সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

আব্দুল হালিম চৌধুরীর অকাল পতন এবং খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের মহাপ্রয়াণঃ

 আব্দুল হালিম চৌধুরীর অকাল পতন এবং খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের মহাপ্রয়াণঃ

 

কয়েকদিন ধরে কানাগোসা শুনছি, এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হবে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দু হালিম চৌধুরীর বয়স ৬৫ বৎসর এখনও হয়নি। তাই তাঁর চাকুরির মেয়াদ আর প্রায় দুই বছর বাড়বে। আমিও ধরে নিলাম তিনি আর দুই বছর পূবালী ব্যাংকের রাজত্ব পাবেন, কারণ একজন ব্যাংকার হিসাবে জানি নতুন একজন এম ডি পাওয়া বেশ কঠিন। পয়ষট্টি বয়সসীমার মধ্যে অন্য ব্যাংকের এমডি কিংবা এএমডি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দেবেনা। হালিম চৌধুরী ধরে নেন, বাহিরে এমডি মিলবেনা এবং তাঁকে ছাড়া পূবালী ব্যাংক চলবেনা। ব্যাংক পরিচালকদের তাকে বিনে কোন গতি নেই, তাই তিনি থাকবেনই।  

তিনি পরবর্তী দুই বছর পূবালীর শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য পছন্দসই লোকদেরকে সুবিধা দিয়ে ইতোমধ্যে স্থানে স্থানে বসায়ে দেন। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিদাতা মহাব্যবস্থাপক সিরাজুল হক চৌধুরীর চাকুরির মেয়াদ কলমের এক খোঁচায় তিন বছর বাড়িয়ে দেন। আব্দুল হালিম চৌধুরীর মেয়াদ বাড়াতে পরিচালকরা বারবার আলোচনায় বসেন। কিন্তু ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেন নি। কাওরানবাজারের জালালাবাদ এসোসিয়েশনের ই এ চৌধুরী মিলনায়তনে আব্দুল হালিম চৌধুরীকে বাদ দিয়েই পরিচালকরা গোপন সভায় বসেন, তখন আমি বুঝে ফেলি আব্দুল হালিম চৌধুরী আর পূবালীতে নেই। ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানসহ অনেক পরিচালক তাঁকে আর রাখতে চাননা। মেয়াদের শেষ দিনে তিনি এ এম ডি শফিউল আলম খান চৌধুরীর কাছে দায়িত্ব সমজিয়ে দিতে বাধ্য হন। একদিন তাঁর হাতেলেখা এ এম ডি শফিউল আলম খান চৌধুরীকে দায়িত্ব সমর্পণপত্র দেখান একজন মহাব্যবস্থাপক। মাত্র কয়েক লাইনের ছোট্ট চিটি। পাশে বসা উপমহাব্যবস্থাপক জগত চন্দ্র সাহাকে চিটিটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এত বছর এমডিগিরি করেছে, এই দেখুন ছোট্ট চিটিটায় কতটা ভূল। একজন গণ্যমান্য নির্বাহী বললেন, ভূল তো হবেই, তাঁকে যে চলে যেতে বাধ্য করেছে। তাঁর অন্তরাত্মা যে তখন খাঁচাছাড়া ছিল।

এ এম ডি শফিউল আলম খান চৌধুরী নেত্রকোনার অভিজাত পরিবারের লোক, তিনি কখনও চিন্তাও করেননি এম ডি হবেন। তারও বয়স ৬৫ বছর হতে মাত্র ১৯ মাস বাকি। ভালয় ভালয় এএমডি হিসাবে অবসরে গেলেই তিনি সন্তুষ্ট। অথচ সৌভাগ্য তাকে ধরে বেঁধে এনে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও নতুন কোন যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহিরে পাওয়া গেলনা। দুচার জন এলেও শর্ত-শার্তের চোরাবালিতে ডুবে মারা গেল। তাই তিনিই তাঁর পুরো উনিশ মাসের জন্য পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পেয়ে যান। শোনা যায় শফিউল আলম খান চৌধুরী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আত্মীয়, তাঁকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক করতে নাকি প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ ব্যাংকের বোর্ডে সুপারিশ করেন। অথচ কোন কাটখড় না পুড়ায়েই ভাগ্যবলে এমনি এমনি তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ পেয়ে যান। তার গুরুজি হরেক কিসিমের ভূল কাজ তাঁকে উপকৃত করে এবং সহজেই পূবালীর মসনদে বসিয়ে দেয়।        

দেখলাম যাবার বেলায় আব্দুল হালিম চৌধুরী কাউকেই খুশি রাখতে পারেন নি, না মালিক, না শ্রমিক, না নিজ এলাকার লোকজন, না আত্মীয়-স্বজন। তাঁর সময়ে মালিকরা বিভক্ত হয়ে বিবাদে লিপ্ত থাকেন এবং তিনি এই কুন্দলের সুযোগে ভালই সময় পার করেন। বোর্ড অফ ডায়রেক্টরস ছাড়াও তখন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কমিটি বলয়েও কম ঠেলাঠেলি হয়নি। ধাক্কাধাক্কির চুটে চাকুরি হারান এএমডি মিজানুর রহমান জোদ্দার, ঋণ বিভাগের সুদক্ষ মহাব্যবস্থাপক প্রথিক করিম, ব্যাংকের চিফ ফাইন্যান্স অফিসার সাইদ আহমদ প্রমুখ। তাঁর আগের দুইজন এমডি খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ ও হেলাল আহমদ চৌধুরী বয়স  পয়ষট্টি পূর্ণ হলে সম্মানের সাথে বিদায় নেন, কিন্তু আব্দুল হালিম চৌধুরীর বিদায় মোঠেও সম্মানজনক ছিলনা। শেষদিন গুমরো মুখে বিষন্ন মনে হেডঅফিসের দু’তলা থেকে বের হয়ে তিনি পূবালী ব্যাংক ছেড়ে দৌড়ে পালান। এই হল পূবালী ব্যাংকের এক হীরকরাজার কাহিনি।          

আমি কখনও ভাবিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী এভাবে হেনস্তা হয়ে অকালে চলে যাবেন। ২০১৪ সাল হতে তিনি দুই মেয়াদে ছয় বছর পূবালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় এসে আমি হেডঅফিসের সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করি। এমডির অধীন সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে এই বিভাগ তাঁর কাজ পরিচালনা করে। আমি জি এস ডি ডি তে এই কমিটির একজন অধস্থন সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসাবে দায়িত্বে ছিলাম। সারাদেশের সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে দেয়া এই বিভাগের কাজ। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সুন্দরবন হতে জকিগঞ্জ সবাই সব সমস্যার সমাধান আমাদের কাছে চায়। কাস্টমারদের সব ধরনের অভিযোগও আমরা শুনি এবং ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু সমস্যার সমাধান আমরা নিজেরা করে দেই, যেগুলো আমাদের পক্ষে সমাধান দেয়া সম্ভব নয়, সেগুলো আমরা আইন, আইটি, হিসাব, ঋণ, মানবসম্পদ ইত্যাদি বিভাগের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমাধান সিন্ধান্ত ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদনের পর শাখাকে জানিয়ে দেই। সারাদেশের প্রায় সাত শতাধিক ভাড়াচুক্তি ও দেড়দুই হাজার অস্ত্র ব্যবস্থাপনা আমাদের হাতে। নতুন শাখা, উপশাখা, ইসলামি উইন্ডো ইত্যাদি খোলা, ব্যাংকের অনুষ্ঠানাদী পরিচালনা করা এবং অফিসসমূহের ডিজাইনকরণ, সজ্জাকরণ, ইস্টিমেশন আমাদের প্রযুক্তি দপ্তর করে থাকে। ব্যাংকের সব রকম বিমাকরণ, দান, অনুদান, বিশেষ রেটে সুদ, কমিশনে বিশেষ ছাড়, শাখাসমূহের আইটি ভূল সংশোধন, এসব আমরা অনুমোদন করে দেই।

সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন বিভাগে বসে আমি সরাসরি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অধীনে কাজ করি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী আত্মীয় হলেও আমি খুব জরুরি কাজ ছাড়া তাঁর চেম্বারে কখনও যাইনি। সাধারণত মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপকেরা এমডির সাথে দেখা করে ব্যাংকের সব কাজ পরিচালনা করেন। সহকারী মহাব্যবস্থাপকের সাথে এমডির অফিসিয়াল তেমন কোন সরাসরি যোগাযোগ হয়না। তাছাড়া আমি তাঁর কাছে তেমন গুরুত্ব পাইনি, কোন আনুকল্য পাইনি, তাঁর একমাত্র পুত্রের বিবাহত্তোর বৌভাত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দাওয়াত ছাড়া।  

বাহিরের লোকজন তাঁকে হাত করে অনেক সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিলেও আমি ন্যায়সঙ্গত কোন আচরণ তাঁর কাছে পাইনি। ঢাকা এসেই আবার গাড়ি ঋণ পাঠালে তা তিনি রিজেক্ট করে দেন। অথচ অনেককে তিনি দুই তিনবার গাড়িঋণ দেন। তিনি দ্বিতীয়বার পদোন্নতির জন্য ডেকে ১৫ মিনিট সাক্ষাৎকার নাটক করেন। তিনি শক্তের ভক্ত নরমের যম। আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় মনে করতাম তিনি আমার সমস্যা বুঝবেন, সে অনুযায়ী কাজ করবেন। আমার আত্মীয় পরিচালক অনেক থাকলেও কেবল তাঁর উপর ভরসা করতাম কিন্তু দুঃখজনক সত্য যে তিনি সব সময় একদম উল্টো আচরণ করে যান। অর্থাৎ আমার প্রতি তাঁর সব আচরণই ছিল বিমাতাসূলভ এবং অন্যায়। 

তিনি সকল কর্মীর সাথে একই মাপকাটিতে আচরণ করেন নি। তাঁর সময়ে আমার চোখের সামনে কোন কোন কর্মী একই ভবনে, একই অফিসে বছরের পর বছর পার করে, অথচ আমাকে সে সময়ে তিনটি জেলায় বদলি করা হয়। সুদীর্ঘ্য কয়েক বছর সাফল্যের সাথে শহরের বড় শাখায় নেতৃত্ব দেয়ার পর আমাকে তাঁর সময়ে গ্রামের ছোট শাখায় ব্যবস্থাপক করে পাঠিয়ে অসম্মান করা হয়। ঢাকায় এনেও পদোন্নতি আটকে দেন। একটি স্টাফ গাড়িঋণের আবেদন করলে দেন নি। অথচ কোন কোন নির্বাহীকে তখন দুই-তিন বার করে গাড়িঋণ বরাদ্ধ দিতে দেখি। তাঁর এইসব আচরণে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে আমি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপরীতে নেয়া আটারো লক্ষ টাকার চাহিদা ঋণ সাথে সাথে পরিশোধ করে দেই। 

আমাকে বললেন পদোন্নতি পেতে হলে বড় শাখার ব্যবস্থাপক হতে হয়, বাহিরের জেলায় যেতে হয়। অথচ হেড অফিসে এসে দেখি অনেক সুচতুর আমলারা একই অফিসে, একই ভবনে, একই শহরে সারাজীবন কাজ করে ব্যাংকের মগডালে উঠে গেছে। বছরের পর বছর শাখা ব্যবস্থাপনা করে, বছরের পর বছর জেলায় জেলায় ঘুরে পরিস্কার চাকুরি নথিদারী আমি ইসফাক কুরেশী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিমের অপসময়ে পেলাম কেবল হাতির আন্ডা আর ঘোড়ার ডিম। তাঁর আমলে আমার চাকুরি সন্তুষ্টি একদম শূন্যের কোঠায় নেমে যায়।  

নানা বিষয় তুলনামূলক চিন্তা করে আমি দেখি তাঁর সময়ে আদৌ কোন ন্যায়নীতি ছিলনা। অনেকে একাধিকবার গাড়ি ঋণ পায়, বাড়ি ঋণ পায়, ব্যাংকের টাকায় বিদেশ যায়, নিয়মিত পদোন্নতি পায়, তাঁরা ব্যাংকের জন্য খানিকটা খাটবে না তো কে খাটবে। সহজ কথায় যারা ব্যাংক হতে অনবরত রসগোল্লা খাচ্ছেন, তাই না হয় তাঁরা একটু বেশি খাটছেন। আর আমরা কোন রসগোল্লা না খেয়েই পরিবার পরিজন ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে দিনরাত অনবরত খেটেই যাই। আমি পূবালী ব্যাংক হতে কখনও কোন আলাদা সুবিধা নেইনি কিংবা পাইনি, পূবালীর কোন রসগোল্লা খাইনি, আমাকে এসব রসগোল্লা খেকোদের মত খাটাখাটি করার ওয়াজ করা কি ন্যায়সঙ্গত। অথচ পূবালী ব্যাংকে আমি অন্যান্য কর্মীদের তুলনায় কখনও কম খাটুনি দেইনি, কম কষ্ট করিনি। আমার ব্যাংকিং ও আইটি জ্ঞান আমার ব্যাচের অন্যদের চেয়ে কম, তাও কেউ বলতে পারবেনা।    

আব্দুল হালিম চৌধুরী যেদিন এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন, আমি ছিলাম সিলেট পূর্বাঞ্চলিক অফিসের এ জি এম। সহকর্মীরা আবদার জানান, আপনার ভাতিজী-বর এমডি হয়েছেন, মিষ্টি খাওয়ান। সেদিন খুশি হয়ে আমি অফিসে মিষ্টি বিতরণ করি। যার আগমনে এত খুশি হ, তাঁর বিদায়ে নিশ্চয় আমার দুঃখ পাবার কথা। কিন্তু আমি তাঁর বিদায়ে সুখ কিংবা দুখ, কোন অনুভূতিই অনুভব করিনি। মনে হল তিনি আমার কে যে, তাঁর শোকে কাতর হব। ভাতিজী-বর, সতীর্থের অগ্রজ, সিলেট শাখায় সাবেক সহকর্মী আমি অনুভব করি, আজকের আব্দুল হালিম সেই আব্দুল হালিম নন, যাকে আমি আগে দেখেছি। অপরিচিত অনাত্মীয় বাহিরের লোকেরা আমাকে সারাজীবন সহায়তা করেছে, আমার ভাল চেয়েছে কিন্তু তিনি যে আমার মঙ্গল কামনা করেন, এমন কোন লক্ষণই তাঁর কোন আচরণে আমি খুঁজে পাইনি। বরং বারবার কষ্ট ও ক্ষতির শিকার হই। 

তিনি আমার চাকুরি জীবনকে অপমানকর অবস্থায় ঠেলে দেন। হয়ত অন্য কেউ এই ব্যাংকের প্রধান আমলা হলে এমনটি হতনা। তাঁর নিজের মগজ তেমন কাজ করেনি, অন্যের মগজে ভর করে তিনি ব্যাংক চালান। সিলেটি কমলা ফেরি করে এতদূর চলে আসেন। একেই বলে রাজভাগ্য।  ফলে তাঁর ভবিতব্য যা হবার তাই হয়েছে। স্মরণ রাখার মত কোন উপকার তিনি কারও করেননি, কারও মনেই তিনি আদৌ স্থান করে নিয়ে পারেননি। অধিকন্তু নিজেও অপমানের বিষ টেনে শেষে আত্মহত্যা করেন। তাঁর বিদায়ক্ষণে মনে হল আমার কাছে সহপাঠির অগ্রজ আত্মীয় আব্দুর হালিম চৌধুরী যা, বাইরের আবুল হাসান কালার বাপ আবুল্যাও তা। তাঁর বিদায়ে আমার চোখে কোন অশ্রু ছিলনা, তাঁর প্রস্থান শোকে আমাকে কোন বিলাপ করতে হয়নি।

কয়েকদিন পর ব্যাংকের পক্ষ হতে তাকে লামসামগুছের এক বিদায় সম্বর্ধণা দেয়া হয়। সাবেক এম ডি হেলাল আহমদ চৌধুরীর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে কোটি টাকার বাজেট ছিল। মালয়শিয়া হতে উপহার পণ্য আসে। খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদও উষ্ণ সম্বর্ধণা পান। অবাক হয়ে দেখলাম তাকে সম্বর্ধনা জানাতে কতৃপক্ষ ভয় পাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত নিয়ম পালনে তড়িঘড়ি করে হেডঅফিসের চৌদ্দতলায় আমাদের মাথার উপরের মিলনায়তনে দ্রুত এক বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। আমাদের সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন বিভাগ এই সম্বর্ধনা পরিচালনার দায়িত্ব পায়। শুধুমাত্র উপমহাব্যবস্থাপক ও মহাব্যবস্থাপকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাকে একটি হাতঘড়ি ও তাঁর বেগম রহিমা চৌধুরী রিপাকে একটি শাড়ি ব্যাংকের তরফ থেকে উপহার দেয়া হয়। পূবালী ব্যাংকের রীতি অনুযায়ী মহাব্যবস্থাপক ও তদুর্ধগণ অবসরে গেলে তাঁদের ব্যবহারে থাকা অফিসের গাড়িটি উপহার পান। ফলে প্রথানুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যবহৃত একটি দামি গাড়ি ব্যাংকের উপহার হিসাবে হালিম চৌধুরীর ভাগ্যে জুটে।    

আমাদের বিভাগ প্রধান মহাব্যবস্থাপক দিলীপ কুমার পাল আমার চেম্বারে এসে বললেন, আপনি চাইলে সভা পরিচালনা কাজের একজন কর্মী হিসাবে এই বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেন। সাধারণ সেবা বিভাগ প্রায়ই ব্যাংকের নানা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। আমি এই সব অনুষ্ঠানে যাইনা কিছুটা হীনমন্যতায়, কিছুটা লজ্জায়। আব্দুল হালিমের আমলে জুনিয়ররা পদোন্নতি পেয়ে আমার উপরে চলে যায়, আর আমি সেখানে গিয়ে তাঁদেরকে মুখ দেখাবো, সেবাযত্ন করবো, আদর আপ্যায়ন করবো। একবার জগত চন্দ্র স্যার এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বললে আমার মনঃসমীক্ষা তাঁর কাছে প্রকাশ করি।

আসলে আব্দুল হালিম চৌধুরীর বিদায় সম্বর্ধনা নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিলনা। আমার মত একজন আদার ব্যাপারীর অতি উৎসাহী হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের খবর জানার কিবা প্রয়োজন। আমি তাকে জবাব দিলাম আমি এই সভায় ঢুকলে নির্বাহীরা বলবে হালিম চৌধুরীর কুটুম পরিচয়ে একজন এজিএম হয়েও সভায় ঢুকে গেছি। তাই এই সভায় আমার না যাওয়াটাই উত্তম। তিনি নীরব রইলেন, আমিও বেঁচে গেলাম।  

মিলনায়তনের বাহিরে দাঁড়িয়ে ফাঁক দিয়ে দেখি এই সভার মঞ্চে আব্দুল হালিম চৌধুরী এবং তাঁর সহধর্মিনী রহিমা চৌধুরী রিপা পাশাপাশি বসে আছেন। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী  এবং এ এম ডি মোহাম্মদ আলী দুইজনই সস্ত্রীক মঞ্চে আসীন। করোনা মহামারির কারণে সবাই আসতে না পারলেও তাঁর নূন-নিমক খেয়েছেন এমন সবাই এসেছেন এবং মাইকে দাঁড়িয়ে প্রিয় গুণীর গুণকির্তন করে প্রাণটা শীতল করেছেন। এই সভায় ব্যাংকের কোন পরিচালকই সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, তবে শুনেছি ফাহিম ফারুক চৌধুরী, মুছা ইয়াকুবসহ কয়েকজন পরিচালক অনলাইনে সভায় যোগ দেন। স্মরণ হল, কয়েকবছর আগে হাফিজ কমপ্লেক্সে সিলেটের মহাব্যবস্থাপক মোসাদ্দেক চৌধুরীকে অবসরকালীন বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হয়। বিশাল সেন্টার লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সিলেটের গণ্যমান্যরা কেউ সেই অনুষ্ঠানে বাদ যাননি। গভীর রাতে অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরি। সেই সভার তুলনায় এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর এই অনুষ্ঠান আমার কাছে ডাল-ভাতই মনে হল। কোথায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর কোথায় একজন মহাব্যবস্থাপকের অবস্থান? দেখলাম, প্রতিষ্ঠানে একজন কেরানির বিদায় হয় সম্মানের সহিত, আবার একজন রাজা বিদায়কালে হয়ে যান অপমানিত। একেই বলে ভাগ্যফল।    

আব্দুল হালিম চৌধুরীর আগে দু’জন জ্ঞানী গুণী ব্যস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ ও হেলাল আহমদ চৌধুরীর সাথে কাজ করেছি, তাঁদের তুলনায় তিনি একেবারেই নিষ্প্রভ। দুধের মাছিরা এসে তাঁর গুণকীর্তিন করে, ব্যাংক অন্যরা চালায়, সিন্ধান্ত অন্যরা দেয়, আব্দুল হালিম চৌধুরী কেবল দস্তখত দেন, বিকেল ৬টা হলেই তিনি অফিস হতে উদাও হয়ে যান। অথচ কোন কোন বিভাগে তীব্র কাজের চাপে কর্মীরা অনেক রাতে বাসা ফেরেন। তাঁর কাজকর্ম ও আচরণে মনে হত একেই বলে রাজভাগ্য।

এই খেলারাম হীরক রাজা পূবালী ব্যাংকে খেলে যান পুরো ছয়টি বছর।  

খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ জাতীয়ভাবে একজন শ্রদ্ধাভাজন লোক। জ্ঞানে গুণে ব্যক্তিত্বে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপুটি গভর্নর, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি পূবালী ব্যাংকের এমডি হয়ে এই ব্যাংককে ধীরে ধীরে প্রবলেম ব্যাংকের তালিকা হতে বের করেন। ব্যবস্থাপকদের প্রফিট টার্গেটের জন্য স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট স্কিম চালু করে দ্রুত পূবালী ব্যাংককে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। ব্যাংকে বাৎসরিক জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলন প্রথা চালু করে নেতৃত্বে গতিশীলতা আনয়ন করেন। তিনি পূবালী ব্যাংকে নৈতিকতার বীজ বপন করেন। পূবালীর এমডি হয়েই তিনি ঢাকায় ডেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে আমাকে ব্যবস্থাপক করেন। তাঁর এবং হেলাল আহমদ চৌধুরীর পুরো আমলে আমি শাখা ব্যবস্থাপক ছিলা এবং কোন পদোন্নতি আমার বাদ পড়েনি। তাই আমি তাঁদের প্রতি সত্যি কৃতজ্ঞ।

আব্দুল হালিম চৌধুরীর বিদায়ের কিছুদিন পরই করোনা মহামারির নিষ্ঠুর ছোবলে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ স্যার মহান আল্লাহের কাছে চলে যান। তাকে প্রায়ই অর্থনীতি, ব্যাংক, শেয়ারবাজার ইত্যাদি বিষয়ে টেলিভিশনের টকশো ও পত্রিকা প্রতিবেদনে দেখা যেত। তাঁর বিদায়ে দেশবাসী শোকাহত হন, তাদের সাথে আমিও ভীষণ দুঃখ পাই। তাঁর জান্নাত কামনায় মহান আল্লাহের দরবারে প্রাণভরে দোয়া করি।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন