মাতৃরূপ ছোটখালা মরিয়মুন্নেসা চৌধুরীর
চিরবিদায়ঃ
জন্মঃ ১৯৪০ খিস্টাব্দ, মৃত্যুতারিখঃ
১৪ জানুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, ভোর ৫ ঘটিকা।
দাফনঃ ঐ দিন বাদ মাগরিব হজরত শাহজালালের(রঃ)
দরগাহে অনুষ্ঠিত হয়। হজরত শাহজালাল(রঃ) দরগাহ টিলার উত্তর-পশ্চিম কোনে তাঁকে
সমাহিত করা হয়।
বিপদে আপদে
অশান্ত সময়ে মায়ের কাছে বসলে যেমন এক অনুপম শান্তি
অনুভব করতাম, ঠিক তেমনি শান্তি পেতাম একজন মানুষের সাহ্নিধ্যে গেলে, তিনি আমার
মায়ের প্রতিরূপ ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা চৌধুরী। তার কোন সন্থান নেই, আমরাই ছিলাম যেন
তার জঠরে জন্ম নেওয়া সন্থান সন্ততি। শৈশবে মায়ের
চেহারার সাথে তাঁর চেহারার বেশ মিল থাকায় চিনতে ভূল করে জড়িয়ে ধরতাম। নানাবাড়িতে
মা ও খালারা একসাথে নামাজ পড়তেন। তাঁরা নামাজের সেজদায় গেলে বুঝা যেত না কে মা, কে
খালা। তাই প্রায়ই মা মনে করে ভুলবশতঃ ছোটখালার পিঠে চড়তাম।
মনে পড়ে আব্বার সাথে কৌশরে কোন কাজে সিলেট
এলে দুইটি বাসায় প্রায়ই যেতাম। বাসা দু’টি দরগাহ মহল্লার
মুফতিবাড়ির ফুফুর বাসা এবং কুমারপাড়া ঝরনারপারের খালার বাসা। ১৯৮১ সালে এম সি
কলেজে ভর্তি হলে খরাদিপাড়ায় ঠায় নেই। খরাদিপাড়ার ছড়ার উপর বাঁশের সরু সেতু ছিল,
সেই সেতু পার হয়ে দর্জিবন্দ দিয়ে পনের বিশ মিনিট হাঁটলেই খালা মরিয়মুন্নেছার বাসায়
পৌঁছে যেতাম। ১৯৮১ সাল হতে দিনে সিলেট, রাতে দাউদপুর, এই চক্রে জীবন বহে বহু বছর। ছোটখালার
বাসায় কিছুদিন না গেলে জবাবদিহি হতে হত, তাই মাঝে মাঝে আমাকে ঝরনারপারে যেতেই হত। বর্তমান
এই পড়ন্ত বয়সেও ঢাকা হতে সিলেট গেলে কাউকে না দেখে এলেও খালাকে না দেখে আসার উপায়
ছিল না। এমন কি কিছুদিন ফোন না করলেও তিনি খুব মাইন্ড করতেন। মাইন্ড করার ভয়ে
তাঁকে মাঝে মাঝে ফোন দিতেই হত। আমি বাহিরে গেলে আম্মা ফোনের অপেক্ষায় থাকতেন, আর
অপেক্ষায় থাকতেন আরেক জন, তিনি আমার এই ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা চৌধুরী।
আম্মার বিদায়ের পর আজ তিনিও চলে গেলেন। তাই আমার ফোনের জন্য অধির অপেক্ষায় বসে
থাকার মত এখন আর তেমন কেউ রইল না।
১৯০৬ সাল হতে ১৯১০ সাল, এই চার
বছর আমি পূবালী ব্যাংকের ইদগাহ শাখার ব্যবস্থাপক ছিলাম। টাকা তুলতে
জনতা ব্যাংকে বেশ অসুবিধে হত, চেক দিয়ে মনাইকে পাঠালেও ব্যাংকে নানা সমস্যা হত। খালু
বললেন, তোমার শাখায় একটি হিসেব খোলব। জনতা ব্যাংকে রাখা সব টাকা তোমার ওখানে নিয়ে
আসব। তাঁরা এই হিসাবের নমিনী আমাকে করলেন। অফিসের
কাজের ফাঁকে বের হয়ে আবহাওয়া অফিসের টিলার পাশের রাস্থা দিয়ে দশ মিনিট হাঁটলেই
কুমারপাড়া পূর্ব ঝরনারপারে খালার বাসা। খালু আখলাকুস সামাদ চৌধুরী চারবিঘা জমি কিনে তাঁর
চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দেন। তাই তাঁর অংশের প্রায় এক বিঘা
জায়গা জুড়ে এই বাসা।
খালুর শখ ছিল বাগান করা। এই বাসার
পিছনের খালি জায়গায় খালু প্রচুর রবিশস্য ফলাতেন। নিজে মাটি কর্ষণ করতেন, নল
দিয়ে শস্যে পানি দিতেন। খুব ভাল ফুলকপি, বাধাকপি, বেগুন, টমেটো, লাইশাক, লালশাক,
পুঁইশাক, চুকা শাক, ধনচে পাতা, টকশাক, শালগম, বাখর, মূলা ইত্যাদি জন্মাত। বাগানের চারপাশে প্লাম, আম, লেবু প্রচুর হত। বাসার সামনে
ছিল ফুল বাগান। বাগানে নানা জাতের ফুল ফুটত, রাতে হাসনাহেনার মধুর সুবাস বাতাসে ভেসে
বেড়াত। পিছনের চাপকল দিয়ে বিনে চাপে অনবরত অটো পানি বেরুত।
খালু ও খালা ১৯৯৫
খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে বাসার পিছনের শখের শস্যবাগান জুড়ে ‘বায়তুন
নুর জামে মসজিদ’ নির্মাণ
করেন, এবং সামনের ফুলবাগানে ইমাম, মোয়াজ্জিন ও তালবাদের থাকার জন্য একটি টিনের ঘর
নির্মাণ করে দেন। পুরো বাসাই মসজিদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। ওয়াকফের শর্তানুসারে
২০১৩ সালে খালুর মৃত্যুর পর খালা মরিয়মুন্নেছা মসজিদের মোতাওয়াল্লি হন। খালার
পক্ষে প্রথমে তাঁর দেবর স্বপন মামা ও পরে ভাগনা মহসিন ভাই মোতাওয়াল্লির কাজ
পরিচালনা করতেন।
মসজিদ নির্মাণের পর মুছল্লিরা খালুকে বললেন, মসজিদের
নাম আপনার নামে আমরা ‘বায়তুস সামাদ’ রেখে দিলাম। খালু জবাব দেন
‘না’। আমি মসজিদ নির্মাণ করেছি সওয়াবের জন্য, আল্লার সন্তুষ্টির জন্য, নামের জন্য
নয়। আমার নামে মসজিদের নাম রাখা হলে অন্তরে তাকব্বরি এসে যেতে পারে, যা আমাদের
দানের সব পূন্য নষ্ট করে দেবে। তাকব্বরি আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। আল্লাহতায়ালার ৯৯ নামের একটি নাম ‘নুর বা আলো’।
আমি খুশী হব, আপনারা মসজিদের নাম ‘বায়তুস সামাদ’ না রেখে যদি
‘বায়তুন নুর’ রাখেন। মুসল্লিরা খালুর ইচ্ছা পূরণ করলেন, মসজিদ
সাদা গেটে নীল রঙ্গের কালিতে লিখে দিলেন ‘বায়তুন নূর জামে মসজিদ’। কয়েক বছরের মধ্যে
মসজিদটি তিনতলা বড় ভবনে পরিণত হল।
নিঃসন্থান খালা ও খালু দুইজনই
ছিলেন খোদাভীরু ও ধর্মপরায়ণ। তাঁরা পাকিস্থান আমলে জাহাজে চড়ে হজে যান।
খালু প্রতি বৎসরই হজে যেতেন। খালাও তিনচার বার হজ্জ করেন।
আমি অনেক অনেক দিন
দুপুরের খাবার খালার বাসায় গিয়ে খেয়েছি। দুই একদিন
আমি তার বাসায় হাজির না হলে তিনি
অস্থির হয়ে অফিসে ফোন করতেন। বাসায় গেলেই
ফ্রিজ খোলে সামনে যত নাস্তা আছে এনে জুর করে খাওয়াতেন। ব্যস্ত
জীবনে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়া বেশ কঠিন কাজ।
আমি তাঁর বাসায় গিয়ে সবার সংবাদ পেয়ে যেতাম। কার রোগ হয়েছে, কার কি বিপদ হয়েছে, কে
মারা গেছেন, কার কোথায় বিয়ে ঠিক হয়েছে, সব খবর তিনি রাখতেন। আমেরিকায় বসবাসরত আমার
মাতৃগোষ্টির সব সুখ দুঃখের কাহিনি তাঁর চেয়ে ভাল কেউ জানত না। সেই আদ্যিকাল হতে
বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল। মোবাইল আসার পর আমার ছোটভাই নিশাত তাঁকে একটি মোবাইল কিনে
দেয়। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে মোবাইলের ব্যবহার শিখে নেন। একটি সাধামাঠা টেলিভিশন ছিল।
টেলিভিশনে গান শোনা, মেয়েদের নাচ দেখা তাদের মতে গুনাহ। তাই এই বাসায় কেবল খবর
শোনা ও নাটক দেখা ছাড়া টিভি বন্ধ থাকত। বাসার কাজের লোকজনই ছিলেন বাসার প্রধান
টিভি দর্শক।
আমি তাকে দিয়ে ইদগাহ শাখায়
অর্ধকোটি টাকার এফডিয়ার করাই। তিনি আমাকেই এই এফডিয়ারের নমিনি করেন। জন কয়েক
ছাত্র লন্ডনে পড়তে যাবে। তাঁরা আমার কাছে স্পন্সর কামনা করে। আমিকে খালাকে বললাম
আপনার এফডিয়ার বন্ধক রেখে ঋণ তুলে ছাত্রদের হিসাবে টাকা রাখলে তা
দেখিয়ে তাঁরা ভিসা পাবে ও লন্ডন যেতে পারবে। খালা বললেন, তাঁদের উপকার হলে তুমি
সাহায্য কর। আমাকে কিছু দিতে হবেনা, তাদেরকে বলবে কেবল আমার জন্য তাঁরা
যেন দোয়া করে। খালার এই সাহায্য পেয়ে দশ বারজন মধ্যভিত্ত ঘরের ছাত্র
যুক্তরাজ্যে যাবার সুযোগ পেল। তাঁরা যারপরনাই খুশী হয়ে তাঁর মঙ্গলের জন্য প্রাণভরে
প্রার্থনা করে।
খালা একা, তাঁর বাপের বাড়ির লোক
মনাই ও সেখানকার কোন না কোন নারী তাঁর সাথে এই বাসায় থাকতেন। শমি, সামিনা, মনাইর বউ, তাঁরা একজন না একজন সব
সময় খালার কাছে থাকত। মনাই বাজার হাট করত। একাকী থেকে তাঁর
বিষন্নতা হতে পারে, তাই আমি প্রায়ই খালার
বাসায় এসে গল্পগোজব করে একাকিত্বের একগুঁয়েমি জীবন হতে
তাকে খানিকের জন্য বিরাম দিতাম।
খালু আখলাকুস সামাদ চৌধুরীর বাড়ি
কানিশাইল, ঢাকাদক্ষিণ। প্রথম জীবনে তাঁরা কানিশাইল ছাড়েন, তারপর আর গ্রামে ফেরা হয়
নি। দেখাশুনা করতে না পেরে ভিটেবাড়ি রেখে গ্রামের জমজামা প্রায় সবই
বিক্রি করে দেন। গ্রামের একজন লোক বছরের পর বছর তাঁর বাড়ি ও জমি
দেখাশুনা করত। সে তাঁর সই জাল করে নিজ নামে বাড়িটির একটি ক্রয় দলিল করে এবং গত
জরিপের সময় সে ভূয়া দলিলে মাঠ ফর্চা নিতে গিয়ে সে ধরা খায়।
খালু ডিসি অফিসে
সরকারি চাকুরি করতেন। যারা
লেখাপড়ায় ভাল ও যোগ্য, খালু তাদেরকে খুব ভালবাসতেন। বেকার ও ফেল মারা ব্যর্থ
মানুষকে তিনি বিষ চোখে দেখতেন। আমরা প্রথমদলের হওয়ায় বাসায় গেলে খালুর খুব স্নেহ
পেতাম। তিনি ছিলেন স্থূলকায় লোক এবং শেষজীবনে
সর্বদা অসুস্থ্য থাকতেন। খালা সযতনে তাঁর দেখাশুনা করতেন। মনাই ও ড্রাইভার
মোহন তাঁকে সহায়তা করত। শেষজীবনে রোগে ও শারীরিক কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে
২০১৩ সালে খালু মারা যান। তাঁকে আমরা শাহজালালের(রঃ) দরগায় চিরশায়িত
করি। খালুর মৃত্যুর পর বড়খালা আবেদা খাতুন এসে প্রায়ই তাঁর সাথে থাকতেন। তাঁকে একা
রেখে যেতে দিতেন না বড়খালাকে। বাসায় একসাথে তিনজন ঘুমানোর মত একটি বড় পালঙ্ক ছিল।
দুই বোন এই পালঙ্কে সর্বদা গড়াগড়ি যেতেন। প্রতিদিন কেউ না কেউ আত্মীয় তাদেরকে
দেখতে আসতেন। তিনি অসুস্থ্য হলে আমি ও ডাঃ নুরজাহান বেগম প্রায়ই ছুটে যেতাম।
আমেরিকা হতে আমাদের কোন আত্মীয় এলে
খালা তাদেরকে খামচে ধরতেন, যেন তাঁরা অন্য কোথায়ও না গিয়ে তাঁর সাথেই থাকেন। তাই মামারা
ও তাদের পরিবারের কেউ বাংলাদেশে এলে এই বাসায় থেকে তাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ পরিচালনা
করতে বাধ্য হতেন। তাঁরা চলে গেলে খালা নীরবে চোখের জল ফেলতেন এবং
মনমরা হয়ে দিন কাটাতেন। আমেরিকার ফোনের জন্য তিনি সারাক্ষণ উম্মুখ হয়ে অপেক্ষা
করতেন।
ব্যস্ততা আমার জীবনকে ঘিরে
ধরেছে। তাই সবার ঘরে দৌড়ানোর সুযোগ ছাত্রজীবনের মত এখন আর নেই। খালার এক কাজ,
দিনরাত নামাজ পড়া, আল্লাহ আল্লাহ জিকির করা। তাই আত্মীয়রা কেউ
অসুস্থ্য হলে খালার কাছে দোয়া চেয়ে তাঁরা ফোন করতেন, ফলে তিনি
সবার বিপদাপদের খবর আগেবাগেই পেয়ে যেতেন। তিনি আমাকে চাপ দিয়ে বলতেন, অসুস্থকে
গিয়ে দেখে আস। রোগী দেখা পূণ্যের কাজ। রোগে শোকে খবর না নিলে, না দেখলে কিসের
আত্মীয়তার সম্পর্ক। তাঁর কাছে খবর পেয়ে আমরা অনেক আত্মীয় রোগীর ভাড়া বাসা খোঁজে
খোঁজে বের করে দেখে আসতাম।
সন্থান না থাকার কারণে তাঁর মায়া
এক জায়গায় জমে যায় নি। তাই আত্মীয়স্বজন সবার জন্য তাঁর ছিল এক তীব্র মায়ার টান, এই
স্নেহের টান বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর বেড়ে যায়। তাঁর বাপের বাড়ির পরিচিত লোকজনের
জন্যও তাঁর দরদ ছিল খুব বেশী। তাদেরকে সর্বদা সাহায্য করতেন, এমন কি সবার কাছ থেকে
চাঁদা তুলেও সহায়তা করতেন। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে মরণাপন্ন হাঁসমতি ঝি কে দেখতে পাতারিয়া
দক্ষিণভাগ ছুটে যান। তাঁর এক নাতি সুহেল। সে এম কম পাস কিন্তু মানসিক সমস্যা, যা
মুখে আসে তা বলতে থাকে। মস্তিস্কের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন কাজ বা চাকুরি
করার মত মানসিক অবস্থা তাঁর আদৌ নেই। ছোটখালা আমেরিকা হতে চাঁদা এনে তাঁকে মেসে
রেখে যাবতীয় খরচ চালাতেন। এখন সোহেল নিরাশ্রয় হয়ে গেল, তাঁর যাবার
আর জায়গা রল না।
পাঁচ বছর আগে একবার খালার হার্টএটাক
হয়। মরণাপন্ন অবস্থায় আমি তাঁকে নুরজাহান হাসপাতালে নিয়ে যাই। বেশ কিছুদিন
আইসিইউতে ছিলেন। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। আমি, নিশাত, তারেক ও বুলবুল ভাই
জেগে জেগে হাসপাতালের চেয়ারে বসে বেশ কয়েক রাত পার করি। আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে ভীড়
জমান। বেশ কয়েক দিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। শ্বাসনালী দিয়ে কোনমতে বাতাস আসা যাওয়া
করে। কেউ কেউ বললেন লাইফ সাপোর্টে রেখে তাঁকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কেন? তারচেয়ে লাইফ
সাপোর্ট খোলে দেওয়া হউক। আমার চিকিৎসক পত্নী নুরজাহান বেগম সম্মত হন নি। তিনি
বললেন অনেক রোগী দীর্ঘদিন লাইফ সাপোর্টে থেকেও আরোগ্য হয়ে যায়। দুই তিন সাপ্তাহ পর
তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে।
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এবার
তিনি বাসায় ফিরলেন, কিন্তু ধরে নিলেন আর বেশিদিন তিনি পৃথিবীতে টিকবেন না। বাসায়
এসেই টাকাকড়ি ও মালামাল সবকিছু আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিতরণ শুরু করেন। আমার
পত্নীকে বার্গার বানানোর মেশিন দান করেন। ইস্ত্রি, শাড়ি, বিছানার চাঁদর, পানদান,
দাও, শড়তা, ইজিচেয়ার কিছুই এই দানযঞ্জের হাত থেকে রেহাই পেলনা। আমি পেলাম অনেক পুরাতন দুইটি গ্রন্থ ‘নেয়ামুল কুরআন’ ও কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবি’। খালার বাসা
প্রায় মালামাল শুন্য হয়ে গেল। মৃত্যুর কবল হতে বেঁচে আসা খালাকে দেখতে আমেরিকা হতে
ছুটে আসেন তাঁর তিনজন ভাই ও ভাইয়ের বউরা। লন্ডন হতে আসেন ভাইজি নিপা ও ভাইপো
তাহমিদ চৌধুরী। তাঁরা ঘর আসবাব শূন্য দেখে আবার মালামাল কিনে নতুনভাবে সাজিয়ে দেন।
এবার বড়খালা আবেদা খানমকে তিনি নিত্য সাথী করে নেন।
ধানমন্ডির লেকপারের চার হাজার বর্গফুটের
এক অট্টালিকা ফ্ল্যাটে আমি একাকী নির্জনবাস করি। ভাইপো আরিকের কক্ষে একাকী ঘুমাই।
মনে মনে ভাবী এই পালঙ্কে অট্টালিকা বাসার মালিক আরিক ঘুমানোর কথা, অথচ
আল্লাহ পাকের কি মেহেরবানি দুইতিন বছর ধরে আমি ঘুমাচ্ছি। শীতের দীঘল রাত। শেষরাতে
আমার ঘুম ভাঙ্গে। লেকপারের পার্কে ছায়া সুনিবিড় বৃক্ষবনে দু’একটা নিশাচর পাখি
ডাকছে। সে রাতে বুকের মাঝে কেমন যেন একটা চিন চিন যন্ত্রণা আমাকে চেপে ধরে। মনে
অশান্তি অশান্তি লাগে। ঘর সংসার সব ফেলে দু’বছর ধরে ঢাকায় আছি। সহধর্মিনী ও
একমাত্র সন্থান বাংলাদেশে থেকেও আমার কাছে নেই। করোনা ও বয়সের কারণে যখন তখন
সিলেটে দৌড়ানোর সেই হিম্মতও শরীরে নেই। অনেক প্রিয়জনের ছবি
মনে উঁকি মারছে, যারা আর পৃথিবীতে নেই। ভাবি তাই বুঝি এই শীতের শেষরাতে মানসিক
অশান্তি আমাকে জোঁকের মত চুষিতেছে।
এমন অসময়ে আমার মোবাইল ফোনটা শিয়রে
বেজে ওঠে। শেষরাতে ফোন, নিশ্চয় কোন অশুভ কিছু শুনতে হবে আমাকে। শংকা নিয়ে মোবাইলে
টিপ দেই। অনুজ পত্নী ফাহমিদা লোমার কন্ঠে শুনি, কোন খবর পাইছেন? কিসের খবর বলতেই
জানালেন, এইমাত্র ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা মারা গেছেন। তখন ভোর ৫টা, খানিক পরেই পাশের
তাকওয়া মসজিদ হতে ভোরের সুমধুর আজান ভেসে আসে। টেলিপ্যাথি নামে একটা বিষয় আছে, সে
রাতে তা আমি ভালভাবেই টের পেলাম। খালার মৃত্যুক্ষণের তীব্র যন্ত্রণার আঘাত আমি যেন
সেই মূহূর্তে ঢাকার পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে একশতভাগ অনুভব করলাম। সেই পাষাণ দিনটি ছিল ১৪ জানুয়ারি ২০২১ সাল, বৃহস্পতিবার।
আমার আম্মা আসমতুন্নেছা বলতেন,
অনুজা মরিয়ম আমার চেয়ে দেড় বছরে ছোট। তাই অনুমিত হয় তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের
জাতিকা।
ছোটখালা মরিয়মুন্নেছার সাথে আমার শেষ
দেখা হয়েছিল মাত্র বারদিন আগে ২রা জানুয়ারি ২০২১, শনিবার। আমি সিলেটে গেলে তাঁকে
অন্ততঃ এক নজর না দেখে আসিনা। সিলেটে গিয়ে শুক্রবার
ব্যস্ততায় সময় পাইনি। শনিবারেও দিনে সময় হয়নি। নতুন বছরের পূবালী
ক্যালেন্ডার ও ডায়রি নিয়ে রাত ৮টায় আমি ও ভাগনা হিমু কার
চালিয়ে খালার বাসায় যাই। দুইজন প্রিয় খালা বসে আছেন। বড়খালা ও
ছোটখালা। তাঁদের দুইজনের মাইজম আমার মা আসমতুন্নেছা নেই। দুই বোনকে বাহ! কি সুন্দর
লাগছে।
পৃথিবীর সব সুখ ও শান্তি যেন দুই
বোনকে আপন করে জড়িয়ে আছে। পাশে নানাবাড়ির কর্মী সামিনা ঘুর ঘুর করছে। শুনতে হল আমি
লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকি, তাই ফোন করিনা।
পাশে খালার জ্যায়ের বাসায়
ইন্টারনেট এসেছে, এ বাসায় তাই ফ্রি ইন্টারনেট। হিমু খালার একটি ফেসবুক একাউন্ট
খোলে দেয়। খালার ফেসবুকে আম্মার একটি ফটো পাঠাই। বোনের ছবি দেখে তিনি খুশীতে
আটকানা। ‘এই দেখো মাইজম আফা’ বলে ছবিটি বড়খালার সামনে ধরেন। দুইবোন মিলে প্রয়াত
বোনের ছবি প্রাণভরে দেখেন।
তখন বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি তিনি অচিরেই বড়বোন আবেদা খানমকে
ফেলে প্রয়াত মাইজম আপা আসমতুন্নেছার কাছে চলে যাবেন। আমরা উঠতে চাইলেই বারবার
আরেকটু বসার অনুরোধ জানান। আমাকে ছাড়তে চাইছেন না, তাই জুর করেই উঠলাম। বললাম আমার
আর বসার উপায় নেই, ঢাকা যাবার গাড়ি রাত ১১টায় ছাড়বে। কাল সকাল ১০টায়
মতিঝিল গিয়ে অফিসে ঢুকতে হবে।
দৌড়ে এসে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। জীবিত
খালা মরিয়মুন্নেছাকে আমার এই দেখাই শেষ দেখা। এই বিদায়ই মাতৃসম ছোটখালার কাছ থেকে
আমার শেষবিদায়।
ছোটখালা, যিনি আমার বিকল্প মা,
তাঁর জানাজায় আমি থাকবনা, তা কি হয়। বাদ জোহর জানাজা হলেও শরিক হব, এই শপৎ নিয়েই
সিলেটের আহমদ এভিয়েশনের ফুজায়েল ভাইকে ফোন করে আমাকে আকাশ পথে সিলেট যাবার একটি
টিকেট দিতে বলি। তিনি সাথে সাথে নভএয়ারের একটি টিকেট
ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দেন। সকাল ৯টায় অফিসের গাড়িতে মতিঝিল অফিসে গিয়ে ছুটি নেই।
আমার বস জগত চন্দ্র স্যার বললেন, আপনি অফিসে এলেন কেন? আমাকে একটা ফোন দিয়ে
এয়ারপোর্ট চলে যেতে পারতেন। একটি উবার মোটরসাইকেল মতিঝিল হতে মাত্র
এক ঘন্টায় আমাকে ঢাকা ডমেস্টিক এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়। ঢাকা এয়ারপোর্টে নর্থইস্ট
মেডিকেল কলেজ এন্ড সার্ভিসেসের পরিচালক ডাঃ কাজি আক্তার ভাইয়ের পত্নী ও কন্যাকে
পেয়ে যাই। আল্লার অপার মেহেরবানি তাঁদের কার আমাকে জোহরের নামাজের আগেই খালার
বাসায় বাসায় পৌঁছে দেয়।
বড় পালঙ্কে সাদা কাফনের আবরণে
শান্ত হয়ে খালা শুয়ে আছেন। আমি আসার আগেই মাইয়িতাকে গোসল করিয়ে কাফন পরায়ে সবাই
ঘুমিয়ে রেখেছেন। তসকিয়া ভাবী খালার মুখের
উপর হতে সাদা কাপড় সরায়ে আমাকে দেখতে দেন। কলিমা শাহাদাত পাঠ করে চোখের পানি ফেলে
শেষমেশ দেখে নেই মাতৃসম খালার স্নেহমাখা সোনামুখ। ছোট্ট বাসায় আত্মীয়স্বজন গিজগিজ
করছেন। পাশে মসজিদে হুজুররা মিলাদ ও জিকির আজকার করছেন। বাসায় সবাই তাসবিহ জপছেন। নূর মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে এসে মহসিন ভাই বললেন মামিকে সবাই শেষবার
দেখে নেন। আমরা তাঁকে নিয়ে শাহজালালের(রঃ) দরগাহের উদ্দেশ্যে শিঘ্রই বেরিয়ে যাব। বাসার আত্মীয়রা চোখের পানি মুছে মুছে শেষ দেখা সমাপ্ত করে
তাঁকে বিদায় জানান।
খালার শবাদার বাসার সামনে ট্রাকে
তুলে আমরা অনেকে সেই ট্রাকে করে তাঁকে শাহজালালের(রঃ) দরগায় নিয়ে যাই। দরগাহ
মসজিদের পশ্চিমের জানাজা-ঘরে শবাদার রাখা হল। এই ঘরে একদা আমার মা, বাবা, বড়বোন,
শ্বাশুড় শ্বাশুড়ি সহ অনেক প্রিয়জনের লাশ রেখে জানাজার নামাজ পড়েছি। আজকে ছোটখালা
মরিয়মুন্নেছার জানাজা পড়ার পালা। জানিনা কখন যে আমারও এই জানাজা-ঘরে আসার ডাক পড়ে
যাবে। মাগরিবের জামাত শেষ হতেই ইমাম সাহেব ঘোষণা দেন কুমারপাড়া ঝরনারপারের মরহুম
আখলাকুস সামাদ চৌধুরীর বেগমের জানাজার নামাজ আছে, আপনারা লাইনে দাঁড়িয়ে যান। আমি,
জেফার ও বুলবুল ভাই জানাজা কক্ষে ইমামের পিছনে জামাতে দাঁড়াই।
গুরখোদক সুরুজ আলীকে আমি খুব ভাল
করে চিনি। এই চেনার কারণ তিনি আমার অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের কবর খনন করেছেন।
আমাকে দেখেই বললেন, আসুন, দেখুন কি সুন্দর কবর হয়েছে। গুরগহ্বরের চারপাশ বাঁশের
চাটাই দিয়ে তিনি সযতনে আবরণ তৈরি করে দিয়েছেন।
এই কবরের পাশেই খালার জীবনসাথী খালু আখলাকুস সামাদ চৌধুরীর সমাধি। জীবনের পরপারেও
তাঁরা পাশাপাশি ঘুমালেন। ঝর্না হতে পশ্চিমের কবরগাহ ঢুকার গেট। এই গেট হতে
পূর্বদিকে গুণে গুণে টিলাগাত্রের সাত নম্বর কবরে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনন্তকালের
নিদমহল সাজিয়ে দেন। পরদিন আমার অনুজ নিশাত খালার কবরে বেশকিছু ফুলগাছের চারা
লাগিয়ে দেয়। জানাজা শেষে আসাদ ভাইয়ের কারে নিশাত ও আমি আবার খালার বাসায় যাই। এই
বাসায় আমার সারাটা জীবনের অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তাই মনটা এই বাসা ছেড়ে আসতে চাইছে
না। বড়খালা, মান্না, বুলবুল ভাই, তসকিয়া ভাবী, মহসিন ভাই ও ভাবী, দিলি, কলি, হুমাউন
ভাই, কবির, তারেক ও ভাবী, ছফুল ভাই ও ভাবী, হানিফ, হাসিব,
মুন্না, জিন্নুন, শ্যামল, হিমু, জেফার, তাওছিফ, তানিহা, আবিহা,
হাসিব সবাই মনমরা হয়ে বসে আছেন।
আগামী শুক্রবার পর্যন্ত আটদিন
বড়খালা আবেদা খানম এই বাসায় থাকবেন। তারপর এই ওয়াকফ বাসাটি বায়তুন নূর
জামে মসজিদের দখলে চলে যাবে। এমনকি এই পুরানো টিনের বাসা হয়ত অচিরেই উদাও হয়ে
যাবে। এই বাসায় আর আসা হবেনা। নিঃসন্থান খালার সাথে বসে বসে তাঁর এই প্রিয় সন্থান
ইসফাক কুরেশী সেফাকের গল্পগোজব হবেনা কোনদিন আর, এমনটা ভাবতেই মনটা ছাঁৎ করে ওঠে।
চোখে জল আসে। তাঁর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের সবার খবরাখবর পেতাম, সেই মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেল।
এই ছোট্ট জীবনে কত প্রিয়জনকে হারাই। হারাতে হারাতে আজ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। অন্তরটা কাচগুঁড়োর মত ভেঙ্গে
খান খান হয়ে গেছে। ‘যে যাবার যায় চলে আসেনা ফিরিয়া,/ স্মৃতি তাঁর দেয় ব্যথা রহিয়া
রহিয়া।‘ জানিনা এজীবনে আর কত স্বজনকে যে হারাতে হবে। কত
প্রিয়জনের লাশ দেখতে হবে। ইন্নাল্লাহা মাওয়াস সয়াবিরিন। সেদিন হয়ত দূরে নয়, যেদিন
আমারও লাশ হবার পালা আসবে। সবাইকে হারাতে হারাতে হঠাৎ নিজেও টুস করে একদিন কবরের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাব।
হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে সবুর করার শক্তি দান করুন এবং ছোটখালা মরিয়মুন্নেছাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান
করুন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন