অনেক অনেক দিন করে পার, দুজন প্রিয় শিক্ষকের দেখা পাই আবার/ একজন শ্রীগুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তী, অন্যজন ডঃ সফিউদ্দিন স্যারঃ
আমার হাইস্কুল
জীবনের দুইজন শিক্ষকের কথা খুবই মনে পড়ে, একজন অমেলেন্দু ভট্টাচার্য্য অন্যজন
শ্রীগুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তী। আমার আব্বার সহকর্মী এই দুই শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন
শ্রেনীতে আমি গনিত, বিঞ্জান ইত্যাদি প্রাইভেট টিউশনি পড়ি। মাসের পর মাস অন্য
ছেলেদের সাথে আমাকে পড়ালেও আব্বার খাতিরে তারা কোন টিউশন ফি কখনও গ্রহন করেন নি। বর্তমান
কালে এমন সৌজন্যতা ভাবাই যায়না। তাদের
কাছে আমি অবশ্যই ঋনী একারনে যে আমাদের সেই অনটনের দিনে তাদের এই বদান্যতা আমাকে পৃথিবীতে
দাড়াতে খুব সহায়তা করে। গুনেন্দ্র স্যারের গলায় কর্কটরোগ হয়েছে, ভারতে চিকিৎসা
নিচ্ছেন। এই চিকিৎসা খুবই ব্যায়বহুল যা একজন অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষকের পক্ষে
বহনকরা বেশ দুঃসাধ্য। হঠাৎ করে জানতে পেরে আমি স্যারের চিকিৎসায় ইতোপুর্বে প্রায় ত্রিশ হাজার
টাকা সহায়তা করি। একবার গুনেন্দ্র স্যারের টেলিফোন পাই, তিনি চিকিৎসার জন্য আবার
ভারতে যাবেন। আমার কাছে ষাট হাজার টাকা ধার চাইলেন। আমি সাথে সাথে দশ হাজার টাকা
অনুদান করে বললাম পূবালী ব্যাংকের কাছে একটা আবেদন পাঠান, আমি চেষ্টা করে দেখি
ব্যাংক হতে কোন সহায়তা করা যায় কিনা?
পূবালী ব্যাংকের এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী আত্মীয় হলেও আমি তার
কাছে কখনও কিছু চাইতে যাইনি। দুই চারটি ন্যায়সঙ্গত সমস্যার কথা নিতান্ত বাধ্য হয়ে তার
পত্নী রহিমা চৌধুরী রিপার কানে দিলেও তিনি কোন পাত্তা দেননি। মনে হল তার কাছে ব্যক্তিস্বার্থ
ছাড়া আত্মীয়তার কোন কানাকড়ি মূল্য নেই। তাই আমি তার কাছ থেকে একটা দুরত্ব নিয়েই
থাকি, এড়িয়ে চলি। কোন কিছুই তার কাছে আত্মীয় হিসাবে আমি পাইনি, এমন লোকের কাছে কিছু
পাবার আশাও আমি করিনা। তবে নিজের জন্য কখনও না গেলেও গুনেন্দ্র স্যারের চিকিৎসার
সাহায্যের জন্য আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দরবারে যাই। আমি আব্দুল হালিম চৌধুরীর
প্রতি কৃতঞ্জ, তিনি আমাকে সেদিন খালিহাতে ফিরিয়ে দেননি। আমি গুনেন্দ্র স্যারের চিকিৎসার
জন্য একলক্ষ টাকা সাহায্য চাইলে তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা সাথে সাথে মঞ্জুর করে দেন।
পঞ্চাশ হাজার টাকা সাহায্যের চেকটি নিয়ে আমি একদিন সিলেটে গুনেন্দ্র স্যারের বাসায়
যাই। সাথে করে নিয়ে যাই তার আর দুজন ছাত্রকে, একজন পূবালী ব্যাংক লালাবাজারের ব্যবস্থাপক দাউদপুর গ্রামের নির্মল কান্তি দাস এবং অন্যজন
জালালাবাদ গ্যাসের ডিপোটি ম্যানেজার আমার অনুজ চৌধুরী নিশাতুর রহমান কুরেশী। অনেক
দিন পর গুনেন্দ্র স্যারের সাথে গল্প করি, ছবি তুলি, একসাথে চানাস্তা করি।
প্রার্থনা করি গুনেন্দ্র স্যার সুস্থ্য হউন, দীর্ঘজীবী হউন।
ডঃ সফিউদ্দিন আহমদ এমসি কলেজে আমার শিক্ষক। অনেকেই শিক্ষক হন
কিন্তু সবাই আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। সফিউদ্দিন স্যার আমার আদর্শ, এখনও মনে
গেঁথে আছে ১৯৮১ সালে আমার কলেজ জীবনের দ্বিতীয় ক্লাসটি তিনিই করান এবং পিনপতন
নিরবতা নিয়ে আমরা স্যারের কথাগুলো শুনে যাই। এমসি কলেজ হতে আসার পর কেবল একবার সফিউদ্দিন
স্যারের সাথে দেখা হয় মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে আব্বার বিদায় সম্বর্ধনা
অনুস্টানে। সেই সভায় ডঃ সফিউদ্দিন স্যার এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। তারপর আর ডঃ সফিস্যারের
সাথে মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি, যদিও তার লেখামালা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
অনেক পড়েছি। মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের ‘রাঙ্গা সকাল’ অনুষ্টানে টিভি পর্দায় তাকে
দেখেছি। পরবর্তীকালে পেশাগত জীবনে সফিউদ্দিন স্যারের অনেক উন্নতি হয়। এমসি কলেজের
বাংলা বিভাগীয় প্রধান হতে ক্রমান্নয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান
হয়ে তিনি অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পরও তার লেখালেখি থেমে থাকেনি।
একদিন পুবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের
অগ্নি নির্বাপন মহড়া হয়। আমরা বাহিরে দাঁড়িয়ে এই মহড়া দেখছি, মজা করছি। ব্যাংকের
চৌদ্দতলায় আগুন লেগেছে, প্রবল বেগে কালো ধুয়ার কুন্ডলী বের হচ্ছে। বাঁশী বাজিয়ে
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কয়েকটি গাড়ি নিয়ে অফিস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। তারা যান্ত্রিক
মই বেয়ে ভবনের চৌদ্দতলায় পানি ঢালে। অসুস্থ্য লোকজন নামানোর কসরত করে। মতিঝিলের
ভাসমান মানুষ ব্যাংকে আগুন লেগেছে মনে করে সামনে প্রচন্ড ভীড় জমায়।
এক সময় যীশু বললেন আমি সফিউদ্দিন স্যারের বাসায় যাবো। তালাশ
করে বুঝলাম তিনি আমার এমসি কলেজের প্রিয় শিক্ষক ডঃ সফিউদ্দিন আহমদ। নরসিংদীর জাতক ডঃ
সফিউদ্দিন আহমদ, আবার এই একই জেলার জাতক আমার সহকর্মী সাইদ আব্দুল্লাহ যীশু। সফিউদ্দিন
স্যার সাহিত্যিক ও গবেষক জানতাম কিন্তু তিনি যে একজন শিকড় সন্ধানী লেখক তা জানা ছিলনা।
নরসিংদী এবং সেখানকার মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে সফিউদ্দিন স্যারের প্রচুর কাজ
রয়েছে। অফিস শেষে পুবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হতে বের হয়ে আমি ও যীশু হেঁটে
হেঁটে ডিসেম্বরের এক শীত সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে সফিউদ্দিন স্যারের ফ্ল্যাটে যাই। সফিউদ্দিন
স্যার এসে দরজা খোলেন। বহু বছর পর তাকে দেখে আমার চিনতে বেশ কষ্ট হয়। স্যারের বয়স
আশী পেরিয়ে গেছে, মাথা প্রায় চুলশূন্য, আগের সেই তরুণ চেহারা নেই, যা বয়স হলে
সবারই হয়। স্যার অসুস্থ, ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছে কিন্তু আলাপ করে বুঝলাম এত
বয়সেও স্যারের মধ্যে প্রাণপ্রাচুর্য্যের কোন ঘাটতি নেই। বসার বড় কক্ষটির দেয়ালে স্যারের
বিভিন্ন বয়সের বেশ কয়েকটি ফটো শোভা পাচ্ছে। আমি ও যীশু সফিউদ্দিন স্যারের সাথে
প্রচুর ফটো তুলি, বহুকাল পর তার স্পর্ষ আমাকে খুব আবেগ আপ্লুত করে। স্যারকে ছেড়ে
আসতে মন চায়নি। স্যারের এক ছেলে নান্দনিক সাকী এবং দুই মেয়ে স্বাতি ও সেঁজুতি। জেনে
খুশী হলাম স্যারের সন্থানরা সুপ্রতিষ্ঠিত।
স্বাতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একথা জেনেও খুশী হলাম যে আমাদের এম সি
কলেজের সহপাঠী হৃদরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী তার চিকিৎসা করেন পরম
মমতায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন