সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মেঘনাপারের চরদিঘলদী গ্রামেঃ

 

মেঘনাপারের চরদিঘলদী গ্রামেঃ

অবস্থানঃ ৩রা এবং ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২০

 

মানবাত্মার কল্পনা পরমাত্মা কোন না কোন সময় বাস্তবে রূপ দেন। আমার জীবনে এমন ভূরি ভূরি নজির আছে। পাঁচচল্লিশ বছর আগে ১৯৭৫ সালে আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। কবি আহসান হাবীবের একটি কবিতা আমি বারবার পড়তাম। কবিতাটির নাম ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে’। পড়ার টেবিলে বসে নীরব হলেই মা মনে করতেন আমরা পড়ছি না। তাই সশব্দে একটা কিছু পড়তে হ। কি আর করা যায়, তাই পড়ি। গড় গড় করে পড়ি আমার প্রিয় শখের কবিতা- ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে আমি, মেঘনা পাড়ে বাড়ি/ ইচ্ছে হলে এপার হতে ওপারে দেই পাড়ি’ কবিতাটি পড়ে পড়ে তন্ময় হয়ে তখন আমি সেজে যেতাম- ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে, আমি মেঘনা নদীর নেয়ে/ মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে তালের নৌকা বেয়ে, আমি বেড়াই হেসে খেলে, আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে’।

এত বছর পর বাল্যকালের সেই কল্পনারাজ্যের মেঘনা পাড়ের ছেলে আমি দুইদিনের জন্য হয়ে যাই স্রষ্টার অপার মহিমায়। সেই কল্পনার মেঘনা, সেই মেঘনা পাড়ের গ্রাম। সিলেট বিভাগের বাহিরে বাংলাদেশের কোন গ্রামের ছেলে এর আগে আমি কোনদিন হই নি, কোন গ্রামে রাতে ঘুমাই নি। তবে হ্যাঁ, আমি এই মেঘনাপারের ছেলে হতে পেরেছি মেঘনা পাড়ে বেড়ে উঠা একজনের কল্যানে, তিনি সাইদ আব্দুল্লাহ যীশু। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে তিনি যোগ দেন পূরালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারে।  

যীশুর গ্রামটির নাম চরদিঘলদী। গ্রামের সামনে হাকালুকির মত প্রসারিত বিশাল মেঘনা। নীল জলে দোলে উঠা ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের হানাহানি। চর-দ্বীপ, দিঘল-লম্বা, দী-এলাকা। অর্থ- লম্বাদ্বীপ এলাকা, যেন নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড। এখানে বায়ু বিশুদ্ধ, পানি আকাশের মত নীল, উপরে মেঘের উড়াউড়ি। কেবল ঢাকা হতে আগত খালদিয়ে বিবর্ণ জল আসে মেঘনায়, তবে তা এখনো মেঘনার বিশাল জলরাশিকে তেমন কালো করতে পারেনি। চরদিঘলদী ঢাকা হতে খুব একটা দূরে নয়। অথচ এই গ্রামে ঢাকার সেই শব্দ দুষণ নেই, বায়ু দুষণ নেই, নেই জল দুষণ। চরদিঘলদী এখনও প্রকৃতির রাজ্য। মানবসৃষ্ট নানান ভেজাল এসে গ্রামটিকে নষ্ট করে দেয় নি।

ঘন ঘন সিলেট যাওয়া বন্ধ। মহামারি করোনা আমাকে বন্দি করে রেখেছে ধানমন্ডির বাসায়। টিকেট করেও যাওয়া হয়নি তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে। সহকর্মী যীশু মাঝে মাঝে বলে স্যার আসুন কোনদিকে ঘুরে আসি। আমার বয়স চৌয়ান্ন, তাই করোনা ভাইরাসকে ভয় না পেয়ে পারিনা। যাওয়া হয় না কোথায়ও, অফিস ও বাসায় থাকি এক স্বেচ্ছাবন্দি জীবনে। এমন কি করোনা ভীতি বাসার সামনের অনন্যসুন্দর ধানমন্ডি লেকপারের বাগানে আমার হাটাহাটিও বন্ধ করে দেয়।

এক বৃহস্পতিবার বিকেলে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই একগুয়ে জীবন হতে শুন্য বেগেজে যীশুর সাথে পালাই। অফিসে বসে ডিসিশন, সাথে সাথে বাস্তবায়ন। যীশু বলল, টুথব্রাশ কিনি। আমি বললাম, লাগবে না। ব্রিটিশ অভিনেতা বেয়ার গ্রিলসের মত বুদ্ধি খাটিয়ে সারভাইভ করে নেবো। আমি টুথব্রাশ হিসাবে ব্যবহার করবো আম পাতা, যে পাতার রস টুথপেস্টের কাজ করে। লুঙ্গি না হয় একটা কিনে নেব।

আমরা মতিঝিল অফিস হতে বেরিয়ে সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের কাছে পুরান ঢাকায় যাই যীশুর বাল্যবন্ধু চরদিঘলদীর জাতক জামিল সাহেবের বাসায়। অনেক বছর পর পুরান ঢাকায় পা রাখা। জনতার ভীড় ও ঘনবসতি পেরিয়ে একটি ভবনের তিতলায় যাই। বাসা ঠান্ডা ও আরামদায়ক। বউ বাসায় নেই, তাই সুদর্শন ফর্সা জামিল সাহেব একা বাসায় আছেন। তিনি গার্মেন্টসের বাইং হাউসে চাকুরি করেন। চরদিঘলদী গিয়ে পরার জন্য দুইটি সুন্দর দামী সার্ট তিনি আমাকে উপহার দেন। শোকরিয়া বলে সার্ট দুটি ব্যাগে ভরে নেই। আসলে সেদিন আমার সাথে পরনের পোষাক ছাড়া আর কোন জামা ছিলনা। তাই সার্ট দুটি মনে হল আপদকালে স্রষ্টার দান।

যীশু ও জামিল সাহেব এই প্রত্যন্ত গ্রাম হতে কঠিন সংগ্রাম করে বেরিয়ে এসে শিক্ষিত হন এবং চাকুরি নিয়ে রাজধানী ঢাকায় জীবনে স্থিত হন। তবে তাদের মনপ্রাণ পড়ে থাকে জনম মাটি চরদিঘলদী গ্রামে। চরদিঘলদী গ্রামের ছেলেদের সংঘটন ‘চরদিঘলদী পশ্চিমপাড়া আদর্শ বন্ধুমহল’। এই বন্ধুক্লাবের উপদেষ্টা এসব ছেলেদের উচ্চশিক্ষিত গুরুজন যীশু ও জামিল সাহেব। জামিল সাহেব বড়মনের মানুষ। তিনি প্রচুর অর্থ খরচ করে গ্রামের ছেলেদের জন্য একবস্তা কালো গ্যাঞ্জী কিনেছেন। প্রতিটি গ্যাঞ্জীতে লিখা আছে ‘চরদিঘলদী পশ্চিমপাড়া আদর্শ বন্ধুমহল’। ঢাকা থেকে বেশ কষ্ট করে ভারী কাপড়ের বড়বস্থা চরদিঘলদী বয়ে নিয়ে যান তাঁরা।

সায়দাবাদ এসে একপ্রান্তে আড়াইহাজারের বাস টার্মিনাল। এখানে আগের যুগের কয়েকটি পুরানো বাস দাড়ানো। টিকেট কেটে তিনজন সিটে বসি। গাড়ির জনতা করোনার ব্যাপারে একদম বেপরওয়া। সবাই গাদাগাদি হয়ে বসে, অনেকের মুখে কোন মাক্স নেই। যীশু বলল ভয় পাবেন না স্যার, আমাদের গ্রামে করোনা ভাইরাসের কোন নামগন্ধ নেই। আমাদের লোকজনকে এই ভাইরাস কিছুই করতে পারবে না। এসব গ্রামে কত ভাইরাস আসে আর যায়। লোকেরা জন্ম থেকে জীবানু ও ভাইরাসের সাথে গলাগলি করে বেড়ে উঠে। ওদের শরীরে ভাইরাসের এন্টিবডি ঠাসা আছে। তাই আমাদের গ্রামের লোকজনের শরীরে প্রবেশ করলে করোনা ভাইরাস নির্ঘাত মারা পড়বে। চরদিঘলদী গিয়ে বুঝলাম, যীশু সত্য কথাই বলেছে। মেঘনাপারের সংগ্রামী মানুষ ‘যাদের ঢেউয়ের সাথে গলাগলি ঢেউয়ের সাথে খেলা/ ঝড়ের সাথে লড়াই করে কাটে সারাবেলা’ তাঁরা কি আর করোনা ভাইরাসকে ডরায়।

আমাদের বাস কাচপুর পার হয়ে চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে আগায়। একসময় বাসটি বামের একটি ছোট রাস্থায় ঢুকে যায়। দুটি বাস ক্রস করতে বেগ পেতে হয় এই ছোট সড়কে। দুই একটি শিল্প কারখানা দেখা গেলেও এক সময় রাজধানী ঢাকার কোলাহল মুছে যায়। একদম খাঁটি পল্লী এলাকায় আমরা ঢুকে যাই। রাস্থার পাশে ধান ও পাট ক্ষেত। খাল ও জলায় মাছ ধরার নৌকা ও জাল। স্থানটি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলা। বাস উপজেলা বাজারে ঢুকে। আড়াইহাজার উপজেলা শহর। লোকজনে ভরা বাজার। বাস বাজার পেরিয়ে আবার অজপাড়া গাঁয়ের তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বাদসন্ধ্যায় গোপালদী আসে। গোপালদী বাজারের ভীড় ঠেলে বাজার পাশের  নদীঘাটে যাই। মেঘনার একটি শাখানদীর পারে এই ঘাট।

গোপালদীর এই ঘাটে একটি বজারা নৌকার শক্ত ছইয়ের উপরে জুতা খোলে বসি। ৪০/৫০ জন আরোহী এসে পূর্ণ হলে নৌকা ছাড়ে। নৌকা এই নদীপথে একটু গিয়েই এক বিশাল হাওরে পড়ে। হালকা বাতাস এসে গরমের অস্বস্থি তাড়িয়ে দেয়। আকাশে মেঘের আড়াল হতে বেরিয়ে আসে রূপালি চাঁদ। হাওরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে চাঁদের প্রতিবিম্ব ভেঙ্গে জলে ৩০/৪০ ফুট দীঘল সাদা কম্পমান চন্দ্রমুখ তৈরি করে। হাওরকে আমার চোখে মেঘনা বলে ভ্রম হয়। যীশু বলল, এটা মেঘনা নয়, বর্ষায় নদী ও হাওর মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

এবার মেঘনায় এলাম, প্রায় মাইল খানেক বিস্তারের বিশাল মেঘনা। বাংলার অহংকার মেঘনা, জল ঢেউ বাতাসের ঝাঁপটায় দোলে উঠা আবাহমান কালের সাক্ষী মহানদী মেঘনা। গরগর আওয়াজ তুলে ঢেউ ভেঙ্গে বজরা এপার হতে ওপারে পারি দেয়। কোন ট্রলার কিংবা ইঞ্জিন নৌকা এগিয়ে আসতে দেখলে বজরার যাত্রীরা ভয় পান, মাঝিরা চিৎকার করে কথা বলে জানতে চান ওরা কারা? কারণ কি জানতে চাইলে যীশু বলে জায়গাটা নিরাপদ নয়। প্রায়ই মেঘনায় ডাকাতি হয়। মেঘনার একেক পারে একেক থানা। সবাই ঠেলাঠেলি করে, কেউ দায়িত্ব নেয়না। ঘুষ বানিজ্য চলে অবাধে, তাই ঘুষখোর পুলিশ, ডাকাত ও অপরাধীরা এখানে বেশ নিরাপদেই অপকর্ম চালিয়ে যায়।

বজরা এসে এবার মেঘনার পূর্বপারের চরদিঘলদী গ্রামের ঘাটে নোঙ্গর করে। চরদিঘলদীর মেঘনারপারে আছে সরকারের তৈরি লম্বা ভাঙ্গন প্রতিরোধ দেয়াল। দেয়ালের পাশ দিয়ে গ্রামের সড়ক। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি ব্যস্ত ছোট নদী। এই ছোটনদী তার জননী মেঘনাকে উপহার দিতে বয়ে নিয়ে আসছে কাছের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পূবালী জল। এই ছোট নদীর পারে পাকা বাঁধ, পাশদিয়ে গ্রামের রাস্থা। নদীপারের গাছের সাথে বাঁধা সারি সারি নৌকা। নদীর তীরে তীরে ঘাট, এইসব ঘাটে ঘাটে নর-নারীরা গোসল করে, কাপড় কাঁচে। বাচ্চারা জলে ঝাঁপ দেয়, সাঁতার কাটে। চরদিঘলদীর শিশুরা খুব অল্প বয়সে সাঁতার শিখে। একটি বালক কয়েকটি কুকের খালি বোতলের মুখ বন্ধ করে রশি দিয়ে বেঁধে কৃত্রিম লাইফ জ্যাকেট বানিয়ে নেয়।

যীশুর বাড়ি ছোট নদীর পারে। টিনের ছোট্ট ঘর, মেঝে পাকা। ছোট্ট জানালা দিয়ে তাকালে পাশের ছোট নদী এবং দূরের মেঘনা দেখা যায়। ছোট নদীর দৃশ্য অপরূপ, একটার পর একটা নৌকা, ট্রলার ও জেলে নাও ঢেউ তুলে চলে যায়। নদীপারের জলাবন ঢেউয়ে খানিক দোল খায়। যীশু ও আমি রাতে এই ঘরে ঘুমাই। টিনের ঘর বেশ ঠান্ডা ও আরামদায়ক। ভাসান জলের জন্য গ্রামটিতে বর্ষায় মশা জন্মাতে পারেনা। তাই মেঘনা পারের গ্রাম চরদিঘলদীকে ঘন বর্ষায় আমি মশাশুন্য পাই। রাতে মশারী ছাড়াই ঘুমাই। যীশু বলল, আমি প্রায়ই নৌকায় ঘুমাই। বাড়ির পাশের ছোটনদীতে সারি সারি ছইয়ে ঢাকা নৌকা নোঙর করা আছে। একটিতে ঢুকে ঘুমালেই নদীর শীতল বাতাস ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যীশু নৌকায় ঘুমানোর প্রস্তাব দিলেও বিদেশ বিভূইয়ে এভাবে খোলা নৌকায় ঘুমিয়ে রাত পার করার সাহস আমার হলনা।

যীশুর ভাবী সিম্পল গৃহবধু। এক পুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার। ভাই চাকুরি করেন চট্টগ্রাম। তিনি আমার জন্য বেশ যতনে রান্না করেন। শহরে দেশী মোরগ পাওয়া যায়না এবং পাওয়া গেলেও হৃষ্টপুষ্ট হয়না। চরদিঘলদীতে দেশী পরিপুষ্ট মোরগের মাংস খেতে বেশ ভাল লাগে। বাড়িতে প্রচুর পোষা কবুতর, ভাবী কবুতরের রোস্ট খাওয়াতে চাইলে  বলি, আমি কবুতর খাইনা। কবুতর নিরীহ প্রাণী, আমার জন্য কবুতরের প্রাণ যাক তা আমি চাইনি। গ্রামের ফ্রেস গরুদুধ আমার ভাগ্যে জুটে।

৩রা সেপ্টেম্বর ২০২০। ‘চরদিঘলদী পশ্চিমপাড়া আদর্শ বন্ধুমহল’ ক্লাবের দ্বি-বর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান চলছে, মাইক বাজছে। যীশুর সাথে অনুষ্ঠান সভায় যাই। সামিয়ানা ঘেরা তেরপাল ঢাকা সভাস্থল বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত। আমি মেঘনাপারের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে এসেছি। সামনের সারির চেয়ারে বসে একজন সাধারণ দর্শক হই। গ্রামের লোকজন এসে দর্শক প্রাঙ্গণ পূর্ণ হল। প্যান্ডেলে বসেন চরদিঘলদী পশ্চিমপাড়া আদর্শ বন্ধুমহলের নেতৃবৃন্দ, গ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলনেতাবৃন্দ এবং ক্লাবের উপদেষ্টা যীশু ও জামাল সাহেব। আমাকেও প্রায় জুর করে নিয়ে প্যান্ডেলের এক আসনে বসানো হল। ক্লাবের দ্বিবর্ষ পুর্তির মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হয়, জাতীয় সঙ্গীত বাজে, জাতীয় ও ক্লাবের পতাকা উড়ে, সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায়। নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। সবাই হাততালী দিয়ে নতুন কমিটিকে বরণ করেন। আলোচনা সভায় চরদিঘলদীর নেতৃবৃন্দ ও ক্লাব সদস্যরা বক্তব্য রাখেন। ক্লাব সদস্যদের উদ্দেশ্য মহৎ। গ্রামের উন্নয়ন, মানুষের উন্নয়ন, এলাকার সমস্যার সমাধানে একসাথে কাজ করা। উদ্দেশ্য একটাই- একে অন্যকে হাত ধরে টেনে উন্নত জীবনে নিয়ে যাওয়া। সদস্যরা অনেকে একে একে বক্তব্য রাখেন। শিক্ষার সমস্যা, বাল্য বিবাহ, মেয়েদের শিক্ষাজীবন হতে অকালে ঝরে পড়া, বেকারত্ব, ইভটিজিং ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধি নিয়ে সবাই বক্তব্য রাখেন।

আমাকে মাইকে কিছু বলতে ডাকা হল। চরদিঘলদীর বন্ধুসভার বক্তব্যে বললাম, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, জকিগঞ্জ হতে সুন্দরবন, আমরা বাংলাদেশীরা এক অভিন্ন প্রতিবেশী। গ্রামের সাথে গ্রাম, জনপদের সাথে জনপদ, বাড়ির সাথে বাড়ি জোড়া লেগে লেগে আমাদের এই বাংলাদেশ হয়েছে। আমরা সবাই একে অন্যের প্রতিবেশী। তাই প্রতিটি গ্রাম বদলে গেলে বাংলাদেশ বদলে যাবে। আমরা প্রতিটি মানুষ বদলে গেলে গ্রামগুলো বদলে যাবে। এভাবে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হিসাবে দাঁড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার একটি দেশ। বাংলাদেশকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা যদি আপনি আমি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাই।

বড় ডেগে ক্ষিচুড়ী রান্না করা হয়েছে। আমি খেতে চাইনি। আমাকে আবার ঘাড়ে ধরে খাওয়ানো হল। মুখে দিয়ে দেখি ভারি মজার ক্ষিচুড়ী। ডাল, মটর, ছোলা, আলু, গাজর ও কুচি কুচি চিকেনের মিশ্রণে পুষ্টিকর খাবার। আমাদের সিলেট এলাকার মানুষকে এমন ক্ষিচুড়ি বানাতে দেখিনি। এই ক্ষিচুড়ি ইচ্ছেমত খেয়ে কেউ কেউ বলল রাতের ডিনার হয়ে গেছে।    

গ্রামের ছেলেদের উচ্ছাস দেখে মনে হল বন্ধুক্লাব চরদিঘলদী গ্রামে অনেক মহৎ নেতা তৈরি করবে এবং তাঁরা একসময় সুনাগরিক হয়ে মেঘনাপার বদলে দেবে। এক সময় এই গ্রামে বাল্যবিয়ে থাকবেনা, ইভটিজিং থাকবেনা। সবাই শিক্ষিত হবে, কেউ বেকার থাকবেনা। পরবর্তী প্রজন্ম মানুষের মত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।

বন্ধুসভা হতে বের হয়ে দেখি মেঘনাঘাটে একটি বজরা সাজানো হচ্ছে। বজরার ছইয়ের উপর কাপড়ের পর্দা ও ছাদ বানিয়ে দুতলা করা হয়েছে। বজরা জুড়ে লাল-হলুদ-নীল মরিচ বাতি জ্বলানিভা করছে। যীশু ও জামিল সাহেব আমাকে পরদিন সকালে এই বজরায় বাংলার গর্বের নদী মেঘনা ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানালেন। মনে মনে বলি, প্রিয় মেঘনা, রাতে আসার বেলা তোমাকে ভাল করে দেখতে পাইনি, কালকে দেখে নেবো তোমার বুকে কত ঢেউ, কত জল।

দূর নৌকায় আলো জ্বলছে, ভিতর থেকে বাজনার সুর ভেসে আসছে। মেঘনাপারের তরুণেরা বন্ধুবান্ধব মিলে বজরায় গান-বাজনা করে, তাস-পাশা খেলে কত যে চাঁদনী রাত পার করে, সে হিসাব কে রাখে। মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, নৌবিহার, পারে বসে হাওয়া খাওয়া, এই মেঘনাপারে সবই এক একটা আনন্দের উৎস। মেঘনার বিশাল নির্জন প্রকৃতি হতে মেঘনাপারের মানুষ তাই জীবনের প্রতিদিনের আনন্দ ও সুখ খোঁজে নেয়। চরদিঘলদীর মেঘনার শাখানদীর ঘাটে আমরা দুইদিনে তিনবার গোসল করি। সাঁতার কেটে ছোট নদী পার হই। নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া ট্রলার ও ইঞ্জিন নৌকার ঢেউয়ে দোল খাই।

নদীপারের চাঘরে বসে চা খাই। মেহমানের জন্য দোকানের মুরব্বী খাঁটি দুধের সর দিয়ে চিনিহীন মজার চা বানান, এই চায়ের বিল পাচ টাকা দেওয়ার সুযোগ আমার কখনও হল না। ছোটনদীর উপর সেতু, দুইপারে চরদিঘলদী বাজার। বাজার হতে ঔষধ কিনে নেই। কাছেই গ্রামের পাকা সুন্দর কবরগাহ। এখানে কাশবনের নিচে ঘুমিয়ে আছেন যীশুর জননী। পাশের খালের উপর একটি সদ্য নির্মিত সেতু সিরিয়ার যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভবনের মত ধ্বসে পড়েছে। কোন সিমেন্ট রড ছাড়াই সরকারের ঠিকাদার এই সেতুটি নির্মাণ করে সিংহ ভাগ অর্থ মেরে দেয়। উচু করে নির্মিত ঈদগাহ দেখি, এখানে ফলদার বৃক্ষ লাগানো হলে গ্রামবাসী উপকৃত হত।

চরদিঘলদী জনবহুল গ্রাম। অল্প জায়গায় অধিক মানুষ বসবাস করেন। ঘরগুলোর টিনের বেড়া ও টিনের ছাদ। জানালা ছোট। প্রতিটি বাড়িতে একটি ছোট ঘরে টিউবয়েল ও বাথরুম পাশাপাশি রয়েছে। এখানকার ভূগর্বে পানির কোন অভাব নেই। প্রতিটি পরিবারে আমার শৈশবের সিলেটের মত রয়েছে গরু, হাঁস, মোরগ ও কবুতরের খামার। আছে ফল ও শাকসবজির দুই চারটি গাছ।                                                                                   

সকালে নাস্তা করে চরদিঘলদী পশ্চিমপাড়া আদর্শ বন্ধুমহলের নৌবিহারে যোগ দিতে বের হই। মেঘনাঘাটে ক্লাবের সদস্যরা এসেছেন। সবাই জামিল সাহেবের আনা গ্যাঞ্জি পরেন। আমিও একটি কালো গ্যাঞ্জি পরে নেই। কিছু ছেলেরা কালো লুঙ্গি পরে। যীশু ও জামিল সাহেব এইসব ছেলেদের গুরুজন। আমি ঢাকা হতে আসা মেহমান। আমাদেরকে উপরে বসানো হয়। নিচে মাইকে সঙ্গীতের তালে তালে নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে উঠে ছেলেরা। প্রমোদ নৌকা মেঘনা ও শাখা নদী দিয়ে চরদিঘলদী বাজার ও পুরো গ্রাম ঘুরে আবার ঘাটে আসে। এবার আমাদের নৌকা প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ জাদুঘর ও পানামনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মেঘনার কিনারে কিনারে চলে নৌকা ভাটির দিকে বেয়ে যায়। মাঝনদীতে ঢেউ তুলে চলছে স্টিমার, জাহাজ, পণ্যবাহী ট্রলার, স্থুপাকার বাঁশের বড় ভেলা ও ইঞ্জিন নৌকা।

চরদিঘলদীর ট্রলার ব্যবসায়ী সাহাবউদ্দিন বসে আছেন পাশে। তিনি মেঘনাপারের এই গ্রামে থেকেই এই ব্যবসা চালান। তিনি একটি থেকে ব্যবসা করে এখন পাঁচটি ট্রলারের মালিক হয়েছেন। তার ট্রলার সিলেট বিভাগের সিমেন্ট, পাথর ও বালি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বহন করে নিয়ে যায়। বললেন, ব্যবসাটি খুব সহজ ও লাভজনক। সারা বছর ট্রিপ চলে, বছর দুয়েকের মধ্যে একটি ট্রলারের দাম বেরিয়ে আসে। এই ব্যবসায়ীর কিশোর পুত্র নৌকায় এসেছে। বললেন, ছেলেকে তিনি দেশের একজন সেরা ক্রিকেটার বানাতে চান।

ইবনে বতুতা মধ্যযুগে চট্টগ্রাম হতে হেঁটে হেঁটে সিলেট যান। এই তার সেই নহরে আজরকের নৌপথ, যে নদীপথ দিয়ে তিনি  দরবেশ শাহজালালের(রঃ) সাথে দেখা করে ১৩৪৬ সালে সিলেট হতে পুর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের দরবারে আসেন। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণকাহিনি ‘রিহলা’তে এই নদী ও নদীপারের বিবরণ দেন- এই নদীপারের মত এত সবুজ আমি মিশরের নীলনদের তীর ছাড়া আর কোথায়ও দেখিনি। এই মেঘনায় ইবনে বতুতা বঙ্গ সুলতান ফখরুদ্দিনের বিশাল শক্তিশালী নৌবহর দেখতে পান। সেই আমলে এখানকার লোকেরা সাগরে চলাচলের উপযোগী কাটের জাহাজ নির্মাণ করত। ইবনে বতুতা আর লিখেছেন পুরো বাংলার কতৃত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুলতান আলী শাহের সহিত ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের বিরোধ ছিল। শীতকালে পদাতিক বাহিনী নিয়ে আলী শাহ সোনারগাঁ আক্রমণ করতেন এবং বর্ষায় ফখরুদ্দিনের শক্তিশালী নৌবাহিনী আলী শাহকে তাড়া করত। ইবনে বতুতার মতে ফখরুদ্দিন শিক্ষিত ও জনদরদী শাসক ছিলেন। বজরা এখানে আসতেই মনে হল আমাদের নৌকা চৌদ্দ শতাব্দীর সার্বভৌম সুলতান ফখরুদ্দিনের মেঘনার নৌঘাঁটিতে এসে গেছি।

মধ্যযুগে চীনারা ভারত মহাসাগরকে বলত পশ্চিম সাগর এবং এই মহাসাগর পারের দেশগুলো তাদের কাছে ছিল পশ্চিমের দেশ। পশ্চিমের সাগর ও দেশসমুহের জরিপ ও মানচিত্র প্রণয়নের জন্য মিং চীনা সম্রাট বিখ্যাত খোজা নাবিক মাহুয়ানের নেতৃত্বে এক বিশাল নৌবহর পাঠান। চীন সম্রাটের দূত ও জরিপবিদ মাহুয়ান পশ্চিমসাগর জরিপ করে করে ১৪০৬ সালে সোনারগাঁর বিখ্যাত স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের দরবারে আসেন। মাহুয়ান ছিলেন একজন চীনা মুসলিম এবং আরবি, ফারসিসহ বহু ভাষা তিনি জানতেন। তিনি সে যুগের একজন হাজিও ছিলেন। তার বিবরণেও এই মেঘনানদী ও সোনারগাঁয়ের চিত্তাকর্ষক বিবরণ পাওয়া যায়।

মেঘনায় পশ্চিম হতে আসা একটি শাখানদী দিয়ে খানিক ঢুকেই সোনারগাঁ পৌরশহরের নৌকাঘাটে আমাদের বজরা নোঙর করে। তবে কি মাহুয়ান ছয় শত বছর আগে তার চীনা নাবিক দল নিয়ে এই ঘাটে আমাদের মত নোঙর করেছিলেন। তবে ঠিক এই ঘাটে না হলেও আশপাশে কোথাও তাঁরা অবতরণ করেছিলেন নিশ্চিত।

আমরা সবাই লেগুনা চড়ে ছুটে যাই পানামনগর ও সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর। এই দুই স্থাপনার বিবরণ আমার এই আত্মকথায় ইতোপূর্বে লিখে ফেলেছি। তাই চর্বিত চর্বণ হতে বিরত রইলাম। দুইঘন্টার মধ্যে ফিরে এসে আবার সোনারগাঁ পৌরঘাটে বজরায় উঠি। নৌকা মেঘনায় আসা মাত্র দুপুরের খাবার আয়োজন চলে। দু’তলায় আমরা সবাই লাইন ধরে খেতে বসি। চিকেন রোষ্ট, পোলাও, বিফ সবজি, মাছ সহ নানা মজাদার খাবার খেয়ে মেঘনার পশ্চিম পার ঘেষে উজান বেয়ে এগিয়ে যাই। এখানে মেঘনার পুর্বপারে কুমিল্লা ও পশ্চিমপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা। মেঘনাপারে বড়সড় জায়গা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এবং অনেকগুলো ফাঁকা ফাঁকা সুরম্য ভবন। নদীপার বরাবর রাস্থা, সি সি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা ঢালু পারে মেঘনার ঢেউ আছড়ে পরছে। মঝে মাঝে সিড়িকাটা ঘাট নেমে এসেছে। আসলেই জায়গাটা যেন ছোট খাট এক সমুদ্র সৈকত। লোকজন এখানে এসে বিশুদ্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামিল সাহেব এই মেঘনা বিচে নেমে ঢাকা চলে যান। রাতে এসে আমরা চরদিঘলদীর ঘাটে নামি।

পরদিন মেঘনার কিনারায় গোসল করে সকালবেলা আমরা একটি খোলা ইঞ্জিন নৌকায় উঠে চরদিঘলদী ছাড়ি। আবার মেঘনার বিশাল উত্তাল ঢেউয়ের বুক বেয়ে সাগর পারি দেই। নৌকার মাঝি যীশু ও তার ভাতিজা পলিটেকনিক ছাত্র ইভান ম ফয়সল। তাঁরা শক্ত হাতে হাল ধরে। আমি সামনে গুলইয়ে বসি। বাতাস ও ঢেউয়ে নৌকা দোলতে থাকে। ‘পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে/ মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে’। মেঘনা অনেকগুলো হাকালুকি ও টাঙ্গুয়া হবে। কিন্তু হাওরের মত প্রশান্ত নয়। মেঘনা অশান্ত চঞ্চল, তাই যখন তখন বিপদ হতে পারে। জলের ঘুর্ণী, প্রবল স্রোতের টান, ট্রলার কিংবা স্টিমারের ধাক্কা প্রাণহানি ঘটাতে একটুও সময় নেবেনা।

মেঘনার শাখানদী দিয়ে একটি জলভরা হাওরে যাই। জল থৈ থৈ করছে। পানিতে বালকের দল ঝাঁপ দিচ্ছে। সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। জলে অজস্র জালের ঘের তৈরি করে মানুষ মাছচাষ করছে। জেলেরা দলবেঁধে মাছ ধরছে। ট্রলার, জেলে নৌকা মুভ করছে। ‘দেশ হতে যাই দেশান্তরে, মনের নৌকা বেয়ে/ আমি মেঘনাপারের ছেলে, আমি মেঘনা নদীর নেয়ে’। মেঘনাপারের হাওর ও গ্রামের মানুষের জীবন সংগ্রামের চিত্র, আহা কি ছন্দময়।

বর্ষার সিলেটের ভাটি অঞ্চলের মত অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখে দেখে দুপুরে জলভরা হাওরপারের নজরপুর গ্রামে যীশুর শ্বশুরবাড়ির ঘাটে আমাদের নৌকা ভিড়ে। যীশুর পত্নী এলমা আব্দুল্লাহ ও কন্যা আরাধ্যা আব্দুল্লাহ সোহা ঘাটে এসে আমাদেরকে বরণ করেন। যীশুর শ্বশুর সৌদি আরবে ছিলেন, পাকাঘর ভাল আসবাবে সজ্জিত। গ্রামটি চরদিঘলদীর মত ঘনবসতি। তবে একটু সচ্ছল। এখানে পাশেই ঈদগাহ ও মসজিদ। বিকেলে নৌকায় করে রাস্থায় উঠে গাড়ি চড়ে বন্ধু শাহিন আহমদের গ্রাম করিমপুরের পাশ দিয়ে নরসিংদী যাই। যীশুর বাসায় খানিক ঘুমিয়ে রাতে নরসিংদী শহর ও রেলস্টেশন ঘুরে বেড়াই।

পূর্ণাঙ্গ কোরান শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী ভাই গিরি চন্দ্র সেনের বাড়ি ইচ্ছে থাকা সত্বেও সময়ের অভাবে যেতে পারিনি। এই শহর ছুঁয়ে বার বার ঢাকা-সিলেট আসা-যাওয়া করলেও এবার প্রথম নরসিংদীর মাটিতে পা রাখি। শহরটি আমার বেশ ভালই লাগে। পরদিন ভোরে রওয়ানা হয়ে ঢাকায় অফিস ধরি। এই দুইদিনে আমি নরসিংদী (সিংহপুরুষের এলাকা) এবং তার মেঘনাপারের চরাঞ্চলকে কাছে গিয়ে আপন করে নেই।                                                              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন