জীবনে প্রথম দেখা দক্ষিণবাংলার
বরিশাল বিভাগঃ
সফরকালঃ ২৭ এবং ২৮ নভেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
অগ্রাহায়ণ এসে গেছে। প্রকৃতিতে
এখন আর গরমের তেজ নেই। রাতে নকশী কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমানোর দিন এসে গেছে। এমন দিনে
অজানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে কার না মন আনচান করে। দক্ষিণ বাংলার বরিশাল আমার
মাতৃভূমি বাংলাদেশের এক বিশাল রত্নপ্রসবা অঞ্চল, যেখানে অর্ধশতাব্দী জীবনকাল
পেরিয়ে আসা আমি একজন সাদামাটা লেখক এবং কবি ইসফাক কুরেশীর পদচিহ্ন এখনও পড়ে নি।
পৃথিবীর চারটি মহাদেশ ঘুরেছি অথচ নিজদেশের দক্ষিণ সাগরপারের অগণিত ভরাযৌবনা নদী ও
খালের চিরসবুজ বদ্বীপ বরিশাল দেখি নি, রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দের চারণভূমি দেখি
নি, বলাটাও বেশ লজ্জার বিষয়। সিলেট বাংলার উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং সমুদ্র সমতল হতে
বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চধাপে সিলেটের অবস্থান। বরিশালের অবস্থান একেবারে নিচধাপে
সাগর সমতলে। তাই এখানে নদীগুলো চিরযৌবনা, বারমাস নাব্য, পানিতে টাইটুম্বুর। সাগরের
জোয়ার ভাটায় কেবল নদীর বুকে জল উঠানামা করে। তাই সিলেট এক ধরনের পর্বত-সমতল
সুন্দর, বরিশাল সাগর-সমতল সুন্দর। এই দুই অঞ্চলই নিজ নিজ সৌন্দর্য্যে অতুলনীয় ও
উদ্ভাসিত।
২৬ নভেম্বর ২০২০। আজ বৃহস্পতিবার
অফিস শেষে ধানমন্ডি না গিয়ে আমি ও যীশু আমাদের সদরঘাট শাখায় ছুটে গেলাম। ১৯৯১ সালে
২১ দিন এই সদরঘাটে অবস্থান করে পুবালী ব্যাংকের ভিত্তি প্রশিক্ষণে অংশ নেই। পুরান
ঢাকায় ভীড় ও ঠেলাঠেলি আগের মতই লেগে আছে। পূবালী ভবনের সামনের পঞ্চমুখ ওভারব্রিজ
আছে, পাশে বাহাদুর শাহ পার্ক আছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট আছে। তবে রাস্থাঘাট
অনেক উন্নত হয়েছে, আগের কালো ধুয়া ছড়ানোর পুরানো গাড়ি ও ত্রিচক্রযান তেমন নেই।
বিপদজনক বৈদ্যুতিক তারজট আগের মত নেই। মান্ধাতা আমলের বাড়িঘর ভেঙ্গে অনেক সুউচ্চ
ভবন সর্বত্র গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি এখনও সদম্ভে টিকে আছে।
সদরঘাট শাখার ব্যবস্থাপক
মহিউদ্দিন ডিজিএম আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন। গার্ড আব্দুল হাকিম এম বি
এডভেঞ্চার-৯ জাহাজের কেবিন রিজার্ভ করে রেখেছে। বরইকান্দি শাখায় ব্যবস্থাপক থাকাকালে
আব্দুল হাকিম আমার সহকর্মী ছিল। হেঁটে হেঁটে আব্দুল হাকিম ও আমরা দু’জন সদরঘাট
টার্মিনালে ঢুকি। একটু পরই টার্মিনালে এসে হাজির হন আমাদের জিএসডিডির অবসরপ্রাপ্ত
সাবেক সহকর্মী প্রিন্সিপাল অফিসার ফারুক আহমদ।
১৯৯১ সালে দেখা সেই জাহাজ
টার্মিনাল এখন বদলে অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। সারাটা টার্মিনাল ঘাট জুড়ে সারি সারি
তিনচার তলা অনেকগুলো জাহাজ নোঙর করা। দক্ষিণবাংলার মানুষের
প্রিয় বাহনে উঠে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। প্রতিটি জাহাজ যেন এক একটা তিনচারতলা
অট্টালিকা, ভিতরে লাল নীল হলুদ আলোক সজ্জা ঝলমল করছে, যেন শহরের সুসজ্জিত বহুতল
বিয়ে বাড়ি। যাত্রী ধরতে জাহাজে জাহাজে সাজসজ্জার বিরামহীন প্রতিযোগিতা চলছে। ছাদে
গিয়ে অনুমান করি আমাদের এম বি এডভেঞ্চার-৯
দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে তিনশত ফুট ও প্রস্থে ষাট ফুটের কম হবে না। বন্যার জলের মত
যাত্রীরা ভিতরে ঢুকছেন। আমরা ২০৮ নম্বর কেবিনের চাবি পাই। আমি, যীশু ও ফারুক সাহেব
কেবিনে ব্যাগ রেখে আবার ছাদে যাই। সেদিন চরমুনাই পীরের বাৎসরিক জলসা ছিল। তাঁর
মুরিদানরা বেশ কয়েকটি জাহাজ রিজার্ভ করে নিয়ে যায়। এসব জাহাজে সাদা পাঞ্জাবি ও টুপিপরা হুজুরদের বন্যা বইছে। প্রায় সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে একটার পর
একটা ব্যাসেল সদরঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। এই জাহাজগুলো হতে আওয়াজ আসছে নারায়ে তাকবীর,
আল্লাহু আকবর। পীরানে পীর চরমুনাই, জিন্দাবাদ।
জাহাজের ছাদ থেকে ঢাকার দৃশ্য
চমৎকার। আবছা অন্ধকারের মাঝে ঢাকাকে একটি আধুনিক নগর মনে হচ্ছে। ওপারের
কেরানীগঞ্জের দৃশ্য নান্দনিক। এত রাতেও বুড়িগঙ্গা দারুণ ব্যস্ত, বুড়িগঙ্গার ঘুম
নেই। এত অগণিত নৌকা, লঞ্চ, ট্রলার, এত বিশাল বিশাল জাহাজ বারমাস ও চব্বিশ ঘণ্টা
যার বুকে রাজহাঁসের মত সাঁতার কেটে সারা বাংলাদেশকে উথাল পাতাল করে, সে নদী আবার
বুড়ি হয় কেমন করে? চিরযৌবনা এই নদীর নাম বুড়িগঙ্গা আদৌ মানায় না, কোন অবুঝের দল না
বুঝে সুন্দর এই নদীটার নাম বুড়িগঙ্গা রেখে দিয়েছে, বলতেই যীশু বলল এককালে
বুড়িগঙ্গার নাম ছিল জোনাকি। জোনাকি রাতের আঁধারে ঝোপ ঝাড়ে জ্বলে আর নিভে। অন্ধকারে
বিন্দু বিন্দু আলো ছড়ায়। ভাবলাম, জোনাকি নামটি বুড়িগঙ্গা নামের চেয়ে বহুত সুন্দর
ছিল।
জাহাজের ছাদে একজন তরুণ আমাদের
কাছে নৌপথে বরিশাল যাবার মুজেজা প্রকাশ করে বললেন, বাসের ভাড়া ছয় শত টাকা, বাস
ভ্রমণ বিপদজনক ও কষ্টকর। অথচ দক্ষিণবাংলার লোকজন সাত
ঘন্টার একটি আরামদায়ক ঘুম দিয়ে মাত্র দেড়-দুই শত টাকায় ঢাকা হতে বরিশাল পৌঁছে যান।
রাত ১০ ঘটিকায় আমাদের জাহাজ
সদরঘাট ছাড়ে। আমরা অনেকক্ষণ দুপারের দৃশ্য ও শিল্প কারখানা দেখে ছাদ থেকে ২০৮
নম্বর কেবিনের খোঁজে সিড়ি বেয়ে নিচে নামি। কিন্তু ভূলপথে নামায় একদম নিচের ঢেকে
চলে যাই। নিচে কোন কেবিন নেই, সারাটা খোলা ময়দান। প্রায় ১৬,০০০ বর্গফুটের এই খোলা
ময়দানে হজ্জের মুজদালিবা মাঠের মত লাইন- বেলাইনে গাদাগাদি করে নর-নারী-শিশু,
বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণী, বুড়া-বুড়ী চাদরে গা ঢেকে পরমানন্দে পাশাপাশি শুয়ে আছেন।
তাবলিগ জামাতের মত তাদের ব্যাগগুলো বালিশে পরিণত হয়েছে। অন্ততঃ তিনচার শত আবাল বৃদ্ধ
বনিতা এই নিদমহলে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে ঢলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতি তলায়
কোন খালি জায়গা নেই, এমন কি ছাদেও চাদরে গা-ঢেকে মানুষ শুয়ে আছেন। ঘুমের এক অপূর্ব
ছন্দ আছে, সুর আছে, তা আমি মুজদালিবার মাঠের পর এখানে দেখতে পেলাম। হ্যাঁ
মুজদালিবার মত এখানেও পূর্ণ নিরাপত্তা রয়েছে। অনেক সুন্দরী তরুণী এবং কিশোরীরাও পূর্ণ
নিরাপত্তায় আরামছে খোলা আঙ্গিনায় ঘুমিয়ে জাহাজে রাত পার করছেন, যা সত্যই বাংলাদেশের
ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মত একটি বিষয় বটে।
একসময় নদীর ঠান্ডা বাতাসে গায়ে কাঁপন
ধরে, শীত এসে চাদরে আবৃত জনতাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। জাহাজের প্রতি তলার ডেকে, পাটাতনে, ছাদে, নিচের
ময়দানে শত শত জনতাকে এই মহাসুখে নিদ্রা যেতে দেখে আনন্দে
আমার দু’চোখে জল এসে যায়।
জাহাজের নিচতলা একেবারে খোলা
ময়দান, দুই ও তিন তলায় কেবিন, ছাদে চালক ও সারংদের কাচঘেরা ককপিট। এক, দুই ও
তিনজনের জন্য নির্মিত কেবিনে একটি ড্রয়ার টেবিল, মোবাইল চার্জার এবং টেলিভিশন।
বিলাসবহুল দামি কিছু এসি কেবিন আছে। নদীর আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় আসলে এসি ব্যবহারের
তেমন প্রয়োজন নেই। জায়গা মত বাথরুম ও বেসিন রয়েছে। নামাজের জন্য মসজিদ ও একটি খাবার
কেন্টিন আছে। চারতলা উঠানামা করার জন্য লিফট সুবিধাও রয়েছে, তবে এই লিফট
কেবল রোগী ও বুড়ো যাত্রীরা ব্যবহার করেন। প্রতিতলায় বাহিরে নদীঘেষে বসার জন্য
চেয়ারের পর চেয়ার সাজানো।
রাত বারটায় ঘুমাতে যাই। মৃদু
কম্পন ও দোলনে জাহাজ ছুটছে। বালিশে মাথা রাখতেই নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। শেষরাতে
জাহাজ চরমুনাই পীরের ঘাটে থামে, কিছু হট্টগোল কানে আসে, অনেক
মানুষ এখানে নেমে চরমুনাই পীরের জলসায় চলে যান।
একসময় ভোরের আজান শুনে কেবিন হতে
বের হই। নিজেকে বরিশাল জাহাজ নদীঘাটে আবিস্কার করি। ঘুম থেকে জেগে দেখি সাধারণ
যাত্রীরা চলে গেছেন। রাতের জাহাজ ভর্তি হাজার যাত্রীর কোলাহল নেই, কেবল কেবিনে
কেবিনে ঘুমিয়ে থাকা অনেকের ঘুম এখনও ভাঙ্গে নি। আমরা বাহিরে এসে কীর্তনখোলার দৃশ্য উপভোগ করি। সারি সারি জাহাজ, নৌকা, ট্রলার নদীতে ছুটাছুটি
করছে। কীর্তনখোলা নদীর গড় বিস্তার ৪৯৭ মিটার, সুরমার মত
চার-পাঁচটি নদী হবে সন্দেহ নাই। কীর্তনখোলা এত নাব্য যে চারতলা জাহাজের সারি
ঘুরঘুর করছে কোথায়ও তলা না ঠেকেই।
অপরূপ সুন্দর ব্যস্ত নদীর পানে
চেয়ে চেয়ে তখন মন নিজের অজান্তে গেয়ে উঠে- ‘কীর্তনখোলা নদী আমার, কীর্তনখোলা নদীরে আমার/ এই নদীতে সাঁতার কাইটা বড় হইছি আমি/ এই নদীতে
আমার মায়ে কলসিতে নিছে পানি/ আমার দিদিমা আইসা প্রতিদিন ভোরে/ থালবাডি ধুইয়া গেছে
এই নদীটির পারে/ দশ বছর পর আইসা দেখি সগলি বদলাইয়া গেছে, নদী আমার যেমন ছিল তেমনই
আছে’।
আমি এখন একজন মহানুভব আরিফ
রাব্বানীর গল্প বলব। তিনি ময়মনসিংহের সন্থান, লেখাপড়া করেছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরিসংখ্যানে অনার্সসহ মাস্টার্স করে সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগ দেন পূবালী ব্যাংকে।
তিনি পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, বরিশাল শাখাপ্রধান ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক। কুয়াশাচ্ছান্ন
ভোর ৬টায় তাঁর ফোন আসে, আপনারা নেমে আসুন, আমি গাড়ি নিয়ে এসে ঘাট স্টেশনে অপেক্ষা
করছি। জাহাজ হতে নামতেই দেখি খানিক শশ্রুধারী সুদর্শন আরিফ রাব্বানী সামনে
হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তখনো আকাশে সূর্যোদয় হয় নি। আমি আগে তাকে কখনও দেখি নি,
চিনি নি। একজন অচেনা মানুষকে আমরা জ্বালাতন করতে ঢাকা হতে এসেছি। তাই মনে একটা
ইতস্ততা ছিল। আরিফ রাব্বানীর চেহারায় পুত পবিত্র জ্যোতি বেরুতে দেখি, বিনয়ে বৈষ্ণব
আরিফ রাব্বানীর সাথে কথা বলে মনে হল এই অচেনা মানুষটি যেন আমার হাজার বছরের চেনা
একজন। কথা বলে জানলাম তিনি আমার দুই আপন ফুফুতো ভাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রথম ভিসি ডঃ সদরুদ্দিন চৌধুরী এবং সাস্টের পরিসংখ্যান বিভাগপ্রধান অধ্যাপক ইমাদ উদ্দিন
চৌধুরীর ছাত্র। তিনি সাস্টের ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী।
আরিফ রাব্বানী আমাদেরকে
বীরশ্রেষ্ট ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন রোডের ১৩৫, এরেনা হোটেলে নিয়ে যান। একটি আদর্শ
হোটেল। চারতলার কক্ষ নম্বর ৪০৮ তিনজনের একটি সুসজ্জিত স্যুট। আমাদের হাতে মাত্র
দুইদিন শুক্র ও শনি, এই দুইদিনে বরিশাল বিভাগের যতটুকু সম্ভব দেখা যায়, তাঁর একটি
পরিকল্পনা করেন আরিফ রাব্বানী। তাই সময় নষ্ট করা যাবে না। চালক বাসার উদ্দিন
আমাদেরকে বরিশাল শাখার পাশে একটি ভাল রেস্তুরায় নিয়ে যান। বিলটা আমাদেরকে পরিশোধ করার
সুযোগ দেন নি আরিফ রাব্বানী। এখানে আমাদের সাথে কুয়াকাটা যেতে সহযোগী হন বরিশাল
শাখার সিনিয়র অফিসার শহিদুল ইসলাম। কুয়াকাটা বরিশাল হতে ১০৮ কিলোমিটার দূরে। তাই
হেমন্তের ছোট দিনটা কুয়াকাটায় শেষ হয়ে যাবে। পথে পথে গাড়ি থামিয়ে স্মরণযোগ্য যা
দেখার তা দেখে নেব।
বরিশাল হতে গাড়ি দক্ষিণের
সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটার পানে ছুটে যায়। পাঠশালায় পড়েছিলাম ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল।
রাস্থার দু’পাশে হলুদ পাকাধান ক্ষেত, ছোট ছোট জলভরা খাল, খানিক পর পর সবুজের
বুকচিরে সুরমা-কুশিয়ারার মত বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা একটার পর একটা নামনাজানা প্রশান্ত
নদনদী বলে দেয় এই নদীবিধৌত বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ, গ্রিন-ডেল্টা।
আগে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যাত্রা
ছিল এক দুর্গম অভিযান। নৌপথই ছিল ভরসা। এই সড়কপথে ছিল অনেকগুলো খেয়া পারাপার, এখন
পায়রা নদীতে মাত্র একটি ফেরি অবশিষ্ট আছে। পাশেই সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার এলে
হয়ত দেখব এই পায়রা ফেরি চিরতরে নাই হয়ে গেছে। পায়রা আসলে নদী নয়, এটা সমুদ্র হতে
ভূভাগে ঢুকে পড়া একটি বিশাল সামুদ্রিক খাড়ি, বা প্র-উপসাগর। এই পায়রা সাগরখাড়ির পারেই
বাংলাদেশের তৃতীয় সমুদ্র-বন্দর পায়রাবন্দরের কাজ বেশ জুরেসুরে চলতে দেখি। আজকাল
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় গাড়ি নিয়ে কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত দেখে রাত ১০টার
মধ্যে বরিশালে ফিরে আসা যায়।
বরিশাল হতে বেরিয়েই
কয়েক মাইল দূরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গাড়ি পৌছে। নবপ্রতিষ্ঠিত
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতেগুণা দুই তিনটি ভবন। এই বিশ্ববিদ্যালয় এখনও যেন সদ্য প্রসূত নবজাতক। তারপর আমরা অনেক পথ পেরিয়ে দুমকীতে পটুয়াখালী বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি। সর্পিল
পুকুর সজ্জিত এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সেতু দিয়ে
পুকুর মাঝের বৈঠকখানায় বসি। এখান থেকে
বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্য অপরূপ। আমাদের সহযাত্রি শহিদুল ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র। এই বিশ্ববিদ্যালয় আগে কৃষি কলেজ ছিল, যা এখন দক্ষিণবাংলার বিশাল
বিদ্যাপীঠ।
কুয়াকাটা পৌছার আগে আর সি সি
খুটির উপর নির্মিত অনেকগুলো সাইক্লোন সেন্টার চোখে পড়ে। এই সেন্টারগুলো মূলতঃ
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তবে আপদকালে হয়ে যায় সাইক্লোন সেন্টার।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দর্শনঃ
আমরা যখন বাংলার দক্ষিণ সীমানার
সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পা রাখি তখন সাগরপারের মসজিদ সমুহে জুমুয়ার আজান ধ্বনিত হয়।
সাগরপারের ছোট্ট জনপদ কুয়াকাটা, হাতেগুণা
কিছু বাজার ও কিছু পর্যটন হোটেল মোটেল রয়েছে। সৈকতটি
দৈর্ঘ্যে ১৮ কিলোমিটার। কুয়াকাটা সৈকত বঙ্গপোসাগরের উত্তরপারে হওয়ায়
এখানে দাঁড়িয়ে ভোরে সুর্যোদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখা যায়। দুপুরের গরম হাওয়ায়
সৈকতে যাই। কক্সবাজারের মত ভীড় না হলেও প্রচুর পর্যটক সৈকতে এসেছেন, জলকেলী
করছেন, স্পিডবোটে সাগরের ঢেউয়ের সাথে খেলা করছেন।
আরিফ রাব্বানী বললেন, আসুন
জুমুয়ার নামাজ পড়ি। কুয়াকাটা এলাকাটি যে সচ্ছল নয়, মসজিদে ঢুকেই বুঝা যায়। আমাদের
সিলেট অঞ্চলের মসজিদের মত চাকচিক্য নেই। অজুখানা ও বাথরুম গিঞ্জি। ফেন ও গালিচা
সংকট প্রখর। হুজুর মসজিদের জন্য সাহায্য চেয়েই ওয়াজের সিংহভাগ সময় পার করে দেন।
নামাজের পর একটি হোটেলে খেতে বসি। গাঢ় মসল্লায় ভাজা টেংরা মাছ আসে। একটি টেংরায়
পুরো প্লেট ভরে যায়। টেংরা মাছ এত বড় যে খেতে বেশ বেগ পেতে হয়। সিলেটে এত বড় টেংরা
মাছ আমি কখনো দেখি নি বলতেই আরিফ রাব্বানী বললেন, দেখবেন কেমনে? এটি সাগরের টেংরা,
তাই এত বড়।
সারাটা বিকেল কাটে সাগর সৈকতে।
হেঁটে হেঁটে মাইল খানেক পূর্ব দিকে যাই। সাগরপারের মাদার, বেলজিয়াম, একাশি, ও ঝাউ
বনে ছবি তুলি। সাগরের রাহুগ্রাসে কিছু বৃক্ষ উপড়ে পড়ে আছে। সৈকতের একটি এলাকার নাম
লালকাকড়া। সেখানে প্রচুর অপূর্ব সুন্দর লাল কাকড়া ডিম পাড়ে ও সৈকত রঙ্গীন করে ঘুরে
বেড়ায়। পর্যটকরা মোটর সাইকেল ভাড়া করে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়ান। নারকেল সারির ধারে
ডাবের পানি কিনে খাই। সূর্যাস্তের সময় ফারুক আহমদ প্রচুর ছবি তুলেন ও ভিডিও করে
ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেসময় আকাশে মেঘের একটি কালোছায়া এসে সূর্যটাকে আড়াল করে দেয়,
তাই সূর্যাস্ত দেখার আনন্দটা যেন ফিকে হয়ে যায়। সৈকতে দাঁড়িয়ে মাগরিবের
আজান শুনি। কুয়াকাটা ভ্রমণে গিয়ে আমরা দক্ষিণবাংলার বরিশাল, ঝালকাটি,
বরগুনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলায় পা রাখি। কুয়াকাটা সৈকতপারের মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ে
আমরা বরিশাল ফেরার জন্য গাড়ি স্টার্ট দেই। বিদায় কুয়াকাটা, এ জীবনে আবার কি দেখা হবে কোনদিন।
রাতে বরিশাল শাখায় ফিরে ডাব খাই।
এখানে রাতের নাস্তা হল। তারপর হোটেল এরেনায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
২৮ নভেম্বর ২০২০ সাল, শনিবার।
খুব ভোরে প্রিয় আরিফ রাব্বানী এজিএম গাড়ি নিয়ে এরিনায় হাজির হন। বরিশাল শাখার
পাশের একটি ভাল হোটেলে ব্রেকফাস্ট সারি। বের হয়েই আমরা একটি খ্রিস্টান পাড়া ও
গীর্জায় প্রবেশ করি। গেটের ভিতর ঢুকে অনুমতি নিয়ে এগিয়ে যাই। এই খ্রিস্টপল্লীর নাম
সেইন্ট পিটার বা পিতর সাধুর ক্যাথাড্রিল। ভিতরে বড় গীর্জা, অফিস, বাগান ও কিছু
ঘরবাড়ি রয়েছে। স্থানে স্থানে মা মেরী এবং যীশুর মূর্তি স্থাপিত। দেয়ালে দেয়ালে
বাইবেলের বানী অংকিত। যীশু, মেরি ও খ্রিস্ট সাধুদের অনেক তৈলচিত্র এই ক্যাথাড্রিলে
সাজানো আছে।
বরিশাল বি এম কলেজ দর্শনঃ
এবার আমরা বরিশালের ঐতিহ্যবাহী
ব্রজমোহন (বি এম) বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে যাই। করোনায় কলেজ বন্ধ। হাতেগুণা দুইচার জন লোক ঘুরাফেরা করছেন। চারপাশে এক সুনশান নীরবতা। আমাদের সাথে
গাইড হিসাবে যান বি এম কলেজের সাবেক ছাত্র পুবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সাহাব
উদ্দিন। ১৮৮৯ সালে অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্তের নামে
কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। গেট দিয়ে ঢুকেই ডানে মসজিদ ও বামে
অফিস ভবন। বি এম কলেজ অনেকগুলো দিঘি ও পুকুরের কলেজ। মসজিদের পিছনের দিঘিটি আমাদের
এম সি কলেজের দিঘির দ্বিগুণ বড় হবে।
কলেজ ক্যাম্পাসে এম সি কলেজের দিঘির মত আরেকটি দিঘির দেখা
পাই। তাছাড়া আর দশবারটি পুকুর রয়েছে। দিঘিপারে শিক্ষকদের আবাস। দিঘিপারে বড় খেলার মাঠ,
মাঠপারে কবি জীবনানন্দ দাস ছাত্রাবাস। গেটে কবির পেইন্ট
চিত্র। প্রায় ৬৪ একর জায়গা জুড়ে কয়েকটি বড় মাঠ,
দিঘি, জলাশয়ের ফাঁকে ফাঁকে সজ্জিত ভবনমালা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বি এম কলেজ অপার
সৌন্দর্য্যে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। বি এম কলেজের শহিদ স্মৃতিস্থম্বে গিয়ে এই
কলেজের ৪২ জন শহিদ ছাত্র ও শিক্ষকের সুদীর্ঘ নামের তালিকা
পড়ে স্থম্বিত হই। শহিদ বীরশ্রেষ্ট ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গিরের
নাম তালিকায় দেখে এই কলেজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর বেড়ে যায়। একাত্তুরে বাংলাদেশের
জন্য বরিশাল বি এম কলেজ অকাতরে রক্ত দিয়েছে। বি এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বর্তমানে
ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে
ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভূলিতে পারি’ গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ ও কবি
আহসান হাবিব এই কলেজের ছাত্র ছিলেন।
ছারছীনা শরিফ দর্শনঃ
বি এম কলেজ হতে আমরা ছারছীনা দরবার শরিফের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। পিরুজপুর জেলার নেছারাবাদ
উপজেলায় ছারছীনা শরিফের অবস্থান। একটি বড় নদীর পারে যেতেই
আরিফ রাব্বানী বললেন আমরা ছারছীনা এসে গেছি। বরিশালের প্রায়
নদীই বিশাল এবং নাব্য। ছারছীনার পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীও তাই। সিসি ব্লকে পার
বাঁধানো নদীটির নাম সন্ধ্যানদী। এই নদীর বিস্তার কির্তনখোলার চেয়েও বেশি, গড়
বিস্তার ৫১০ মিটার। নৌকা, লঞ্চ, কার্গো হাঁসের মত সাতঁরে চলছে দূরে দূরান্তরে।
নদীটি সিলেটের যে কোন নদীর তুলনায় ব্যস্ত এবং দৃশ্য অপরূপ।
ছারছীনা শরিফে আমাদের
গাড়ি যেতেই গেট খোলে গেল। পরদিন সন্ধ্যানদী পারে ছারছীনা মাদ্রাসা মাঠে তিনদিনের বাৎসরিক জলসা শুরু হবে। তাই ভিতরে
স্বেচ্ছাসেবীরা জলসার কাজে ক্লান্ত। উৎসব উৎসব আমেজ। আমাদেরকে বরণ করতে এগিয়ে আসেন
ছারছীনা শরিফের বর্তমান গদ্দীনশীন
পীর শাহ মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ ছাহেবের প্রতিনিধি
মুহাম্মদ সাইদুর রহমান। তাঁর বাড়ি গলাচিপা, পটুয়াখালী। নতুন ভবনে আমাদের পূবালী
ব্যাংক ছারছীনা শাখা স্থানান্তর হবে। আমরা তা দেখতে যাই। ছারছীনা
পীরের পক্ষে মৌলানা সাইদুর রহমান আমাদেরকে চা-নাস্তা করান এবং দুপুরে সরাইখানায়
খাবার আমন্ত্রণ জানান।
পুবালী ব্যাংক ১৯৭৬ সালে ছারছীনা মাদ্রাসায় কাজ শুরু করে। সাইদুর হুজুর বললেন অনেকে আমাদের কাছে প্রশ্ন
করেন মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে সুদী প্রতিষ্ঠান কেন? মানুষকে আমরা কেমনে বুঝাই, এত বড়
ইসলামি প্রতিষ্ঠান চালাতে একটি ব্যাংক ছাড়া যে উপায় নেই। এই শাখায় ছারছীনা মাদ্রাসার বিভিন্ন হিসাবে ৩৫/৪০ কোটি টাকা সব সময় জমা থাকে, কিন্তু তাঁরা
কোন সুদ গ্রহণ করেন না। ইসলামি ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ গ্রহণ করাকেও ছারছীনার পীর সাহেবানগণ বৈধ বলে মনে করেন না। বিভিন্ন ইসলামি
ব্যাংকের লোকজন ভাল লাভ দিয়ে ডিপোজিট নিতে চাইলে ছারছীনার পীর সাহেব ফিরিয়ে দেন।
পীর সাহেবের মতে ধানাই ফানাই করে সুদকে জায়েজ করে ফেলা সুদ খাওয়ার চেয়ে আর বড় গুনাহের কাজ। তাই ছারছীনা
মাদ্রাসার টাকা রাখার গোদাম শেষমেষ পূবালী ব্যাংকের ছারছীনা শাখার সুদবিহীন চলতি হিসাব সমুহ। এই হিসাব সমূহে লাখ লাখ টাকা আসে
কিন্তু পীর সাহেব একটি টাকাও তাঁর ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন না। সব টাকাই
মাদ্রাসা ও দীনের কাজে তিনি চেকের মাধ্যমে পেমেন্ট করেন।
মৌলানা সাইদুর রহমান জানান,
এখানে পঞ্চাশটি কম্পিউটার সজ্জিত একটি আইটি শিক্ষাকেন্দ্র করে দেয় পুবালী ব্যাংক।
পূবালী ব্যাংকের এম ডি এবং কয়েকজন পুরুষ পরিচালক এসে তখন
বর্তমান পীর মোহেব্বুল্লাহ সাহেবের অতিথি হন।
পীরসাহেব তাদের সম্মানে এক রাজভোজের আয়োজন করেন।
ছারছীনা মাদ্রাসায় কোন নারীর প্রবেশাধিকার নেই। একবার প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এই
মাদ্রাসায় আসেন কিন্তু বেগম সাহেবাকে গেটের বাহিরে রেখেই
তাকে ছারছীনা শরিফে ঢুকতে হয়।
ছয়তলা বিশাল মাদ্রাসা ছাত্রাবাসে
আমরা যাই। মাদ্রাসার হোস্টেলে অবস্থান করে নামমাত্র খরচে সাড়ে চার হাজার ছাত্র
অধ্যয়ন করেন। সামনে বড় পুকুর ও চারপার জুড়ে একসাথে শতাধিক মানুষের গোসল করার জন্য
উন্নত সাস্থ্যসম্মত স্নানাগার। চারপারে হুজুরদের গোসলের দৃশ্য মনে রাখার মত। এই মাদ্রাসা বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ডে সবচেয়ে
ভাল ফলাফল করে। ছারছীনার ছাত্ররা অনেকে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।
অনেকে বিসিএস পাস করে সরকারি উচ্চপদে চাকুরি করছেন।
ছারছীনার জলসা মাঠ বিশাল, এখানে অনায়াসে অর্ধলক্ষ মানুষের স্থানসংকুলান সম্ভব।
পাশে রন্ধনশালা দেখতে যাই। এখানে জলসায় আগত শত শত মানুষের জন্য তিনদিন রান্না
বান্না হবে। আয়তাকার বিশাল ডেগচিতে পোলাও রান্না হয়। এক একটি ডেগচি নাড়াচাড়া করতেই
চারজন জোয়ান লোককে হিমশিম খেতে দেখি। অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণে কাজ চলছে। ওয়াজকারীদের
জন্য একটি পাকা খোলা ভবনের মাঝে মাইক সজ্জিত স্থায়ী প্যান্ড্যাল। ছারছীনা
মাদ্রাসা চত্বরে উন্নত ডিজাইনে একটি বিশাল পাঁচ তলা মসজিদের নির্মাণ
কাজ চলছে। মসজিদের কাছে ১৩৮ ফুট উচ্চ একটি ফটক-মিনার নির্মাণ
হচ্ছে।
শাহ সুফি নেছারুদ্দিন আহমদ(রঃ) এই আধ্যাত্মিক দরবার শরিফ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পীর শাহ সুফি নেছারুদ্দিন আহমদের(রঃ) সমাধিতে
যাই। সাদামাটা চার পাঁচটি কবর, সবুজ ঘাসের আস্তরণে ঢাকা। কোন নামফলক নেই, তাই কোনটি
যে পীর নেছারুদ্দিন আহমদের(রঃ) কবর তা বুঝার উপায় নেই। পাশে একটি সাধারণ টিনের এবাদত খানা। একজন হুজুরকে বলে জানলাম সামনের ফুলগাছের তলায় পীর শাহ
সুফি নেছারুদ্দিন আহমদ(রঃ) চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এখানে
ঘাসের নিচে আর শায়িত আছেন বর্তমান গদ্দীনশীন পীর শাহ মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ ছাহেবের বাবা শাহ
সুফি আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ(রঃ)। জেয়ারতের নিয়ম একটি সাইবোর্ডে লিখা। আমি তাই
অনুসরণ করে জেয়ারত করি।
ছারছীনা একটি শান্তির রাজ্য।
একটা স্বর্গীয় সৌরভ যেন পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। এখানে ঢুকামাত্রই মনে হয় এটি
আল্লার রাজ্য। মনের ভয় ভীতি দুশ্চিন্তা সব উদাও হয়ে যায়। এখানে কলব জিন্দা হয়,
জীবনকে আধ্যাত্মিক চোখে দেখা যায়। দুনিয়ার ভালবাসা কমে যায়। লোভ লালসা, হিংসা
বিদ্বেষ, কাম ক্রোধ, অবিশ্বাস সব যেন অন্তর হতে বিদায় নেয়। শাহ সুফি নেছারুদ্দিন আহমদ(রঃ), আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ(রঃ) এবং শাহ মুহাম্মদ
মোহেব্বুল্লাহ(রঃ) এই তিন প্রজন্মের পবিত্র স্পর্শে ছারছীনা
ইসলামি সাম্রাজ্য দেড় বর্গমাইল জায়গা জুড়ে দিনে দিনে পুষ্প
পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠে।
আমরা ছারছীনা মাদ্রাসার
ছাপাখানায় মুদ্রিত মুজাদ্দিদে জমান শাহ সূফি নেছারুদ্দিন আহমদের জীবনী, মারেফত
তত্ব, স্বপ্নের তাবির, রাসুলের জীবনী ইত্যাদি ইসলামি কেতাব কিনি।
প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্রায়ই ছারছীনা
শরিফে আসতেন এবং তাঁর আমলে এখানে নতুন উপজেলা স্থাপিত হলে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ
ছারছীনা ছেলছেলার প্রতিষ্ঠাতা প্রথম পীর মরহুম শাহ সুফি নেছারুদ্দিন আহমদের(রঃ) সম্মানে এই উপজেলার নাম রাখেন নেছারাবাদ। নেছারাবাদ ফিরুজপুর
জেলার একটি নবীন উপজেলা। ছারছীনা এই ভাটি উপজেলার সন্ধ্যানদীর
পারের একটি ছায়া সুনিবিড় গ্রাম।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি দর্শনঃ
ছারছীনা হতে বরিশাল ফেরার পথে একটি ছোট
রাস্থা বামদিকে ঢুকে গেছে। এই রাস্থা দিয়ে কয়েক মাইল ভিতরে গিয়ে আমরা বানারীপাড়া
উপজেলায় আসি। এই উপজেলার চাখারে অবিভক্ত বাংলার সর্বভারতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে
ফজলুল হকের বাড়ি। বাড়ির সামনে একটি রাস্থা ও খাল পাশাপাশি বয়ে গেছে। তাঁর বাড়িতে ২৭ ডেসিমেল জায়গায় শেরেবাংলা
স্মৃতি জাদুঘর। টিকেট কেটে আমরা পাঁচ জন গেটের ভিতরে প্রবেশ করি। সামনে সাজানো
ছোট্ট বাগান। শেরেবাংলার জন্ম ২৬ অক্টোবর ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
এই জাদুঘরে ঢুকে শেরে বাংলার ব্যবহৃত খাট পালং, ইজিচেয়ার দেখি। শেরেবাংলার বংশ
লতিকা, ছবি, পত্র পত্রিকায় তাঁর ভাষণ, বক্তৃকা কাটিং, লাহোর প্রস্থাবের সভার ছবি,
তাঁর নানা কর্মকান্ডের সচিত্র বিবরণ ও জানাজার ছবি রয়েছে।
তাঁকে দেয়া উপহার একটি বড় কুমির মমি করে কাচের জারে সংরক্ষণ করা। জাদুঘরের বাম পাশেই কিছু খুটির মাচাঙ্গের উপর শেরে বাংলার পাকা
বাংলো, সামনে বাগান, রাস্থা হতে গেট খোলে একটি সরু সেতুপথ দিয়ে বাংলোয় যাবার
ব্যবস্থা। শেরে বাংলার বাড়িতে রয়েছে চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজ, পিতার নামে
ওয়াজেদ আলী বালিকা বিদ্যালয় এবং একটি বড় মসজিদ। শেরে বাংলার বসতবাটি এই বাড়ির
অন্দরমহলে, সেখানে আমাদের যাওয়া হয় নি। সিলেটের দাউদপুরে আমার পিতামহ মোহাম্মদ
মোফজ্জিল চৌধুরীর বাড়ি দিঘিসহ প্রায় ৩৬ বিঘা। শেরে বাংলার বাড়ি আমার
পিতামহের বাড়ির মত এত বড় হবে না। তবে বাড়ির সামনের সারাটা প্রাঙ্গণ
জুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে।
সরফফুদ্দিন আহমদ সান্টুর মসজিদ
কমপ্লেক্স পরিদর্শনঃ
শেরে বাংলার বাড়ি হতে বেরিয়ে গাড়ি বরিশালের বেশ আগে এস সরফুদ্দিন আহমদ সান্টু এমপির মসজিদের
গেটে থামে। তখন বিকেল ৩টা। আমরা এই অপরুপ সুন্দর মসজিদে ঢুকে জোহরের কসর নামাজ আদায়
করি। আমি মক্কা, মদীনা, পুত্রজায়া, দিল্লি জামে মসজিদ,
বাগেরহাটের খানজাহান আলীর ষাটগম্বুজ মসজিদ, সুনামগঞ্জ ইয়াসিন মির্জার মসজিদ, আবুধাবির
শেখ জায়েদ মসজিদ সহ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মসজিদ দেখেছি। এই মসজিদে আমি আবুধাবির
শেখ জাহেদ মসজিদের আংশিক মিনি ডিজাইন লক্ষ্য করি। শেখ জাহেদ মসজিদের মত চারপাশ
জুড়ে খালকাটা সরোবর। সামনে খুব সুন্দর ঘাট বিশিষ্ট বড় পুকুর। মসজিদের চারপাশে
বাগান ও আবর্তন করার পাকা রাস্থা। মসজিদের উত্তরদিক ঘেষে মহিলা ইবাদাতখানা ও এমপি
সরফুদ্দিনের মায়ের নামে স্থাপিত একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা। এই মসজিদে মক্কা, মদিনা,
জান্নাতুল বাকি, বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানি ও খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মাজারের মাটি
ও পাতর সংরক্ষিত আছে। মসজিদের মালিকানায় রাস্থার অপর পাশে একটি পর্যটন হোটেল
রয়েছে। হোটেলের আয়ে মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। তাজমহল
যেমন সম্রাট শাহজাহানকে অমর করে রেখেছে, এই মসজিদও তাঁর নির্মাতা সরফুদ্দিন
আহমদ সান্টুকে দক্ষিণবাংলায় অমর করে রাখবে নিশ্চিত।
দুর্গাসাগর দর্শনঃ
বরিশাল শহর হতে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে
বিখ্যাত দিঘি দুর্গাসাগর। আমরা বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে টিকেট কেটে এই দিঘি উদ্যানে
প্রবেশ করি। সামনা নয়নাভিরাম। দেড় শত ফুট বিস্তারের একটি বড় কারুকার্যময় ঘাট নেমে
গেছে দুর্গাসাগরে। দিঘির জলাভূমি ২৭ একর, খননকালে দিঘিপারে এত মাটি পড়ে যে চারপাশ
অনুচ্চ টিলার আকার ধারণ করে। পারসহ দুর্গাসাগরের আয়তন ৪৫.৪২ একর। দুর্গাসাগরের
মাঝখানে দুইবিঘা আয়তনের একটি ছোট
বৃক্ষশোভিত জঙ্গলা দ্বীপ আছে। আমরা এই দিঘিতে প্রচুর পরিযায়ী
পাখি ও হাঁস দলবেঁধে সাঁতার কাটতে দেখি। সুন্দর দিঘিটা পানকৌড়ি,
বালিহাঁস ও নানা জাতের পাখির কল কাকলীতে মুখরিত।
সাইনবোর্ডে দুর্গাসাগরের ইতিহাসে চোখ
বুলাই। ১৭৮০ সালে রাজা শিব নারায়ণ এই বিশাল দিঘি খনন করেন এবং তাঁর স্ত্রী
রানি দুর্গামতির নামে দিঘির নাম রাখেন দুর্গাসাগর। বরিশালের প্রাচীন নাম ছিল
চন্দ্রদ্বীপ। চন্দ্রদ্বীপের রাজা শিব নারায়ণ এক সন্ধ্যারাতে রানি দুর্গামতিকে কথা দেন
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রানি যতদূর পর্যন্ত হেঁটে ঘুরে আসবেন, ততোটুক জায়গা জুড়ে
রানির নামে দিঘি খনন করাবেন। সকালে রানি ছুটলেন তো ছুটলেন, থামার নামগন্ধ নেই।
রাজা প্রমাদ গুণলেন, রানি দুর্গামতিকে থামানো না গেলে এত
বিশাল দিঘি খনন করা যে তাঁর সাধ্যে কুলাবে না। তাই কর্মচারী পাঠিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে
আনেন। রাজা ও বড়লোকেরা খামখেয়ালী হয়। রাজার প্রতিজ্ঞার জয় হল। রাজা শিবনারায়ণ রানির
ঘুরে আসা সমুদয় জায়গা জুড়ে খনন করান দুর্গাসাগর দিঘি। প্রতি বছর চৈত্রমাসের অষ্টম
তিথিতে এই দিঘিতে হিন্দু সমপ্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পুণ্যস্নান অনুষ্ঠান হয়।
দিঘির চারপাশ আবর্তন করছেন পর্যটকের দল। এই দিঘির একবার ঘুরে আসতে পাক্কা এক মাইল পথ হাঁটতে হয়। আমরা পাঁচজন দিঘিপারে হাঁটতে থাকি। সরোবরের
টিলাপার দিয়ে হাঁটছি। এপারে উদ্যান ও চিড়িয়াখানার মত স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। অন্যান্য পারে বৃক্ষ বন ছাড়া তেমন কিছু নেই। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা
এসে অভিসার করছে। আমি প্রতিদিন ধানমন্ডি লেকপারে হাঁটি। ধানমন্ডি লেকপার আবর্তন
করতে আর অনেক বেশি সময় লাগে।
আমাদের সাথী ফারুক আহমদ বেশ রসিক
মানুষ। তিনি কিছু হাস্যরসাত্মক গল্প বলে আমাদের সফর জমিয়ে রাখেন। একজন লোক তাঁর
বউকে বলল আমি যদি বেহেশতে যাই তাহলে সেখানে তোমার চেয়ে সুন্দরি রূপসি অনেক অনেক
হুর পাব। বৌ তখন স্বামীকে প্রশ্ন করল তুমি হুর পাবে ভাল কথা, তবে আমি যদি বেহেশতে যাই তাহলে কি পাব। পত্নীর প্রশ্নের জবাব পেতে এবার
স্বামী বেচারা হুজুরের কাছে ছুটে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে
জানতে চান তাঁর বউ বেহেশতে গেলে তাঁর মত হুর গেলমান পাবে
কিনা। হুজুর জবাব দেন নারীরা কোন হুর
গেলমান পাবে না, তাঁরা কেবল নিজ নিজ স্বামীকে পাবে। স্বামীর কাছে এই
জবাব শুনে বৌ তখন গালে হাত দিয়ে বলল, হায়রে পুড়া কপাল আমার, আমার ভাগ্যে দুনিয়ায় যে বানর, বেহেশতে গিয়েও
সেই একই বানর। বিয়ে করে দুনিয়ায় ঠকলাম, মরণেও পাঁজিটার কবল হতে নিস্তার নেই। রাতের
ঘুম ভাঙ্গলে সকাল, না ভাঙ্গলে পরকাল। পরকালে
জান্নাতে গিয়েও দুষ্ট শেয়ালটার সাথে বোনাস জুটবে সতীনের ঘর, এক
দঙ্গল সতীনের জ্বালা।
যীশু বলল শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয়ের তাদের একজন সহজ সরল সহপাঠির গল্প। নাম তাঁর তরিকুল,
মাঝে মাঝে তাঁকে ক্লাসে পাওয়া যায় না। তাবলিগ জামাতের চিল্লায় গিয়ে তরিকুল জরুরী
ক্লাস ফেলে হারিয়ে যায়। তাদের শিক্ষা জীবনের শেষ ক্লাশ নিচ্ছেন একজন অল্প বয়স্কা
অনিন্দ্যসুন্দরী মেডাম। মেডাম ছাত্রদেরকে
আশির্বাদ করে বললেন, তোমাদের অনেক উন্নতি হবে, তোমরা জীবনে অনেক বড় হবে। একজন একজন করে দাঁড়িয়ে
সবাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে। এবার তরিকুলের বলার পালা।
তরিকুল দাঁড়িয়ে সিলেটি ভাষায় বলল, মেডাম আমরা যে যত বড় হই না কেন, আমরা কেউই কক্ষণও
আপনার উপরে উঠতে পারব না। সেয়ানা ছাত্রছাত্রীরা তরিকূলের এই সরল বক্তব্যের উল্টো
তরজমা কল্পনা করে হেসে উঠে।
তরিকূল কোন বাজেচিন্তা মাথায় নিয়ে একথা বলেনি নিশ্চিত। একটা কথার যে কত রংচটা তরজমা হতে পারে তা কি হুজুরের
মাথায় লয়? সহজ সরল তাবলিগ হুজুর তরিকূল, তাঁর চামড়ার ঠোট
একটু লড়খড়া, তাই কথা বেরিয়ে গেছে সামান্য তেড়াবেড়া, এই যা। সে যাই হউক তরিকুলই
ধন্য, সেদিন অন্যদের বক্তব্য কেউ মনে না রাখলেও তরিকুলের ভাষণ সবাই মনে রেখেছে,
হয়ত মনে রাখবে আজীবন।
ফারুক আহমদ তাঁর
ময়মনসিংহ এলাকার একজন বুড়ো ইমাম সাহেবের কাহিনি বললেন। ইমাম
নোয়াখালী এলাকার লোক। দেশে বউবাচ্চা থাকলেও এখানে একা থেকে মসজিদে ইমামতি করেন।
মুসল্লিরা বলল বউ দেশে রেখে মাসের পর মাস দূরে থাকা ইসলামের বরখেলাফ। এভাবে চললে
হুজুরকে এখানে ইমাম পদে রাখা যাবে না। কি আর করা যায়, চাকুরি বাঁচাতে ইমাম সাহেব
তের বছর বয়সের এক ইয়াতিম গরিব মেয়েকে বিয়ে করলেন। বুড়ো
হুজুরের ঘরে ছোট্ট মেয়েটির মন টেকে কতক্ষণ। মেয়েটি মসজিদের মুয়াজ্জিন ছেলেটার দিকে
ঝুঁকে পড়ে। ভোরে মুয়াজ্জিন তালবা আজান দিলেই হুজুর ইমামতি করতে মসজিদে ছুটে যান।
হুজুর বেরিয়ে আসতেই মুয়াজ্জিন ছেলেটা হুজুরের কামরায় ঢুকে তাঁর বালিকা বিবির সাগরে
সাঁতার কাটে। একদিন তালবা মুয়াজ্জিনের মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ইমাম হুজুরের বালিকা
বিবির সান্নিধ্যে যাবার জন্য তাঁর মন আনচান করছে। হুজুরকে ঘর হতে বের করে আনতে
তালবাটার ঠায় সইল না, সময়ের আগেই শেষরাতে সে ফজরের আজান দিয়ে দেয়। ‘আসসালাতু
খাইরুম মিনান নাউম’ শেষ হতেই ইমামহুজুর মসজিদে ছুটে যান। তখন হুজুরের ঘরে একটা
ইঁদুর ঢুকে পড়ে। ইমাম ভাবেন ব্যাপারখানা কি? কোন মুসল্লি যে আসছে না, অন্ধকারও
যাচ্ছে না। মুয়াজ্জিন পোলাটা বুঝি ভূলবশতঃ ফজরের সময় হবার আগেই আজান দিয়ে ফেলেছে।
হুজুরের চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন। আরেকটু ঘুমিয়ে আসি বলেই ইমাম হুজুর গৃহপানে ছুটলেন। হঠাৎ
হুজুরের আগমনবার্তা টের পেয়ে পালাতে না পেরে মুয়াজ্জিন পোলাটা হুজুরের পালঙ্ক তলায়
লুকিয়ে যায়।
এক সময় চারদিকে একসাথে ধ্বনিত হয়
ভোরের আজান, কিন্তু হুজুরের মসজিদে আজানের কোন খবর নেই। ঘুমন্ত মুয়াজ্জিনকে জাগাতে
ইমামহুজুর পাশেই মুয়াজ্জিনের কক্ষে গিয়ে দেখেন সে নেই। সবাই মুয়াজ্জিন তালবাকে
খোঁজছে। কিন্তু কোথায়ও তাঁর সাড়াশব্দ নেই। ইমাম মুসল্লিদেরকে বললেন তালবাটা শেষরাতে
ফজরের আজান দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গাল, অথচ এখন
আজান দেবার সময়টায় সে লাপাত্তা? ইমাম হুজুরের সন্দেহ হল। ইঁদুরটা তবে
আমার খামারে ঢুকে গেল নাকি। তিনি মুসল্লিদেরকে
সাথে নিয়ে নিজ বাসায় তল্লাশি চালান।
আচমকা খোঁজ মেলে বুড়ো ইমামের
পালঙ্কের তলায় ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে মুয়াজ্জিন পোলা। ইমাম সাহেবের বালিকা বিবি
বোরকায় গা ঢেকে পিছনের দরজা দিয়ে এক দৌড়ে উদাও। বুড়ো হুজুর গর্জে উঠলেন, তবে রে
হারামজাদা, তুই আমার বিবিরে পত্তিদিন ঠান্ডা করে দিস, তাই বহুদিন ধরে তাঁর আগের
সেই ছটফটানী নেই। মুয়াজ্জিন পোলা ভয়ে কাঁপছে, বড়হুজুর তাঁর কান শক্তকরে ধরে
হুঙ্কার দেন ওরে বদমায়েশ, তঁরে আমরা শাস্তি দেব, মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারব।
আমরা ছারছীনা হতে বরিশাল ফিরে
আবার কির্তনখোলার পারে যাই। নদীর দৃশ্য নয়নাভিরাম। অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছেন।
উদ্ধারকারী জাহাজ রোস্তম বিশাল ক্রেন নিয়ে পাশে ভেসে আছে। বরিশালে যেমন নদী ও
খালের ছড়াছড়ি, তেমনি দিঘির ছড়াছড়ি। আমরা বিবিরদিঘির পাশদিয়ে বরিশাল শাখায় হাজির
হই। গার্ডরা ডাব কেটে দেয়, বরিশালের ডাবের পানি ও নরম শাঁস বেশ সুস্বাধু। আমাদেরকে
এক জমকালো ডিনার খাওয়ান বরিশাল শাখার এ জি এম আরিফ রাব্বানী। হ্যাঁ, আমরা মেহমানরা
তাঁকে শুধু খাটাই নি, তাঁর পকেটও বেশ খালি করি।
বরিশাল শহরটা তেমন বড় নয়।
চার-পাচটা বরিশাল শহর পাশাপাশি বসালেও সিলেট মহানগরের সমান হবে কিনা সন্দেহ। এমন
কি বিভাগীয় শহর বরিশাল মৌলভীবাজার জেলাশহরের চেয়েও অনেক ছোট ও নিস্প্রভ। কৃষি ও
মৎস্য ছাড়া এখানে তেমন কোন শিল্প নেই, পর্যটন খাত দুর্বল। একটি শিল্প অমৃতলাল
গ্রুপ, এখানে মসলা, নারকেল তেল, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি প্রস্তুত হয়। আমৃতলাল
শিল্পগ্রুপের শ্লোগান কর্মই ধর্ম। বরিশালের আয় প্রকৃতি নির্ভর। সামুদ্রিক সাইক্লোন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় আছে। অঞ্চলটা আসলেই গরিব, তাই জাহাজের পেঠ ভরে দরিদ্র
লোকজন কাজের খোঁজে রাজধানী ঢাকায় ছুটে। ভাটি এলাকায় ধর্মীয় মোল্লাদের প্রভাব এখনও
অটুট।
বরিশাল নদীবন্দরে এসে
সুন্দরবন-১০ জাহাজে আরোহন করি। লিফট সজ্জিত চারতলা জাহাজ। ঢাকা হতে বরিশাল যে
জাহাজে আসি সেটির চেয়ে এই জাহাজ আর গর্জিয়াস, আর বিলাসবহুল। আরিফ রাব্বানী বললেন,
এইসব জাহাজ ঢাকায় একবার আসা যাওয়া করলেই চৌদ্দ লক্ষ টাকা আয় হয়। জ্বালানী ও অন্যান্য খাতে সাত লক্ষ টাকা খরচ
বাদ দিয়ে লাভ থাকে প্রায় সাত লক্ষ টাকা। একটি জাহাজ প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর
একটানা টিকে থাকে।
আমাদের সুন্দরবন-১০ জাহাজ রাত ১০টায়
কির্তনখোলা বন্দর হতে যাত্রা করে। নভেম্বরে নদীবক্ষে বেশ শীত। কেবিনে কাঁথা গায়ে
একাকী শুয়ে পড়ি। ভোর ৫টায় আজান শুনে বেরিয়ে এসে দেখি সামনে ঢাকা সদরঘাট, জাহাজ
জনশূন্য, লোকজন নেমে গেছে। বড় সৌভাগ্য আমার, বরিশালের বড় জাহাজ চড়ে মহাসাগরের বুকে
টাইটানিক চড়ার বহুদিনের দুধের শখ যেন ঘুলেই মিঠে গেল।
জাহাজ হতে নেমেই দক্ষিণবাংলা
দেখানোর জন্য মহান আল্লাহকে শোকরিয়া জানাই। আজ ২৩ ডিসেম্বর ২০২০। আমার পঞ্চান্নতম
এই জন্মদিনে দক্ষিণবাংলা ভ্রমণকাহিনি লেখা শেষ হল। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন