সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্বাগতম ২০২১ খ্রিস্টাব্দঃ

 

স্বাগতম ২০২১ খ্রিস্টাব্দঃ       

‘করোনার বিষে বিষে চলে গেল দুই হাজার বিশ, একুশ হউক আলোয় ভরা। নববর্ষ সবার জন্য মঙ্গলবার্তা বয়ে আনুক, আমিন’। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই শুভেচ্ছা বার্তা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে পোস্ট করি। একটু পরই ইমেইল খোলে একটি মঙ্গলবার্তা পেয়ে যাই। লটারি জিতে পাওয়া রবির ৫০০ শেয়ার আমার বিও হিসাবে জমা হয়েছে, যা বাজারে চারগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। ফেসবুকে অনেক বন্ধু আমিন বলেছেন। কার না কারও ‘আমিন’ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ কবুল করেছেন।    

শীতের আলোকিত দিন। বছরের এই শেষদিনে পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অফিস করে বিকেলে সিলেটের বাস ধরি। দিবস ছোট্ট, ঢাকা হতে বেরুতে না বেরুতে বাসে রাত নেমে আসে। ঘন কুয়াশার মাঝে চালক রাস্থার রেখা চোখে আন্ধাজ করে করে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের রাস্থায় অনেক গাড়ি ও ট্রাক একটি মাত্র লাইট জ্বালিয়ে চলে। এসব একচোখা যানবাহনকে দ্বি-চক্র কিংবা ত্রি-চক্রযান মনে করে বাস এগুলে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ সংঘর্ষ, রাস্থার প্রান্তরেখা দেখতে চালকের ভুল হলে ঠিকানা হবে নিশ্চিত গাছ উপড়ে সড়কের খাল।

আমার পরিবার ঢাকায় আনা সম্ভব নয়। তা জেনেও পুবালী ব্যাংকের মোঠা মাথাওয়ালারা সিলেটে তাদের প্রাণের পিয়ার দোস্ত বান্দাদেরকে বছরের পর বছর একই জায়গার চাকুরি করার সুযোগ দিচ্ছে, অথচ আমাকে বেহুদা মৌলভীবাজার ও ঢাকায় বদলি করে। নাটেরগুরু অন্য কেউ নন, আমার আত্মীয় আব্দুল হালিম চৌধুরী। পূবালী ব্যাংকের চাকুরি জীবনে বাহিরের কেউ আমার কোন ক্ষতি করেনি। ননসিলেটি অনাত্মীয় লোকজন আমাকে সব সময় ভালোবেসেছে। আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। আমি তেমন মূল্যবান কেউ না হলেও যতটুকু সামান্য মূল্য আছে তারচেয়ে বেশী মূল্য তাঁরা আমাকে দিয়েছে। তাদের সময় আমার একটি পদোন্নতিও বাদ পড়েনি। আমার পত্নীর কিছুটা দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতা রোগ হয়, ঔষধ না খেলে ঘুম হয় না। শরীর শুকিয়ে যায়। সিলেটে সবকিছু দেখাশুনা করা, সংসার চালানো তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে যায়। বদলির আবেদন করার পরও আমাকে চৌধুরীবাজার, মৌলভীবাজার ও ঢাকায় আটকে রাখা হয় একটানা সাত আট বছর। অথচ আমার পরিবারের লোকজনের মালিকানাধীন এই ব্যাংকে তাঁদের আনুকুল্য ও সহায়তা পেয়ে কোন বানিজ্যিক জ্ঞান ছাড়াই রাজসিংহাসন কৌশলে দখলে রেখে ব্যাংকটার সব সুযোগ সুবিধা রাক্ষস জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে খেয়ে বটগাছ হওয়া জনাকয়েক সিলেটি লোক আমাকে নিয়ে দাবা খেলে আব্দুল হালিম চৌধুরীর আশকারায়। ধিক, হালিম চৌধুরী এবং ধিক, তাঁর এই প্যাঁচাটার দল।

বিমানেও সিলেট যাবার উপায় নেই। অফিস হতে বেরিয়েই বাসের মত বিমান নেই। মতিঝিল হতে বিমানবন্দর যেতে লেগে যায় পাক্কা আড়াই তিন ঘণ্টা। ট্রেনে টিকেট দুর্নীতি ও রাতে খুনি গামছাপার্টি। তাই শেষমেশ বাসই একমাত্র ভরসা। রাত বারটা, একটা, দুইটায় প্রায়ই চন্ডিপুল পৌছি। কখনও কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে, কখনও ঝুম বৃষ্টিতে। ঝড় বৃষ্টি কুয়াশায় ভিজে ভিজে পাশের শেডে অপেক্ষা করি কখন ছেলে জেফারের লালকার দেখা যাবে।

সুদখানার হর্তাকর্তারা বঞ্চিত করলেও মহান আল্লাহ আমাকে কখনও বঞ্চিত করেন না। ১৯৯৫ সাল থেকেই আমি নিজস্ব কার চালাই। ভাগ্য ভাল পূবালীর মগডালে বসা কৃপণেরা আমাকে গাড়িঋণ না দিলেও আল্লাহর মেহেরবানিতে শেয়ারবাজারের লাভের টাকায় ২০০৮ সালে একটি কার কিনেছিলাম। আমার ছেলে জেফার তাঁর মাকে নিয়ে এই কার চালিয়ে আমাকে মধ্যরাতে চন্ডিপুলে নিতে আসে। এই তিনজন মিলে আমার একক সংসার। এই তিনজন মানুষ একত্র হলেই আমি একেবারে নির্ভার হয়ে যাই। সব দুঃখ যন্ত্রণা, না পাওয়ার ব্যদনা নিমিষেই ভূলে যাই। অন্তরে নেমে আসে শান্তি, ওহম শান্তি।

আমি এক ব্যাগেজ ভর্তি ক্যালেন্ডার, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, ডায়রি নিয়ে সিলেট যাই। প্রতি বছরের মত প্রিয়জনদের ঘরে ঘরে এসব উপহার শুক্র ও শনি, সাপ্তাহিক বন্ধের এই দুইদিনে পৌঁছে দেই। বেশ কিছুদিন ধরে না জানি কেন যে আমার একজন প্রিয় বন্ধুকে বারবার মনে পড়ে। অফিসে বসেও তাঁকে মনে পড়ে। নরসিংদীর মেঘনায় নৌবিহার করি, তাঁর গ্রাম করিমপুরের পাশ দিয়ে ফিরে আসি, তখনো তাঁকে মনে পড়ে। তিনি সিলেটের কুদরতউল্লাহ মসজিদ মার্কেটের শাহিন লাইব্রেরির মালিক শাহিন আহমদ। ১৯৯৮ সালে সিদ্দিক নির্ঝর আমাকে তাঁর শাহিন পুস্তকালয়ে নিয়ে যান। সেদিন থেকে পরিচয়। সিলেট শাখায় হিসাব খোলাই, একটি ২৪ মাস কিস্তির ক্রেতাঋ দেই। সুদূর নরসিংদীর লোককে ঋ দিতে আমার শাখাব্যবস্থাপক আব্দুল মান্নান স্যার রাজী হন নি, স্যার বেশ ইতস্ততা করলে বললাম আমি শাহিন ভাইকে ভালভাবে জানি, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ এত প্রখর যে প্রয়োজনে ডাল ভাত খেয়েও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করবেন। তিনচার মাস কিস্তি পরিশোধ করে শাহিন ভাই আমাকে বললেন, কোরেশী ভাই, আমাদের পাঠ্যবই বিক্রির সিজন জানুয়ারি হতে মার্চ। আমার ব্যবসা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। আপনার দেয়া ব্যাংকঋণ আমার বেশ কাজে লেগেছে, ব্যাংকের একটাকাও রাখব না, এখনই বাকি সব ঋ পরিশোধ করে দেব। তিনি ঋটি পরিশোধ করামাত্র মান্নান স্যারকে ঋণের শূন্য বিবরণী দেখিয়ে আমার কথার সত্যতার প্রমাণ দেখিয়ে দিলাম।

একদিন শাহিন ভাই তাঁর বিয়ের আমন্ত্র জানান। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর করিমপুর। এই ব্যস্ত ব্যাংকারের পক্ষে তাঁর বিয়েতে যাবার সময় ও সুযোগ হল না। তবে এই বিয়ে খেতে সিলেট হতে ছুটে যান আমার দুইবন্ধু সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন এবং হাইস্কুল শিক্ষক সিদ্দিক নির্ঝর। কিছুদিন পর বেশ সুন্দরি ফর্সা অল্প বয়স্কা জীবনসঙ্গিনী তাহসিমা বেগমকে নিয়ে শাহিন ভাই সিলেট ফেরেন। কোন এক বসন্তের ছুটির দিনে আমার সাদা কারে নবদম্পতিকে নিয়ে আমি ও নির্ঝর ছুটে গেলাম সিলেট বিমানবন্দর, মালিনিছড়া চাবাগান, ইকোপার্ক, পর্যটন ঘুরে দেখতে। আমি গাড়িতে তেল ভরতে গেলে শাহিন ভাই ছুটে এলেন পেট্রোলের দাম পরিশোধে। নির্ঝর দিলেন এক শক্ত ধমক, তাঁর কি টাকার অভাব পড়েছে যে আপনি দেবেন। এই ধমক খেয়ে বিনয়ী শাহিন ভাই থামলেন।

এখানে আসার আগে বি এ পাস শাহিন ভাই ঢাকায় বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি ভাল বাংলা জানেন। শুদ্ধ বানানরীতি ও বাক্যবিন্যাসে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ২০১২ সালে আমার লেখা “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” প্রকাশ হবে। তিনি আমার বিশাল পান্ডুলিপির ভুল সংশোধনে বিনে পারিশ্রমিকে দিনরাত খাঁটাখাঁটি করলেন। আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, এই লেখাভান্ডার একটি অমূল্য সম্পদ। এই সাহিত্যকর্ম আমরা মারা যাবার পরও হয়ত টেকে রবে অনন্তকাল।

শাহিন ভাই বিপদে আপদে রোগে শোকে চলে আসেন আমার চিকিৎসক বেগমের আস্তানায়। দুই পুত্র ও দুই কন্যার  টানাপোড়নের সংসার। পত্নী তাহসিমা বেগম সব সেকেন্ড ক্লাস বি এস সি। একটি স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও ঘর সামলাতে চাকুরি ছেড়ে দেন। অভাব অনটনের সংসারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়া স্বাভাবিক। আমার পত্নী একবার গিয়ে দুজনের কথাবার্তা শুনে মিটমাট করে দেন। প্রতি ইদে শাহিন ভাই আমাদেরকে খাওয়াতে উদগ্রীব হয়ে যান। শাহিন ভাই খবর রাখেন সিলেটের কোথায় রানি মাছ, কোথায় দেশী শিং মাছ কিংবা কোথায় লাছো মাছ পাওয়া যায়। সব বিরল প্রজাতির মাছ, নরসিংদীর কড়কড়ে সন্দেশ পরিবেশন করেন। একবার আমার ছোট ভাইয়ের পরিবারকেও আমন্ত্রণ জানান। আমাদেরকে খাওয়াতে তাঁর কি যে আনন্দ।       

সিলেট থেকে বিতাড়িত হবার পর সেইখানের বন্ধুরা থেকেও নেই। ইনফরমেশন টেকনোলজির মাধ্যমে কৃত্রিম যোগাযোগ আছে সত্য কিন্তু  প্রাণবন্ত সেই সম্পর্কটা আর নেই। পূবালী ব্যাংকের ক্যালেন্ডার পেলে শাহিন ভাই খুব খুশী হন। একটি ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি নিয়ে তাঁর দোকানে ছুটে গেলাম। দেখি শাহিন লাইব্রেরিতে তালা। অপেক্ষায় আছি তিনি এসে তালা খুলবেন। অনেকদিন পর অনেক গল্প হবে।

এমন সময় পাশের দোকানের ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, কার অপেক্ষা করছেন? জবাব দেই, শাহিন ভাইয়ের। ভদ্রলোক অবাক নয়নে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি জানেন না তিনি নেই। হার্টএটাক হয়ে ঢাকার কোন এক হাসপাতালে দুইতিন দিন আগে মারা গেছেন। আমি হতবাক, এই কি শুনছি। শাহিন ভাই আমার সমবয়স্ক লোক। পৃথিবীর প্রতি তাঁর এমন কি অভিমান যে মাত্র পঞ্চান্নতে পূত্র-কন্যা-স্ত্রী সব ফেলে চলে গেলেন।

ভাবলাম, তাঁর জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিবা দেবার আছে আমার। পাশের কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে নামাজ পড়ে চোখের জল ফেলে আল্লাহের দরবারে ফরিয়াদ জানাই, হে আল্লাহ শাহিন ভাইকে ক্ষমা কর, জান্নাত দাও এবং তাঁর অসহায় পরিবারের প্রতি করুণা বর্ষ কর।

বাসায় ফিরে গিন্নীকে বললাম আমি এমন একটি খবর জানাবো যা তোমাকে নিশ্চিত দুঃখ দেবে। তখনই বললেন সেই খবরটা আমি জানি, শাহিন ভাই নেই। তুমি দু’দিনের জন্য সিলেটে এসেই দুঃখ পাবে তাই জানাই নি। ঢাকা ফেরার সময় জানাতাম। সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন ভাইয়ের বাসায় গেলে তিনি বললেন আমি ম্যাসেঞ্জারে আপনাকে অবহিত করেছি। কিন্তু খবরটা পাব কেমনে? ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার আমি যে এই ক’দিন চেকই করি নি।

শাহিন ভাই কোন সম্পদ রেখে যাননি। অসহায় ভাবী সন্তান সন্ততি নিয়ে নরসিংদীর বাপের বাড়ি চলে যান। তাঁর জীবিত মা-বাবা সেখানে মেয়েকে কিছু জায়গা দেন। তাঁর পুলিশ সুপার ভাই সেখানে একটি ঘর নির্মাণ করে দেন। শাহিন ভাইয়ের মেয়ে শাহরিয়ার আক্তার নাবিলা এইচ এস সি পাশ করলে আমি তাঁর উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নেই। সে নরসিংদী কলেজে মনোবিজ্ঞান অনার্সে ভর্তি হলে তাঁর পড়ার খরচবাবদ প্রতিমাসে বিকাশে ২৫০০/= টাকা করে পাঠিয়ে দিতাম।      

কিছুদিন পর অফিস থেকে ধানমন্ডি বাসায় ফিরে ফেসবুক অন করি। ফেসবুকে আমার দরগামহল্লার ফুফুতো ভাই মুফতি নজমুদ্দিন মামুনের ছবি ও মৃত্যুসংবাদ পাই। সাথে সাথে ছোটভাই নিশাতের কাছে ফোন করে জানতে পারি তিনি আজ সকালে মারা গেছেন এবং এইমাত্র শাহজালালের দরগাহে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তিনি ছিলেন বি এ, এল এল বি এবং পেশায় সিলেট শহরের বিয়ের কাজি। এক সময় প্রচুর আয় রোজগার করতেন এবং বড় সংসারের ঘানি একাকী টানতেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানী, সৎ ও সরল মনের মানুষ। তাঁর একমাত্র পূত্র মুফতি শামিম আমার প্রায় সমবয়স্ক। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। কলেজ জীবনে আমি ও শামিম দরগামহল্লার এই বাসার নিচতলায় গল্প করে, গান শুনে বেশুমার রাত পার করেছি। বাসায় রাখা হজরত শাহজালালের পাদুকা ও তরবারি দেখতে সব সময় লোক ভিড় জমাত। নিচতলার সামনের কোঠা ছিল কাজি অফিস, এখানে সর্বদা বরেরা আসতেন, বিয়ে পড়ানো হত ও শুষ্ক খেজুর বিতরণ হত। এখানে  বিবাহ বিচ্ছেদের বেশ কিছু  করুণ ঘটনাও দেখেছি।

শেষজীবনে মামুন ভাই বয়সের ভারে শয্যাশায়ী হন। করোনা ভাইরাস আসার আগে একদিন আমার পুত্র জেফারকে নিয়ে তাঁকে দেখতে যাই। আমাকে চানাস্তা করানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। পুত্রবধুকে চা দেবার জন্য বারবার তাগদা দেন। জেফার বলল চাচাকে একদম দাদার মত লাগছে। বললাম, লাগবেনা কেন? তিনি যে তোমার দাদার আপন ভাগনা। আমাকে পেয়ে সেদিন তিনি খুব খুশী হন। তারপর আর কখনও দেখা হয়নি।

বহু বছর আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। একবার একজন ডিম বিক্রেতার কাছ থেকে তিনি পঞ্চাশটি ডিম ক্রয় করেন। বাসায় নিয়ে ভালভাবে গুণে একটি ডিম কম পান। লোকটাকে এসে একটি ডিম কম আছে জানালে সে বলল, সাহেব আমি ভালভাবে গুণে দিয়েছি, কম তো হতেই পারেনা। আপনি সঠিক বলছেন না। একথা শুনে তাঁর আত্মসম্মানে খুব আঘাত লাগে। তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলছিস, আমি সামান্য একটা ডিমের জন্য মিথ্যা বলব ভাবছিস। এই নে তর সব ডিম, সাথে নে এই পাঁচ শ টাকাও। শালার বেটা, তুই কারে কি বলছিস। বলেই রাগে আগুন হয়ে ডিমের ঝুড়ি ও পাঁচশ টাকার নোট ছুঁড়ে দেন। লোকটি পাঁচশত টাকা নিতে না চাইলে দেন এক শক্ত ধমক, নে এই নোট, এই পাঁচশত টাকা তকে নিতেই হবে। তাঁর আগুন গরম অবস্থা দেখে ডিম বিক্রেতা ভীষণ ভয় পায়। সে কোন দুসরা আওয়াজ না করে ডিমঝুড়ি ও পাঁচশত টাকার নোট ভূমি হতে কুড়িয়ে পকেটে পুরে প্রাণপনে দৌড়ে পালায়। হৈ চৈ শুনে এসে আমি বিষয়টা দেখি, চোখের সামনে পাঁচশত টাকা গচ্চা যেতেও দেখি, কিন্তু আমারও সাহস হয়নি এগিয়ে যাই, পাঁচশত টাকা বাঁচাই। এমনই শক্ত ছিল তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ।

আমাদের গ্রামের বুয়া হেনারের মা ভাল তৈলবাজি জানতো। সে দরগার বাসায় গিয়ে তাঁর পা ছুয়ে সালাম-কুর্নিশ দিয়ে আমার মিয়া, আমার ভাইজান, আমার ঠাকুর ইত্যাদি বিশেষণে তুষামুদি করে, প্রায়ই প্রচুর টাকা এনাম নিয়ে দাউদপুর ফিরে যেত

জানুয়ারি দুই হাজার একুশের আগমনে আমি অফিসের তিনজন প্রাণপ্রিয় দক্ষ কর্মীকে হারাই। তাঁরা বিক্রমপুরের খালেদ আহমদ, নরসিংদীর সাইদ আব্দুল্লাহ যীশু ও বগুড়ার ইফতি। খালেদ ছিল অতি মেধাবী, তাঁর কাছে যে কোন প্রশ্নের জবাব তাৎক্ষকণিক পাওয়া যেত। যীশু লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় বেশ আগ্রহী। সে নরসিংদীর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে বেশ সচেতন একজন শিকড়সন্ধানী লেখক। দুইজনের কাজ ছিল নিখুঁত ও নির্ভূল। দুইজনই সিনিয়র অফিসার হিসাবে ব্যাংকে যোগদান রেন। ৮ মার্চ নারী দিবসের বিকেলে আমরা এই তিন সহকর্মীকে একটি অনুষ্ঠান করে বিদায় জানাই। নারায়নগঞ্জের কন্যা নীলা সুলতানা বেশ শিল্পসম্মত ভঙ্গিতে সভা উপস্থাপনা করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মহাব্যবস্থাপক দিলীপ কুমার পাল। তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করেন আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন মাস্টার্স জান মোহাম্মদ রাসেল ও মার্জানা বেগম। মোহাম্মদ রাসেলের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্ধীপ ও মার্জানার নোয়াখালী। মার্জানার স্বামী বিদেশী জাহাজের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমি তাঁকে কৌতুক করে বলতাম সারেংবৌ। একজন নতুন অতিথি পাই, তিনি সাইমুম আক্তার। তিনি বিছায়ে বিছায়ে বিশুদ্ধ বাংলায় কথা ন, তাঁর বাড়ি মাগুড়া।

১লা এপ্রিল আমার পরম স্নেহভাজন বস উপমহাব্যবস্থাপক জগত চন্দ্র সাহা স্যার অবসরে যান। বিগত সোয়া দুই বছর জগত স্যারের সাথে পরম আনন্দে অফিসে কাজ করি। তিনি প্রতিদিন নিজহাতে আদা, জিরে, লবঙ্গ, তুলসি তেজপাতা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের উপাদান মিশিয়ে চা তৈরি করে আমাকে পান করাতেন। এই বিচিত্র চায়ের ঘ্রাণ এখন নাকে লাগে। তিনি একজন হাসিখুশি ভরা বন্ধুবৎসল মানুষ।

২০২১ সালে ঢাকায় এসে তিনজন মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যাংক নির্বাহির সাথে পরিচিত হই। তাঁরা প্রিন্সিপাল শাখার মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম, মতিঝিল শাখার উপমহাব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন ও গাজীপুরের অঞ্চলপ্রধান উপমহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম।

সৈয়দ সাইফুল ইসলামের বাড়ি মৌলভিবাজারের বড়কাপন এবং তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। রফিকুল ইসলামের বাড়ি ময়মনসিংহ এবং তাঁর তরুণী পত্নী ও দুই ফুটফুটে শিশু সন্থান ছিল। এই তিনজন নির্বাহিই করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে পরলোকগমন করেন।

২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ সাল। এই দিন সিলেটে তিরানব্বই বছর বয়সে মারা যান সিলেটে আমার প্রতিবেশী মইনুদ্দিন কুরেশী ওরফে আঞ্জির ভাই। তাঁর পিতা এবং মাতা দুই জনই আমার সবংশীয়। আমাকে তিনি আপন ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। ২০০৮ সালে তাঁর দুইকোটি টাকার এফডিয়ার বন্ধক রেখে ঋণ লিমিট করে আমাকে ছাত্রদের বিদেশে ছাত্রভিসা দিতে সহায়তা করেন, ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বিদেশে যেতে সমর্থ হয়। দুইজন হুজুর তাঁর দেখাশুনা করতেন। একমাত্র কন্যা সেহানা চৌধুরী সবসময় পাশে থাকতেন। শেষ বয়সে তাঁর স্মৃতি হ্রাস পায়। আমি সিলেট গেলেই তাঁকে দেখে আসতাম। কিন্তু আমাকে চিনতেন না। নাম বলার পর চিনতেন, কিন্তু একটু পর আবার ভূলে যেতেন। একদিন আমাকে বললেন এভাবে অযথা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বেঁচে কি করব? তারচেয়ে মরে যাওয়াটাই তো ভাল। জবাবে আমি বললাম, হায়াত আল্লাহপাকের একটি বড় নিয়ামত। মারা গেলে মুমিনের সওয়াব হাসিল করার রাস্থা বন্ধ হয়ে যায়। বরং শুয়ে শুয়ে প্রতি দমে দমে আল্লাহকে ডাকলে আমলনামায় সওয়াব যোগ হতে থাকবে। তিনি তাই করতেন। মহান আল্লাহের জিকির ও দান খয়রাত করে করেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন। তাকে হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগাহ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।    

৯ম অক্টোবর ২০২১ সাল, শনিবার। উপমহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতির আশায় আবার পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এমডি অফিসে ইন্টারভিউ দিতে হাজির হই। সিরিয়াল ২২ ডাক পড়লে নতুন নীল স্যুট পরে বোর্ডরূমে প্রবেশ করি। সামনে বসে আছেন এমডি শফিউল আলম খান চৌধুরী, এএমডি মোহাম্মদ আলী, ডিএমডি জাহিদ আহসান, ডিএমডি শাহাদাত হোসেন, মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর ও মহাব্যবস্থাপক ইসমত আরা। 

আমি বেশ কয়েকদিন আগেই ভালভাবে জেনে যাই এএমডি মোহাম্মদ আলী আমাকে চান না। আমি তাঁর হিসাবের ধারকাছেই নেই। অথচ তিনিই প্রমোশনের ব্যাপারে প্রধান সিন্ধান্ত গ্রহণকারী। এমডি শফিউল আলম খান চৌধুরী কিছুদিন পরই অবসরে চলে যাবেন। ব্যাংকের হাল ধরবেন এএমডি মোহাম্মদ আলী। তাঁর সিন্ধান্তই এখানে চুড়ান্ত। তাই আমি নিশ্চিত আমার ইন্টারভিউ অরণ্যে রোদন।

রাজতলব, তাই নিয়ম পালনেই রাজদরবারে আসা। এমডি এস এ খান চৌধুরী বললেন, কুরেশী সাহেব আপনি তো লেখালেখি করেন। আমি মাত্র দুইটি প্রশ্ন করব, একটি সাহিত্য ও একটি ব্যাংক নিয়ে। তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃতি করে বললেন, বলুন তো কবিতাটি কোন কবির লেখা। বড় বড় কবিদের কবিতা শুনলেই বুঝা যায় কোন কবির লেখা, বললাম কবিতাটি রবি ঠাকুরের। কিন্তু কবিতাটি তাঁর কোন কাব্যের? এই প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হলাম। চার পাঁচ মিনিট দায়সাড়া মার্কা প্যানপ্যানানি শুনে বেরিয়ে আসলাম। 

পরদিন সকাল ১১টায় রেজাল্ট আসে। ৮৯ জন এজিএমের ইন্টারভিউ নিয়ে ২৭ জনকে ডিজিএম করা হয়। লম্বা তালিকা কিন্তু আমি নেই। তবে আমার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলনা, হতাশাও হলনা। কারণ ভবিতব্য অচিরেই জেনে গেছি। বুঝে নেই আমাকে পুবালী ব্যাংকের এজিএম পদে আর চার বছর বসবাস করেই বিদায় নিতে হবে এবং এটাই আমার সুদীর্ঘ চাকুরি জীবনের ললাটলিখন। চাকুরি ছেড়েও লাভ নেই, কারণ প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রেচুয়িটি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ব্যাংকে বসে বসে সময় কাটানোই ভাল। দুই বৎসর পর পুত্র জেফারের এমবিবিএস সমাপ্ত হলে নাগরিত্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্র চলে যাব। বই লিখব। ব্যবসা, জনসেবা ও বিনিয়োগ করব। এমনি এক ভবিষ্যত পরিকল্পনা মনে মনে সাজিয়ে নেই।

তিন বছর ধরে ঢাকায় আছি। ছয় বছর ধরে সিলেট হতে দূরে ঘরছাড়া। গ্রামের বাড়ি দাউদপুর এখন দূরকাওয়াস্ত। সংসারবিহীন এক খাপছাড়া জীবনে আছি এতটা বছর। ঘনিষ্ঠজনেরা মারা গেলে ফেসবুকে খবর পাই, চোখের জল ফেলি, শেষদেখা হয়না।

আমার অনুপস্থিতে সিলেটে ঘরসংসার বেশ কষ্টে একাকী চালিয়ে যাচ্ছেন আমার কঠোর পরিশ্রমী ও ধর্য্যশীলা পত্নী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরী। আমি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে পূবালী ব্যাংকের হেডঅফিস মতিঝিলে সময় পার করছি। ব্যাংকের একটি মাইক্রোবাস আমাকে ধানমন্ডির বাসা হতে সকালে আনে, রাতে পৌঁছে দেয়। এই গাড়িতে পাঁচজন এজিএম আসা-যাওয়া করেন। আমার কাজ বিকেল ৬টায় সমাপ্ত হলেও অন্য পঞ্চজনের সবার কাজ একসাথে শেষ হয়না। তাই মাইক্রোবাস ছাড়ে রাত ৭ হতে ৮ ঘটিকায়। ঢাকার রাস্থার প্রচন্ড জ্যাম ঠেলে ধানমন্ডি বাসায় পৌঁছতে দেড়দুই ঘন্টা সময় লেগে যায়। প্রতিদিন সকালে সাড়ে ৮টায় গাড়ি আসে। প্রতিদিন বিকেলে দুইতিন ঘণ্টা এবং সকালে এক ঘন্টা মিলে পাক্কা ৫/৬ ঘন্টা মূল্যবান সময় ঢাকার রাস্থায় অযথা বিনষ্ট হয়।

প্রতি বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকে বড় ধরনের বদলির অর্ডার হয়। ভাবলাম সিলেটে বদলি হয়ে গেলে আমার এই সময়গুলো বাঁচবে, ভাল কাজে লাগবে এবং পরিবারকে একটুখানি সময় দিতে পারব। তিন বছর অন্তর ব্যাংকের কর্মীদেরে সাধারণত এমনিতেই স্থানান্তর করা হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সাপ্তাহে আমি মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের চেম্বারে গিয়ে আমাকে সিলেটে বদলি করার জন্য বলি। তিনি বললেন, এমডির কাছে যান। আমি এমডি শফিউল আলম খান চৌধুরীর কাছে গেলে তিনি বললেন ঢাকায় কত বছর হয়েছে। বললাম তিন বছর। আগে কোথায় ছিলেন? বললাম, মৌলভিবাজারে তিন বছর। তারপর বললাম, আমার পুত্র সিলেটে মেডিকেলে পড়ে, পত্নী সিলেটে মেডিকেল পেশায়। তাঁদের পক্ষে আমার সাথে দেশের এখানে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি প্রায় সাত বছর ধরে ঘরসংসার ছাড়াই আছি। এমডি আমাকে বললেন, কুরেশী সাহেব আমি বলে দেব। আপনি সিলেট চলে যাবেন। পরদিন বিকেলে এ এম ডি মোহাম্মদ আলীর দরবারে ধর্ণা দিলাম, তিনি অনেকক্ষণ নানা বয়ান করলেন। আমার সামনে মানব সম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের কাছে ফোন করে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে বদলি করে দিতে বললেন। একদিন খবর পাই সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসের ক্যান্সার আক্রান্ত এজিএম জামিলুর রহমান মারা গেছেন। চেয়ার খালি আছে তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম সিলেট চলে যাব।

২৮ ডিসেম্বর ২০২১ মানবসম্পদ বিভাগ হতে একটি সুদীর্ঘ বদলি অর্ডার আসে। ২৮৭ জন লোক নিজ নিজ পছন্দসই জায়গায় বদলি হন। কিন্তু বিগত ছয় সাত বছর ধরে ঘরছাড়া আমার নাম সেখানে নেই। কেউ কেউ বলল মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর পজিটিভ রিপোর্ট দেন নি, তাই ধরা খেয়েছেন। দেখে অবাক হলাম, এই পূবালী ব্যাংকের এমডি এবং এএমডি এদের কারো কথায় কোন ঠিক ঠিকানা নেই কিংবা মূল্য নেই। একটা তোষামুদি সংস্কৃতি এবং অন্যায্যতার অক্টোপাসে আব্দুল হালিম চৌধুরীর আমলে পূবালী ব্যাংক আটকা পড়ে। তাঁর অকালবিদায় সত্বেও এইসব নানান অন্যায়, অবিচার ও অসমতা হতে পূবালী ব্যাংক মুক্তি পায়নি।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন