রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট আগমনের শতবর্ষপূর্তি উৎসব কাছ থেকে দেখাঃ
এক শতাব্দী আগে ১৯১৯ সালের ৫ থেকে ৮ নভেম্বর বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণ করেন, এসময় তিনি ছিলেন সিলেটবাসীর মহাসম্মানিত
মেহমান। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ৬, ৭ এবং ৮ নভেম্বর সিলেটে তার আগমনের শতবর্ষ
স্মরণোৎসব পালন করেন আজকের সিলেটবাসী। সর্বকালেই সিলেটবাসী গুণীজনকে যথাযত সম্মান
দিতে জানেন। রবীন্দ্রনাথের সিলেট আগমনের একশত বছর পর এই বরেণ্য কবির স্মরণ সভায়
আসা আমি কর্তব্য কর্ম মনে করে ঢাকা থেকে সিলেটে এসে যোগদান করি। স্মরণোৎসবের জন্য
কিছুদিন আগে “সিলেটে রবীন্দ্রনাথঃ শতবর্ষ স্মরণোৎসব পর্ষদ”কে পূবালী ব্যাংক
লিমিটেড সামাজিক দায়বদ্ধতা ফান্ড হতে বিশ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করে। পূবালী ব্যাংকের
সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন বিভাগ হতে আমরা পে-অর্ডারটি ইস্যু করি। আমার সহকর্মী সায়েদ
আব্দুল্লাহ যীশু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে পে-অর্ডারটি আমার হাতে দিয়ে বলল,
স্যার আমি এই অনুষ্ঠানে যেতে চাই। বললাম, আমি শৈশব হতে একজন রবীন্দ্র ভক্ত লোক,
আমার জন্মস্থান সিলেটে রবীন্দ্র স্মরণোৎসব হবে, সেখানে আমি থাকবনা তা কি হয়? যীশুকে
বললাম, কোন অসুবিধা নেই আমরা দুজনই যাবো ইনশাহ আল্লাহ।
রবীন্দ্রনাথের মত একজন বিশ্ববরেন্য মানুষের সিলেট আগমনের
শতবর্ষ স্মরণোৎসবে যোগদান আমার মত একজন নগন্য মানুষের জন্য বেশ গৌরবের বিষয়। আমি
এই আত্মজীবনীতে কেবল সেই উৎসবের গৎবাঁধা বর্ণনা দিয়েই দায়ছাড়া লিখা সমাপ্ত করতে
চাইনা। তাই আমি টাইম মেশিনে চড়ে শতবর্ষ পিছনে চলে যাব। সিলেটের সাথে বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথের আত্মিক সম্পর্ক ও ভালবাসার দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭মে ১৮৪১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং
নোবেল প্রাইজ পান ১৯১৩ সালে। সেই হিসাবে নবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ছয় বছর পর ৫৮ বছর
বয়সে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সিলেট সফর করেন। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে বৃটিশদের
গণহত্যার প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ “স্যার” উপাধি বর্জন করেন।
ইতোমধ্যে কবি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের আমন্ত্রণ পান। চারমাস পর অক্টোবর মাসে তিনি
অস্ট্রেলিয়া যাবার প্রস্তুতি নিতে শিলং যান। কবি শিলঙে অবস্থানকালে সিলেটের
ব্রাহ্মসমাজের সাধারন সম্পাদক গোবিন্দনারায়ন সিংহ মজুমদার, আঞ্জুমানে ইসলামিয়া,
শ্রীহট্ট মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সংঘটন তাকে সিলেট আসার আমন্ত্রণ জানান। সিলেট এমসি
কলেজ হতে পাঠানো তারবার্তায় লিখা ছিল “Sylhet desires India’s greatest son to honour her by his visit.”
সেবার কবির অস্ট্রেলিয়া যাওয়া
হয়নি, তাই তিনি সিলেট যাবার সিন্ধান্ত নেন। ১৯১৯ সালে শিলং রাজধানী হলেও
সিলেট ছিল আসামের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। সিলেট-শিলং যোগাযোগ ব্যবস্থা
আজকের মত উন্নত ছিলনা। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি হয়ে ছাতকের ভিতর দিয়ে সিলেটে আসতে হত।
গাড়িতে শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি এসে খাসিয়া পাহাড়ের দেড়মাইল নিচে নেমে আসতে হত হেঁটে,
নতুবা খাসিয়াদের কাঁধে স্থাপিত বেতের চেয়ার ‘থাপা’তে বসে। মানুষের পিঠে চড়ে এই
পাহাড় যাত্রা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ সিলেটে আসেন ট্রেনে আসাম-বেঙ্গল রেলপথে এক সুদীর্ঘ
দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ঘুরে। পথে করিমগঞ্জ, কুলাউড়া ইত্যাদি স্টেশনে কবিকে ট্রেন
থামিয়ে সম্বর্ধণা দেয়া হয়। গৌহাটি, লামডিং, বদরপুর, কুলাউড়া, ফেন্সুগঞ্জ,
মোগলাবাজার, দাউদাবাদ পেরিয়ে ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও
পুত্রবধু প্রতিমা দেবীকে নিয়ে তিনি সিলেট রেলস্টেশনে পৌছান। এইদিন আমার পিতা
সফিকুর রহমান চৌধুরীর বয়স ছিল মাত্র এগার মাস ছাব্বিশ দিন। একথা লিখার কারণ হল অনুধাবন
করে নেয়া যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আমার পিতামহ মোহাম্মদ মোফজ্জিল চৌধুরীর
সমকালীন প্রজন্মের লোক। কবিগুরুর ফিটন গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্রই সমবেত ছাত্রজনতা
ঘোড়া ছেড়ে দেন এবং নিজেরাই গাড়ি টেনে নিয়ে যান। কবি আপত্তি জানান, কিন্তু কে শোনে
কার কথা, কবির ভক্তদেরে থামানোর সাধ্য কার ?
কিনব্রিজ নির্মিত হয় ১৯৩৬ সালে তাই সে সময় সুরমায় কোন ব্রিজ
ছিলনা। সিলেট রেলস্টেশন নদীর দক্ষিণপারে হলেও মূল শহর ছিল সুরমার উত্তরপারে। তখনকার
সিলেটবাসী ডোল করতাল বাজিয়ে, আতশবাজি পুড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনী দিয়ে রেলস্টেশনে
কবিকে বরণ করেন। কয়েকটি নৌকা সারিবেধে কবিকে ওপারে চাদনীঘাটে নিয়ে যায়। সুরমাপারে
দাঁড়ানো হাজার জনতা কবিগুরু কী জয়, রবীন্দ্রনাথ কী জয়, বিশ্বকবি কী জয় ধ্বনীতে
চারপাশ মুখরিত করে তুলেন। চাদনীঘাটে কবিকে ঘোড়ায় টানা তাজা ফুলে সাজানো একটি ফিটন
গাড়িতে বসানো হয়। কবির পাশে বসেন সিলেটের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মৌলভি আব্দুল করিম।
তিনি ছিলেন কবির পূর্ব পরিচিত এবং তার “Islam’s
contribution of science and civilization” বইয়ের
ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মৌলভি আব্দুল করিম ছিলেন সরকারি শিক্ষা
ইন্সপেক্টর এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৬ সালের গ্রেজুয়েট।
১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথের নাগরিক সম্বর্ধণা হয়
কিনব্রিজ সংলগ্ন সারদা হলে। তখন সারদা হলের নাম ছিল রতনমনি লোকনাথ টাউন হল। তখনও
মুসলিম লীগের জন্ম হয়নি। সভাপতিত্ব করেন মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক সংঘটন আঞ্জুমানে
ইসলামিয়ার সিলেট জেলার সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া। তিনি
ছিলেন সিলেট লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৮৯১ সালের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
গ্র্যাজুয়েট ইংরেজী শিক্ষিত লোক। সম্বর্ধনা সঙ্গীত রচনা করেন অম্বিকাচরণ দেব এবং
সভায় তা পরিবেশন করেন যতীন্দ্র মোহন দেব। বেহালা বাজান যামিনী কান্ত রায় দস্তিদার।
রবীন্দ্রনাথ সংশয়ে ছিলেন বাংলার সীমারেখার ওপারের আসামের এই জেলার শ্রোতারা তার
কথ্য বাংলা বুঝবে কিনা, তাই জানতে চান তিনি কোন ভাষায় বক্তৃতা দেবেন। লোকজন তাকে
বাংলায় ভাষণ দিতে অনুরোধ করেন। রতনমনি লোকনাথ টাউন হলে কবির বক্তৃতা ছিল “বাঙালীর
সাধনা”। সম্বর্ধণা অনুষ্ঠানের সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ উর্দুতে ভাষণ
দেন, যা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে উল্লেখ করেছেন। এব্যাপারে
সৈয়দ আব্দুল মজিদ পরে বাখ্যা দেন, সিলেটের কথ্যভাষা লিখিত বাংলা থেকে বেশ আলাদা,
তাই তিনি উর্দুতে বক্তৃতা দেওয়া সমীচীন মনে করেন। সিলেটের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক
সৈয়দ মোস্তফা আলীর আত্মজীবনী হতে জানা যায় তিনিও সেই সম্বর্ধণা সভায় শ্রোতা হিসাবে
উপস্থিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সিলেটে ছিলেন মাত্র তিনদিন। এখানে তার আবাস ছিল
নয়াসড়ক টিলার উপর অবস্থিত পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোয়। সিলেটে তিনি তিনটি অনুষ্ঠানে
বক্তৃতা দেন এবং ব্রহ্মমন্দিরে উপাসনায় যোগ দেন এবং কিছু বিশিষ্ট হিন্দু ও ব্রাহ্ম
পরিবারের আতিথ্য গ্রহন করেন। তিনি শহরের পূর্ব প্রান্তে মাছিমপুর মনীপুরী পাড়ায়
যান, মনীপুরী পল্লীতে গিয়ে তাদের কারুকার্য্যময় বস্ত্র বুনন দেখে বিমুগ্ধ হন।
সেখানে মনিপুরী বালকরা কবিকে রাখাল নৃত্য পরিবেশন করে। টমাসের বাংলোর মনীপুরী বালক-বালিকাদের
নৃত্য দেখে কবি বিমোহিত হন এবং মনীপুরী নাচকে খুবই ভালবেসে ফেলেন।
কবি সিলেট থেকে একজন মনিপুরী নৃত্যশিল্পীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে
যেতে চাইলেন। কিন্তু এতদূর যেতে কেউ রাজি হননি। ১৯৩৫ সালে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী
নৃত্যের শিক্ষক হন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মনিপুরী নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জী।
রবীন্দ্রনাথ সিলেটের মনীপুরী নৃত্যে দেখতে পেয়েছিলেন ‘Graceful best form of physical exercise’. সম্ভবত একারণে নৃত্যের মাধ্যমে ব্যায়ামের ব্যবস্থা তিনি শান্তিনিকেতনে
চালু করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেটে আসেন, জমিদার ও বাউল কবি হাসন রাজা তখন
জীবিত ছিলেন। বর্তমান কালের মত তখন তার এত পরিচিতি ছিলনা। মাত্র বার বছর আগে ১৯০৭
সালে তার গানের বই ”হাসন উদাস” প্রকাশিত হয়। সিলেট সফর কালে হাসন উদাসের একটি কপি
রবীন্দ্রনাথের হাতে আসে। ১৯২৫ সালে ভারতীয় দর্শন সমিতির সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ
হাসন রাজা সম্পর্কে বলেন, পূর্ব বঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড়
তত্ত্ব পাই সেটি হল এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য। তারপর
তিনি গাহিলেন- ‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন/ শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম/ আর
পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম/ নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়’। রবীন্দ্রনাথ আর
বললেন, এই সাধক কবি দেখিয়েছেন যে, পরম পুরুষ তারই ভিতর হতে বের হয়ে তার নয়ন পথে আবির্ভুত
হইলেন, “রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে/ আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা
দিল আমারে”। ‘The Religion of Man’ শিরোনামে
অক্সফোর্ডে দেয়া হিবার্ট লেকচারে ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার এই গানটি
ইংরেজিতে অনুবাদ করে উদ্ধৃত করেন। রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকৃতি হাসন রাজাকে মরমি কবি
হিসাবে সারা বাংলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে।
সেসময় রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ পেয়ে সিলেটের আর একজন প্রতিভা
জ্বলে উঠেন, তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। তখন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ ছিল শহরের
কেন্দ্রস্থলে বর্তমান হাসান মার্কেটে। কলেজ হোস্টেলটি ছিল টিলাগড় এলাকায়।
রবীন্দ্রনাথ এম সি কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন কলেজ ছাত্রাবাসের সামনের
প্রাঙ্গনে বর্তমান কলেজ শহিদ মিনারের সামনে। এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “আকাঙ্ক্ষা”। সেই
বক্তৃতা শোনে কিশোর সৈয়দ মুজতবা আলী ঘুমভেঙ্গে জেগে উঠেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে সবার
অগোচরে একটি চিটি লিখে জানতে চান আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চ করার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া
দরকার। সিলেট থেকে ফেরার পথে কবি তখন ছিলেন ত্রিপুরার আগরতলায়। আগরতলা হতে কবির
নিজহাতে লেখা চিটির জবাব এলো। রবীন্দ্রনাথের এই চিটিতে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছুকাল পর ১৯২১
সালে সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়তে যান এবং রবীন্দ্রনাথের একজন প্রিয়পাত্র
হয়ে উঠেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ একদিন সৈয়দ মুজতবা আলী ও কয়েকজন
বালককে তার ‘সোনার তরী’ আবৃত্তি করতে বলেন। সবার আবৃত্তি শেষে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য
করেন “আলীর আবৃত্তিই সবচেয়ে ভাল, তবে একটু কমলালেবুর গন্ধ”। সেইথেকে সিলেটিদের
শুদ্ধ বাংলা বলার সময় যে সিলেটি টান থাকে তার নাম হয়েছে “কমলালেবুর গন্ধ”।
উচ্চারনে কমলালেবুর গন্ধ রবীন্দ্রনাথের পছন্দ না হলেও সিলেটের
“কমলা মধু” রবীন্দ্রনাথ খুব পছন্দ করতেন। মৌমাছি কমলাফুলের রস আহরণ করে যে মধু
তৈরী করে তাই কমলা মধু। একবার সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন হতে সিলেট ফেরার সময়
রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চান তার জন্য কিছু আনবেন কিনা? রবীন্দ্রনাথ বললেন “কমলা
মধু”র কথা।
সিলেটের রতনমনি লোকনাথ টাউনহলের “বাঙালির সাধনা” এবং এমসি কলেজ
ছাত্রাবাসের “আকাঙ্ক্ষা” নামীয় রবীন্দ্রনাথের দেয়া দুটি বক্তৃতাই ছিল অলিখিত। কিছু
নোটসের ভিত্তিতে তিনি সেই ভাষন দুটি দেন। পরবর্তীকালে এই বক্তৃতা দুইটি লিখিত হয়
এবং তিনি তা অনুমোদন করেন।
রবীন্দ্রনাথ সিলেটে আসেন ১৯১৯ সালে, কিন্তু তার সিলেট ভ্রমনের
স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় সুদীর্ঘ্য বাইশ বছর পর ১৯৪১ সালে, যে বছরটি ছিল কবির
মহাপ্রয়াণের কালোবর্ষ। ‘কবি প্রনাম’এ সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বহস্তে
লিখিত এবং কবিতার শেষে ‘রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর’ স্ব-স্বাক্ষরিত তারিখ বিহীন এই বহুলপঠিত কবিতাটি পাওয়া যায়- “মমতাবিহীন
কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।/ ভারতী
আপন পূন্যহাতে/ বাঙালীর হৃদয়ের সাথে/ বানীমাল্য দিয়া/ বাঁধে তব হিয়া।/ সে বাঁধনে
চিরদিন তরে তব আছে/ বাঙালির আশির্বাদ গাঁথা হয়ে আছে”। এই বিখ্যাত কবিতাটি কিভাবে
কোথায় পাওয়া গেল তার কোন উল্লেখ ‘কবি প্রণাম’এ নেই।
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে বাঙ্গালি
হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট ও কাছাড় জেলা আসামে অন্তর্ভুক্ত থাকার বিষয়ে বাংলায়
প্রায়ই কথাবার্তা হত। সম্ভবতঃ এই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি লিখেছিলেন।
প্রভাতকুমারের মতে এই কবিতাটি ১৯৩২ সালের পর কোন এক সময়ে লেখা। কারণ কবি এখানে
স্বাক্ষরের আগে “শ্রী” লিখেন নি। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তিনি নাম লিখতেন
“শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”। অথচ কোন প্রমাণ ছাড়াই অনেকে বলছেন কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের
সিলেট ভ্রমণের সময়ে লেখা।
আমি টাইম মেশিন চড়ে এবার ফিরে আসব বর্তমান ২০১৯ সালের অক্টোবরে।
৫ নভেম্বর ২০১৯ সকাল ৭টায় বন্দরবাজার ব্রহ্মমন্দিরে রবীন্দ্রনাথ উৎসব আয়োজন করেন
শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজ। এখানে শোভাযাত্রা, শব্দে ছন্দে রবীন্দ্র স্মরণ ও সন্ধ্যায়
কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সকাল ১১টায় সিলেট
সিটি কর্পোরেশন শোভাযাত্রা করে এবং ৩.৩০টায় কিনব্রিজের নিচে তার কবিতাযুক্ত ম্যুরাল
উম্মোচন করা হয়। নেতৃত্ব দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বিকেলে
সহস্রাধিক শিল্পীর পরিবেশনায় নৃত্য, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হয়। পুরস্কার
প্রদান ও একক গান পরিবেশন করা হয়।
৬ নভেম্বর মাছিমপুরে রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠান বিকেল ২.৩০ হতে শুরু
হয়ে ভোর পর্যন্ত চলে। এখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি, রাখাল নৃত্য, রাস নৃত্য ও আলোচনা সভা
হয়। এদিকে আলাদাভাবে সিংহবাড়ি চৌহাট্টায় সারাদিন নানা অনুষ্ঠান হয়। নেতৃত্ব দেন
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এইদিন সকাল ৯টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মুরারিচাদ
কলেজে রবীন্দ্র-ম্যুরাল উদ্বোধন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও দক্ষিণ এসিয়া’ শীর্ষক সেমিনার ও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় এম সি কলেজ মিলনায়তনে।
৭ নভেম্বর সকাল ৯টায় “রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ” শীর্ষক
আন্তর্জাতিক সেমিনার হয় সিলেট মহিলা কলেজ মিলনায়তনে। বিকাল ৩.৩০টায় সিলেট
স্টেডিয়ামে রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে সিলেট মেট্রোপলিটান
পুলিশ। বিকাল ৪টা থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সিলেট স্টেডিয়ামে শতবর্ষ
রবীন্দ্র স্মরণোৎসব শুরু হয় । বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক বরেণ্য শিল্পী ও আবৃতিকার এই
অনুষ্ঠানকে সার্থক করে তুলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন