সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

প্রথম দেখা ময়মনসিংহঃ

 প্রথম দেখা ময়মনসিংহঃ                                                                                                                                                                              

 

ময়মনসিংহ বাংলাদেশের নতুন বিভাগীয় শহর। রাজধানী ঢাকার কাছেই এই শহর, অথচ কখনও দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে বাহিরে দু’পা ফেলিয়া। নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরীনের আত্মজীবনী ‘উতল হাওয়া’ গ্রন্থে ডুব সাঁতার কেটে ময়মনসিংহ শহর আমি অনেক অনেক আগে অন্তরের চোখে ভাসা ভাসা দেখেছি। তসলিমার বাসাবাড়ি, তাঁর বাবা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাঃ রজব আলী, পাঠ আদায়ে খুব কঠোর ও নিয়মানুবর্তী এই অধ্যাপক ছিলেন তাঁর ছাত্রদের গজব আলী স্যার। উতল হাওয়া আমাকে ময়মনসিংহ শহরের ডাঃ রজব আলীর বাসার একজন অশরীরী মেহমান করেছিল ক’বছর আগে। আমি বেশ মজা করে বইটি পড়ি। তসলিমার ছোটবোন ইয়াসমিনের কাল্পনিক জন্মদিন পালনের জন্য চুলায় খড়ি ঠেলা মা ও মেয়ের আবদারে বিরক্ত অধ্যাপক ডাঃ রজব আলীর উক্তি- ‘আজাইরা ফুর্তি ফার্তা বাদ দেও। মেয়ে নাচে, সাথে দেখি মাও নাচে। যত্তসব বান্দরের নাচ’। কিংবা তসলিমার ছোটদার উক্তি- ‘কুড়িটা বসন্ত পার হয়ে গেল, কোনও কোকিল তো দূরের কথা, একটা কাকও ডাকল না। আজও ভূলিনি।

আমার পাঠ্য বিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের রম্যরচনা ‘আয়না’ ও তাঁর আত্মকথন ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বই দু’টির পটভূমিও এই ময়মনসিংহ শহর ও তাঁর আশপাশ হাইস্কুল জীবনে ‘আয়না’ পড়তাম, আর একা একা হাসতাম। এক সময় দৈনিক সিলেটের ডাকে ধারাবাহিক প্রকাশিত ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ পড়ে পড়ে  ময়মনসিংহ অঞ্চল আমার মননে গেঁথে যায়।

ধানমন্ডির নির্জন নিবাসে বসে ঠিক করি এবার বাস্তব ময়মনসিংহ দেখে নেবো ঝটিকা বেগে, কোনও ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারে। যেইমাত্র ভাবন, সেইমাত্র বাস্তবায়ন। সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশুকে বললাম, আগামী ছুটির দুইদিন ময়মনসিংহ চরে বেড়াবো। যীশু বলল, আলবৎ স্যার, আমি তিস্তা এক্সপ্রেসের টিকেট কাটছি। পূবালী ব্যাংকের ময়মনসিংহ অঞ্চলপ্রধান শফিউল হাসান চৌধুরী ডিজিএম সিলেটে আমার সহকর্মী ছিলেন। তাঁকে ফোন দিলাম, আমি কখনও ময়মনসিংহ দেখিনি, আগামী শুক্রবার ময়মনসিংহ আসছি। শফিউল হাসান বললেন, কুরেশি ভাই কোন চিন্তা নেই, আমার বাসায় চলে আসেন। বললাম, না তোমার বাসায় যাব বটে, তবে উঠবো না। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস শাখার ব্যবস্থাপক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউস বুকিং করেছেন, আমাদের জন্য কেবল একটা গাড়ি বরাদ্ধ দিলেই চলবে।

৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার। টিকেট কাটা শেষ, ট্রেন ছাড়বে সকাল ৭ টায়। ট্রেন ধরার তাড়ায় ভোর ৪ টায় ঘুম পালায়। ধানমন্ডির বাসাকর্মী সুমন আজ বাসায় নেই, সে সিলেটে। ঠান্ডা ভোরে ধানমণ্ডি লেকপার্ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে কলাবাগান আসি। কমলাপুর রেলস্টেশন এসে যাই বেশ আগে।

সহযাত্রী যীশুর বসত সরদার কলোনি। কমলাপুর রেলস্টেশন ও টার্মিনালের একজন দুর্দান্ত কুলি সরদার স্বাধীনতার পরপরই পাশেই বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। আজ কুলি সরদারের ছেলেরা এই ভবনগুলোর মালিক। মতিঝিলের অফিসে অফিসে ভাসমান চাকুরিজীবীরা এসব সরদার কলোনির ভাড়াটিয়া।

ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যে যীশু এসে হাজির। তিস্তা এক্সপ্রেসের শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত কম্পার্টমেন্ট, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। অনেকদিন পর ট্রেনে চড়ি। যাত্রীরা সবাই ফিটফাট। ঝিকির ঝিকির ময়মনসিং, ঝিকির ঝিকির ময়মনসিং, জপে জপে ট্রেন ময়মনসিংহ পানে ছুটে। ট্রেন ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে জয়দেবপুর যায়। জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে বাহিরে তাকাই, কারণ এই রাস্থা দিয়ে আমি এই প্রথম যাচ্ছি। জয়দেবপুর পার হয়ে একটি সুন্দর শালবনে ট্রেন ঢুকে যায়। মধুপুর ভাওয়ালের বন, বাংলাদেশ বনবিভাগের মালিকানাধীন অরণ্য জায়গাটা সিলেট, সিলেট লাগছে। শাল, সেগুন, করই, শিরিষসহ নানাজাতের বৃক্ষের সমারুহ। উঁচু মাটির ঢিবিতে ঢিবিতে বনভূমি, বনের ফাঁকে ফাঁকে জলাভূমি। সাদা বকের ঝাঁক, মাছরাঙ্গা জলে ঢুপ মারছে। জনমানবহীন এই বনভূমি পার হতে তিস্তা এক্সপ্রেসের প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যায়।

মধুপুর বনভুমির শেষপ্রান্তে গফরগাঁও রেলস্টেশনে গাড়ি থামল। একজন যাত্রী বললেন, গফরগাঁও ভেজাইল্যা জায়গা। এখানকার এমপি থেকে শুরু করে একজন বাচ্চাও ভেজাইল্যা। এমপি শখের বসে ডানে বামে পিস্তলের গুলী ছুঁড়ে, পাগলটা একজন বালককে গুলিবিদ্ধ করে। বালকেরা চটে গেলে ট্রেন ছেড়ে দেয়ামাত্র ইস্টক বর্ষণ করে সব জানালা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। বেপরওয়া জনতার মুলুক গফরগাঁও ছেড়ে খানিকপর ট্রেন আউলিয়াগঞ্জ স্টেশনে আসে। চট্টগ্রামের মাস্তাননগর স্টেশনের কথা মনে হল, চট্টগ্রামী ‘মাস্তাননগর’ শব্দের ময়মনসিংহী প্রতিশব্দই ‘আউলিয়াগঞ্জ’। সিলেটি অনুবাদ হবে পিরেরবাজার, পীরগঞ্জ কিংবা অলিগঞ্জ। সকাল ১০টায় ট্রেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে যায়। ঢাকা হতে মাত্র তিনঘন্টার এক আরামদায়ক ভ্রমণের পর ময়মনসিংহ এসে গেলাম।

পূবালী ব্যাংকের ড্রাইভার রইস উদ্দিন বেশ দায়িত্ববান, তিনি গাড়ি নিয়ে সকাল ৯টা হতে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে মেহমানদের আগমনের অপেক্ষায় আছেন। ময়মনসিংস্টেশনে আরেকজন ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন, তিনি যীশুর বন্ধু ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও পূবালী ব্যাংকের ক্লায়েন্ট সৈকত হায়াত। সৈকত হায়াত আমাদেরকে নিয়ে সহজেই ছোট্ট শহর ময়মনসিংহ ঘুরে দেখান। সামনে একটি বহুতল ভবন দেখিয়ে বললেন, এখানে তসলিমা নাসরিনের বাবা ডাঃ রজব আলীর চেম্বার ছিল, তখন এই বহুতল ভবন ছিলনা। যীশু লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বাড়ি দেখতে চাইলে সৈকত হায়াত বললেন, অনেক অনেক দিন আগে বাসাটি উম্মুক্ত জনতা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে। উতল হাওয়ার অধ্যাপক ডাঃ রজব আলীর সেই বাড়ির অস্তিত্ব এখন আর  নেই।

পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী ছিলেন প্রতিথযশা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদতাঁর টিনের পাকা পুরানো সাদামাটা বাড়িতে দেখলাম চুনকাম নেই, কেমন যেন বিবর্ণ। শান্তিপাড়া ও ব্যবসাকেন্দ্র ঘুরে দেখি। সৈকত হায়াত আমাদেরকে ময়মনসিংহ শহরের বিশেষ মিষ্টান্ন দোকানে নিয়ে যান। ময়মনসিংহের সুপ্রসিদ্ধ মিষ্টি ও দৈ খেতে বাধ্য হলাম, ডায়বেটিসের দোহাই দিয়েও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেলাম না। সৈকত হায়াতের গ্যাসের দোকানও দেখা হল। রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের শ্বশুরবাড়ি সুন্দরমহলের সামনে গাড়ি থামে। সৈকত হায়াত বললেন রওশন এরশাদের বাপের বাসা সুন্দরমহল একসময় হিন্দু জমিদার বাড়ি ছিল। হ্যাঁ, বাড়ির বৃটিশ আমলের নির্মাণশৈলী দেখে তাই মনে হ   

গাড়ি হতে নেমে সুন্দরমহল দেখছি, এমন সময় ড্রাইভার রইস উদ্দিন বললেন, এই বহুতল ভবনে ডিজিএম স্যারের বাসা। এই ডিজিএম স্যার আমার সিলেট শাখার দীর্ঘদিনের সহকর্মী চৌধুরী শফিউল হাসান সাকিল। যীশুকে বললাম, ময়মনসিংহ এসেছি, এককালের প্রিয় সহকর্মী চৌধুরী শফিউল হাসান এখন ময়মনসিংহ অঞ্চল প্রধান, তাকে অবশ্যই এক নজর দেখে যেতে হবে। শফিউলকে ফোন দিতেই সাড়া পাই, কুরেশী ভাই, তিনতলায় চলে আসুন। ২০১৫ সালে সিলেট ছাড়ার পর কয়েক বছর চলে গেছে, শফিউল হাসানের দেখা পাইনি। ক্লিনসেভ স্মার্ট শফিউল হাসানের গালভরা কালো দাড়ি এই প্রথম দেখি। সুদর্শন ফর্সা হাসানকে দাড়িতে বেশ ভালই মানায়। তাঁকে প্রশান্ত লাগছে, সে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা সহধর্মিনী সাবিহা আফ্রিন  ও দুই পুত্রকন্যা নিয়ে সুখেই আছে।

চৌধুরী শফিউল হাসানের পত্নী সাবিহা আফ্রিন চৌধুরী শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এসোসিয়েট প্রফেসর। পুত্র আয়মন হাসান চৌধুরী এবং কন্যা রাবিয়া নেফারতিতি হাসান ময়মনসিংহ শহরে লেখাপড়া করছে। করোনায় ভয়ে সবার জন্য ঘরের বাহির নিষিদ্ধ, সেলুনে যাওয়া বন্ধ, তাই অনেকেই দাড়ি রেখে দেন। কেউ কেউ চুল লম্বা রাখেন, নিজে আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল কাটেন, কাজের লোকও কেটে দেয়। আরেক য়ে সবাই অস্থির, আল্লাহ না করুক যদি করোনার যমদূত এসে ঘাড় ধরে আল্লারবাড়ি টেনে নিয়ে যায়, তবে সেখানে আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত দাড়ি ছাড়াই গিয়ে হাজির হওয়া কি শোভা পায়।

চৌধুরী শফিউল হাসানের বেগম সাহেবা পি এইচ ডি করছেন, তাই তিন বছরের জন্য রিলাক্সে আছেন। আমরা চানাস্তা করে প্রায় অর্ধঘন্টা এই বাসায় কাটালাম। শফিউল হাসানের বাবা সদরুল হাসান চৌধুরী ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তাই শফিউলের শৈশব ও কৈশর এই ময়মনসিংহ শহরে কাটে। এখান থেকে বদলি হয়ে এক সময় সিলেট সরকারি কলেজ যান। এসোসিয়েট প্রফেসর সদরুল হাসান চৌধুরী সিলেটে থাকাকালে অল্প বয়সে মারা যান। চৌধুরী সফিউল হাসানের বাসায় সবাই মিলে ফটো উঠাই, তারপর বেরিয়ে আসি।        

সৈকত হায়াত বললেন, বৃটিশামলে ময়মনসিংহ ছিল বড় বড় হিন্দু জমিদারদের শহর। তিনি বিখ্যাত জমিদারবাড়ি শশীলজে আমাদেরকে নিয়ে যান। শশীলজ উঁচু দেয়ালঘেরা নয় একর জায়গা জুড়ে বিরাট প্রাচীন জমিদার বাড়ি। মুক্তাগাছার জমিদার নিঃসন্থান মহারাজা  সুর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী তার দত্তক পুত্র শশীকান্তের নামে বিলাসবহুল দুতলা ভবনশশীলজ নির্মা করেন। মহারাজার নিজের কোন সন্থান নেই, তাতে কি? তিনি পরের পোলা পুষে তাঁর নামে এই রাজকীয় অট্টালিকা বানান। মহারাজা সূর্যকান্ত পরবৃক্ষের বাকল ভালভাবেই নিজ গায়ে জড়ান। এই শশীলজ মহারাজার ইউরোপ ও দেশবিদেশ হতে সংগৃহীত নানা সৌকিন উপকর দিয়ে সুসজ্জিত। বর্তমানে এই ভবনটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পুরাকীর্তি হিসাবে সংরক্ষিত আছে। শশীলজ বাংলাদেশে বৃটিশ স্থাপত্যকলায় নির্মিত এক ঐতিহাসিক নিদর্শন চুনসুরকির প্রশস্ত দেয়ালে নির্মিত রঙ্গিন কাঁচ, মার্বেল পাথর, স্নানাগার সজ্জিত দ্বিতল ভবন। আজ শুক্রবার, শশীলজ বন্ধ। আমরা দারোয়ানকে অনুরোধ করে গেটের ভিতর ঢূকি। সামনের বাগানে বেশকিছু ছবি তুলে নেই।   

আনন্দ মোহন কলেজ দেখতে গেলাম, এখানকার আয়তাকার তিনসারি দু’তলা ভবনসমূহ বৃটিশ স্থাপত্যকলার সৌন্দর্য্য প্রকাশ করছে। কলেজের পিছন দিকে আছে এযুগে নির্মিত অনেকগুলো পাকা ঢালাই ভবন। তখন জুম্মার জামাতের ডাক পড়ে। আমার কাছের মসজিদে ঢুকে যাই।

এবার ব্রহ্মপুত্র নদের পারে একটি বড়সড় পার্কে প্রবেশ করি। নদের পার দিয়ে পার্কে হাঁটছি। আগে এই নদপারে সুন্দর কাশবন ছিল, ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল বাতাস তাতে ঢেউ খেলতো। মানুষ কাশের নাচন দেখতে আসত। এখন ব্রহ্মপুত্র সে অপরূপ কাশবন নেই। এই পার্কের বৃক্ষমালা ও নদপারের হাওয়াখানা জনতাকে বিরাম দেয়। ডায়বেটিস রোগীদের জন্য পার্কটি একটি আদর্শ হাঁটার জায়গা। ব্রহ্মপুত্র একটি নদ, বিস্তারে ডাবল সুরমানদী হবে নিশ্চিত। যীশু বলল, আমাদের গ্রামের মেঘনা একজন মহিলা, তাই তিনি নদী, কিন্তু এই সামনের ব্রহ্মপুত্র যে নদ, একজন পুরুষ। আমি সাথীদেরে বললাম, ব্রহ্মপুত্র যে একজন পুরুষ তাঁর প্রমাণ কি? সৈকত হায়াত বেশ ভাবনায় পড়লেন। নদী তো প্রাকৃতিক জড় মাল, এই জড় মাল আবার নারী (নদী) কিংবা পুরুষ (নদ) হয় কেমন করে? তিনি ব্রহ্মপুত্রের দিকে ভাল করে তাকান তাঁর কোন পুরুষাঙ্গের দেখা মেলে কিনা। কিন্তু কোন প্রমাণ তাঁর চোখে ধরা পড়ল না। যীশুও কোন কারণ বের করতে পারল না। আমি বললাম, এটা নামকরণের কারসাজি। যখনই কোন স্রোতশ্মিনীর নাম স্ত্রী-বাচক নামে রাখা হয়, তা নারীগোত্রীয় ‘নদী’ হয়ে যায়, পুরূষবাচকরা হয় পুংগোত্রীয় ‘নদ’।

বললাম সিলেটে আমার জানামতে মাত্র দুইটি নদ আছে মনু ও মহাসিং, বাকীরা সবই নদী। তবে সিলেটের মানুষ ‘নদ’ শব্দ কখনও উচ্চারণ করেনা। তাঁদের ভাষায় নদ এবং নদী সবাই বেটি মানুষ ‘নদী’, কেউ বেটা নেই।

এবার প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশে সবগুলোই নদী, নদ সংখ্যা এত কম কেন? জবাব দেই এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। এটাও পুরুষতন্ত্রের কারুকাজ। প্রাচীনকালে পুরুষরা ছিল সর্বেসর্বা এবং নারীরা তাঁদের অধীনস্ত শখের ধন। স্নেহের প্রিয়ধনদের নামে তাঁরা তটিনীদের নাম রাখে, তাই বাংলাদেশে এত নদী আর নদী, নদ হাতেগুণা দু’চারজন মাত্র। ঢাকা হতে প্রতি শুক্রবারে ইংলিশ শেখাতে যাওয়া একজন টফেল টিচারের সাথেও এই পার্কের নদপারে দেখা হল।

পার্ক হতে নদতীর দিয়ে বেরুতেই শিল্পাচার্য্য জয়নাল আবেদীনের এক বিশাল ভাস্কর্য্য, তাঁর মস্তক মস্ত বড় ডিম্বাকার, প্রায় ৩ফুট x ৪ফুট। পাশেই নদপারে জয়নাল আবেদীন সংগ্রহশালা। এই বিশাল পার্কের কাছেই সরকারি আমলাদের বাসভবন ‘সাহেব কোয়ার্টার’ ও অফিসার্স ক্লাব। এই শহরের বড় বড় সরকারি হর্তাকর্তারা এখানেই এই সুরম্য পরিবেশে পরিবার পরিজন নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের হাওয়া খেয়ে খেয়ে আরামে দিন কাটান।                                                              

রইস উদ্দিন এবার গাড়ি চালিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানে ছুটেন। বাগানঘেরা একটি রেস্ট হাউসে ঢুকে বুকিং খোঁজে পাওয়া গেলনা। ফোন আসে এই রেস্টহাউস নয়, আমাদেরকে নবনির্মিত বিনা আবাসিক এলাকার রেস্ট হাউসে যেতে হবে। এই বিনা (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার এগ্রিকাচার) রেস্টহাউস বাগানঘেরা নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত। রেস্টহাউস কর্মী তাজুল ইসলাম আমাদেরকে দু’তলার একটি দুইবেডের কক্ষের চাবি দেন। তিনি মর্টিন স্প্রে করে দেন ফলে রাতে মশারী লাগেনি। ব্রিজারে পানি গরম করে আমরা দুজনে স্নান করি। আচমকা গড় গড় শব্দে রেস্টহাউস কেঁপে উঠে। পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি পাশ দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।

বিকেলে ক্যাম্পাসে ঘুরতে বের হই। হল, বাগান, অনুষদ ইত্যাদি ঘুরে রাত হয়ে যায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবে যাই। দুইজন পত্রিকা প্রতিনিধি ছাত্র মনযোগ দিয়ে লেখালেখির কাজ করছেন। তাঁরা আমাদেরকে তেমন গুরুত্ব দেন নি। আমরা পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের লোক। আমাদের মাধ্যমে এই প্রেসক্লাব বিভিন্ন সময় অনেক অনুদান পেয়েছে।  খানিকক্ষণ পর তাঁদের নেতা আসেন। তিনি এসে আমাদেরকে খুব সাদরে গ্রহণ করেন। সবার কাজকাম বন্ধ করে আমাদেরকে নিয়ে বসেন। আর কয়েকজন প্রেসক্লাব সদস্যকে ডেকে আনেন।  চানাস্তা আসে, তাঁদের দুই বছরের ম্যাগাজিন উপহার আসে। ফটোসেশন হয়।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বিশাল, এত জায়গা খুবসম্ভব বাংলাদেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গার পরিমান ৪.৮৫ বর্গকিলোমিটার। সক্রিয় জায়গা ১৩০০ একর, ভিতরে অবারিত খালি জায়গা। ১৯৬১ সালে এই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভোধন হয়। একজন মুরব্বী জানালেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে একজন সিলেটির অবদান অবস্মরণীয়, তিনি রনকেলী গ্রামের ডঃ এস ডি চৌধুরী, যিনি খান বাহাদুর মাহমুদ চৌধুরীর সন্থান। খান বাহাদুর মাহমুদ চৌধুরীর নামেই গোলাপগঞ্জের বিদ্যাপিঠ এম সি একাডেমি। ডঃ এস ডি চৌধুরী ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাফল্যের সাথে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চেন্সেলারের দায়িত্ব পালন করেন। আমি বেশ গর্বানুভব করলাম, ডঃ এস ডি চৌধুরী যে আমার ছোট সমন্দি আজিজ চৌধুরীর চাচা শ্বশুর।  

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাগানচর্চার জন্য বেশুমার অর্থ বরাদ্ধ করা হয়। সারাটা ক্যাম্পাস নানাজাতের বৃক্ষলতায় ছেয়ে আসে। যেদিকে তাকানো যায় রঙবেরঙ্গের ফুল আর ফুল, গাছ আর গাছ। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস শাখায় যাই। ক্যাম্পাস শাখার আশপাশ ঘুরে দেখি। মসজিদ, বাগান, স্মৃতিসৌধ, ছাত্রাবাস, সোহরাওয়ার্দী মিলনায়তন অপরূপ। পূবালীর ক্যাম্পাস শাখাটি যেন এক স্বর্গোদ্যান প্রাসাদে রয়েছে। শাখায় আছেন একজন পঙ্গু প্রহরী ফিরোজ আলী, তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় খোঁড়া হয়ে যান। আমরা শাখায় ঢুকি। গার্ড ফিরোজ আলী প্রাক্তন ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলামের প্রশংসা করে বললেন, স্যার খুব ভাল মানুষ, এক্সিডেন্টের পর তিনি ব্যাংক হতে সাহায্য না করলে পায়ের চিকিৎসা হতনা। ব্যবস্থাপক তালিকায় আমার দু’জন বস আবু হাবিব খায়রুল কবির, জগতচন্দ্র সাহা ও আরিফ রাব্বানীর নাম পাই। কয়েকজন ব্যবস্থাপকের নামের আগে ‘কৃষিবিদ’ শব্দটি সংযুক্ত আছে। তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং কৃষিপেশার বদলে তাঁরা ব্যাংকিং পেশায় যোগদেন।

নামের আগে ‘কৃষিবিদ’ লেখার কারণ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে জানান দেয়া- আমি তোমাদেরই লোক।

তিনি কৃষিবিদ উজ্জল কুমার সাহা। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে হন পুবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। এখন পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, ময়মনসিংহ প্রধানশাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক। উজ্জ্বল শ্যামলা মেদহীন তনু একজন মেধাবী বুদ্ধিমান মানব উজ্জল কুমার সাহা। হ্যাঁ, এসব মেধাবীরা পুবালী ব্যাংককে বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার যুদ্ধমাঠে সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

রাতে এসে তিনি আমরা দুজনকে ময়মনসিংহ শাখায় নিয়ে যান। তাঁর শাখায় বসেই আবার চোখ বুলাই ব্যবস্থাপক তালিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শাখার প্রায় সকল ব্যবস্থাপকের পদোন্নতি পেলেই পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারিত হয় ময়মনসিংহ শাখা। আমার ঘনিষ্ঠজন আবু হাবিব খায়রুল কবির, জগত চন্দ্র সাহা, আরিফ রাব্বানী ও উজ্জ্বল কুমার সাহা সবাই এই একই রুটে এসে ময়মনসিংহ শাখার ব্যবস্থাপক হন। উজ্জ্বল কুমার সাহা আমাদেরকে পাশের গ্রিনপার্ক হোটেলে নিয়ে যান। একটি ভবনের ছাদে স্থানীয় ঐতিহ্যে সাজানো হোটেল, সামনে জলফোয়ারা ও জলাধারে একুরিয়াম-ফিসের বিচরণ। রেস্টুরেন্টটি ময়মনসিংহকে তুলে ধরছে। উজ্জ্বল সাহার হেভি নাস্তা ও কফিতে সেইরাতে ডিনার সমাপ্ত হয়।                        

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল। বসন্তের ভোর। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত ক্যাম্পাস। রোদ নেই, কোয়াশা ভিজিয়ে দিচ্ছে ফুলের পাপড়ি, সতেজ পাতার ধূলা ধুয়ে নিয়ে টপ করে ঝরে পড়ছে শিশির বিন্দু। আমি ও যীশু ভোরের আলোয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে বেরিয়ে যাই। ভিসি বাংলা পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার, দেশী বিদেশী বৃক্ষপল্লী হরিক্যালচার পার্ক, স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখি। শিক্ষকদের নিরিবিলি আবাসিক এলাকার ঢুকে মনে হল আমেরিকার কোন জনপদে হাঁটছি। পাখির কুজনে মুখরিত পুরো ক্যাম্পাস। কমছে কম দুই মাইল হাঁটি। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের গাইড হন ক্যাম্পাস শাখার খোঁড়া গার্ড ফিরোজ আলী। শিক্ষকদের নিরিবিলি আবাসিক এলাকার ঢুকে মনে হল আমেরিকার কোন জনপদে হাঁটছি। পাখির কুজনে মুখরিত পুরো ক্যাম্পাস।

আমরা তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চাস্টলে ব্রেকফাস্ট করি। আল মামুন একজন গরিব কিশোর। সে এই হোটেল কর্মী এবং আমাদেরকে নাস্তা পরিবেশন করে। হোটেল মালিক মামুনকে দ্রুত কাজ সেরে খেয়ে পড়তে যেতে তাগদা দিচ্ছেন। সাধারণত মালিকেরা কর্মচারীদেরকে সহজে ছাড়তে চায়না, যতক্ষণ সম্ভব বেশি খাটাতে চায়। কিন্তু এখানে উলটো চলে যাবার তাগদা দিচ্ছে দেখে আমরা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাই সে কোথায় যাবে। হোটেল মালিক বললেন, আল মামুন একজন এতিম কিশোর, বাড়ি নেত্রকোনা। তাঁর মাতা ও এক বোন। বাবা না থাকায় মামুনের এই আয়ে সংসার চলে। সে চাস্টলে কাজ করে স্থানীয় ঈশ্বরগঞ্জ বারহিত উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। খুব ভাল রেজাল্ট করে, তাই শিক্ষকরা তাঁকে সহায়তা করেন। হোটেল মালিক বললেন, আমরা স্কুলের সময় হলে তাঁকে ক্লাস করার জন্য ছেড়ে দেই। সংসারের হাল ধরার কেউ না থাকলেও পড়াশুনায় মামুনের আগ্রহ দেখে আমরা বিষ্মিত হই। মনে মনে ভাবি আমাদের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের সাথে আল মামুনের শৈশব যেন একই রেখায় মিলে গেছে। মামুন স্বপ্ন দেখে বড় হবে, বোনের বিয়ে দিবে, মায়ের দুঃখ মুছে দিবে। জীবন সংগ্রামের কাহিনি শুনে আমি তাঁর দিকে ৫০০ টাকার একটি নোট এগিয়ে দেই। সে নিতে চায়নি। বললাম তোমার লেখাপড়ার কাজে লাগাবে। এবার খুশী হয়ে হাতে তুলে নেয়।

রেস্টহাউসে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা কেবিন ছাড়ার প্রস্তুতি নেই। বিনা রেস্টহাউসের বুড়ো কেয়ারটেকার তাজুল ইসলাম চাঁদপুরের লোক, বললেন এই রেস্টহাউসে অনেক ভিনদেশীরা আসেন। দীর্ঘসময় এখানে অবস্থান করে তাঁরা গবেষণা কাজ করেন। নিজেরা পি এইচ ডি করেন, আবার অনেক দেশীবিদেশী মনিষীরা পি এইচ ডি গবেষণারত শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে আসেন। আমাদের কাছ হতে বখশিশ পাবার আশায় তিনি এসব বিদেশী ও বিদেশিনীদের কাছ থেকে মোবাইল সেটসহ নানা উপহার পাবার গল্প শুনান। তাঁর গল্প শুনে মনে মনে ভাবছি তাঁকে কত বখশিশ দেবো। এমন সময় কি যেন এক দরকারে তাঁকে দুইশত টাকা দেই। ফিরে এসে শুনালেন ১৪০টাকা খরচ হয়েছে, তিনি বাকি ৬০টাকা ফিরিয়ে না দিয়ে আমতা আমতা করছেন। তাঁর ভাবনা এই ৬০টাকা যদি বখশিশ পেয়ে যান। আমি তাঁকে ২০০টাকা বখশিশ দিতে ইতিমধ্যে মনস্থির করেছি, কিন্তু মাত্র এই ৬০টাকা ছাড় দিতেই তিনি আনন্দে আত্মহারা। তাঁর চাহিদার মাত্রা বুঝে ফেলি। তাঁকে খুশীতে আটকানা অবস্থা দেখে ভাবলাম এতটুকুতেই তিনি ১০০% সন্তুষ্ট, তাই দুইশত টাকা বখশিশ দিয়ে আর ১৪০ টাকা খোয়ানোর দরকার কি? এই ৬০ টাকাই যথেষ্ট।

তখনি একজন বিখ্যাত ফরাসি লেখকের কাহিনি মনে পড়ে গেল। তিনি প্যারিসের এক বস্তি এলাকায় বসবাস করতেন। তাঁর উন্নত পান্ডুলিপি পড়ে একজন প্রকাশক প্রচুর রয়েলিটি মানি নিয়ে লেখকের ঠিকানায় রওয়ানা হন। ঘিঞ্জি বস্তিতে ঢুকতেই প্রকাশকের মনে হল এই নোংরা বস্তিবাসী লেখককে এত টাকা না দিলেও চলে। তিনি বান্ডিল হতে অর্ধেক টাকা সরিয়ে নেন। লেখকের বাসায় ঢুকে দেখেন সবকিছু এলোমেলো অগুছালো। ভাঙ্গা চেয়ারের বসতেই ম্যাচম্যাচ করে ওঠে আসন। এবার ভাবলেন নাহ, এই এত ফতুর লেখককে এত টাকা দেবার দরকার নেই, অর্ধেকের অর্ধেক দিলেই যথেষ্ট। লেখক চানাস্তা আনতে আড়ালে গেলে প্রকাশক খাম খোলে আর অর্ধেক টাকা সরিয়ে নেন। কোয়ার্টার রয়েলিটি মানি হাতে দিতেই লেখক দারুণ খুশি হয়ে বললেন, ধন্যবাদ প্রকাশক ভাই, আপনি বড় কষ্ট করে এত টাকা নিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত ছুটে এসেছেন, এতএত বদান্যতা না দেখালেও হত, তাঁর চেয়ে আমাকে একটা ডাক দিলেই আপনার অফিসে গিয়ে টাকাগুলো নিয়ে আসতাম। প্রকাশক এবার সহাস্যে জবাব দেন, লেখক ভাই আপনি বড়ই ভাগ্যবান, আমি যে অনেক খোঁজে বাসা বের করে আপনার মেহমান হতে পেরেছি। আপনার বাসায় আসায় জরিমানা চার আনা, না এলে নিশ্চিত ছিল ষোল আনা।              

চালক রইস উদ্দিন সময়ের আগে এসে রেস্টহাউসে হাজির। ময়মনসিংহ শাখায় গিয়ে হালুয়াঘাট স্থলবন্দর দেখতে ছুটি। পথে পথে ময়মনসিংহের রূপালি বিপ্লব চোখে পড়ে। নানা আয়তনের মৎস্যখামারে পুরো এলাকা ছেয়ে আছে। পুকুরের সাথে পুকুর, দিঘির সাথে দিঘি। একরের পর একর জুড়ে মৎস্যক্ষেত। পুকুরের পারে পারে রবিশস্যের মেলা। ঋণ আদায়ের তাগদা দিতে ব্যবস্থাপক উজ্জল সাহা একজন ধনী মৎস্য খামারীর বাড়িতে যান। চারপাশে অসংখ্য পুকুরঘেরা বাড়ি। পাকা টিনের ঘর। বাড়িতে টিভি ফ্রিজ সব আছে। সোফাসেট বেশ দামী। সামনে মোটর সাইকেল। নিরিবিলি বাড়িতে অবারিত আলো-বাতাস। ভদ্রলোক ঘরের পিছনে হাঁস-মোরগ ও বিদেশী গরুর খামার ঘুরে দেখান। বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আঙ্গুলের তর্জনী তুলে সামনের অনেকগুলো পুকুর দেখিয়ে বললেন সামনের ২০ একর জায়গাজুড়ে সব আমার মৎস্য খামার, মহাদুঃখে বললেন, টাকার অভাবে ফিসফিড বন্ধ, মাছকে কেবল গোখামারের গোবর খেতে দিচ্ছি। মাছ বিক্রি হলেই ঋণ পরিশোধ করে দেবো। আসলেই তিনি একজন সৌকিন খামারি।

এখানে ভাল নাস্তা হল, খামারের দুধ, পেঁপে থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের নানাপদের সন্দেশ পিঠা। বের হবার সময় উজ্জ্বল বাবু ভাবীজানকে একনজর দেখার আবদার জানিয়ে বললেন, ভাবী সাহেবা এত এত নাস্তা বানিয়ে আমাদেরকে পরিবেশন করেছেন, তাঁকে আশির্বাদ না জানিয়ে আমরা কেমন করে যাই। ঘোমটা টেনে ফর্সা পৌঢ় ভাবীজান এলেন। আমাদের আশির্বাদ পেয়ে ধন্য হলেন।     

ভদ্রলোককে বললাম, আমরা ব্যাংকের হেডঅফিসের লোক। ঋণ আদায়ের জন্য ঢাকা হতে এসেছি। ভদ্রলোক ইশারায় বুঝালেন এলাকায় তাঁর যথেষ্ট সম্মান আছে। মেয়েজামাই আর্মির মেজর। আমরা যে ঋণের তাগদায় তাঁর বাড়ি এসেছি তা আশপাশের কেউ জানলে, এমন কি বাড়ির চাকর জানলেও লজ্জার কারণ হবে। তাই বেশ সতর্কতার সাথে তিনি ময়মনসিংহী ভাষায় ফিস ফিস করলেন, যেন পাছে লোকে কিছু না শুনে।

ভদ্রলোক মস্যচাষী, তাঁর ধারণা গরুর গোবর সরাসরি মাছে খায়। গাড়িতে বসে বললাম, তাঁকে দিয়ে মাছচাষ কি করে হবে, মাছের নাস্তা কি, সেই জ্ঞানটুকু যে তাঁর নেই। লোক কেন পুকুরে গোবর দেয়? কেউ জানতে চাইলে বলি, গোবর পানিতে সবুজ প্লাঙ্ক(শেওলা) তৈরি করে। এই প্লাঙ্ক(শেওলা) মাছের খাবার। কৃষিবিদ উজ্জ্বল সাহা হাসলেন। এবার উজ্জ্বল বাবু ভাবী সাহেবাকে ডেকে এনে সালাম দানের ফজিলত বয়ান করলেন। ধনবান পতিসাহেব ব্যাংকের টাকা ধার নিয়ে দিচ্ছেন না, ব্যাংকের টাকা গাইয়া ঘির কোরমা পোলাও খাচ্ছেন, সেই খবরটা আসল জায়গায় পৌঁছে দিলাম। এ এমন এক জায়গা, যার ঠেলা বীরবিক্রমরাও সইতে পারেন না। এবার খবর আছে, সাহেবের হাতে টাকা দেখলেই ভাবীজান ধাক্কা মারবেন, যাও ব্যাংকের টাকা জলদি দিয়ে এসো, আগে ইজ্জত বাঁচাও।

পথে একটি বাজারে গাড়ি থামিয়ে উজ্জ্বল কুমার সাহা একটি মূল্যবান বন্ধকি জমি ফিতা টেনে জরিপ করেন। পাশের ইউনিয়ন অফিস থেকে চেয়ার আসে। আমরা বসে বসে এক মজার করুণ ট্রাজেডি দেখি। এই জায়গা ব্যাংকে বন্ধক রেখে এক দোলাভাই উদাও। শালাশালীরা দেখছে বাজারসংলগ্ন তাঁদের মূল্যবান পৈত্রিক জমি কোর্টের আদেশে নিলামে উঠছে। আমাদের সামনে বিষন্ন হয়ে দাঁড়ানো লিকলিকে শালারা সবাই গরিব মানুষ, চোখের সামনে পৈত্রিক জমি খোয়ানোর নাটক দেখা ছাড়া তাঁদের করার কিছুই নেই। বন্ধকি দলিলে দোলাভাইয়ের প্ররোচনায় তারাও যে স্বাক্ষর দিয়েছে। শঠ দোলাভাইয়ের বাঁশ খেয়ে সহজ সরল শালক-শালিকারা আজ নিঃশেষ।

আমাদের গন্তব্য হালুয়াঘাট কড়ইতলী স্থলবন্দর, জেলা ময়মনসিংহ। ব্যাংকের কাস্টমার ব্যবসায়ীরা সারাটা বন্দর ঘুরে দেখান। বন্দর প্রাঙ্গণে অজস্র পাথর ও কয়লার স্থপ। শ্রমিকরা পাথর ভাঙছে, ধুলা উড়ছে। ভারত ও ভূটান দুই দেশ হতে পাথর এসেছে। আমরা হেঁটে হেঁটে দুইদেশের জিরো সীমান্তে যাই। ‘স্বাগতম বাংলাদেশ’ তোরণে ছবি উঠাই। ভারতীয় ট্রাক হতে পাথর নামানো হচ্ছে। খালি ট্রাক ভারতে ফিরে যাচ্ছে। ট্রাক ভারতে ঢুকা মাত্রই দুইজন লোক দু’দিক থেকে এসে করোনা ভাইরাস তাড়াতে ট্রাকের চাকায় মেডিসিন স্প্রে করছে। বাংলাদেশের চরম শত্রু করোনা ভাইরাস পরম বন্ধু ভারতে ঢুকেই খতম। ট্রাকচাকার ভাইরাস খতম বটে, কিন্তু চালক ও হেলপাররা বাংলার বন্ধুদের প্রীতি উপহার যদি গায়ে করে নিয়ে যায়, তাহলে তা আটকাবে কে?

দুই ভাতৃপ্রতিম বন্ধুরাষ্ট্রের দুইদল প্রাণবন্ধু লাটিয়াল বাহিনী বিজিপি ও বিএসএফ বন্দুক হাতে মুখামুখি রণপ্রস্তুত।

ব্যবসায়ীগণ এবার আমাদেরকে নিয়ে যান কড়ইতলি পার্ক ও পিকনিক স্পটে। অনুচ্চ টিলা এলাকা নানাজাতের কুসুমবিথি লাগানো। বাগান জুড়ে বাঘ, হাতি, হরিণ, বক ও পাখপাখালীর অনেক ভাস্কর্য্য। জায়গাটিকে সিলেট সিলেট লাগছে। ওপারে ভারতের টিলাটক্ষর দেখা যাচ্ছে। সিলেটের বড়ছড়া কিংবা তামাবিল স্থলবন্দরে ভারতের খাসিয়া পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। দৃশ্য নয়নাভিরাম। হালুয়াঘাটে তেমনটি নয়। সিড়ি বেয়ে পাহাড়ি টংঘরের আকারে নির্মিত কড়ইতলী পার্ক অফিসে বসি। ব্যবসায়ীদের পক্ষে মেজবান কফি ও বিস্কুট আসে। ফেরার পথে আমরা ঢুকে পড়ি শেরপুর জেলার নাকুগাও স্থলবন্দরে। এখানেও একই চালচিত্র। এই দুই বন্দরেই আমদানি প্রচুর, রফতানি নেই বললেই চলে। এত ট্রাক ট্রাক পাথর ও কয়লা আসছে, নিশ্চয়ই সারাদেশে অগণিত রাস্থাঘাট সেতু ও স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। শেরপুর জেলার  নাকুগাও ও ময়মনসিংহ জেলার কড়ইতলী, হালুয়াঘাট স্থলবন্দরসমূহের এত কর্মব্যস্ততা দেখে মনে হল, সত্যই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।

রাতে ফিরে এসে ময়মনসিংহ শাখায় খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে ঢাকার এসি বাসে চেপে বসি। চারলেনের আধুনিক সড়ক, তাই মহাসড়কে গাড়ির ‘ওভারটেক’ নামক মরণনাচ নেই। সিটে বসামাত্র চোখজুড়ে নেমে আসে ঘুম। রাতের আঁধারে বাস সাঁ সাঁ করে মাত্র তিনঘণ্টায় কাওরানবাজার চলে আসে। আমি ও যীশু চলে যাই ধানমন্ডির বাসায়। ঢাকার শিয়রে ময়মনসিংহ যেন বাংলার এক স্বর্গদোয়ার। শহরটি তেমন বড় নয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে সুনামগঞ্জ কিংবা হবিগঞ্জ শহর হবে কিনা সন্দেহ। মাত্র দু,দিনের এক ঝটিকা অভিযানে আমি ও যীশু বাংলার স্বর্গদোয়ার ময়মনসিংহে আচমকা এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন