যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং
ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ
যাত্রাঃ ৫ জুন ২০১৯ ফেরাঃ ১৮ জুন
২০১৯ বিদেশ অবস্থানঃ প্রায় ১৪ দিন
প্রতিবছর আমেরিকা যাত্রাকালে আমি
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্য একটি দেশ ভ্রমনের চেষ্টা করি। এবার টার্কি নয়তো মিশর
যাবো এমনটি ভেবেছিলাম। তুরস্ক যেতে হলে টার্কি এয়ারলাইনে যেতে হয় অথচ এই এয়ারলাইনের
টিকেটের দাম দেড়গুণেরও বেশী। কুয়েত এয়ারলাইনের টিকেট বেশ সস্তায় পেয়ে যাই। আমরা
তিনজনের সাথে একই যাত্রায় শরীক হন আমার ভাগ্লা ডাঃ মুফতি শামসের শ্বাশুড়ি। তিনি
সাথে থাকায় ও টিকেটের উচ্চমূল্যের জন্য তৃতীয় কোন দেশে সফর এবার বাদ দেই। আমি অফিস
হতে মাত্র বারদিনের সাধারন ছুটি নেই, সেইসাথে আগেপিছে সাপ্তাহিক ছুটির চারদিন যোগ
হয়ে ষোলদিন সময় পেয়ে যাই।
৪ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার। দিনটি ছিল
২৯ রমজান। রোজা রেখেই সিলেট থেকে গ্রীনলাইনে ঢাকা আসি। আজিজ ভাইয়ের বড় গাড়ি আমাদেরকে
রাজারবাগ হতে ধানমন্ডির বাসায় নিয়ে আসে। পরদিন ৫জুন রাত ৩.৩০ মিনিটে আমাদের
ফ্লাইট। প্রত্যাশিত ঈদের চাঁদ দেখা গেলনা। তাই পরদিন ৩০রমজান শেষ রোজাটি ধানমন্ডিতে
সমাপন করে রাত সাড়ে বারটায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি।
জীবনে এই প্রথম একটা আনন্দের ঈদ আকাশপথে নিরবে হারিয়ে গেল। মজার মজার নাস্তা করার
কিংবা নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের জামাতে যাবার কোন সুযোগই হল না।
কুয়েত এয়ারপোর্ট বেশ আধুনিক
কিন্তু দুবাই আবুধাবির মত এত ব্যস্ত নয়। কুয়েত এয়ার লাইনের গ্রাহকসেবা বেশ
মানসম্মত। এবারের আকাশযাত্রায় কোন নতুন দেশে যাবার সুযোগ না হলেও আল্লাহের
মেহেরবানীতে সীমিত সময় কুয়েত দেখার সৌভাগ্য হয়। মাত্র সাড়ে সাত হাজার বর্গমাইল
আয়তনের ছোট্ট দেশ কুয়েত। সিলেট বিভাগের সাথে বিবাড়িয়া জেলা যোগ করে দিলেই একটি
কুয়েত রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সারাটা দেশ মরুভূমি, তারি মাঝে একটি মাত্র জনপদ কুয়েত
সিটি। ইরাক ও সৌদি পরিবেষ্টিত দেশটির দক্ষিনে কেবল পারস্য উপসাগর। আমরা যখন
দেশটিতে পা রাখি তখন প্রচন্ড গরমে দেশটি পুড়ে যাচ্ছিল। বাহিরে চোখ মেলে দেখি ঘাস
গাছ জ্বলে খড়ের মত হলুদ হয়ে আছে। লোকে বলল এবছর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গরম পড়েছে
কুয়েতে, আকাশ বাতাস যেন রোদে ঝলসে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে সর্বপ্রথম
তৈলখনি আবিস্কার হয়। তখনকার দিনে পৃথিবীতে উত্তোলিত তরল সোনার শতকরা বিশভাগই এখানে
পাওয়া যেত। শেখ শাসিত দেশটি খুব দ্রুত উন্নতির উচ্চশিখরে চলে যায় এবং পরিণত হয়
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রে কিন্তু দেশটির এই বিশাল সম্পদ একসময়
বিপদের কারন হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমুহের শকুন দৃষ্টি পড়ে
ক্ষুদ্র এই মরুদেশটির উপর। দখলবাজ নেকড়েরা দেশটিকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত করে। তারা
সবগুলো তৈলখনি ও স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেশটাকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। আমি
আবুধাবি ও দোবাই সফরকালে সেথায় যে আধুনিকায়ন দেখি, তা কুয়েতে হয়েছিল অনেক আগে
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জ্বলে ছাই হয়ে আবার সেই ছাই থেকে ফিনিশ পাখির মত গড়ে
উঠেছে আমার নয়ন সম্মুখের এই ধুসর ফ্যাকাসে কুয়েত। উন্নয়নের সাপলুডু খেলায় আমাদের
ঘুরে দেখা স্বপ্নময় দেশ আরব আমিরাত কেবল মই-ই বেয়েছে, অথচ কুয়েতকে মই বেয়ে অনেক
উপরে উঠে পড়ে যেতে হয় অজগরের মুখে। সেই অজগর তাকে গোগ্রাসে গিলে পাঠিয়ে দিয়েছে
খনিযুগের আগের জায়গায়। আমাদের স্বাধীনতা লাভের চার বছর পর ১৯৭৫ সালে জন্ম নেয়া
নবীন রাষ্ট্র কুয়েত দ্রুত আগায়, আবার পিছায়। ধ্বংসস্থুপ হতে আবার শিরতুলে দাঁড়ানো
কুয়েতকে দেখে মনে হল ফিনিস পাখিরা কখনও মরেনা, মরলেও ছাই থেকে আবার জন্ম নেয়।
কুয়েত এয়ারপোর্ট হতে আমাদের
উড়ালযান টেকঅফ করে প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা পর নিউইয়র্কের জে.এফ.কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ
করে। সিলেটে আমাদের একজন আত্মীয়া মহিলাকে আমাদের সাথে নিয়ে আসি। তিনি হাঁটতে পারেন
না, ইজিচেয়ার তাকে একজন বয়ে নিয়ে যায়। সুদীর্ঘ্য যাত্রায় ব্যথাগ্রস্ত হয়ে নুরজাহান
বেগম একটা ইজিচেয়ারে বসে পড়েন। আমাদের সাথে আসা আত্মীয়াকে ইজিচেয়ারে একাকি আলাদা
লাইনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে জেফারকে তার সাথে দিলাম। আমরা দুইটি ইমিগ্রশন চেকআপ দিয়ে
ঢুকার জন্য লাইন ধরি। সার্টপ্যান্ট পরিহিত আমাদের ইজিচেয়ার চালক ছিলেন একজন ভারতীয়
স্মার্ট মহিলা, তিনি পাসপোর্ট নিয়ে গিয়ে কোন চেকআপ ছাড়াই আমাদেরকে পার করে দেন।
আমরা খুব খুশী হই কোন ইন্টারভিউ ছাড়া এই প্রথম আমেরিকায় ঢুকলাম। নূরজাহান খুশী হয়ে
এই মহিলার হাতে একশত ডলারের একটি নোট তুলে দেন যদিও এই চেয়ারের ভাড়া মাত্র দশ ডলার।
চলমান বেল্টের কাছে বসে লাগেজ এবং ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় ত্রস্তব্যস্ত
হয়ে ছুটে আসেন আমাদের আত্মীয়া, এসেই বললেন আমার মেয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে ব্যাগটা
এখনই দেন আমি চলে যাব। জেফার কোথায়? বলতেই জবাব দেন তাকে আটকে রেখেছে। তিনি তার
ব্যাগের জন্য এতই তাগদা দিতে শুরু করেন যে তাকেও যেন এখনি আটক করে ফেলবে। আমার মনে
হল তিনি খুব দ্রুত বিমানবন্দর হতে প্রাণ নিয়ে পালাতে চাইছেন। বিরক্ত নূরজাহান বেগম
তার ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে রাগের সাথে বললেন এই নেন আপনার ব্যাগ। ব্যাগটি পেয়েই তিনি এক
নিঃশ্বাসে এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে যান। খুবসম্ভব তিনি ভীতসন্তস্ত্র ছিলেন জেফারের মত ইউ
এস ইমিগ্রেশন যদি তাকেও আটকে দেয়।
আমি জেফারের সাথে দেখা করতে গেলে
সিকিউরিটি যেতে বাঁধা দেয়। গ্লাস দিয়ে দেখি সে আর অনেক লোকের সাথে একটি কক্ষে বসে
আছে। এবার নুরজাহান ইজিচেয়ার চালক ইন্ডিয়ান মহিলাকে ৫০ ডলার এনাম দিয়ে জেফারের খোজ
নিতে পাঠান। সে এসে বলল চিন্তা করবেন না, খানিক পরীক্ষা করেই ছেড়ে দেবে। গ্লাস
দিয়ে জেফারকে দেখছি সে বিমর্ষ হয়ে কোনদিকে না চেয়ে বসে আছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও
তার দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারলাম না।
নুরজাহান এই ভারতীয় মহিলাকে আর
১০০ ডলার দেন। এমনি এমনি ২০০ ডলার আমাদের অযথা গচ্চা গেল। ইতিমধ্যে জেফারের মা পুত্রের
মুক্তির জন্য একটি গরুও মানত করে বসেন। গচ্চাটা এভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পেরিয়ে
গেল। জে.এফ.কে.তে প্রায় তিনচার ঘণ্টা আমাদের খুব অশান্তিতে কাটে, নুরজাহান পূত্রের
চিন্তায় কান্নাকাটি জুড়ে দেন। মনে খুব আঘাত লাগে এই রোগী আত্মীয়াকে সাথে করে নিয়ে না
এলে জেফার আমাদের সাথেই থাকত এবং বিমানবন্দরে এই বাজে ঝামেলায় আমাদের পড়তে হতনা। আমার
মত গরীবকে বিনা অপরাধে পঞ্চাশ হাজার টাকা দন্ডসুদ দিতে হত না।
অসুস্থ একজন বেয়াইনকে সিলেট হতে বয়ে
নিয়ে জনসেবা করতে গিয়ে জে.এফ.কে.তে এক উঠকো ঝামেলায় পড়ে আমরা মারাত্মক দুশ্চিন্তার
আগুনে প্রায় চারঘণ্টা জ্বলেপুড়ে ছারখার হই, সেইসাথে পঞ্চাশ হাজার টাকা অযথা খোয়াই,
একেই বলে জনসেবার বিড়ম্বনা।
বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়, পরে উড়ালযানে
নিউইয়র্ক হতে ফ্লোরিডা যেতে দেখি যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি এয়ারপোর্টে জেফারকে সারি
থেকে আলাদা করে মেশিনে ঢুকায়ে ঘণ্টা দেড়ঘণ্টা পরীক্ষা করছে। কতৃপক্ষের আচরণটা এমন
যে জেফার যেন একজন সন্দেহভাজন অপরাধী। লাইনের সব লোকজনকে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে আমাদেরে
পরীক্ষা করছে, যা সহজে শেষ হচ্ছেনা। আমাদের প্লেন ছেড়ে দেবে এদিকেও যেন তাদের কোন খেয়ালই
নেই। আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশের লোক, তদুপরি দেশটি মুসলিম। তাই বলে কি আমরা
তাদের কাছে এত অবজ্ঞা অবহেলার পাত্র। নুরজাহান বললেন, জেফারকে নিয়ে আমেরিকার ভিতরে
আর প্লেনে ঘুরাফেরা করা যাবেনা। জেফারকে জেএফকের ইমিগ্রেশনে ফেলে রেখে আমার ভাগনার
শ্বাশুড়ি দ্রুত চলে যাবার কারনেই অভিভাবকহীন জেফারকে কতৃপক্ষ খুবসম্ভব সন্দেহের
তালিকায় ফেলে দেয়, নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি এয়ারপোর্টে তার সাথে কেন এমন বিদগুটে
অসদাচারণ করবে ওরা।
জে.এফ.কে.তে তিনচার ঘন্টা
অপেক্ষার পর আবার সিকিউরিটির সাথে ঠেলাঠেলি করে জেফারের আটক কক্ষের দিকে যাবার
চেষ্টা করি। একজন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার এগিয়ে এলে তাকে বললাম, Please give me
chance to meet with my son who is staying here এবার অফিসারটি
জেফারকে আমার সামনে নিয়ে আসে এবং সে আমাদের ফেসবুক পরীক্ষা করে। তারা আমার নোঠখাতা
পড়ে দেখে এবং জানতে চায় জেফার কেন বারবার বাংলাদেশে আসা যাওয়া করছে। আমরা প্রমাণ
দেখিয়ে বললাম সে বাংলাদেশের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছে, লেখাপড়া শেষ হলেই স্থায়ীভাবে
যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসবে। শেষমেশ তাদের হাত থেকে আমরা রেহাই পেলাম।
আমাদের গন্তব্য আজিজ ভাইয়ের
বাসাটি জে.এফ.কে এয়ারপোর্ট হতে খুববেশী দূরে নয়। বের হয়ে মাত্র বিশ বাইশ মিনিটে ওজনপার্কে
অবস্থিত আজিজ ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে যাই।
৭ জুলাই ২০১৯। নিউইয়র্কের এই
দিনটি ছিল শুক্রবার। আমরা সবাই দলবেঁধে ওজনপার্ক মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ি।
মান্নান সুপার মার্কেটে মালামাল কিনি, এখানে গতবারের মত এবারও আমার বাসার সাবেক
ভাড়াটিয়া কানাইঘাটের ফজল মিয়ার সাথে দেখা হয়।
জেফার ও আমাকে বিকেলে আরিক গাড়ি
চালিয়ে ‘আমেরিকান বক্সিং এন্ড ফিটনেস ক্লাবে’ নিয়ে যায়। আরিক এই ক্লাবের একজন
মেম্বার। এই মেম্বারসীপের জন্য তাকে একটা মাসিক চাঁদা দিতে হয়। সাথে ছিলেন আরিকের
একজন ল্যাটিন বন্ধু। এখানে দড়িলাফ হতে শুরু করে ধারাবাহিক বেশ কিছু ব্যায়াম করানো
হয়। খাবারের ছড়াছড়ির দেশ আমেরিকা। তাই স্থুলতা এখানে এক মৌলিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
এই ক্লাবে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করা হয়। ওজন পরীক্ষা করে যথাযত খাবার
তালিকা নির্ধারন করে দেয়া হয়। মেম্বারদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে, তাও দেখা হয়
ও প্রতিকার করা হয়। এখানে কুস্তি ও ব্যাডমিন্টন খেলার ইন্ডোর ব্যবস্থা এবং কুস্তিমঞ্চ
রয়েছে। আরিক জ্যাকেট পরে তার ল্যাটিন বন্ধুর সাথে মঞ্চে গিয়ে কুস্তি প্র্যাকটিস
করে। এসি ঘরের ভিতর সবাই ঘেমে ভিজে চুপসে যান। আমি ও জেফার আর অনেক আমেরিকানদের
সাথে দড়িলাফ দিয়ে হাফিয়ে উঠি।
এই আমেরিকান ক্লাবের ইন্সটাক্টর
একজন নীলচোখের শ্বেতাঙ্গ। হাফপ্যান্ট ও গ্যাঞ্জিপরা ক্লিনসেভ লোকটাকে দেখতে তরুণই
লাগে। গড়িতে করে বাসায় ফিরছি। আরিকের ল্যাটিন বন্ধুটি আমাকে বিস্মিত করে বলল, This guy is
youngman of ninety, somedays ago we have taken his birthday cake. আসলে উন্নত দেশের মানুষ আমাদের চেয়ে গড়ে বাচে বেশী এবং সহজে বুড়ো হয়না।
এমনকি তারা বুড়ো হতেও চায়না। বুড়ো শব্দটিকে তারা মনেপ্রাণে ঘৃনা করে। কাউকে ‘বুড়ো’
বললে সে আপনার প্রতি সিরিয়াস ক্রুদ্ধ হবে। ধরে নেবে তাকে বুড়ো ডেকেছেন তো গালী
দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প তার প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়ার
প্রেসিডেন্ট কিম জন উনকে টাট্টা করে বললেন ‘মিস্টার রকেটম্যান’, ওমনি তেলেবেগুনে
জ্বলে উঠে কিম পালটা হুমকি দেন তাকে ‘রকেটম্যান’ বলে হাসিটাট্টা করলে বয়স্ক
মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কোন ছাড় দিবেন না, তাঁর আসল জায়গায় ঘা মারবেন তিনি, ট্রাম্পকে
বলে দিবেন ‘আমেরিকান ওল্ডম্যান’। পাগলা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আচ করলেন সত্যি তো
বিপদ। ‘বুড়ো আমেরিকান’ বলে তাঁর ইজ্জত মানসম্মান সব ভূলুন্ঠিত করে ছাড়বে উত্তর
কুরিয়ার একনায়ক বালক কিম জন উন। তাই আর ‘রকেটম্যান’ বলে টাট্টা নয়, এবার সম্মান
নিয়ে এক দৌড়ে পালাও।
আপনি যদি মিস্টার ইয়াংম্যান কিংবা
মিসেস ইয়াং লেডি বলে সম্বোধন করেন তাহলে পশ্চিমা দেশের বুড়ো বুড়িরা নিদ্বিধায় খুশী
হবে এবং আপনাকে সহজেই আপন করে নেবে।
বুড়োত্ব ঢেকে দিতে যত ধরণের
প্রচেষ্টা আছে, পশ্চিমারা অবলীলায় সব করে যান। এসময় তারা ক্লিনসেভ করা বাড়িয়ে দেন,
ঠুটে গাঢ় লিপিস্টিক দেন, জমকালো পোষাক পরেন। চামড়ার বলিরেখা মুছে দিতে প্লাস্টিক
সার্জারি করেন এবং যৌবন ধরে রাখার জন্য ভিটামিন-ই খান। অথচ আমরা বুড়ো হলে সাদা
কাপড় পরি, দাড়ি রাখি, চাকচিক্য পরিহার করি। তাই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পশ্চিমারা
যে আচরণ করেন তা আমাদের দেশের মানব চরিত্রের একদম বিপরীত। আমরা বুড়ো হওয়াকে
হাসিমুখে মেনে নেই, আল্লাহের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নেই,
কেবলার দিকে মুখ ফিরাই কিন্তু তারা তেমনটি করে না।
ইপক আমার রণকেলীর খালাত বোন কলি
আপার ছেলে। রাতে সে তার গাড়িতে করে আমাদেরকে মামাত বোন রিপনের বাসায় নিয়ে যায়। ইপক
একসময় ডাচবাংলা ব্যাংকে চাকুরি করত। এখন সে আমেরিকায় আছে। দেশে ডাচবাংলা ব্যাংকের
ভাল চাকুরি ছেড়ে এখানে এসে কি পেলে? আমার এই প্রশ্নের জবাবে ইপক বলল, এখানে শান্তি
পেয়েছি। ডাচবাংলার চাকুরিতে কোন শান্তি ছিলনা। এখানে কাজ হতে বাসায় ফিরে অনাবিল
শান্তিতে নির্ভেজাল ঘুম হয়। আমার বড় মামা মামির বহুদিন পর এবাসায় সাথে দেখা হল।
ভাগ্নি মুনিয়াত এবং নিয়ামাকে আবার পেলাম।
আমার এবারের ভ্রমণ টার্গেট ডিজনিওয়াল্ড,
অরলান্ডো, ফ্লোরিডা। সব তথ্য আগেই ইন্টারনেটে নিয়েছি। এবার ডিজনীওয়াল্ড সফরের পরিকল্পনা
বাস্তবায়নের পালা।
৮ জুন ২০১৪, শনিবার। রাতে
ওরলান্ডো যাবার জন্য ৭২৫ ডলার করে প্লেনের টিকেট পাই, কিন্তু রিপন অফিসে থাকায়
ডেবিট কাডের অভাবে বুকিং করতে পারিনি। পরদিন সকালে মামাত বোন আরফার বাসায় যাই,
সেখানে বুকিং করতে গিয়ে দেখি একই টিকেটের দাম বেড়ে ১০০০ ডলার হয়ে গেছে। এদেশে
প্লেনের টিকেটের দাম চাহিদার সাথে এভাবেই আকাশ-পাতাল উঠানামা করে। আমাদের অপেক্ষার
সময় নেই, তাই ভাগ্নি রাইসার ডেবিট কাডে ৩০০০ ডলার পরিশোধ করে আমাদের তিনজনের
ফ্লোরিডা যাবার রিটার্ন টিকেট করি। ডিজনিওয়াল্ডের কাছে মেরিন ড্রাইভ সড়কের সেরালাগো
হোটেল এন্ড রিসোর্টে তিনজনের একটি ফেমিলি কটেজ ১১ হতে ১৪ জুন চাররাতের জন্য বুকিং
করি।
এইদিন দুপুরে ইপক আমাদেরকে
ওজনপার্কে আমাদের মূল স্টেশনে পৌছে দেয়। বিকেলে আসেন সুমির সুদর্শন ও শিক্ষিত আজাদ
কাশ্মিরী স্বামী যিনি পাকিস্থান এম্বেসির একজন ডিপ্লোমেট। সুমি আমার বড় সম্মন্দি
কবির আহমদ চৌধুরীর কন্যা।
৯ জুন ২০১৯, রবিবার। দুপুরে ইপক
এসে আমাদেরকে খালাতো ভাই সাহেদ ও খালাতো বোন শিবলী খানমের বাসায় নিয়ে যায়। একটি
গাড় সবুজ পাহাড়ি এলাকায় এই বাসার অবস্থান। বাসার এক কক্ষে ভাগ্নির বিয়ের গায়েহলুদ
অনুষ্ঠান অয়োজনের প্রস্তুতি দেখে আসি। কাছেই আমার চাচাত শালিকা মনাচাচার মেয়ের
বাসায় যাই। সে হাতে তৈরি নানাপদের নাস্তা পরিবেশন করে। এই শালিকার স্বামীর বাড়ি
ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া। ইপকের বাসায় গিয়ে একই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটে আমার খালাতো বোন
এলি আপার সাথে দেখা করি। এলি আপার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার কামাল এ চৌধুরীর বাড়ি
জকিগঞ্জের গনিপুর। মুন্সিপাড়ায় বড় বাসা ফেলে এসে আমেরিকার ছোট ফ্ল্যাটে ছটফট
করছেন। ইপকের ফ্ল্যাটে রাত কাটাই। তার দুই শিশুপুত্র ইয়াকিদ ও আরবিদ স্কুলে যায়। ইপকের
স্ত্রী মৌলভীবাজারের বেকামুরার কন্যা। তিনি এম পি গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর ভাতিজী। এই
গুণবতী কন্যা আমাদের খুব সেবাযত্ন করেন। তিনি রাতে রান্না করে প্রচুর মাছ ভাত
রোস্ট পোলাও এবং ফল হিমবক্সে প্যাকিং করে দেন। শেষরাতে ইপক আমাদেরকে প্রায় ঘন্টাখানিক
কার চালিয়ে হার্ডসন ব্রিজ পেরিয়ে নিউজার্সির নিউআর্ক এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। স্পিরিট
এয়ারের ছোট প্লেনটি বাহাত্তুর জন যাত্রী নিয়ে দশ হাজার ফুট উপর দিয়ে ফ্লোরিডার
দিকে যাত্রা করে। নিচে আটলান্টিক মহাসাগর ও সবুজ উপকুল পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
এমনকি সমুদ্রগামী বেশ কয়েকটি নদীকে আটলান্টিকে মিলিত হবার দৃশ্যও চোখে পড়ে। প্লেনে
নুরজাহান পানি কিনতে চাইলে ডেবিট কার্ডের অভাবে কেনা সম্ভব হয়নি। নগদ ডলারে এখানে
কিছুই কেনার ব্যবস্থা নেই। একজন আমেরিকানকে ডলার দিলে তিনি তার কার্ড দিয়ে এক বোতল
পানি কিনে দেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর ডিজনীওয়াল্ডের শহর ওরলান্ডোর আকাশে এসে
যাই। প্লেনটি ওরলান্ডোর আকাশে চক্কর দিলে নিচে নদী সাগর ও ঝিল পরিবেষ্টিত
বাংলাদেশের মত চিরসবুজ অরলান্ডকে অপুর্ব সুন্দর একটি শহর মনে হল। দুইটি নদী যেন
শহরটাকে আবর্তন করে মিলিত হয়ে দূরসাগরে গিয়ে পড়েছে।
১০ জুন ২০১৯ অরলান্ডো বিমানবন্দর
হতে বের হয়ে একটি ক্যাব ভাড়া করি। অর্ধঘন্টা পর আমরা Seralago Hotel
& Suits পৌঁছে যাই। একটি পাচতলা সুন্দর হোটেল, নিচে লবী, কিচেন,
ডাইনিং হল এবং কয়েকটি নিত্যপন্যের দোকান রয়েছে। গাছপালা ঘেরা পার্কিং এবং বাগান,
বসার জায়গা সহ এই রিসোর্টের পরিবেশ বেশ মনোরম। আমরা সেরালাগো হোটেলের অফিসে গেলে
তারা বলল আপনাদের বুকিং বিকেল ৪টায় কার্যকর হবে, কাজেই হোটেলের লবিতে কিংবা
ডাইনিঙয়ে বসে সারাদিন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কোন পথ নেই। এখানে পিথজা, বার্গার,
পাউরুটি, ফ্রেঞ্চফ্রাই, ডিম, কলা, আপেল এসব ছাড়া ভাত-মাছ-তরকারি জাতীয় কোন দেশী
খাবার নেই। রাইসবিহীন এসব আমেরিকান খাবারে আমরা বাঙ্গালীদের চলেনা। ইপকের বউয়ের
দেয়া খাবার তাই আমাদের খুব কাজে লাগে। খাবার এত বেশী ছিল যে সে খাবারে তিনজনের দুইদিন
আনায়াসে চলে যায়। রাইসার ক্রেডিট কার্ডে আমরা হোটেল বুকিং করি। তারা কার্ডটি চাইলে
আমরা দেখাতে পারিনি। আমাদেরকে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রেখে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে।
তারপর পাসপোর্ট ও গ্রিনকার্ডের ফটোকপি রেখে আমাদেরকে বহিরাঙ্গনের ফেমিলি স্যুট
বরাদ্ধ করে। স্যুট নম্বার-৬১১। আমাদেরকে হোটেল কতৃপক্ষ বললেন, আপনাদের ব্রেকফাস্ট বুকিং
করা হয়নি। খুবসম্ভব রাইসা বুকিঙয়ের সময় এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তাদের একজন
কর্মচারী একটি বাগান ও সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে আমাদের স্যুটে নিয়ে যায়।
হোটেলের পাশে রয়েছে অসংখ্য
খোলামেলা ফ্যামিলি স্যুট, প্রতি স্যুট কোয়ার্টারের সামনে রয়েছে পরিস্কার নীলজলের সুইমিংপুল,
খোলা ময়দান, পুস্পবাগ এবং গাড়ি পার্কিং স্পেস। এই সেরালাগো রিসোর্টের বিরাট এলাকা
জুড়ে দুই শতাধিক ফেমিলি স্যুট আছে। প্রতিটি স্যুটে দুই বিছানায় চারজন লোক থাকার
ব্যবস্থা রয়েছে। সোফা, ফ্রিজ, ওভেন, ইস্ত্রি, এসি, আলমিরা, ফোন ইত্যাদি সব লাইফ
গুডসে এই ফেমিলিস্যুট সুসজ্জিত। রয়েছে ওয়াশ রুম ও গরমঠান্ডা পানির ব্যবস্থা।
একটা লামসাম হিসাব করে দেখি এই
রিসোর্টের দৈনিক আয় বিশ হাজার ডলারের কম হবে না।
স্যুটের বাসিন্দা নর-নারী-শিশুরা
দলবেঁধে সামনের সুইমিংপুলে সাতার কাটছেন।
কোন এক উলঙ্গ শ্বেতাঙ্গিনী
তরুণীকে কাঁধে তুলে সুমিংপুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার স্পাউস একজন উলঙ্গ তরুণ। নুরজাহান
তা দেখে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে বললেন এরা মানুষ, নাকি অন্য কোন গ্রহের লোক। আমি বললাম
কেন? বাংলাদেশে এরকম লাল টকটকে মোঠাসোঠা উলঙ্গ মানব মানবী কখনো দেখিনি। তিনি জবাব
দেন, এদেরকে যে আমার ভিনগ্রহের মানুষই মনে হচ্ছে। বললাম এরা এইমাত্র স্বর্গ হতে
বেরিয়ে আসা আদম এবং হাওয়া। তুমি তাদেরকে ভিনগ্রহের এলিয়ান মনে করলে কি হবে, এরাই
যে বর্তমান পৃথিবীর আসল মানুষ। এই আধুনিক সভ্যতা এরাই গড়েছে।
রাতে হোটেল লবি হতে ডিজনিওয়াল্ড দেখার
জন্য ১১, ১২ ও ১৩ জুন এই তিনদিনে জন্য আমরা তিনজনের টিকেট কাটি। খরচ আসে ১২৫ ডলার x ৩ x ৩ = ১১২৫ ডলার। আমাদেরকে জানানো হল প্রতিদিন
সকাল ৯টায় ডিজনির গাড়ি এসে আমাদেরকে সারেলাগো হতে নিয়ে যাবে এবং রাত ১২ ঘটিকায়
হোটেলে পৌঁছে দেবে।
ডিজনিওয়াল্ডে প্রবেশের আগে
পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এই বৃহত্তম আমেরিকান থিমপার্ক নিয়ে হালকাভাবে আলোচনা করা
যেতে পারে। পার্কটির আয়তন প্রায় ৪৫ বর্গমাইল যা ধারন করে আছে প্রায় ২৯০০০ একর জমি।
ফ্লোরিডার অরলান্ডো শহরের ধারে বে লেক এবং লেক বুয়েনা ভিস্তা এলাকায় এই পার্ক জন্ম
নেয় আমাদের স্বাধীনতা বর্ষ ১৯৭১ সালের ১লা অক্টোবর। এই থিমপার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও
স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি, যার স্ট্যাচু আমরা পার্কের বাগানের একটি মঞ্চে
দেখতে পাই। প্রতিষ্টানটি একদিনে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠতে সময় লেগেছে বছরের পর বছর।
ডিজনিওয়াল্ডের বর্ধন, পরিবর্তন এবং সময়ের চাহিদার সাথে বিবর্তনের কাজ সব সময়ই
বহমান আছে। ডিজনিওয়াল্ডের প্রধান থিমপার্ক
চারটি ১। ম্যাজিক কিংডম, এটি শিশুপার্ক ২। এপকট সেন্টার, এটি মহাকাশ ও বিঞ্জান
পার্ক ৩। হলিউড স্টুডিও, এটি থ্রী ডাইমেনশন ছবি ও অভিনয় পার্ক ৪। এনিমেল কিংডম, এটি
হল এশিয়ান, আফ্রিকান ও বৈশ্বিক সাফারি পার্ক ও গার্ডেন। প্রতিটি থিমপার্কে রয়েছে
আড়াইহাজার গাড়ির পার্কিং মাঠ, চার পার্কের মধ্যে আছে আভ্যন্তরীণ বাস ও ট্রেন
যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।
তাছাড়া এখানে আছে ৩টি ওয়াটার
পার্ক, ২৭টি থিম-হোটেল, বেশকিছু গলফ ময়দান, এন্টারটেইনমেন্ট ভেনু, আউটডোর সপিং
সেন্টার, বিচিত্র বিচিত্র স্থাপনা, জলবাগান এবং স্থলবাগান এবং কয়েকটি নয়নাভিরাম
লেক। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় পচাত্তুর হাজার কর্মী।
১১ জুন ২০১৯ ভোরে ঘুম থেকে উঠে
নামাজ পড়ি। এই হোটেলে খুব সম্ভব আল্লাহকে সেজদা করার মত লোকজন আমরা ছাড়া আর কেউ
নেই। পরে ভোরের আলোয় সেরালাগোর সুন্দর প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখি। হোটেলের ডাইনিংহলে বসে
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পিৎজা খেয়ে চা পান করি। এসময় হোটেলে বিপদ সংক্ষেত বেজে ওঠে।
আমাদেরকে বের হতে বলা হলে গেটের বাহিরে এসে দেখি দুইটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, সাথে
রয়েছে ভারী অস্ত্রধারী পুলিশের দল। বিভিন্ন স্যুটের বোর্ডাররা এসে জড় হন। আমরা
সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে আঁতকে যাই। কিন্তু পরে জানলাম বিষয়টা কিছুই না। হোটেল ভবনের
কোথায়ও সর্ট সার্কিটের সংক্ষেত দিলে এত হৈ চৈ পড়ে যায়, যা আমাদের দেশে হলে কোন
খবরই হতনা।
সকাল সোয়া ৯ টায় আলপনা আঁকা নীল
কালারের একটি সুন্দর টুরিস্ট বাস আমাদেরকে নিতে আসে। বাসের গাঁয়ে লিখা ছিল ডিজনিওয়াল্ড।
আমরা বিদেশীদের সাথে লাইন ধরে বাসে উঠি। কিসিমি এলাকার শ্যামল সবুজ পাহাড় ও জলাভূমি
পেরিয়ে বাসটি অর্ধঘন্টা পর আমাদেরকে ডিজনিওয়াল্ডের এস্কট সেন্টারের বাসস্টেশনের ৪৮
নং টার্মিনালের নামিয়ে দেয় এবং সেরালাগো ফিরতে রাত ১১টায় এখানে এসে তাদের বাসে
উঠতে বলে।
দিনটি
ছিল বেশ গরম, যেন বাংলাদেশের এপ্রিল মাস। বৃক্ষের ছায়া দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি।
গেটে এসে আবার লাইনে দাড়াই। এখানে অজস্র মানুষের ভীড়, প্রথমে ব্যাগ ও দেহ পরীক্ষা,
তারপর ভিতরে যাত্রা। আবার লাইন ধরে একটি মেশিনে টিকেট স্পর্শ করলেই সবুজ সংক্ষেত
আসে। এবার স্বপ্নের ডিজনিওয়াল্ডের একটি থিমপার্ক এস্কট সেন্টারে আমরা তিনজন
প্রবেশ করি। দিনটি ছিল গরম, মাথায় উপর সুর্যের
চান্দিফাটা রোদ। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল কিছুটা ভিজে, শরীর ঘেমে যায়। কিন্তু
ফ্লোরিডার গরমে গা ঘামছেনা, এই যা তফাৎ। প্রথম দিনেই আমরা হোঁচট খেলাম। ডাঃ
নুরজাহান হাঁটতে পারছেন না, হাটুতে ব্যথা। ইজি চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলেও অচেনা
জায়গায় খোঁজে বের করা যায়নি। এবার গরমে তার অবস্থা নাজেহাল। পথেপথে বৃক্ষছায়া আছে,
রাস্থার পাশের বড়বড় ফ্যান জনতার উপর বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার পরও তিনি ব্যাঞ্চে
বসে যান। তারপর পায়ের ব্যথায় শুয়ে যান। পানির বোতল শেষ করে স্বস্তি এলোনা। তাকে
কোনমতে টেনে টুনে নিয়ে মঙ্গলগ্রহে যাবার স্পেসমিশনে নিয়ে যাই। আমরা তিন জনকে
ব্যাল্টে বেঁধে নেই। পোষাকপরা রবুটিক পাইলটরা স্পেসশিপ স্টার্ট দেন। রকেট আমাদেরকে
নিয়ে সুদূর আকাশে উড়াল দেয়। ধোয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন হয়ে আসে। রকেটটি আকাশ ফুড়করে
অজস্র তারার মাঝদিয়ে মহাকাশে চলে যায়। বিশাল বিশাল গ্রহানুর কাছ দিয়ে উড়ে যায়।
গ্রহানুর সাথে আঘাত লাগার ভয়ে গা শিউরে উঠে। লালমাটির উঁচুনিচু মৃত পাহাড়
পর্বতঘেরা মঙ্গলের উপর দিয়ে স্পেসশিপ আবর্তন করে নিচের এক গিরিখাদের কিনারায় অবতরন
করে। মঙ্গলের এক গভীর গীরিখাতের কিনারায় নামতে গিয়ে স্পেসশিপটি দুর্ঘটনায় পড়তে দেখে
প্রাণ ভয়ে খাপছাড়া হবার উপক্রম হলেও পাইলটরা কোনমতে থামিয়ে দিতে সমর্থ হয়। এবার
দরজা খোলে, আমরা বেরিয়ে আসি। এই মঙ্গলগ্রহ অভিযানের কোন কোন ইভেন্টে এতই ভীতিকর
ছিল যে আমি দুচোখ বন্ধ করে আত্মরক্ষা করি। আর দুই একটা ইভেন্টে তিনজন অংশ নেই।
এসকট সেন্টারে দুইঘন্টা অবস্থান করি।
অসুস্থ শরীর নিয়ে নুরজাহানের পক্ষে ডিজনীওয়াল্ডে অবস্থান করা আর
সম্ভব নয় দেখে এবার বেরিয়ে আসি। হলুদক্যাবে ফিরে যাই সেরালাগো হোটেল স্যুটে। মনটা
খারাপ হয়ে গেল, তিন দিনের মধ্যে প্রথম দিনটাই বরবাদ। কিছুই দেখা হল না, অথচ হেরে
গেল তিনজনের একদিনের টিকেট ৩৭৫ ডলার। যাক তবে আল্লাহের মেহেরবানিতে দিনটা অন্য
কাজে ব্যয় হল। নুরজাহান এবার দেশে ফোন করে ফুফুতো সেলিম ভাইয়ের কাছ থেকে তার
শালিকা নাসু বোনের মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করেন। নাসু বোনকে ফোন করতেই তার স্বামী
দেওয়ান ফয়জুল হক গাড়ি চালিয়ে স্যুটে হাজির
হন। আমাদেরকে নিয়ে যান কিসিমি এলাকায় তার বাসায়। দেওয়ান ফয়জুল হকের বাড়ি আমার
নানাবাড়ির পাশে পাতারিয়ার পুর্বগাও। একসময় বাংলাদেশ বিমানে চাকুরি করতেন। অনেক
অনেক আগে চাকুরি ছেড়ে আমেরিকায় এসে স্থিত হন। সদ্য কেনা তার বাসাটি খুব সুন্দর ও
শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত। বাসার পিছনে বাগানসহ সুইমিংপুল। এখানে নাসু আপার রান্নাকরা
নানাপদের মজাদার খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পুতুলের মত একটি শান্তশিষ্ট ফিলিপিনো শিশু
এবাসায় সারাদিন থাকে। আমরা স্নেহ করলে রাগ দেখায়, কেবল নাসু আপার সাথে তার সদ্ভাব।
বিকেলে তার মা এসে নিয়ে গেলে আমরা বেড়াতে বের হই।
আমেরিকা নাসু আপাদেরকে সব দিয়েছে। ঢাকায় তাদের একটি ফ্ল্যাট
আছে, এখানে আছে আর তিনটি বাসা। প্রতিটি বাসা হতে প্রচুর ভাড়া আসে। কারে করে
অরলান্ডোর কিসিমি এলাকার বাসাগুলো নাসু আপা বিকেলে ঘুরে দেখান। বাংলাদেশের মত
তাদের বাসায় লাগানো আছে আম জাম ও লিচু গাছ। রাস্থা দিয়ে যেতে প্রচুর ওক এবং ম্যাপল
গাছের দেখা পাই। বাংলাদেশের মত রয়েছে ছন ও বাদা বন। এ যেন সুদূর আমেরিকায় আরেক
বাংলাদেশ। শেষে জানলাম কেবল আবহাওয়া কিংবা বৃক্ষলতা নয়, আয়তনেও ফ্লোরিডা উপদ্বীপ
একটি বাংলাদেশ। ফ্লোরিডার উত্তর ও পুর্বদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিনে মেস্কিকো
উপসাগর এবং পশ্চিম সীমানা কেবল আমেরিকার সাথে সামান্য জোড়া লেগে আছে। নাসু আপা
বললেন, আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করে এলে ভাল হত। হোটেলে না উঠে এখানে থাকতে পারতে
এবং ডিজনিতে কর্মরত কাউকে সাথে দিলে ভালভাবে সব দেখাতে পারত। আসলে ডিজনিওয়াল্ড এত
বড় এবং জটিল যে জানা একজন গাইড ছাড়া সময়কে যথাযত ব্যবহার করে এখানে সবকিছু ঘুরে
দেখা সম্ভব নয়। আমরা তৃতীয় বিশ্বের লোকজন জানিনা, এখানে কি কি আছে। কোনটি দেখা
বেশী জরুরী কিংবা কোনটি কম জরুরী। কোনদিকে গিয়ে কি দেখতে হবে ও কোন ইভেন্টে কি আছে।
কোনটায় বেশী সময় বা বেশী মনযোগ দেয়া দরকার। আমাদের হাতে এখনও দুইদিন বাকী আছে।
নাসু আপার মেয়ে ডিজনিতে চাকুরি করত। তাদের কাছ থেকে উপদেশ নিয়ে বাকি দুইদিন যথাযত
কাজে লাগানোর সিন্ধান্ত নেই। ডিজনিওয়াল্ডের ম্যাপ ও গাইড বুক আমার হাতেই ছিল। এই
হ্যান্ডবুকের সাহায্য ছাড়া ডিজনিওয়াল্ড যথাযত ঘুরে দেখা আদৌ সম্ভব নয়।
সাজেদা খালা, আমার শ্বাশুড়ি মলিকা খাতুন চৌধুরীর চাচাত বোন।
সাজেদা খালার জৈষ্ট্য পুত্র শামিম চৌধুরী কিসিমির বাসিন্দা। কিসিমি মসজিদের কাছেই
তার বাসা। এখানে এসেছেন প্রায় বার বছর হয়ে গেছে। তাদের ট্রিপ্লেক্স বাসায় এসে খুব
আদরযত্ন পাই। বড় বাসায় পুত্র, নতুন পুত্রবধু এবং তারা থাকেন। দেওয়ান ফয়জুল হক পাতারিয়ার
জমিদার বংশের লোক, তার মনটাও জমিদারের মত বিশাল। সারাদিন আমাদেরকে নিয়ে ঘুরাফেরা
করে গাড়ি চালিয়ে তিনি বেশ রাতে আমাদেরকে সেরালাগো হোটেল স্যুটে পৌছে দেন।
১২ জুন ২০১৯। আমরা তিনজন সেরালাগোর লবিতে গিয়ে লুফ, জেলি, কলা
ও ডিম সহযোগে ব্রেকফাস্ট করি। নুরজাহান বললেন ডিজনিওয়াল্ড যাবার তার কোন ইচ্ছে
নেই। আমার মনে হল তাকে রেখে যাওয়াই ভাল, সেখানে গিয়ে গতকালের অবস্থা হলে এই দিনটাও
মাটি হবে। তের হাজার মাইল দূর হতে ডিজনিওয়াল্ড দেখতে আসার শ্রম, অর্থ ও আনন্দ সব
ধুলায় লুন্ঠিত হবে। আমি ও জেফার লাইন ধরে ডিজনিওয়াল্ডের বাসে চড়ে বসি। নাসু আপার
সাথে ফোনে আলাপ করে পরিকল্পনা তৈরি করি। এই দিনটি সম্পুর্ণ কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই।
একটির পর একটি ইভেন্টে লাইন ধরে প্রবেশ করি। ইভেন্টগুলোর বিবরন দিচ্ছি। স্পেসশিপ
আর্থে উঠে সারাটি পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসি। চোখের সামনে বিভিন্ন দেশের মানচিত্র ও
সেসব দেশের দর্শনীয় স্থান ও বিষয় ভেসে ওঠে। লিভিং উইথ দা ল্যান্ডে গিয়ে
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত ভুমির ব্যবহার ও ধাপে ধাপে কৃষি
উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করি। সয়ারিন এরাউন্ড দা ওয়াল্ড চড়ে পৃথিবীর প্রাচীন ও মধ্যযুগের
সপ্তম আশ্চর্য যেমন ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, রুমের কলাসিয়াম, মিশরের পিরামিড,
ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, তাজমহল, চীনের প্রাচীর, পেরুর মিচুপাচু,
উত্তরমেরুর হিমবাহ, এভারেস্ট শৃঙ্গ ইত্যাদি দেখা হয়। এপকটের পিছনের লেকপারে গড়ে
তুলা মেস্কিকো, নরওয়ে, চীন, জার্মানী, ইটালি, জাপান, মরক্কো, ফ্রান্স, বৃটেন,
ক্যানাডা ইত্যাদি দেশের নামে এসব দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সংস্কৃতিধারক
এক একটা ছোট এলাকা। এইসব ছোট্ট এলাকায় ঢুকলেই সেখানে ঐ দেশটার ইতিহাস ঐতিহ্য
সংস্কৃতি এবং বিশেষত্বকে সংক্ষেপে দেখা যায়। সকাল হতে গরমের মধ্যে একটানা হাঁটা
আমি ও জেফারকে অবসন্ন করে দেয়। বারবার পানি ও খাবার আমাদেরকে শক্তি দিলেও আর যেন
হাঁটা যাচ্ছেনা। ভিনদেশি আবহাওয়ায় অনাভ্যস্থতা সহজেই আমাদেরকে কাবু করে ফেলে। আমার
সংকল্প ছিল রাত এগারোটা পর্যন্ত একটার পর একটা ইভেন্টে অংশ নেবো। কিন্তু বিকেল
চারটার পর আর পারলাম না। একটি ক্যাবে চড়ে ফেরে আসি সেরালেগো স্যুটে। আমাদের সাথে
না গেলেও স্যুটে নুরজাহান বেগমের দিন ভালই গেল। তাকে এসে হাসিখুশিই পেলাম। হোটেলের
পরিস্কার কর্মি শ্বেতাঙ্গিনী বুড়ির সাথে তার বেশ ভাব জমে যায়। প্যান্টসার্ট পরা এই
মহিলার সাথে তার খাবার ও সৌজন্য বিনিময় হয়। বুড়ি আমাদের দেশী খাবার খেয়ে বেজায় খুশি।
তিনি আমাদের জানালার পর্দা ও কার্পেট পাল্টিয়ে দেন, সেইসাথে প্রচুর সাবান, টিস্যু,
ক্রিম এবং স্যাম্পু দিয়ে যান। দিনের হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত থাকায় বিকেলে চোখজুরে
নেমে আসে প্রশান্তির ঘুম। বিকেলে সারেলাগো পেরিয়ে ওপাশের রাস্থায়, বাগানে, লবীতে
ঘুরেফিরে রাত দশটা হয়। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পাড়ি, পরদিন সকাল ৯টায় আমাদেরকে যেতে হবে
ডিজনী অভিযানে।
১৩ জুন ২০১৯। গতকাল পিতাপুত্র মিলে বিঞ্জানের এতএত বিস্ময়কর
লীলাখেলা দেখি যা আমরা আগে কখনও কল্পনা করতে পারিনি। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সিমুলেশনে যে
এত কিছু আধুনিক বিঞ্জান ও টেকনোলজী তৈরি করতে পারে তা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের
মানুষের কাছে ধারনাতীত। তাহলে এই সিম্যুলেশন দিয়ে পৃথিবীতে কৃত্রিম স্বর্গ-নরকও
তৈরী করে ফেলা সম্ভব। আমি ও জেফার চাইলাম নুরজাহান বেগম যেন এই চমৎকার রত্নাবলী
দর্শন হতে বঞ্চিত না হন। গতকাল আমরা অপার বিষ্ময় নিয়ে একটার পর একটা ইভেন্ট দেখেছি
আর সেই সাথে পসতাই আমাদের সাথি একজন এত টাকা খরচ করে এসে এত টাকার টিকেট করেও এসব দেখতে
পারছেন না। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে। জেফার ও আমি বললাম, আজ এসো, আমরা
ইজিচেয়ারে বসায়ে তোমাকে ইভেন্টে ইভেন্টে নিয়ে যাবো। তার জবাব না আমি যাবনা। এখানে
দেখার কি আছে ? তারচেয়ে এই স্যুটেই আমার আরাম।
সেরালাগো হোটেলের লবিতে হাঁটছি। স্যুট-কোট-টাইপরা রাজপুত্রের
মত স্মার্ট ও সুদর্শন একজন স্পেনিশ তরুণ আসেন। ভাবলাম তিনি হয়ত হোটেলের কোন
বড়কর্তা হবেন। ওমনি তিনি ঝাড়ু নিয়ে মেঝে ঝাড়ু দিতে লেগে যান। আসলে তিনি কেউকেটা
কেউ নন, একজন সামান্য পরিস্কার কর্মি। এখানে ছোট সাহেব বড় সাহেব বলে কিছু নেই। সবাই
মিস্টার ও সম মর্যাদার অধিকারী। হোটেল ডাইনিঙয়ে ব্রেকফাস্ট করে শেষমেশ আমরা বাপ-পুত
দুইজন নুরজাহান বেগমকে আরামে রেখেই ডিজনির ট্যুরবাসে চড়লাম।
ম্যাজিক কিংডমের গেটে দেখি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মোমের পুতুলের মত
অপরূপ সুন্দর কিছু শ্বেতাঙ্গ তরুণ তরুনীকে নেচে নেচে গান গাইছে। এই গাড়ির চারপাশে
একঝাক সুসজ্জিত সুন্দরী আমেরিকান পোষাক পরে নেচে গেয়ে স্বল্পগতির ঘোড়ারগাড়িটিকে
আবর্তন করছে। ম্যাজিক কিংডম হেঁটে হেঁটে আমরা দেখতে থাকি। এখানে সব ইভেন্ট
বাচ্চাদের জন্য তৈরী। অদ্ভুদ সুন্দর ফোর-ডি ছবিগূলো শিশুদের জন্য সাজানো। কয়েকটি
ছবি সিনেমাহলে ডুকে পরখ করি। আমরা দুজনের কেউ শিশু নই। দোলনা, চরকা, খেলনাযান,
কার্টুন ইত্যদিতে সময় নষ্ট না করে ম্যাজিক কিংডম হতে ট্রেনে আমরা ছুটে গেলাম হলিউড
স্টুডিও। ম্যাজিক কিংডমের রাতের আতশবাজি ভূবন বিখ্যাত। ভাবলাম রাত ৮টার ফিরে এসে এখানকার
বিখ্যাত আতশবাজি উপভোগ করে নেব।
হলিউড স্টুডিওতে বিশ্বের বিস্ময় জাগানোর মত অনেক অনেক ৪-ডি,
৫-ডি অত্যাধুনিক ফিল্ম এবং এডভেঞ্চার রয়েছে। এখানে বিশটি ইভেন্ট রয়েছে। আমরা বেশ
কয়েকটি ইভেন্ট উপভোগ করি। টাইম ইন ফরেভারে আমরা প্রাগৈতিহাসিক হোমোসেপিয়ান্স যুগ
হতে পাতর তামা লোহার যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন
চোখের সামনে যেন বাস্তবেই সংঘটিত হতে দেখি। স্টার ওয়ারের মহাকাশ যুদ্ধযান চড়ে
ভিনগ্রহের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহন করি। আমাদের রবোট ও
যুদ্ধারা চোখের সামনে মরনপর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সামনে ফ্রন্টলাইনে প্রচন্ড গোলাগুলী
ও লেজার যুদ্ধ হচ্ছে। কালোধুয়া এবং আগুনের লেলিহান শিখা আকাশকে জ্বলিয়ে দিচ্ছে।
গরমের হলকা এসে গায়ে লাগছে। আমরা ভীত হয়ে কখনো কখনো দমবন্ধ হয়ে যাই, না জানি কখন
যেন বোমায় বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। আমাদের যুদ্ধারা অতি সাহসিকতার সাথে লড়াই করে
শেষ পর্যন্ত দুষ্ট এলিয়ানদেরে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। রক্ষা পায় আমাদের এই প্রিয়
পৃথিবী। স্টার ট্যুরে বিগব্যাং হতে শুরু করে এখন পর্যন্ত ষোলশত কোটি বছরে সংঘটিত
তারা জগতের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ প্রত্যক্ষ করি।
একসময় একটি রাস্থা দিয়ে মানুষের স্রোত ধাবিত হতে দেখি। ভাবলাম
এত মানুষ যখন যাচ্ছে নিশ্চয় এদিকে ভাল কিছু হবে। আমরাও ছুটে গেলাম। পিছনে এক
পাহাড়ের ধাপে পাঁচটি দর্শক গ্যালারি এ, বি, সি, ডি এবং ই। প্রতিটি গ্যালারিতে
সাত-আট শত বসার সিট রয়েছে। এখানে দেখানো হবে ইন্ডিয়ানা জোন্সের এপিক স্ট্যান্ট
স্পক্টাকুলার। সামনে বিশেষভাবে নির্মিত বিশাল কাঠামো এবং মাঠে স্ট্যান্ট অভিনয়
মঞ্চস্থ হবে। বন্যার মত এগিয়ে আসা পশ্চিমা জনতায় গ্যালারীগুলো কানায় কানায় পূর্ণ
হয়ে গেল। আমাদের সামনে এসে হাজির হন হলিউডের একজন সেলিব্রিটি নায়িকা। এই নায়িকার
নাম আমার মনে নেই, তবে মানুষ হাততালি দিয়ে যেভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করেছে তাতে সন্দেহ
নেই যে তিনি একজন বিখ্যাত নায়িকা। অনেকক্ষণ অভিনয় করলেন তিনি, আমি কিছুই বুঝিনি
তবে সবার হাসির ঝড় দেখে বুঝলাম রম্যরসের নদে উতলে উঠেছে জোয়ারের বান।
স্ট্যান্ট অভিনয় শুরু হল। মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসা অজস্র বল্লমের
আঘাত হতে নিজেকে রক্ষা করে এগিয়ে যান একজন অভিনেতা। সামান্য ভুল হলে একটি বল্লমের
আঘাতই তাকে এফুড় ওফুড় করে দেবে। উপর হতে নেমে আসা একটি বিশাল গোলাকার পাতর ঠেলে আটকে
দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন আরেকজন স্টান্ট। শ্ত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে
তিনতলা, চারতলা ভবনের ছাদ হতে লাফিয়ে পরছেন নায়িকা, এসব ভয়ঙ্কর কান্ড দেখে মনে হয়
এই চিকন নায়িকা বুঝি আমাদের মত রক্তমাংশের মানুষ নয়, যেন রবারের তৈরি বিড়ালী।
প্রচন্ড গোলাগুলীর মধ্যে আত্মরক্ষা করে স্ট্যান্টদের এগিয়ে যেতে দেখে গায়ের লোম
খাড়া হয়ে যায়। শত্রুর আক্রমনে প্রচন্ড বোমা বিস্ফোরণে সৈনিক ভর্তি গাড়ী ছিন্নভিন্ন
হয়ে যাবার দৃশ্যদেখে আফগান ও সিরীয় যুদ্ধের বিভৎস্যতা মনকে ক্ষনিকের জন্য বিষন্ন
করে দেয়। যখন ভাবছি বিস্ফোরিত গাড়ির সবাই নির্ঘাত মারা গেছে, ওমনি এই জ্বলন্ত জীপ
থেকে বেরিয়ে আসেন উচকো কুচকো স্টান্ট অভিনেতার দল। সামনের মঞ্চের এই ভয়ঙ্কর স্ট্যান্ট
অভিনয় কিন্তু পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের সিমুলেশন নয়, এটি বাস্তব। হলিউডের একদল স্টান্টের
যথারীতি অভিনয় করা একটি শ্বাসত বাস্তব প্রদর্শন। হলিউডের একটি স্টান্ট ছবি যেন
আমাদের সামনে নির্মিত হতে দেখে অভিঞ্জতার ঝুড়ি পূর্ণ করে নেই। বিগত তিনদিন এতকিছু
দেখে মনে মনে ভাবি, আমেরিকানরা আমেরিকানই, তারা কত কিছুইনা করতে জানে। বাহিরের
পৃথিবীর সাথে তাদের তুলনা হয়না, তারা অতুলনীয়। এক নিঃশ্বাসে প্রায় দুইতিন ঘন্টা শেষ
হল। সময় যে কিভাবে নিঃশেষ হল টেরই পেলাম না। বৈঞ্জানিক আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ
অনুসারে সময় ছোট কিংবা বড় হয়ে যেতে পারে যদি বস্তু আলোর গতিতে ছুটে। সেদিন দেখি
কর্মব্যস্ততার তীব্রগতি মানুষের সময়কেও দ্রুত বহায়ে ছোট করে দেয়। ডিজনিওয়াল্ডে
আমাদের সময়ের প্রবাহ যেন সজুরে বইছিল। এত এত কিছু দেখার, শেখার, কিছুই বাদ দেবার
নয়। কিন্তু সময় কোথায়? বেরিয়েই জেফারকে বলি, চল ছুটে যাই এনিমেল কিংডম নইলে এই থিমপার্কটি
আমাদের ভ্রমণ তালিকা হতে বাদ পড়ে যাবে।
এনিমেল কিংডমের গেটে গিয়েই আমরা আফ্রকান লাইভ কনসার্টের সামনে
পড়ি। একঝাঁক কালো নর্তক নর্তকি নেচেগেয়ে এলাকাটিকে উৎসবমুখর করে রেখেছেন। তাদের
সাথে সাদারাও নেচে গেয়ে একাকার। একটি সুবিশাল বৃক্ষের সামনে দাড়াই। অজস্র ডালপালার
বৃক্ষ দানবটি পল্লবঘন পুস্পে ভরা, ডালে ডালে বসে আছে প্রচুর বুনো পাখি। এতবড় বৃক্ষ
আমি জীবনে আর কখনও দেখি নি। লাইন ধরে মানুষ এই বৃক্ষের তলায় যেতে দেখে আমরাও
গেলাম। গিয়ে দেখি ওমা গাছটির কান্ডে দরজা আটা, দরজা দিয়ে ডুকে অনেকগুলো অফিসকক্ষ।
আরে এটা যে ঢালাই করে মানুষ্য নির্মিত একটি প্রকান্ড গাছ, বুঝার কোন উপায় নেই এটি
বাহিরে বৃক্ষ ভিতরে ভবন। এ যে বেহেশতের কল্পিত বহুতল বৃক্ষ ভবন। এখানকার অনেক
ইভেন্টের মধ্যে আফ্রিকান কিলিমাঞ্জারো সাফারি সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রচুর মানুষ লাইনে
দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ও জেফার লাইনে দাড়াই। সারাদিন হাটাহাটি করে হাটু ও কোমরে ভীষন
ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ লাইন এগুচ্ছে অতি ধীর গতিতে। একটার পর একটা ট্রাক এসে
সামনের স্টেশন হতে লাইনের লোকজনকে নিয়ে যাচ্ছে। এখানকার কাটের কাজ, বাড়িঘর, রাস্থাঘাট,
ভবনছাদ সব আফ্রিকার ধাঁচে নির্মিত। এমনকি যে খোলা ট্রাকে আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে আরোহন
করি সেটির চালকও কালো আফ্রিকান এবং ট্রাকটির বসার চেয়ার ও ছাদ আফ্রিকান দড়ি দিয়ে
নির্মিত। ট্রাকটি এবড়ো তেবড়ো পথে উঁচুনিচু ঢালু বেয়ে মেটো পথে ধীর গতিতে চলতে শুরু
করে। এখানে মাটি লাল, শিলাময় পাহাড়ি এবং গাছপালা আফ্রিকা মহাদেশীয়। কোন কোন স্থানে
রাস্থার উপর দিয়ে বন্যার পানি বইছে। ট্রাক পানি ভেঙে এদিক ওদিক ঝাকুনি দিয়ে আগায়।
শৈশবে আমাদের দেশের রাস্থার এমন দশা প্রায়ই দেখেছি। ট্রাকটি যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমরা
আফ্রিকা মহাদেশের কোন এক পাহাড়ি বনভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। পথে পথে খোলা মাঠে
বিচরণরত বানর, সিংহ, উটপাখি, জেব্রা, জিরাফের পালকে খোলা বনে বিচরন করতে দেখি।
জলাভূমিতে কুমির এবং জলহস্থির পাল চোখে পড়ে। প্রায় দেড় ঘন্টা আফ্রিকার জঙ্গল ঘুরে
ট্রাকটি যখন স্টেশনে ফিরে এলো তখন বিকেল হয়ে গেছে।
আমরা সারাদিনের অবিশ্রান্ত পথচলায় ক্লান্ত শ্রান্ত। আমাদের
তিনদিনের ডিজনির টিকেটের মেয়াদ আজ রাত ১২টায় শেষ হয়ে
যাবে। ডিজনিওয়াল্ডে অনেক কিছু দেখার ছিল। প্রথম দিনটি ডাঃ
নুরজাহান বেগমের অসুস্থতায় বেস্তে যায়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিন দু’টি আমরা সাধ্যমত ব্যবহার করি। এখানে সংখ্যাতীত বিস্ময়কর ইভেন্ট রয়েছি যা
দুইতিন দিনে দেখা কোনমতেই সম্ভব নয়। আমরা গিয়েছি ফ্লোরিডার গ্রীষ্মকালে, এই গরমে
হেঁটে হেঁটে এক ইভেন্ট এলাকা হতে অন্য এলাকায় যেতে দেহমন ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই
সম্ভব নয় সকাল দশটা হতে রাত বারটা পর্যন্ত একটানা ঘুরে দেখা। অনেক ইভেন্ট তাই
দেখার বাকি রয়ে গেল। নাসু আপার সাথে ফোনে আলাপ হল। তিনি বললেন রাত আটটায় ম্যাজিক কিংডমে
অগ্নিবর্ষন ও আতশবাজির প্রদর্শন বিশ্ববিখ্যাত। একঘন্টার এই প্রদর্শনী যেন কোনমতে
মিস না করি।
আমরা এত ক্লান্ত হই যে বিশ্রাম প্রয়োজন। একটি ক্যাব ভাড়া করে
ছুটে গেলাম আমাদের অস্থায়ী নিকেতন সেরালাগো হোটেলে। ভোর পাঁচটায় অরল্যান্ডো
বিমানবন্দর হতে আমাদের প্লেন টেকঅফ করবে। একটি ক্যাব ভাড়া করি, রাত ৩টায় এসে
আমাদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাবে। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে রাত ৮টায় এসে ম্যাজিক
কিংডমের আতশবাজি অনুষ্টান দেখার সিন্ধান্ত নেই। কিন্তু স্যুটে গিয়ে দেখি ডাঃ
নুরজাহান বেগম খুব চিন্তিত, এমন কি অস্থিরতায় ভূগছেন। সারাদিন তিনি বাহিরের বাগানে
ও সুমিংপুলে হাটাহাটি এবং হোটেলের লোকজনের সাথে গল্পসল্প করে পার করেছেন। তিনি
স্যুটের টেলিভিশনে খবরে শুনেছেন ফ্লোরিডায় সামুদ্রিক ঝড় আসছে। এই খবরই তাকে ভীষন
চিন্তায় ফেলে দেয়। বিকেলে বৃষ্টি হয়, ঝড়ো বাতাস বয়, চারদিকে আমাদের কালোবৈশাখীর মত
একটা অন্ধকার নেমে আসে। রিসোর্টের পার্কিং খানিকটা গাড়িশুন্য হয়ে যায়। তিনি
মালামাল সব স্যুটক্যাসে ভরে নেন। আমি বলি রাত ৩টায় আমরা এয়ারপোর্ট যাব, তিনি বলেন,
না না এখনই চলো। ঝড় এসে গেলে যাওয়া যাবেনা, প্লেন মিস হয়ে যাবে। তাকে কোনমতে
বুঝাতে পারি নাই বিমানবন্দর মাত্র পাঁচচল্লিশ মিনিটের রাস্থা, চালক অবশ্যই তিনটায়
এসে বিমানবন্দর পৌছে দেবে।
এই ক্যাবচালককে ফোন দিলে সে ১০টায় এসে আমাদেরকে অরল্যান্ডো
বিমানবন্দর পৌছে দেয়। মনটা খারাপ হয়ে গেল, ম্যাজিক কিংডমের রাতের আতশবাজি গোল্লায়
গেল, অনেক অনেক মজার ইভেন্ট দেখা হলনা। প্রায় ছয় হাজার ডলার খরচ করে একটা গভীর
অতৃপ্তি নিয়েই ফিরলাম। তবে ডিজনীওয়াল্ডের প্রতিষ্ঠাতা স্কট ওয়াল্টার ডিজনির একটি
অমর বানী সাথে করে নিয়ে এলাম ‘যদি তুমি স্বপ্ন দেখতে পারো, তাহলে তুমি সেটা করতেও
পারবে’। অরল্যান্ডো বিমানবন্দর ঠান্ডা, সেইসাথে নির্জন এবং নিস্থব্ধ। সোফার নরম
গদীতে ঘুমিয়ে গেলাম। এখানে মশা মাছি নেই, তাই চোখজুড়ে নেমে এলো শান্তির ঘুম।
তিনটায় নুরজাহান বেগমের ডাকে আমরা বাপ-পুত জেগে উঠে বর্ডিং পাশের জন্য লাইনে
দাড়াই। এখানে জেফারকে আলাদা করে নিয়ে কি যে পরীক্ষা নিরীক্ষা। স্পীট এয়ারযানটি
আকাশে ওড়ার খানিক আগে গিয়ে আরোহন করি। নিউইয়র্কে আর কিছুদিন কাটিয়ে ১৮ জুন ফিরে
আসি বাংলাদেশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন