সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

উপমহাব্যবস্থাপক পদে পুনরায় পদোন্নতির সাক্ষাৎকার খেলায় অংশগ্রহণ

 

উপমহাব্যবস্থাপক পদে পুনরায় পদোন্নতির সাক্ষাৎকার খেলায় অংশগ্রহণ                       

২০১৪ সালে সিরাজুল হক চৌধুরী সিলেটের অঞ্চলপ্রধান হবার পরই পুবালী ব্যাংকে আমার ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। এই বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন আমার আত্মীয় আব্দুল হালিম চৌধুরী। এই দুই ব্যক্তির উন্নতিকে আমার উন্নতি মনে করে অতীতে আমি খুব খুশী হতাম, গর্ব অনুভব করতাম অথচ দুঃখজনক সত্য হল এই দুইজন লোকের সময়কাল আমার জন্য অপয়া সময়ে পরিণত হয়। তাদের আমলে আমি পদে পদে নিগৃহীত হই, অপমানিত হই। সিলেট শহরের বিভিন্ন শাখায় এক দশক ব্যবস্থাপনা করা আমাকে এই সময় গ্রামে বদলি, মৌলভীবাজার প্রেরণ, পরিবার ঢাকায় নেয়া সম্ভব নয় জেনেও আমাকে ঢাকায় বদলির মত ঘটনা ঘটে। এমনকি আমাকে কোন ভাল দায়িত্বও দেয়া হয়নি। আমার প্রতিবেশী পরিচালক মনির আহমদ বলতেন, আপনারা সিলেটের বাইরে যান না, পদোন্নতি হবে কেমনে? অথচ এই অলক্ষি সময়ে বছরের পর বছর আমাকে জেলা-জেলান্তরে নানান ঘাটের ঘোলাজল পান করায়েও ধারাবাহিক পদোন্নতি হতে বঞ্চিত করে রাখা হয়।

ব্যাংকের গতানুগতিক কাজ থেমে থাকেনা। বিগত প্রহসন নাটকের প্রায় দুই বছর পর আবার আরেক প্রমোশন ইন্টারভিউ নাটকের ডাক পেলাম। এমডির লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে গেলাম দুইদিন। এমডি পত্নী আমার ভাতিজী রহিমা চৌধুরী রিপা খুব সেবাযত্ন করে, ভাল ভাল ফল ও হাতে তৈরি নানা পদের নাস্তা পরিবেশন করে। কিন্তু এমডি হালিম চৌধুরীর গোমট ভাব কাটলনা। জানিনা কে বা কারা তার মনে আমার সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং এই নেগেটিভ ভূল ধারণাই তাকে পরিচালিত করছে।

একদিন পত্রিকায় বিঞ্জাপন দেখি পুবালী ব্যাংকের মালিকানাধীন কোম্পানি পূবালী সিকিউরিটিজ লিমিটেডে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হবে। আমি স্টকমার্কেট সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখি। তাছাড়া শেয়ার ব্যবসায় অনেক অর্জন আছে আমার। আমাকে পদোন্নতি দিয়ে উপমহাব্যবস্থাপক করে পূবালী সিকিউরিটিজের প্রধান করা হলে ভাল করতে পারবো একথা জানাতে একদিন এমডি অফিসে যাই। বারবার একজনের পর একজন মহাব্যবস্থাপকদের আগমন ঘটলে সামনের চেয়ারে বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ, মানুষ সরলেই আমাকে শুনতে হয় প্রমোশন পেতে হলে অঞ্চলপ্রধান হতে হবে, কর্পোরেট শাখা চালাতে হবে, ইত্যাদি কথাবার্তা, যেন আমি এসব চেয়ারে বসতে অপারগ কিংবা অক্ষম। নতুবা আমি এসব দায়িত্ব কাঁধে নিতে রাজি নই। অথচ এই তিনের কোনটাই আমি নই। তিনি যে সব আই এ/ বি এ পাস অজ্ঞ লোকদেরে এজিম/ডিজিএম/জিএম বানিয়ে ব্যাংক চালাচ্ছেন, এদের তুলনায় ঢের ভালভাবে আমার হাতে ব্যাংকের অনেক শাখা আগের সুযোগ্য এমডিগণের আমলে চলেছে। আব্দুল হালিম চৌধুরীর এসব আজেবাজে ওয়াজের ফাঁকে আসল কথাটা বলার সুযোগ পেলামনা, আমার শেয়ার বিষয়ক দক্ষতার খবরটা না জানিয়েই ফিরে আসি।

ব্যাংকের প্রমোশনের সাথে অঞ্চলপ্রধান কিংবা কর্পোরেট শাখাপ্রধান হবার সম্পর্কও আমার কাছে পরিস্কার হয়নি। পূবালী ব্যাংক বিশাল প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংকে বিভিন্ন ধরণের কাজ ও বিভাগ রয়েছে, যে ধরণের কাজে যার যত ভাল দক্ষতা ও ভালবাসা রয়েছে, সে সেইকাজে তত ভাল করতে পারে। তাকে সেই কাজে নিয়োগ দিলেই প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ফিডব্যাক পেতে পারে। সবাইকে যে শাখা কিংবা অঞ্চলপ্রধান হতে হবে তা এই এমডির একটি ভ্রান্ত ধারণা। তাঁর পাশের চেম্বারে ব্যাংকের সেকেন্ড চীফ এএমডি মোহাম্মদ আলী বসে আছেন, তিনি কখনো ম্যানেজারি করেন নি, অঞ্চল প্রধানও হননি। আইন বিভাগের দেওয়ান রুহুল আহসান একই অফিসে সারাজীবন কাজ করে মহাব্যবস্থাপক হন।  অনেক দক্ষ কর্মকর্তা সারাজীবন আঞ্চলিক কার্যালয় কিংবা প্রধান কার্যালয়ে কাজ না করে অফিসার থেকে জিএম পর্যন্ত হবার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। এই হটকারী এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী আমাকে নিয়ে যেন অন্যদের আঁকা অংকের ছকে ডুব সাঁতার মারেন। চাটুকারের দল তাঁর বুদ্ধিসুদ্ধি সব খেয়ে তাকে ফোকলা শূন্যকলসে পরিণত করে। অন্যরা কৌশলে নিজের কাছের লোকদেরে খেয়াপার করে দিচ্ছে, তখন আব্দুল হালিম চৌধুরী আপনমনে বসে বসে আঙ্গুল চুষেন। মনে মনে ভাবী, বাবারে, লোকটা যে একটা অপদার্থ রাবিশ।       

আর একটি জগন্য বাক্য আমাকে শুনতে হল, সিলেটি হিসাবে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ এখন আর নেই, যেন আমি সিলেটি হিসাবে তার কাছে প্রমোশনের জন্য কাঙ্গালিপনা করতে গিয়েছি। আমি কিছু বলার আগেই তাঁর এসব কথাবার্তা শুনে আপন মনে ভাবলাম, আমি নয়, সিলেটি হিসাবে সুযোগ-সুবিধা অতীতে তিনিসহ সবাই নিয়েছেন। কেরানি হতে ডিজিএম/ জিএম হয়েছেন। অল্প বিদ্যায় বড় বড় পদে বসেছেন। সিলেটি হবার কারণে সব প্রবীণ পরিচালকদের কাছ থেকে কমলালেবু নিজেরা ষোলআনা খেয়ে দেয়ে ঝুড়ি খালি করে এখন অন্যের জন্য এই সস্তামালকে যেন ঘোষণা করা হচ্ছে গন্ধমফল। সেদিন আর মনে হল সিলেটি লোক না হলে ও আমার চাচাত ভাই ই এ চৌধুরী তাকে এই ব্যাংকে নিয়ে না এলে এবং আমার পরিবারে বিয়ে না করলে, এই সামান্য প্রাণিবিদ্যার লেখাপড়া দিয়ে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পূবালী ব্যাংকের মগডালে কখনো বসতে পারতেন না। মানুষের কৃতঘ্নতার একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিত।        

২৭ এপ্রিল ২০১৯ শনিবার, আমি নিশ্চিত ধারণা নিয়েই যাই, এই এমডি আব্দুল হালিম আমাকে প্রমোশন দিচ্ছেনা। রাজতলব, চাকুরিতে আছি আমাকে যেতেই হবে, তাই গেলাম। শুক্র ও শনিবার দুইদিনে প্রধান কার্যালয়ের তিন তলায় ৮৫ জন এজিএমের সাক্ষাৎকার নেয়া হল। আমি ভিতরের পাতানো খেলায় অংশ নিতে বাহিরের জলসা ঘরে অনেকের সাথে অপেক্ষায় বসি। সিরিয়াল অনুযায়ী ডাক পেলাম। ভিতরে একটি বিরাট চেয়ারের এপাশে আমি একাকী বসি। ওপাশে বসেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান জুয়ার্দার, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আখতার হামিদ খান এবং মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর।

আব্দুল হালিম চৌধুরী জানতে চান আমি কোথায় কোথায় কাজ করেছি? তার সহজ প্রশ্নের সহজ জবাব দেই। আখতার হামিদ খান বললেন, আপনি ব্যাংকের কোন কোন কাজ জানেন। আমি একটি কাজের ফিরিস্তি দেই। একসময় জানতে চান আপনি কোন কাজে দক্ষ? বললাম আমি শেয়ার বাজার ভাল বুঝি। আমার মনে হল তাদেরকে শেয়ার বাজারে ঢুকিয়ে দেই। এবিষয়ে প্রশ্ন করলে আমাকে আটকাতে পারবেনা, তাছাড়া আমাকে প্রমোশন দিয়ে পূবালী সিকিউরিটিজে পাঠালে ব্যাংকের ভাল হবে, আমারও মঙ্গল হবে। আমার চাকুরি এবং বিনিয়োগ দুইটিই একি সরলরেখায় চলে আসবে। আখতার হামিদ খান পিই রেশিও কি জানতে চাইলেন? সাধারণ সংঞ্জা ‘শেয়ারের বাজারদর/ প্রতি শেয়ারের আয়’ না বলে অন্যভাবে বললাম, পি ই হল একটি শেয়ার তার ইপিএসের কতগুণ দামে বাজারে আছে তাই। এমন সময় মোহাম্মদ আলী বললেন, আপনি একজন ব্যাংকার আপনি শেয়ার ভাল বুঝেন তার মানে কি? তিনি সি আর জি (ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং), হিসাব খোলার ফরমের কিছু অঙ্ক সম্পর্কে জানতে চান। শফিউল আলম খান চৌধুরী আমার কাছে জানতে চান এসেট ম্যানেজমেন্ট কি? ব্যাংকের এসেট কি? লাইবিলিটি কি? এটা খুবই সাধারণ প্রশ্ন, যাক যথাযত জবাব দেই। আহমদ এনায়েত মঞ্জুর জানতে চান পেপস কি। বললাম পলিটিক্যাল এক্সপোসড পারসনস। আপনার এলাকার একজন পেপসের কে হতে পারেন? বললাম এম পি, উপজেলা চেয়ারম্যান, সরকারী চাকুরিজীবী প্রমুখ। দশ পনের মিনিট প্রশ্ন করে এবার এমডি বললেন, আপনি যান।

পরদিন রাতে সিলেটের রাজুর ফোন পাই স্যার আপনার খবর কি? শফিউল হাসান স্যার ডিজিএম হয়ে গেছেন। তার কাছে আর অনেকের নাম পেয়ে যাই। আমার নাম তালিকায় আসবেনা তা অনেকটা জানাই ছিল। অনেক প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারে ঢুকে দুইতিন মিনিট পরই বেরিয়ে আসতে দেখি, অথচ সাক্ষাৎকারের সময় বোর্ডের সামনে দীর্ঘ্য পনের মিনিট আমাকে বসিয়ে রাখার সুবাদে কিছুটা আশায় আশায় ছিলাম। বারজনকে ডিজিএম করা হয়। 

ভয়ে ভীতসন্তস্ত্র হয়ে অথবা আপদক্ষণে ব্যবহারের জন্য ৮৫ জনের তালিকার একদম পিছন থেকে টেনে এনে দুদকের চেয়ারম্যান সুজন মাহমুদের ভাই শাহজাহান মাহমুদকে পদোন্নতি দেন এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী। উল্লেখ্য শাহজাহান মাহমুদ ব্যাংকে চাকুরি করলেও কম্পিউটার চালু করার মত সামান্য জ্ঞানটুকুও ছিল না। ব্যাংকের কাজে তার তেমন কোন দক্ষতা নেই। বিশ্বস্ত সূত্রে জানলাম গতবার তাঁকে পদোন্নতি না দেয়ায় এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরী ডেকে নিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চান এবং আগামী বার নিশ্চিত পদোন্নতি দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। একেই বলে ঠেলার নাম বাবাজি। এবার শুধু পদোন্নতি নয়, তার চাকুরি মেয়াদ শেষে বাড়িয়ে দিতেও বাধ্য হন আব্দুল হালিম চৌধুরী। এই আব্দুল হালিম চৌধুরী যতই বড় গলায়ই কথা বলেন না কেন তিনি আসলে একজন ভীতু প্রকৃতির লোক এবং শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তিনি সর্বক্ষেত্রেই একজন সুবিধাবাদী লোভী খলনায়ক ছাড়া কিছু নন।       

পূবালী ব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক। দশ হাজার মানুষ এখানে কাজ করেন। একজন নির্বাহীর প্রমোশনে/ ডিমোশনে পুবালীর মত বিশাল ব্যাংকের কিছু যায় আসে না। এই ব্যাংকের একজন নির্বাহী একটি বড় হাতির পিঠে বসা একটা ক্ষুদে মাছি মাত্র। এতে হাতির পিঠে মাছি বসলে যে ভার পড়ে তা শুন্য বৈ কিছু নয়। এই মাছি হাতির গাঁয়ে বসলেই বা কি, উড়ে গেলেই বা কি। তাই বছরে হাজার কোটি টাকা লাভ করা পূবালী হাতির পিঠে সওয়ার হওয়া আমি এক ক্ষুদে মাছি ইসফাক কুরেশীর এজিএম থেকে ডিজিএম হওয়ার ভারে নিশ্চয় পুবালী ব্যাংক কাঁথ হয়ে পড়ে মারা যাবে না। এখানে অনেক ল্যাংড়া, খোড়া, আঁতুড়, কানা, কঠিন রোগাক্রান্ত মানুষও চাকুরি করে দিব্যি বেঁচে আছেন। তাই বলা হয় ব্যাংকটি মানবিক।    

আমার পদোন্নতি নিক্তির পাল্লায় ফেলে মাপা শুরু হল এবং যারা এই মাপামাপি শুরু করলেন তারা সবাই আমার চাচাত ভাই ই এ চৌধুরীর নেকনজরে পড়ে আজ এই ব্যাংকের বড় বড় চেয়ারে বসে আছেন। তারা এতই অকৃতঞ্জ যে ভূলে গেছে দাউদপুর চৌধুরী পরিবার এই ব্যাংকটির মালিকানায় না এলে তারা এখানে চাকুরি পেত না এবং এখান  থেকে এত লাভালাভ তুলে নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ কিংবা বটগাছ হতে পারতো না। ব্যবসা বিষয়ে আদৌ কোন লেখাপড়া ছাড়াই গাছপালার সামান্য বিদ্যা দিয়ে জীবনে কখনও ব্যাংকের ডি এম ডি/ এম ডি হবার খায়েশ তাদের পুরণ হত না। আমি যে এই দাউদপুর চৌধুরী পরিবারেরই একজন সদস্য। তাই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরানে বলেছেন, মানুষ অল্পই কৃতঞ্জতা প্রকাশকারী হয়। মানুষ মাত্রেই অকৃতজ্ঞ।  

আমি এমন একটি ব্যাংকে কাজ করছি, যেখানে অসংখ্য ইন্টারমেডিয়েট ও ডিগ্রি পাশ লোক এজিএম/ ডিজিএম/ জিএম, আমি ডাবল মাস্টার্স এবং হাফ ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারী হয়েও এজিএম। একদিনও ম্যানেজারি না করে অসংখ্য লোকেরা এখানে এজিএম, ডিজিএম এবং জিএম। আমি চৌদ্দ বছর ম্যানেজারি করে দুইবার শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপক ক্রেষ্ট পেয়েও এই ব্যাংকে একজন এজিএম। এটাই পূবালী ব্যাংকে আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এখানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের অধীনে বুয়েট ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারিদেরেও চাকুর করতে দেখি। আমার চাকুরি জীবনের বিকেলবেলায় এসে পূবালী ব্যাংকের এমনই বিদগুটে কদাকার চিত্র দেখতে হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। ১৯৫৯ সালে জন্ম লাভের পর থেকে পূবালী ব্যাংক আর কখনও ব্যাংকিং বিষয়ে এত অজ্ঞ এবং এত অপ কুটকৌশলী স্বার্থপর লোকের হাতে পড়ে নি।    

কিছুদিন পর আবার স্টাফ গাড়িঋণের সার্কুলার পাই। আমার খুব একটা ইচ্ছে ছিলনা আবেদন করি। বাসা ফেরার সময় অফিসের গাড়িতে ডিজিএম বেলায়ত হোসেন বললেন, গাড়িঋণ আবেদন করুন পেয়ে যাবেন। বস, একটা আবেদন করে দিলাম। আবেদনটি মানবসম্পদ বিভাগে পাঠিয়ে দিয়ে একদিন নিচের প্রিন্সিপাল শাখার মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলামের চেম্বারে বসি। তাকে বিষয়টি জানাতেই বললেন হবেনা। মাত্র বারটি গাড়িঋণ অনুমোদন হবে, একটি ডিএমডি মোহাম্মদ আলী স্যার পেয়ে যাবেন। বাকি এগারটিও নির্ধারণ করাই আছে। তার কথা শুনে মাথায় এলো না তাহলে কেনইবা সার্কুলার জারি করে গাড়িঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়ে তামাসা করা? এখানে কি আমাদের কোন কানাকড়ি মূল্য আছে। ভাবলাম, তাহলে আমি কেন গাড়িঋণ আবেদন করে সম্মান খোয়াতে গেলাম। আগে এই তামাসা বুঝতে পারলে এই আবেদন পাঠিয়ে অসম্মান হতাম না। একদিন অফিসের গাড়িতে বসে শুনি গাড়িঋণ বিতরণ দুইমাস আগেই শেষ হয়ে গেছে, বারজন নির্বাহীকে স্টাফ গাড়িঋণ মঞ্জুরের কোন খবরই আমরা পেলাম না। ‘দুঃখিত, আপনাদের আবেদন অনুমোদন করা সম্ভব হয় নি’ এধরনের একটা সৌজন্য চিটি দেওয়ার গরজও কতৃপক্ষ অনুভব করে নি। আমিতো অন্যদের মত ব্যাংক হতে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেইনি, ব্যাংকের টাকায় অনেকের মত দেশবিদেশও ঘুরি নি। অথচ সামান্য স্টাফ-কারলোন এই ভদ্রলোকের শাসনামলে তার কর্তা ব্যক্তিরা ডাস্টবিনে ছুড়ে দেয়। অথচ এই পুবালী ব্যাংকে আমার চোখের সামনে কোন কোন লোককে একবার নয়,  দুই/তিনবারও গাড়ি ঋণ দেয়া হতে দেখি। এই হল এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর পূবালী ব্যাংকে ন্যায্যতার পরিবেশ।  আমি এই আত্মীয় এমডি লোকটার প্রতি খুব বিরক্ত হলাম, যে আত্মীয়তার কোন মূল্য দিতে জানে না এবং যার কাছে আত্মীয়তা সম্পর্কের বিন্দুমাত্র কোন দাম নেই। কৃষিব্যাংকের প্রবীণ লোকজন প্রায়ই বলতেন, ভাগ্যিস তোমার চাচাতো ভাই ই এ চৌধুরীর সুনজরে পড়ে আব্দুল হালিম চৌধুরী পুবালী ব্যাংকে চলে যান নতুবা এখানে থাকলে বড়জুর কৃষি ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক হয়েই বিদায় নিতেন।

ব্যাংকে যারা চাকুরি করেন, সবারই শখ থাকে একবার বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর কোন প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেয়া। পুবালী ব্যাংকে সুদীর্ঘ্য কাল চাকুরি করলেও বিআইবিএম দেখার সৌভাগ্য আমার কখনো হয় নি। আমি একদিন হেড অফিসের দশম তলায় মহাব্যবস্থাপক নীতিশ কুমার রায়ের চেম্বারে যাই। নীতিশ স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স সহ মাস্টার্স। তার ব্যাংকিং ডিপ্লোমাও রয়েছে। তিনি ব্যাংকের একজন প্রশিক্ষক, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে তিনি ক্লাস নেন।

নীতিশ কুমার রায় বেশ মেধাবী এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার লোক,  হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি সর্বধর্মে এবং সুফিবাদে বিশ্বাসী। এক ঈশ্বরের বিশ্বাস তাকে পরিচালিত করে যদিও প্রথা পালনে পুজাপার্বনেও অংশ নেন। আমি একদিন তাকে হজরত শাহজালালের(রহঃ) মাজারে পেয়ে এককপি “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” উপহার দেই। তিনি বইটি পড়ে আমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে যান। আমার লেখা হজরত শাহজালালের(রহঃ) জীবনী ও আধ্যাত্মিক সঙ্গীত পড়ে তিনি প্রভাবিত হন এবং আমাকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যাক্তি বা জিন্দাপীর ভাবতে থাকেন।

তিনি আমাকে বিআইবিএমের রিসার্স এলমনাক বিষয়ে একদিনের একটি কোর্সে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, আপনাকে হজরত আলী শাহ এবং কুমির শাহের মাজারে নিয়ে যাব। বিআইবিএম যাবার আমার বেশ আগ্রহ থাকলেও ইহা কোথায় তা জানতাম না। নীতিশ স্যার আমাকে ধানমন্ডি বাসা হতে তার কারে করে মিরপুরে বিআইবিএম কার্যালয়ে নিয়ে যান।

বিআইবিএমের ক্যাম্পাস বেশ বড়, এখানে ক্লাস কক্ষ, থাকার ছাত্রাবাস, পাকঘর, ব্যাংকিং বিষয়ের গ্রন্থমালার পাঠাগার, খেলার স্থান, বাগান, গাড়ি রাখার জায়গা সব রয়েছে। এখানে পিএইচডি হোল্ডার শিক্ষকরা ক্লাস নেন। বিভিন্ন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা বিভিন্ন কোর্সে অভিঞ্জতা ও ঞ্জান বিতরণে অংশগ্রহণ করে থাকেন। বিআইবিএমের এই প্রশিক্ষণে গিয়ে আমার একটি লাভ হল, বহুদিন পর আমার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরীকে পেয়ে যাই। তিনি বিআইবিএমের সম্মানজনক সুপার নিউমেরারী প্রফেসর পদে নিয়োগ পেয়েছেন। হেলাল আহমদ চৌধুরী স্যার দারুণ কর্মপাগল একজন পন্ডিত মানুষ। পঁয়ষট্টি বছর বয়স পূর্ণ করে তিনি পূবালী ব্যাংকের এমডি এবং সিইও পদ হতে অবসরে যান। কিন্তু এই কর্মঠ মহামানবের কাছে বয়স পরাস্ত, তিনি এখনও কাজের মধ্যেই ডুবে আছেন। হেলাল আহমদ চৌধুরী স্যার আমাদের ক্লাস নেন এবং ক্লাশ শেষে স্যারের সাথে ছবি তুলি। তার সৌজন্যবোধ এবং ভদ্রতা কিংবদন্তিতুল্য।

নীতিশ স্যার এবার আমাকে কুমির শাহের মাজারে নিয়ে যান। মিরপুরের একটি নিরিবিলি জায়গার বার-তের ফুট অনুচ্চ একটি টিলার উপর এই মাজার। মনে হল মাটি ফেলে কৃত্রিম ভাবে টিলাটি তৈরি করা হয়েছে। টিলাজুড়ে মাজার, মসজিদ, পূন্যার্থীদের গড়াগড়ি যাওয়ার মেঝে। চারপাশে আমগাছ মাজারের ঘরটিকে ঘিরে আছে। নিতীশ স্যার নিচের দোকান থেকে শতাধিক টাকার আগর, আতর ও গোলাপজল ক্রয় করেন। সিড়িবেয়ে উপরে উঠে আমি কিবলামুখি হয়ে জেয়ারত করি। নিথীশ স্যার গোলাপজল ছিটিয়ে মাজারে একটি সেজদা দেন। মাজারের তন্দ্রাচ্ছন্ন সেবায়েতদেরে ডেকে জাগিয়ে এনাম দেন।

কুমির শাহের মাজার জেয়ারত শেষে ছুটে গেলাম মিরপুর আলী শাহের(রহঃ) মাজারে। আলীশাহ(রহঃ) মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত দরবেশ এবং ইসলাম প্রচারক। সুলতানি আমলে বাগদাদ হতে এখানে এসে তিনি বাঙ্গালায় ইসলাম প্রচার মিশনে অংশগ্রহণ করেন। একটি অস্টকোনাকার একগম্বুজ ঘরে মাজারটি অবস্থিত। চুনসুরকি ও ইস্টক নির্মিত ঘরটির দেয়ালের প্রশস্ততা ছয়ফুটের কম হবে না। এই মাজারের সাথে একটি বড় মসজিদ এবং বড় মাজার প্রাঙ্গণ রয়েছে। এই মাজারে প্রচুর লালকাপড় জড়ানো পীর পীরানির আনাগুণা দেখি। প্রচুর দর্শনার্থী মাজারে হাটাফেরা করছেন। আলীশাহের মাজারকে কেন্দ্র করে মাজার প্রাঙ্গণের বাহিরে বিশ-বাইশটা দোকানে আগর, গোলাপজল, আতর, মোমবাতি, বাতাসা, শিরনি ইত্যাদির ব্যবসা জমে আছে। আমি কিবলামুখী হয়ে এই পবিত্র ওলির মাজার জেয়ারত করি। নীতিশ স্যার মাজারে আতর গোলাপ ছিটিয়ে আবার একটি সুদীর্ঘ্য সেজদা দেন। কুমিরশাহের মাজার মানবসৃষ্ট মনে হলেও শাহ আলীর(রহঃ) মাজারের ঐতিহাসিক সত্যতার ভিত খুব মজবুত। শিলালিপি পড়ে মনে হল এই মাজারটি পাঁচ ছয়শত বছর আগেকার একটি শক্ত স্থাপনা। মাজারটি যে একজন মৌলিক দরবেশের এব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।    

আমরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করি না। একথা বলতেই নীতিশ স্যার বললেন, মানবাত্মা ঈশ্বরাত্মার সম্প্রসারিত একটা রূপ, যে আল্লাহের মধ্যে বিলীন হয়, সে আল্লার কাছাকাছি চলে যায়, হয়ে যায় আল্লাহময়। যে শয়তানের মধ্যে বিলীন হয় তার মধ্যে ঈশ্বর থাকেন না। সে হয়ে যায় ঈশ্বরহীন শয়তান।  

নীতিশ কুমারের মতে আল্লাহকে যদি সেজদা করা যায় তাহলে তার ওলিকে সেজদা দিতে অসুবিধা কোথায়? আল্লাহের ওলিকে সেজদা করার মাধ্যমে প্রকারান্তে মহান আল্লাহকেই সেজদা দেওয়া হয়। এই সেজদা ঘুমন্ত ওলির মাধ্যমে আল্লাহের দরবারে পৌছে যাবে।  

আল্লাহকে বললাম, হে আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি লাশরিক নিরাকার তোমাতে বিশ্বাসী। আমি কেবল তোমার উপাসনা করি, তুমি ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করি না। লাকুম দিনুকুম, ওয়ালিয়া দিন। আমার জন্য আমার বিশ্বাস, নীতিশ কুমারের জন্য নীতিশ কুমারের বিশ্বাস।

বয়স তো কম হয় নি, ইতোমধ্যে চৌয়ান্নর ঘাটে নোঙর করেছি। আমি আজীবন একজন ধ্যানী পত্রিকা ও গ্রন্থ পাঠক। কিছুদিন ধরে ছোট অক্ষরের বইপত্র পড়তে আমার বেশ দেখার সমস্যা হতে থাকে। পত্রিকার শেয়ারদর আতশি কাঁচে দেখতাম। সবাই বললেন চোখ দেখান, চশমা লাগান। তা নাহলে চোখের প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাবে। সিলেটে গিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠান নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজে চোখ পরীক্ষা করি। একজন মহিলা চক্ষু বিশেষঞ্জ চোখ পরীক্ষা করে বললেন তেমন সমস্যা নেই। রিডিং গ্লাস পরলেই চলবে। আমার পিতার চোখে বিরানব্বই বছর বয়সেও চশমা ওঠে নি, এত বয়সেও তিনি দিব্যি পত্রিকা পড়তেন, কোরান তেলাওত করতেন। আমার চোখে চশমা ওঠে চৌয়ান্ন বছর বয়সে ১০ মে ২০১৯। এক হাজার টাকায় চশমাটি প্রস্তুত করে দেন স্টেডিয়াম মার্কেটের ‘সিলেট চশমা বিতানে’র মালিক আমার বন্ধু সুদেব বাবু। এতদিন ছোট অক্ষরে ছাপা বই পড়তে আমার বেশ অসুবিধে হত। এখন আমি কেবল বইপত্রিকা পড়তে চশমা পরি এবং বই পড়ার আগেকার আনন্দ আবার ফিরে পাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন