেক। মাহাথির ছিলেন তার দেশের চতুর্থ
প্রধানমন্ত্রী। সত্য কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায়না- একথাটাই তার কাজে ও কথায় ফুটে
উঠেছে।
ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম
১৯২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। তার পিতা
ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। মেধাবী ছাত্র হিসাবে তার পছন্দের বিষয় ছিল আইনবিদ্যা
কিন্তু সরকার তাকে পরামর্শ দেয় ডাক্তার হবার। তাই তিনি সিঙ্গাপুরের কিংএডওয়ার্ড
সেভেন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের ৫ আগষ্ট তিনি বিয়ে করেন। কিছুদিন
সরকারি চাকুরী করার পর তা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তার নিজ জন্মস্থান আলোরসেতার
এলাকায় চলে আসেন। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডে অংশ নেন। ঐ
এলাকায় তিনি একটি প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে তুলেন। এটাই ছিল এ এলাকায় কোন মালয়
পরিচালিত প্রথম হাসপাতাল। মাহাতিরের রক্তে মিশে ছিল দেশপ্রেম আর রাজনীতি। তিনি
১৯৬৪ সালে তার এলাকা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হলে কি হবে, তিনি
তার দলের অনেক নীতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে তিনি একটি বই লিখেন, যার
নাম-‘মালয়ীদের উভয়সংকট’। বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তিনি তার পার্টির ভূলক্রুটির
সমালোচনা করে দলীয় প্রেসিডেন্ট টেংকু আব্দুর রহমানের কাছে একটি চিঠি লিখেন। এরফলে
তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
তিনি এবার তার চিকিৎসা পেশায়
ফিরে গেলেও অনেক ঘটনার পর ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ পার্টিতে আবার ফিরে আসেন। পরবর্তী
সময়ে ১৯৭৪ সালে এমপি নির্বাচিত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী হন। শিক্ষামন্ত্রী হয়ে তিনি
ঘোষনা দেন তার নামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্টানের নামকরন করা যাবেনা। এই ধারা তিনি প্রধানমন্ত্রী
হয়েও অব্যাহত রাখেন। তার কোন ছবি শিক্ষা প্রতিষ্টানে কিংবা সরকারী অফিসে টাঙ্গানো
যাবেনা বলেও তিনি নির্দেশ দেন। মালয়েশিয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা সংস্কার
হচ্ছে মাহাথিরের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ১৯৭৫ সালে মাহাতির পার্টির ভাইস
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তুন হোসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি
উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। ১৯৯১ সালের ১৬ আগষ্ট ৫৫ বছর বয়সে ডাঃ
মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং
একটানা ২২ বৎসর ক্ষমতায় থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বেচ্ছায়
ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। তার সফল নেতৃত্ব, নির্ভেজাল দেশাত্মবোধ আর
দূরদৃষ্টি পশ্চাৎপদ মালয়েশিয়াকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ আধুনিক মালয়েশিয়ায় পরিণত
করেছে। সেইসাথে তার প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাকে বিশ্বনেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
সিবা ড্রাইভারের কাছে জানতে পারি তিনি বর্তমানে পুত্রজায়ায় অবসর জীবনযাপন করছেন।
মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার ৬৯%
মালয়ান। তারা মালয়েশিয়ার আদি ভূমিপুত্র। ২৩% চাইনিজ, ৭% ভারতীয় এবং ১% অন্যান্য।
এখানে ধর্মের বিন্যাসও বিচিত্র। জনসংখ্যার ৬১% মুসলিম, ২০%বৌদ্ধ, ১০% খ্রিস্টান,
৭% হিন্দু এবং ২% অন্যান্য। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির তিনটি নৃতাত্বিক
জনগোষ্টির দেশ মালয়েশিয়াকে মাহাথির মোহাম্মদ এক সম্মিলিত মানব বাগানে পরিণত করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন