প্রথম দেখা সীতাকুন্ড ও খাগড়াছড়ি, চৌদ্দবর্ষ পর রাঙ্গামাটি এবং একত্রিশ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
১৯৯১ সালে এক প্রলয়ঙ্করী সামুদ্রিক
সাইক্লোনের ধ্বংসযঞ্জের পর পরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাই।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, অফিস খোলা আছে। অফিস কর্মকর্তা রনধীর শর্মাদার সহায়তায়
মাস্টার্স সার্টিফিকেট তুলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায়
সম্ভাষণ জানিয়ে সুদূর সিলেট চলে আসি। ইতোমধ্যে তিরিশ বছর পেরিয়ে
গেছে, অথচ এই তিনযুগে স্মৃতিময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আর কখনও আমার পা
রাখা হয়নি। নানা কাজে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এসে বেশ কয়েকবার ক্ষণিকের জন্য বিরাম
নিলেও রাউজান উপজেলা পেরিয়ে সুদূরের ফটিকছড়ির অজপাড়াগাঁয়ে পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে দেখার জন্য প্রাণ আনচান
করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। মহান আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর রাখেন। তাই মরণের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে হয়ত শেষবার দেখার একটা সুযোগ করে দেন।
করোনার মাঝে ভ্রমণে বিপদ হতে পারে, তাই আমি দু’টানায় ছিলাম যাবো কিনা?
ঢাকা অফিসে আমার ভাতৃসম বস উপমহাব্যবস্থাপক জগত চন্দ্র সাহা ১লা এপ্রিল অবসরে
যাবেন, তিনি চাকুরিতে থাকাকালেই তাঁকে নিয়ে চারদিনের একটা আনন্দ ভ্রমণে যাবার ইচ্ছে যীশু ও আমাকে করোনার
মধ্যে ঝুঁকি নিতে সাহস যোগায়। ঢাকা হতে ট্রেনে চট্টগ্রাম বেশ দীর্ঘ্যপথ। ১৬ মার্চ
রাত সাড়ে ৯টায় ট্রেন কমলাপুর ছাড়ে। বগি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত।
ভাগ্য ভাল কম্পার্টমেন্টের ঠিক মধ্যভাগের টেবিলযুক্ত খোলামেলা সিট পাই। চেয়ারে
হেলান দিয়ে আমরা সারারাত ঘুমাই। সকালে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে
গাড়ি থামলে নিদ্রা পালায়। পাশের ভদ্রলোক জগত স্যারকে বললেন, আপনার খুব ভাল ঘুম হয়েছে। আমার সামনের সিটে বসা জগত স্যারের নাকডাকার শব্দের জ্বালায় ভদ্রলোক ভালভাবেই টের পান তাঁর
প্রতিবেশী মহাশয় ট্রেনের নিদমহলে কি প্রগাঢ় নিদ্রা যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম প্রিন্সিপাল অফিসের
সম্মানিত মহাব্যবস্থাপক নরেশ চন্দ্র সাহা আমাদেরকে রাঙ্গামাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য
সিডিএ শাখা হতে একটি গাড়ি পাঠান। রেলস্টেশন হতে বেরুতেই চালক খোরশেদ আলম সালাম
জানিয়ে মাইক্রোবাসে সাদরে বরণ করেন। রাঙ্গামাটির ব্যবস্থাপক দেলওয়ার হোসেন জনী
এসপিও রাঙ্গামাটি লেকে সারাদিনের জন্য এক নৌবিহারে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করেছেন।
তাঁর দাওয়াত রক্ষায় সকাল ৯টা হবার আগেই আমাদেরকে রাঙ্গামাটি পৌঁছে যেতে হবে। গাড়ির
সামনের সিটে আমাদের বটবৃক্ষ বস জগত চন্দ্র স্যারকে বসাই। দুই তালপাতার সিপাই আমি ও
যীশু পিছনের সিটে বসি। গাড়ি শহরের টাইগার পাসের পাহাড়ি রাস্থা, নাসিরাবাদের
ওভারব্রিজ পার হয়ে ছুটে গেল। বহুতল ভবনে ভবনে সয়লাব সারাটা শহর, যেন কংক্রিটের
এলোমেলো পাহাড়। পাহাড়-নদী-সাগর-লেকের সম্মিলন পৃথিবীর অল্প শহরেই আছে। চট্টগ্রাম
শহর সত্যই ভাগ্যবান, এখানে পাহাড়-নদী-সাগর-লেক
ও সন্দীপ চেনেলের মিলন ঘটেছে। এমন সম্মিলন বাংলাদেশের অন্য কোন শহরে হয়নি। ১৯৮৮
হতে ১৯৯০ সালে আমার অবিরাম চরে বেড়ানো প্রকৃতির লীলানিকেতন নীরব সেই বন্দরনগরী চাটগা আজ নেই। সব বদলে গেছে, মনে হয়
সেখানে আর সেখানটি নেই।
চট্টগ্রাম হতে রাঙ্গামাটির
দুরত্ব সাতাত্তুর কিলোমিটার। দুই ঘন্টার পার্বত্যপথ।
রাঙ্গামাটির অর্ধেক সড়কই আঁকাবাঁকা পাহাড়ের উপর দিয়ে নির্মিত। অতীত জীবনে বেশ
কয়েকবার এই রাস্থার যাত্রি ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে একসময় বিখ্যাত
হালদানদীর সাথে দেখা হয়। আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি নদীটি মহান আল্লাহপাকের এক অপূর্ব
নেয়ামত, নদীটির গঠন এমন যে এটি মাছের একটি প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এই হালদা
নদীর মৎস্যরেনু ও পোনা সারা বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয়। পথে গাড়ি থামিয়ে চায়রিবাজারে নাস্তা করি। হোটেলে
ও লোকভীড়ে তাকিয়ে মনে হল উপজাতি ও বাঙ্গালি এই বাজারে সংখ্যায় সমান সমান। একটা
দারিদ্রতার দুঃখময় ছায়া পাহাড়ি-বাঙ্গালি সবার
চেহারায়। ব্রেকফাস্ট শেষ, পাহাড়ি রাস্থায় আবার যাত্রা শুরু। উঁচু
পাহাড়ের ঘা ঘেসে ঘেসে রাস্থা। একটার পর একটা গীরিখাদ। একটি জায়গায় অপূর্ব পাহাড়ি
দৃশ্য। ছবির মত সুন্দর এই জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলি। মনে পড়ে আমি ও নির্ঝর
এইস্থানে ১৯৮৭ সালে ক্যামেরা দিয়ে আমাদের ছবি তুলেছিলাম।
১৭ মার্চ, ২০২১ সাল। আজ
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের ছুটি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে শুনে পার্কে স্থাপিত তাঁর এক বিশাল ভাস্কর্যের পাশদিয়ে সকাল ৯টায় আমরা রাঙ্গামাটি শাখায় আসি।
এই পূবালী শাখাটি কাপ্তাই লেকের পারে। শাখার কাঁচের জানালা দিয়ে তাকালে লেকের দৃশ্য
অপরূপ। শাখার সুসজ্জিত বাথে আমরা গোসল সেরে নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে একজন চৌকষ
সুদর্শন তরুণ এসে হাজির হন। জিন্স প্যান্ট ও হাফ সার্ট পড়া কিছুটা ইন্দোচিনা
চেহারার এই গৌরাঙ্গ তরুণকে দেখে ভাবলাম তিনি একজন বিদেশী অথবা উপজাতীয়
হতে পারেন। তিনি আমাদেরকে ব্যাবস্থাপক চেম্বারে নিয়ে যান। ব্যবস্থাপক তালিকায় চোখ
রেখে তালিকার শেষ নামটি পড়ি মোঃ দেলোয়ার হোসেন জনী, পদবী সিনিয়র প্রিন্সিপাল
অফিসার। ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন জনীর ঠেলায় পড়ে এখানে পুনরায় ব্রেকফাস্ট হল। নৌবিহারকালে তাঁর বাবার
সাথে পরিচয় হলে জানতে পারি তাঁরা চট্টগ্রামের এক বনেদী পরিবারের সদস্য।
সুযোগ্য পুত্র জনীকে নিয়ে পিতার তৃপ্তির শেষ নেই।
বসন্তকালের নাতিষীতোষ্ণ আবহাওয়া ও নরম উজ্জ্বল রোদে বাংলাদেশের পাহাড়ি লেকশহর রাঙ্গামাটিকে দারূণ লাগে, মন প্রফুল্ল হয়ে যায়। রাঙ্গামাটি শাখা হতে আমরা ক’জন লেকপারের রাস্থা দিয়ে হেঁটে হেঁটে লেকঘাটে
আসি। বেশ সুপ্রশস্ত ঘাট, প্রায় চল্লিশটির মত সিড়ি নিচে জলে নেমে গেছে।
রাঙ্গামাটি শাখা ও বনরূপা উপশাখার সবাই সপরিবারে এসে ঘাটে জমায়েত
হয়েছেন। বাঙ্গালি ও উপজাতি মিলে পয়ত্রিশ চল্লিশেক প্রাণচঞ্চল
আদম সন্থানের সাথে বসন্তের মিঠেরোদে লেকঘাটে পরিচয় হয়। বনরূপা উপশাখার ব্যবস্থাপক
তাজুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি শাখার সেকেন্ড অফিসার বিশাল চাকমা, কাহিনি খীসা, রিতেশ খীসা ও ব্যবসায়ী আশিষ কুমার ওরফে স্বপন মহাজন, রাঙ্গামাটি
শহরের সব সম্মানীত পূবালী ব্যাংকারগণ এবং তাঁদের পরিবারের সাথে মিলেমিশে বজরায়
আরোহন করি। কাটের তৈরী বড়সড় প্রমোদনৌকা, ছাদে তেরপালের ঢাকনা দিতে
মাদুর পাতা আরেক তলা। আমরা মুরব্বী মানুষ, তাই সম্মান জানিয়ে নিচের
আসনে বসানো হল। নৌকার দু’পাশে লাল মেটে সুশ্যামল ছোট ছোট দ্বীপমালা,
কাজল কালো টলমলে পরিস্কার জল, বসন্তের কমলা রঙের রোদ, বেহেশতি বাতাস রেখে কবি আমি কতক্ষণ
নৌকার খোলের মাঝে বন্দি থাকি। এবার খোলা ছাদে গেলাম। ছাদে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে
চাকমা, টিপরা ও বাঙ্গালি পূবালীয়ানগণ সবাই সুখাসনে বসে যেন পৃথিবীর রূপ দেখে স্রষ্টার তপস্যা করছেন। মুরব্বী স্যার আমি, তাই
বসলাম সামনে, খানিক তফাতে।
মজাদার বিস্কুট, ফল ও পানীয় আসে। যাক তাতো আসবেই। কিন্তু একটি নতুন উপজাতীয় পিঠে খাই যার স্বাদ এখনও জিবে লেগে আছে। নাম বাপাপিঠে, জুমক্ষেতের আটালো বিরুন
চালের গুড়ো ও খাজুরে গুড় দিয়ে বানানো। এই পিঠের রঙও অভিনব,
গাঢ় বেগুনী। কাহিনি খীশা দিদি সযতনে এই পিঠা তৈরী করে নিয়ে
এসেছেন। স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই পিঠা এতই বিচিত্র যে এখনই
বাংলাদেশের প্যাটেন্ট নেয়া উচিত। আমার মনে হল এই বাপাপিঠে রপ্তানী পণ্যের তালিকায়
ঢুকায়ে দিলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।
আমাদের বজরা একটি একটি অপরূপ সুন্দর
এগ্রিক্যালচার নারিকেল বাগান দ্বীপে অবতরণ করে। এদ্বীপ থেকে
যেদিকে তাকানো যায় দৃশ্য অপরূপ। লেকে ভাসমান দ্বীপ ও পাহাড় সারির
দৃশ্য স্বর্গকেও হার মানাবে। আমরা সবাই পাশাপাশি অনেক
ছবি উঠাই। এবার চাকমা কন্যা কাহিনি খীসার গল্প বলি। পূবালী ব্যাংকার
কাহিনি খীসা দিদির বেশ বয়স হলেও যথেষ্ট সুন্দরী। তিনি তাঁর বোন ও ভাইজি নিয়ে
এসেছেন। বুদ্ধিমতি কাহিনি দিদিকে এক সময় বললাম আপনার
সন্থানরা কি করে। দিদি বললেন বিয়ে টিয়ে করিনি। আমার বিশ্বাস হলনা যেন কৌতুক করছেন।
তাই বললাম আপনি এই বয়সেও এত সুন্দরী, কুমারের ছোবল হতে বেঁচে কুমারী রইলেন কেমনে?
কারও নজর যে আপনার মত অনিন্দসুন্দরীর উপর পড়বেনা, তা বিশ্বাস হয়না। এবার কাহিনি
দিদি হেসে হেসে বললেন আমাকে কেউ পছন্দ করেনি, তাই বিয়ে-তিয়ে হয়নি। শেষে জানলাম একজন
ব্রিলিয়েন্ট এলিট চাকমা ছেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল, সে তাঁকে ছেঁকা দিয়েছে।
তারপর কাহিনি দিদির ভাল ভাল বিয়ের আলাপ এলেও একে একে সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
কৌমার্য্যব্রত পালনকারীদের তালিকায় ঢুকে যান।
দুপুরের বসন্ত রোদে বজরা এবার আমাদেরকে
আওলাদ বাজার এলাকার বড়গাঙ দ্বীপে নিয়ে যায়। ঝিলের উপর ঝুলন্ত মসজিদে জোহরের নামাজ
পড়ি। পাহাড়ি মাচাং ছাপড়ায় গোলাকারে বসে সবাই বেশ আড্ডা জমাই। লেকের বাতাস আমাদেরকে
শীতল করে দেয়। খেলনা ইয়ট ভাড়া করে দ্বীপের চারপাশে নীল জলে অনেকে বৈঠা বাইছে। এই
সুন্দর দ্বীপে একটি মনোরম খাবার হোটেল। হোটেলটি চাকমা উপজাতীয় ঐতিহ্যে সাজানো। এই
হোটেলে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের ডাক পড়ে। হোটেল পরিচালনায় আছেন পুর্ব-এসিয় চেহারার
উপজাতীয় লোকজন। আমার মনে হয়েছে তাঁরা সবাই প্রশিক্ষিত। এখানের অধিকাংশ খাবারই
স্থানীয় উৎস্য হতে এসেছে। কড়কড়ে কেসকি মাছ, লেকের সতেজ মৃগেল, লুইট্টা ভূনা, ডাল,
ভর্তা, মোরগ, খাসি, কুক, ফিরনি কিছুই বাদ পড়েনি। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে আর কতই বা খাওয়া
যায়। আহারে, আজ যদি আমি তরুণ হতাম।
আবার বজরায় চলে আসার ডাক পড়ে।
এবার কিছু পাহাড়ি দ্বীপমালার পাশ দিয়ে বজরা ছুটে। জেলেদের জাল ও বল ভেসে আছে।
পাখিরা জলে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে। আমাকে অবাক করে দেলোয়ার জনী বললেন, এই দেখুন সিলেটি
পাড়া। ভাবলাম সিলেটিরা উন্নত বিশ্ব আবাদ করে, রাঙ্গামাটির পাহাড় আবাদ করার তো কথা
নয়। অবাক কান্ড, কাছেই আসাম বস্তি, অহমরা তাহলে অতীতে এতদূর পর্যন্ত এসেছিল বুঝি?
মনোরম একটি দ্বীপে বজরা নোঙর করল। অনেকগুলো সিড়ি বেয়ে বেয়ে অপূর্ব সুন্দর এই
উচ্চ দ্বীপে যাই। এই দ্বীপরানির বুকে কয়েক একর
জায়গা জুড়ে ডিভাইন লেক রিসোর্ট। ফুলে ফলে বৃক্ষে সুসজ্জিত পাহাড়ি
সাপটাগৃহ সজ্জিত দ্বীপটির সৌন্দর্য্য তুলনাবিহীন। এই স্বর্গদ্বীপে হাঁটছি তখন
আসরের আজান হয়। আমরা কাট-গ্লাস-বাশে নির্মিত মাচাং স্যুটে নামাজ পড়ি। জলপাহাড়ে
সূর্য ডুব দেবার আগেই আমরা র্যাফাল ড্র এবং খেলাধূলায় মেতে উঠি। আমি কোন টিকেট
কিনি নি। বিনামূল্যে একটি টিকেট দান করা হয়েছে। আমাদের সাথে আসা চাইনিজ চেহারার
একটি টিপরা শিশু লটারি উঠায়। লটারির নম্বর আমার হাতের টিকেটের নম্বারের সাথে মিলে
যায়। সবাই হাততালী দেন। কিন্তু আমি লটারির গিফট নিতে সংকুচবোধ করি। আমরা তিনজন
মেহমানকে পূবালী ব্যাংক রাঙ্গামাটি শাখা নিঃস্বার্থ সেবা দিয়েছে সারাটা দিন। এই
বিশাল আনন্দ আয়োজনে তাঁরা প্রচুর খাটাখাটি করেছে ও খরচপাতি জোগান দিয়েছে। তাই এই
লটারিতে আমার নাম বাদ পড়ে তাদের কা’রো নাম উঠলে বরং আমি বেশিই খুশি হতাম। দেলোয়ার
জনীর হাত থেকে চকচকে রাংমোড়ানো গিফটের বাস্ক হাতে নিয়ে বললাম, এই গিফট আমি প্রিয়
কাহিনি দিদিকে দিলাম। কিন্তু গর্জে উঠলেন
কাহিনি দিদি, এই কি বলছেন স্যার। এটা আপনাকে আমাদের স্মৃতি। এই গিফট আপনার
বাসায় আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সিলেটে গিয়ে গিফটবক্স বেগম সাহেবার
হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও রাঙ্গামাটির মানুষের ভালবাসার স্মৃতি। তিনি রাংমুড়ানো
প্যাকেজ খোলে বললেন, এতো উপজাতীয় হস্তকর্মের কারুকাজ সমৃদ্ধ একটি বেশ দামী বিছানার
চাদর। সিলেট বলি, আর চট্টগ্রাম বলি, সবখানেই বাংলার উপজাতীয়রা সহজ-সরল ও উদারমনা। তাঁরা
বাংলাদেশের গলে স্বর্ণফুলের মালা। আমাদের সব উপজাতীয়দেরে মহান প্রভু সুখ ও সমৃদ্ধি
দান করুন। আমিন।
আজ এত সুন্দর রাঙ্গামাটি লেকের দ্বীপে
দ্বীপে ঘুরে দিন পার করলাম। অথচ এই লেকের জলে মিশে আছে উপজাতীয়দের প্রচুর নয়নের
জল। এই লেকে একসময় তাঁদের গ্রাম ছিল, মাচাংবাড়ি ছিল, রাজা ছিল, রাজ্য ছিল,
প্যাগোডা ছিল, জীবন জীবিকার উৎস জুমক্ষেত ছিল। আজ কিছুই নেই। কাপ্তাই লেকের নীল
জলে সব তলিয়ে গেছে। ১৯৮৭ সালে আমি ও নির্ঝর এই লেকে নৌভ্রমণকালে পানির নিচে চাকমা
রাজবাড়ির ইট-সুরকির স্থাপনা দেখেছিলাম। পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে এই কাপ্তাই লেক
মেঘাপ্রকল্প বাস্থাবায়িত হলে পাহাড়িরা সব হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে যান। কেউ কেউ খাগড়াছড়ি,
রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হলেও সিংহভাগের ভাগ্যে আশ্রয় জুটেনি। পাহাড়ে
তাঁদের জন্ম যেন আজন্ম পাপে রূপান্তরিত হয়।
বজরা নৌকা যখন রাঙ্গামাটি ঘাটে
ফিরে এলো তখন রাত হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ী স্বপন মহাজন প্রচুর
অর্থব্যয়ে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি জমকালো কালি মন্দির নির্মাণ করেছেন।
তাঁর আগ্রহ ও আমন্ত্রণে আমরা সেই মন্দির দেখতে গেলাম। পুরোহিত ও পূজারীরা ভগবানের গুণকীর্তণ
করছেন। ঢাক ঢোলের নিনাদে ধূনার গন্ধে এক ভাবগাম্ভির্য্যময় পরিবেশ। স্বপন মহাজন
আমাদেরকে ফ্রেস ডাবের পানি পরিবেশন করেন। জগত স্যার মন্দিরের অর্ঘ্য কলা পুরোহিতের
পরামর্শে পরিবারের জন্য ঢাকায় নিবেন। পাকা কলাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে মনে করে আমি একটি
কলা খাবার জন্য হাতে তুলে নেই। অমনি জগত স্যার বললেন, এই কলা খাওয়া যাবেনা। আমি
আপনাকে বাহিরে গেলে কিনে ভাল কলা খাওয়াবো। বুঝে গেলাম মন্দিরের কলার সাথে জগত
স্যারের ধর্মীয় আবেগ মিশে আছে। এক সময়ে মাদ্রাসা ছাত্র হলেও যীশুর মধ্যে কোন
ধর্মীয় কুসংস্কার নেই। সে বলল, এই কলা ঢাকায় নিয়ে পচায়ে গলায়ে খাবার মানে কি? আমরা
কবে যে এসব অপবিশ্বাস হতে মুক্ত হবো।
চালক খোরশেদ আলম অন্ধকারে
গাড়ি টানছেন স্যা স্যা করে যাতে রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে ঝুঁকিবহুল পাহাড় অঞ্চল পেরিয়ে সমতলে পৌঁছা
যায়। পূবালী ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল অঞ্চলপ্রধান
আমার সহপাঠি উপমহাব্যবস্থাপক মাহবুব আহমদ। চলন্ত
গাড়িতে হঠাৎ তাঁর ফোন পেলাম, কুরেশী, আগামিকল্য শুক্রবার আমার গাড়ি যাবে। সেই গাড়ি তোমাদেরকে সারাটা চট্টগ্রাম শহরের আশপাশ ঘুরে দেখাবে।
হোটেল হোয়াইট ইন, গুলপাহাড়েরমোড়,
চট্টগ্রাম। খানিকটা পাহাড়ি এলাকা, কয়েকটি রাস্থা এসে এখানে মিলেছে। আমাদের পূবালী
ব্যাংকের একজন অফিসারের মালিকানাধীন হোটেল এটি। তিনটি বিছানাপাতা একটি সুন্দর
স্যুটে উঠলাম। পুবালী ব্যাংকার হিসাবে এখানে আমরা বিশেষ ক্রেতাসেবা পাই। হোটেন মালিক ব্রেড- জেলি-
মাখন এবং পরোটা-ডিম-সবজি এই দুইধরণের ব্রেকফাস্ট পাঠিয়ে নিজে স্যুটে এসে এসে আমাদের
খোঁজখবর নেন। হোটেল ব্যবস্থাপক সাইফুরও বারবার নজরদারি করেন।
আজ ১৮ মার্চ ২০২১ সাল।
বসন্তকালের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমলে চট্টগ্রাম। আমাদের আজকের ভ্রমণসূচি তৈরি। স্বল্প
সময়টাকে যথাযত ব্যবহার করে যতটুকু দেখা যায়। সকালে নির্ধারিত সময়ের আগেই ড্রাইভার
আব্দুল মতিন এসে হাজির। আমাদের গাড়ি ছুটে গেল নাসিমন ভবন, বিএনপি অফিস, চট্টগ্রাম।
প্রায় দুইশত বছর আগে একজন ধনী সওদাগর প্রায় তিন একর মূল্যবান জায়গা জনসেবার জন্য
ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান। এই জায়গায় বৃটিশ আমলে নির্মিত দুইটি বিশাল ভবন
রয়েছে, একটি ভবনে চট্টগ্রাম ওয়াকফ সরকারি কার্যালয় এবং অন্য ভবনটি দখল করে
নিয়েছে বিএনপি চট্টগ্রাম। বৃটিশ ঐতিহ্যে নির্মিত উঁচু ছাদের ওয়াকফ অফিসে ঢুকে সাদর
অভ্যর্থনা পেলাম।
এই অফিস প্রধান নাসির উল্লাহ
আমাদের সহসঙ্গি যীশুর চাচাত ভাই। তাঁর পদবী ওয়াকফ পরিদর্শক। তিনি দু’তলার বাসিন্দা
ও নিচতলা অফিস। অফিসে তাঁর অধীনে বেশ কয়েকজন পাইক পেয়াদা ধরণের কর্মচারী কাজ করেন।
ভাল নাস্তা ও কফি আসে। বিদেশে ড্রাগন ফলের স্বাদ নিলেও করোনার জন্য বিদেশ যাত্রা
বন্ধ। বহুদিন পর আবার এখানে ড্রাগন ফলের স্বাদ নেই। এই অফিসে বসে কিছু অজানা বিষয়
জানা হল, যা আগে আমার ধারণায় ছিলনা। আদিমকাল থেকেই কর্ণফুলি নদী ও বঙ্গপোসাগর
বিধৌত চট্টগ্রাম বাংলার প্রসিদ্ধ বন্দর ও ব্যবসাকেন্দ্র। সব সময়ই এই এলাকায় ছিল
সম্পদ ও টাকার ছড়াছড়ি। তাই যুগেযুগে এখানকার অনেক মহানুভব ভিত্তবান মানুষ প্রচুর ধনসম্পদ
ও ভূমি জনকল্যানে ওয়াকফ করে যান। মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এবং অসংখ্য পীরের মোকাম এসব ওয়াকফ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত। এসব ওয়াকফ সম্পদের আয়ও কম
নয়। ওয়াকফ পরিদর্শক নাসির উল্লাহ জানান, চট্টগ্রামের ওয়াকফ সম্পদ-দাতাদের অসিয়ত
অনুসারে আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব তাঁদের। যে সব মাজারে আয়
বেশী সে সবের দানবাস্ক ওয়াকফ পরিদর্শক ও সরকারি ম্যাজিস্টটের উপস্থিতিতে খোলা হয়।
অনেকটা ব্যাংকের ভল্টের মত, দানবাস্ক খোলতে খাদেরমদের চাবির সাথে সরকারের
প্রতিনিধির চাবির দরকার হয়। মাসে একবার দুইবার সরকারি ওয়াকফ পরিদর্শক গিয়ে বাস্ক
খোলেন এবং সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা নিয়ে যান। নাসির উল্লাহ জানালেন সরকারের এত
প্রহরার পরও ওয়াকফ সম্পদ ও এইসব সম্পদের প্রচুর আয় নয়ছয় হয়ে যায়। অফিসে বসে সীমিত
জনবল দিয়ে এত ওয়াকফ সম্পদ যথাযত ব্যবস্থাপনা ও পাহারা দেওয়া সম্ভব হয়না।
চট্টগ্রামে ওয়াকফকৃত প্রায়
মাজারই পাকা ঢালাই ঘরের মেঝে সুসজ্জিত করে স্থাপিত। কবরের উপর ও দানবাস্কে হাজার
হাজার টাকা বর্ষণ হয়। কবরের উপর ফেলা ভক্তদের দানের টাকা ও সোনা হরহামেশা চুরি হয়ে
যায়। এই চুরি ঠেকাতে কিছু মাজারে চিকন গ্রিল লাগানো হয়। কিন্তু দেখা যায় লাটির
আগায় আঠা লাগিয়ে খাদেমরা টাকা তুলে লোপাট করে দেয়। তারপর সরকার বাধ্য হয়ে গ্রিলের
সাথে কাঁচের শক্ত আবরণ টেনে দেয়।
হজরত বায়জিদ
বোস্তামির(রঃ) মাজার দর্শনঃ
আমরা হজরত বায়জিদ বোস্তামির(রঃ)
মাজারে যাব জানতে পেরে ওয়াকফ পরিদর্শক নাসির উল্লাহ বললেন তিনিও আমাদের সাথে
যাবেন। এই মাজারও একটি ওয়াকফ করা ভূসম্পদ। নাসির উল্লাহ সাহেব আমাদের সাথে থাকায়
এখানেও আমরা রাজানুকল্য পেলাম। স্বয়ং দরগার মোতাওয়াল্লি মৌলভি হাবিবুর
রহমান সাহেব আমাদের খেদমতে হাজির হন।
তিনি ফর্সা সাদা শশ্রুধারি সুদর্শন প্রৌড় বয়সী লোক। ধবধবে সাদা পঞ্জাবি ও পাজামা পরে আমাদেরকে দুতলায় তাঁর অফিসে
নাস্তায় আমন্ত্রণ জানান। আমি দুইধরনের লোকের চেহারায়
প্রশান্তির আলো দেখতে পাই। একদল যারা প্রচুর পরিশ্রম করে জীবনে সফলতা পান এবং আরেকদল যারা তেমন পরিশ্রম না করেই জীবনে সবকিছু সহজে পেয়ে যান। আল্লাহ পাকের নিয়ামতরাজি হল ধন, জন, মান, সম্মান,
সুখ শান্তি ইত্যাদি। মোতাওয়াল্লি হাবিব সাহেবের অভিজাত নুরানি চেহারার
পানে তাকিয়ে তাঁকে আমার দ্বিতীয় দলের একজন ভাগ্যবান লোকই মনে হল। তিনি
প্রায় সত্তুরটি সিড়ি বেয়ে আমাদেরকে পাহাড়ের উপর বায়জিদ
বোস্তামির(রঃ) স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। কবরের মত সাজানো স্মৃতিকাঠামো একটি সুরম্য
ভবনের ভিতরে স্থাপিত। কবরাকৃতির কাঠামোর উত্তর শিরোভাগে বড় সবুজ পাগড়ি লাগানো যেন পাগড়ি মাথায় দিয়ে কেউ মাটিতে শুয়ে আছেন। মাজার
কাঠামোর চারপাশে আগর ধূনা ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ভক্তরা বসে বসে জিকির আজকার করছেন।
মোতাওয়াল্লি জানালেন কুড়ি একরের এই বিশাল দরগাহ কমপ্লেক্স হাজার বছরের পুরানো। পাহাড়ের
ধাপে সিড়ির দুপাশে কিছু জনকবর রয়েছে, তবে হজরত শাহজালালের(রঃ) মাজারের মত
পরিবেষ্টিত গুরুস্থান নেই। মোতাওয়াল্লি
হাবিবুর রহমান মাজারটি হাজার বছরের পুরানো দাবি করলেও পরে জানলাম এই সমাধি আবয়ব ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনায়
আবিস্কার করা হয়। আঙ্গিনার ঠিক মাঝামাঝি একটি শবাধারের
কাঠামো ছিল। পরে এখানে আধুনিক সমাধি কাঠামো ও ভবন নির্মাণ করা হয়। সমাধি পাহাড়ের
পাদদেশে মোঘলরীতিতে নির্মিত একটি তিন গম্বুজ মসজিদ এবং একটি
বড় পুকুর রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী দেখে অনেকে
ধারণা করেন এই মসজিদটি মোঘল সম্রাট আলমগীরের আমলে নির্মিত।
এই মাজারটি যদিও ইরানের বিখ্যাত সূফি বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) নামে স্থাপিত, কিন্তু তিনি চট্টগ্রাম
এলাকায় আসার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়না। প্রাচীন আমলে অনেক সূফি সাধক ও আউলিয়া চট্টগ্রাম এলাকায় ইসলাম প্রচারের সময় পাহাড়ের উপর
জঙ্গলঘেরা স্থানে আবাস স্থাপন করেন। তাঁরা এসব জায়গায় মাজার কিংবা এধরনের বিভিন্ন
স্মৃতি স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) মাজারটাও মূলত উনাকে উৎসর্গ
করে তাঁর ভক্তগণের প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিরূপ মাত্র।
কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া না
গেলেও এলাকায় জনশ্রূতি আছে যে হজরত বায়জিদ বোস্তামি(রঃ) চট্টগ্রামে এসেছিলেন এবং
এখানে কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি পারস্যে ফিরে যান। ভক্তগণ তাঁকে চট্টগ্রামে থেকে
যাবার অনুরোধ করলে তিনি তাঁদের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে স্বীয় আঙ্গুল কেটে কয়েক ফোটা
রক্ত মাটিতে ফেলেন এবং ঐস্থানে তাঁর নামে মাজার গড়ে তুলার কথা বলে প্রস্থান
করেন।
বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) কাছিমঃ
বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) মাজারের
পাদদেশে একটি বিশাল দিঘি রয়েছে। এই দিঘি বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) কাছিম ও গজার মাছের জন্য বিখ্যাত। মোতাওয়াল্লি সাহেব আমাদেরকে পুকুরের
ঘাটে জলে ভাসা বড় আয়বয়ের কচ্ছপদের সামনে নিয়ে যান ও ছবি তুলেন। মোতাওয়াল্লি বললেন বায়জিদ বোস্তামির(রঃ)
কাছিম বিশ্বে একটি বিরল ও চরম বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপ হিসাবে
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আর বললেন, বর্তমানকালে বায়জিদ বোস্তামির(রঃ) মাজার
প্রাঙ্গণ ব্যতিত পৃথিবীর আর কোথায় এই প্রজাতির কাছিমের দেখা মেলেনা। বর্তমানে
মাজারদিঘিতে দুই তিন শত শত কচ্ছপ রয়েছে বলে তিনি ধারণা করেন। মাজার কতৃপক্ষ প্রজনন
মৌসুমে মূল পাহাড়ের পিছনে সংরক্ষিত বালুকাময় স্থানে এই কাছিমদেরকে ডিম পাড়ার
ব্যবস্থা করে দেন।
এই মাজারের ভক্তকূলের ধারণা ও
জনশ্রুতি হল, আদিকালে এই অঞ্চলে প্রচুর দুষ্ট জ্বিন ও পাপাত্মাদের পদচারণা ছিল। বায়জিদ
বোস্তামি(রঃ) চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে এইসব দুষ্টদেরকে কাছিমে পরিণত করে
আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ প্রদান করেন।
সীতাকুন্ড ইকোপার্ক, চন্দ্রনাথ
পাহাড় ও গুলিয়াখালি সাগর সৈকত দর্শনঃ
আমাদের দলনেতা জগত চন্দ্র সাহা স্যারের
অদম্য ইচ্ছে সীতাকুন্ডের সন্নিকটে বারশত ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়চূড়ে
অবস্থিত হিন্দু ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান প্রাচীন চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই চন্দ্রনাথ মন্দিরের অনেক নামডাক শুনেছি, কিন্তু
সেখানে পা ফেলার সৌভাগ্য হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতাকুন্ড বাংলার এক
প্রাচীন জনপদ, পশ্চিমে কূলহীন বঙ্গোপসাগর ও পুর্বদিকে সুউচ্চ পর্বতমালার মাঝে
সীতাকুন্ড যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপূর্ব লীলানিকেতন। আমরা সীতাকুন্ডে আসছি
জানতে পেরে জগত স্যারের আত্মীয় পূবালী ব্যাংকের ইপিজেড শাখার কর্মকর্তা রবিন কুমার
সাহা তাঁর গ্রামের বাড়িতে দুপুরের খাবারে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ
জানান। সীতাকুন্ডের সেই গ্রামটির নাম জাফরাবাদ,
বাংলাদেশের আর দশ গ্রামের মত একটি চিরসবুজ গ্রাম। গাড়ি গ্রামের ছোট রাস্থার মুখে
আসতেই একজন সুদর্শন তরুণ আমাদেরকে বরণ করতে আসেন। মায়া মায়া
চেহারার এই তরুণকে দেখে ভাবী সে হয়ত সদ্য স্কুল ছেড়ে কলেজে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র
হবে। তাঁর বাবা হয়ত আমাদেরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে ওকে পাঠিয়েছেন। ছোট ছোট বাড়ি,
প্রতি বাড়ির সামনে পুকুর। টিনের পাকা পাকা ঘর, গ্রামে বিদ্যুৎ
ও গ্যাস রয়েছে। পুরো গ্রামে এক আধুনিক মধ্যভিত্ত জীবনের অবয়ব।
জাফরাবাদের এই ছিমছাম হিন্দু বাড়িতে
ঢুকে সোফায় বসতেই জানতে পারি পথপ্রদর্শক এই বিনয়ী তরুণটিই আমাদের মেজবান রবিন কুমার সাহা। তাঁর বাবা নেই, ঘরে আছেন
চিরলক্ষি মা এবং সদ্য বিয়ে করে ঘরে নিয়ে
আসা নববধু নোয়াখালী কন্যা তৃষা সাহা। রবিনের বয়স্কা জননী এবং নববধু তৃষা সাহা
মেহমান সেবায় অতিতৎপর হয়ে যান। অতিথিসেবায়
চট্টগ্রামবাসীদের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। শরবতের পর ফল, তারপর ডাইনিং
টেবিল। সেখানে এলাহি কারবার। চিংড়ি, খাশি, মোরগ, ডিম, রূপচাঁদা, শুটকিভুনা,
সাদাভাত ও পোলাও। মনে মনে লজ্জা পেলাম এই ভেবে, রবিনের মা ও বৌকে আমরা ঢাকার
মেহমানরা তাহলে অনেক রান্নাকষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি জানতাম চাটগাবাসী মানুষকে
খাওয়াতে খুব আনন্দ পান। রবিন সাহার ঘরে তাঁর সত্যতা শতভাগ পেয়ে
গেলাম। জাফরাবাদের এই বাড়িতে এসে বুঝলাম রবিনের ঘরে সুখ আছে।
ঘরের তিনজন মানুষের সবাই বিনয়ী, সবাই দিলখোলা। আমাদের সাথে তাঁরা
ছবি তুলেন। পাশে বসেন। গল্পগোজব করেন। ভাবনাটা এমন, তাঁরা যেন আমাদের অনেক দিনের
পরিচিত আপনজন।
সীতাকুন্ডের জাতক রবিন সাহা এখানে
আমাদের গাইড। তিনি আমাদেরকে সীতাকুন্ড ইকোপার্কে নিয়ে যান। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের
পাদদেশে টিলাময় উপত্যকা্র সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে এই বড় পার্কের অবস্থান। আমরা
টিকেট কেটে গাড়ি নিয়ে পার্কের ভিতরে ঢুকে পড়ি। এই পার্ক হতে চন্দ্রনাথ মন্দিরের
দূরত্ব কয়েক মাইল। উচ্চতাও হাজার ফুট পার হবে। আমরা পার্কে সময় নষ্ট না করে গাড়ি
নিয়ে মন্দিরের আশায় গাড়ি ছুটালাম। ঘন বনবৃক্ষের আবরণ ভেদ করে গাড়ি ধাপে ধাপে উপরে
উঠতে থাকে। উপর থেকে উপরে, তারপর আর উপরে, বায়ুর চাপ কমে দুইকানের পর্দা পটপট
করছে। জগত স্যার আঙ্গুল কানে ঢুকিয়ে কান বাঁচাতে ব্যস্ত। আমার শ্রবণ শক্তি যেন আর
বেড়ে গেল। তিন চার মাইল যাবার পর বন বিভাগের একটি নয়নাভিরাম পর্যটন স্পটে এলাম। এই স্পটে প্রহরীরা আমাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেন এবং বিনয়ের সাথে জানিয়ে দেন আর যাওয়া
যাবেনা। কেন যাওয়া যাবেনা ? জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, চন্দ্রনাথ
মন্দির এখনও কয়েক মাইল ভিতরে। এই দুর্গম পথ চোর ডাকাতের অভয়ারণ্য। তাই বাৎসরিক পূজা
পার্বণ ছাড়া এই রাস্থা দিয়ে কাউকে মন্দিরে যাবার অনুমতি
প্রদান করেনা সরকার। সার্বভৌম শক্তিধর সরকার বাহাদুর কি এখানে ব্যর্থ?
বলতেই রবিন সাহা জানালো এই জংলাকীর্ণ পাহাড়ে স্থানীয় জংলি ডাকাতরা এত ভয়ংকর যে,
সরকার ওদের সাথে পেরে উঠতে পারেনা, জননিরাপত্তায় তাই এই ব্যবস্থা। কি আর
করা যায়। জীবনে অনেক শখই অপূর্ণ থেকে যায়।
আমি ও জগত চন্দ্র স্যারের চন্দ্রনাথ মন্দির জয়ের স্বপ্নীল রথযাত্রা
এখানেই থেমে গেল।
উঁচু পাহাড়ে এলোমেলো হাওয়া বইছে।
বসন্তের মায়াবী রোদ পাহাড়ি বৃক্ষের পাতায় পাতায়
লুকোচুরি খেলছে। চিরসুন্দর এই পাহাড়ি এলাকার মনোরম দৃশ্য দেখতে আমরা
গাড়ি ছেড়ে নামলাম। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে সিড়ির পর সিড়ি নিচে নেমে গেছে।
আমরা সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করি। ছায়াবৃক্ষের চিরল পাতার ফাঁকে বসন্ত রোদ ঝিকিমিকি
করছে। পাখি গাইছে। সুন্দর বিকেল, শতাধিক সিড়ি নেমে দেখি পাতালপুরী এখনও- দিল্লি
হনজু দূর কাওয়াস্ত। আর নিচে নামলে বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে আসা কঠিন হবে। তাই পাতালপুরী
না ছুঁয়েই ফিরে এলাম মর্ত্যলোকে পাহাড়ের মাথায়, পাহাড়ি রাস্থায়। এবার ফেরার পালা, গাড়ি নিচে নামছে তো নামছেই।
পাহাড়ি ধাপ বেয়ে নামতে নামতে আসরের সময় আমরা সীতাকুন্ড ইকো
পার্কে নেমে আসি। সীতাকুন্ড পাহাড়ের পাদদেশে
নিম্নধাপের উপত্যকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে সীতাকুন্ড ইকোপার্ক। এখানে
একটি নৈসর্গিক মঞ্চে সাম্যবাদী কবি কাজি নজরুল
ইসলামের বিশাল আকৃতির ম্যুরাল রয়েছে। এই সুরম্য পার্কে ঘুরে ঘুরে
আধা ঘন্টা সময় পার করি। পশ্চিমাকাশে তখনও সূর্য জ্বলছে।
এবার আমাদের গুলিয়াখালি সমুদ্র
সৈকতে যাবার পালা। এই পার্ক থেকে বেরুতেই সমতল ভূমি। গাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়। মহাসড়কের পশ্চিমের একটি
গ্রাম্য সরু রাস্থা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যায়। চালকের পাশে আমাদের গাইড রবিন কুমার
সাহা। সাগরপারের অন্য দশটা গ্রামের মত এক জনপদে যখন ঢুকি তখন গোধূলিবেলা। রাখালেরা
গরুর পাল নিয়ে বাটি ফিরছে। সাগরপারের খালে খালে জোয়ারের পানি নেমে কাদা ছুঁয়ে আছে।
রাস্থার দু’পাশে শস্যক্ষেত সবুজে ছেয়ে আছে। ভূল রাস্থায় যাবার কারণে সৈকত বেশ
দূরে। গাড়ি নিয়ে সেখানে যাবার সংযোগ নেই, একটি খাল সৈকতের রাস্থা আটকে রেখেছে।
দূরে গুলিয়াখালি সৈকতে মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। আমাদের দৃঢ প্রতিজ্ঞ এতদূরে যখন
এসে গেছি, রাত হলেও গুলিয়াখালী সৈকত না দেখে যাবনা। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে বাঁশের
সরু সাঁকো বেয়ে খাল পার হলাম। শস্যহীন জমি দিয়ে আমরা যখন গুলিয়াখালী সৈকতের পানে
উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি, পর্যটকরা তখন দলে দলে ঘরে ফিরছেন। আমরা যখন সাগরসৈকতে গেলাম,
সৈকত তখন প্রায় জনশূন্য। এই সৈকত বাংলাদেশের অন্যান্য সৈকতের মত নয়। এখানে সৈকত
জুড়ে ছেয়ে আছে মনগ্রোভ বনের বৃক্ষরাজি। সারাটা সৈকতে ধ্বসে পড়া কবরের গর্তের মত অসংখ্য গর্ত, যেন যুদ্ধকালীন সময়ে
সেনাদলের খনন করা বাংকারের সারি ছোট ছোট নালা কেটে কেটে একটার সাথে অন্যটা যেন
সংযোগ করে দেয়া। জোয়ারের সময় সবগুলো বাংকার ও মনগ্রোভ বৃক্ষরাজি জলে সাঁতরায়।
আবার ভাটায় পর জল শুকিয়ে বাংকারগুলোর সাথে সাগরগামী আঁকাবাঁকা নালারা
মুখ মেলে। ফাঁকে ফাঁকে সুন্দরবনের নানান প্রজাতির বৃক্ষরাজি
কোমরজল হতে বেরিয়ে আসে। বেশ রাত করেই আমরা ফিরলাম
চট্টগ্রামের হোটেল হোয়াইট ইনে।
সেদিন আমরা পূবালী ব্যাংকের
তিনটি শাখা ভ্রমণ করি। আগ্রাবাদ শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক শামসুদ্দোহা খুলনার
জাতক। বুদ্ধিমান ও বাচাল শামসুদ্দোহা আমাদের খুব খাতিরযত্ন করেন। ধুলাবালি ঠেলে
আমাদের গাড়ি পোর্টশাখায় যায়। ব্যবস্থাপক কাশেম শিকদার ফল খাবারে আপ্যায়ন করেন। ক্ষণিকের
জন্য সীতাকুন্ড শাখায় ঢু মারি। ব্যবস্থাপক মোঃ গোলাম কিবরিয়া মুরাদের সাথে পরিচয়
হয়।
প্রথমবার পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি
ভ্রমণ, ফিরে দেখা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
১৯ মার্চ ২০২১, পূবালী ব্যাংকের
গাড়ি আমাদেরকে আজ খাগড়াছড়ি পৌঁছে দেবে। পরদিন ২০ মার্চ চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের
আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সম্মেলন। সেই সম্মেলন উদ্ভোধন করবেন সদ্য নিযুক্ত ব্যবস্থাপনা
পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী। এই জরুরী সময় গাড়ি পাঠানো খুব কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটি
করলেন আমার সহপাঠি ও সহকর্মী উপমহাব্যবস্থাপক মাহবুব আহমদ।
সকাল ৬টায় চালক আব্দুল মতিন এসে
হাজির। আমরা ছুটলাম পতেঙ্গা সাগর সৈকতে। নতুন নির্মিত চারলেন বাইপাস সড়ক। দুইপাশের
পাহাড়ি দৃশ্য দারুণ উপভোগ্য। আমরা নিরিবিলি রাস্থায় নেমে পাহাড়ের ছায়ায় অনেক ছবি
তুলি। পতেঙ্গা মেরিন ড্রাইভ সড়ক বিশাল, নির্মাণকাজ অত্যাধুনিক। ডানপাশে বয়ে গেছে
কর্ণফুলী। অত্যাধুনিক পতেঙ্গা সি-বিচে গিয়ে মনে হল যেন বিদেশে আছি। কর্ণফুলির
মোহনায় নদী ও সাগরের মিলনস্থল পতেঙ্গা সি-বিচ। কিন্তু ছাত্রজীবনে কংক্রিট ব্লকে
বসে দেখা সাগরের সেই উত্তাল বাতাস ও ঢেউয়ের দেখা না পেয়ে বেশ হতাশ হলাম। নীলসাগর
যেন একেবারে শান্ত মনে বসন্তের রোদ পোহাচ্ছে। কিছু সংখ্যক জাহাজ ও নৌকা দূরে ভেসে
আছে। নব্বইয়ের দশকের সেই জমজমাট ঝিনুকবাজার নেই। কেবল দু’একজন হকার চা-বিস্কুট ও
বাদাম বিক্রি করছে।
খাগড়াছড়ির পথে খানিক যাবার পর
বাদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক পেয়ে যাই। আমার ছাত্রজীবনে এই গেট ছিলনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শহর থেকে অনেক দূরের অজপাড়াগাঁয়ে। এখন চট্টগ্রাম শহর
এসে যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে ছুই ছুই করছে। গেটের ভিতর গাড়ি প্রবেশ করলে দেখি তিরিশ
বছর আগের দু’পাশের সেই শিম বাগান, ধানক্ষেত, সবজিক্ষেত আগের মত নেই। আশপাশে কেবল
পাকা ঘরবাড়ির ছড়াছড়ি। গড়ে উঠেছে অনেক নতুন নতুন পাড়া ও জনপদ। বিশ্ববিদ্যালয়
রেলস্টেশনের কাছে আমাদের গাড়ি এলে অবাক হই লোকে লোকারণ্য একটি সড়কবাজার দেখে।
আমাদের সময় এই রাস্থার হাট ছিলনা। আশপাশের গ্রাম হতে আসা মাছ-মোরগ, তরিতরকারি,
ফলমূল সবই এই বাজারে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। হাটুরে ভীড় ঠেলে গাড়ি ক্যাম্পাসে ঢুকে
গেল। আমরা নামলাম, উঁচু সড়কদ্বীপের চারপাশে, পাহাড়ের কাছে ছবি নিলাম। স্মৃতিবিজড়িত
রেলস্টেশনে এলাম। সেই একই সুদীর্ঘ্য রেলস্টেশন, সামনে লম্বা প্লেটফর্ম, বালির
স্থুপ, খানিক ময়লা। জনাকয়েক বালক লাফালাফি করছে, বেওয়ারিক কুকুরের দল ঘুমাচ্ছে। এই
স্টেশন, সেই তিরিশ বছর আগেকার মতই আজও আছে। প্লেটফর্মের দুইপ্রান্তে এখনও দুইটি
সাদা সাইনবোর্ড দু’পায়ে দাড়িয়ে কালো হরফে জানান দিচ্ছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
রেলস্টেশন।
রেললাইনের ওপারে শান্ত সবুজ
গ্রাম।
করোনা মহামারির
কবলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়
শ্যাটল ট্রেন এবং বাস চলাচল করছেনা। ক্যাম্পাস বন্ধ,
ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল নেই। এমনিতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এক পাহাড়ঘেরা অরণ্য জনপদ। সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারির আতংক, চারপাশে
পিনপতন নীরবতা। গেটে ঢুকেই আমি চালককে সড়কদ্বীপের ডানদিকে যাবার নির্দেশ দেই। এই নৈসর্গিক ক্যাম্পাসে চিরপরিচিত শাহজালাল হল, আমানত হল, সোহরাওয়ার্দি হল পেরিয়ে বৃত্তাকার পথে
এগিয়ে যাই। পাহাড়ের উপর নির্মিত অডিটরিয়ামের সামনে থেমে সাজিয়ে রাখা
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িগুলোর সামনে ছবি নেই।
গাড়ি এগিয়ে সামনে আমাদের প্রিয়
সমাজবিজ্ঞান অনুষদে প্রবেশ করে। ছাত্রজীবনে সিলেট থেকে এসে প্রথম এই ছয়তলা ভবন
দেখে ওটাকে সীমাহীন বড় লেগেছিল। আজ এই একই ভবনকে সেদিনের মত বিশাল মনে হচ্ছেনা। আজ
আমি রাজধানী ঢাকায় বাসিন্দা। ঢাকায় এবং পৃথিবীর দেশে দেশে সফর করে নানা মহানগরে
অনেক দৈতাকার ভবনমালা দেখায় হয়ত এই দৃষ্টিভ্রম। চারপাশে কোকিল ডাকছে, বসন্ত বউড়ি
গাইছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এই সাবেক শিক্ষার্থীকে স্বাগত না জানালেও প্রকৃতি যেন ফলে-ফুলে,
বসন্তের রোদে-গানে তাঁকে বরণ করে নিচ্ছে।
দেখে খুব খুশি হলাম, আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস ভবনের নামকরণ করা হয়েছে ‘মোহাম্মদ ইউনুস ভবন’। তিনি
একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অর্থনীতি
বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পাশের জোবরা গ্রামে তিনি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে
গবেষণা করেন। তাঁর সামাজিক মালিকানা এবং ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বাংলাদেশ পেরিয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামীন ব্যাংকের কল্যাণ্যে নারীরা স্বাবলম্বী হন, অবলাদের ক্ষমতায়ন ঘটে এবং গরিবরা উপকৃত হন। ফলে ডঃ
ইউনুসের দারিদ্র হটানোর ক্ষুদ্রঋণ উন্নত মডেল দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশের
গৌরব, ক্ষুদ্রঋণের দার্শনিক ও সফল
প্রয়োগকারী শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের নাম সমাজবিজ্ঞান অনুষদের
ভবনমালায় ক্ষুধিত দেখে আমার বুকটা সত্যিই ব্যাঙফোলার মত গর্বে ফোলে ওঠে।
প্রায় দুই হাজার একর আয়তনের
বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটা স্বল্প সময়ে ঘুরে দেখা চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া আমাদের
হাতে তেমন সময় নেই যে বিশাল বিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয় পল্লী চরে বেড়াই। সামনে
পাহাড়ঘেষে নতুন বানিজ্য অনুষদ হয়েছে। সময় ব্যবস্থাপনার শিকলে আমাদের হাত-পা বাঁধা
থাকায় অফিস, পাঠাগার, বুটানিক্যাল গার্ডেন, বিজ্ঞান অনুষদ, বন অনুষদ,
সমুদ্রবিজ্ঞান অনুষদ ইত্যাদি ঘুরে দেখা হলনা। মনে হল আমার স্মৃতিময় জায়গা যতটুকু
দেখেছি, তাই এনাফ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে একত্রিশ
বছর পর আমার পা-রাখা সফল ও সার্থক।
সময় নষ্ট করা যাবেনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছেড়ে গাড়ি খাগড়াছড়ির
পানে ছুটল। হাটহাজারী দারুল উলুম কওমি মাদ্রাসার পাশে এলাম।
আমি ও যীশু বাংলাদেশের এই বিখ্যাত কওমি মাদ্রাসা দেখতে উদগ্রীব ছিলাম কিন্তু সময়ের
অভাব। কোন কোন সময় আসে, যাকে নষ্ট করা যায় না, অথচ জীবনে কত সময়ই না অযথা অকাজে নষ্ট
হয়। আমরা রাজধানী ফেরার পরই ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মুদী ঢাকা আসেন। তাঁর আগমনের প্রতিবাদে হাটহাজারী দারুল
উলুম মাদ্রাসা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগুন জ্বলে ওঠে। তালবা-পুলিশ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন মানুষ এই দুই জায়গায় নিহত হন। দাঙ্গায় উপজেলা
শহর হাটহাজারী ধ্বংসস্থূপে পরিণত হয়। সহজ সরল হুজুরদেরকে বাইরের কেউ উসকানি দিয়ে
হয়ত এমন লঙ্কাকান্ড ঘটায়। মানুষের লিল্লাহ জাকাতে চলা এসব মাদ্রাসার হর্তাকর্তাদের
বিচিত্র সব কান্ডকারখানা টেলিভিশনে দেখে দেশবাসী হতবাক হন। আমরা পস্তাই, হায়রে
হায়, যত্তসব লংকাকান্ড এবং দ্বীনি
কর্যকলাপের নীরব সাক্ষী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী দারুল উলুম
মাদ্রাসা কেন যে না
দেখে ফিরে এলাম।
চট্টগ্রাম হতে খাগড়াছড়ির দূরত্ব
১১২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পার্বত্যজেলা খাগড়াছড়ি যাবার ইচ্ছে
হলেও আমরা যেতে পারিনি। তখন সেখানে ছিল শান্তিরক্ষী বাহিনীর উৎপাত। অপহরণ,
চাঁদাবাজি, খুন, সেনা-বিদ্রোহী গুলীবিনিময়, হত্যাকান্ড ছিল সেখানকার নিত্যনৈমিত্তিক
ঘটনা। সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে খুব প্রয়োজন ছাড়া এই জেলায় সেকালে কাউকে যেতে
দিতনা। তাই বাংলাদেশের এই জেলায় আমি আজ সম্পূর্ণ নতুন অতিথি। উচু-নীচু পাহাড়ি
রাস্থা, গাড়ি পাহাড় বেয়ে বেয়ে অনেক উপরে উঠে , আবার ধাপে ধাপে নেমে আসে। এভাবে অপর
হতে নিচে ওঠানামা করে ক্রমান্বয়ে গাড়ি উপর হতে উপরে উঠতেই থাকে। বিপদজনক মোড়,
সামনে দৃষ্টিদূরত্ব সীমিত, গাড়িতে বসে মাঝে মাঝে ভয়ে প্রাণ সিউরে উঠে। দু’পাশে
সবজি, আম ও আনারাস বাগান। জুমুয়ার আজান কানে এলো। একটি সুউচ্চ পাহাড়ি গ্রামে গাড়ি
থামে। খানিক উপরে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে মসজিদের পিছনে পেঁপে বাগানে
ঘুরে বেড়াই। এখানে পাহাড়ি দৃশ্য বেশ মনোরম। পাহাড়ি ও বাঙালি সেথায় আছেন মিলেমিশে।
খানিক এগিয়ে রাস্থার পাশে
পরিপাঠি পাহাড়ে নির্মিত সুদৃশ্য সেনানিবাস। সেনাপ্রধান আজিজ আহমদের বড় তৈলচিত্র
ভিতরে শোভা পাচ্ছে। খাগড়াছড়ি শহরে ঢুকার প্রায় দুই মাইল আগে আলোক নবগ্রহ
ধাতুচৈত্যের বৌদ্ধবিহারে গাড়ি থামে। পাহাড় বেয়ে অনেক উপরে এক জমকালো প্যাগোডায়
আরোহন করি। প্যাগোডার রঙ সোনালি হলুদ। কমলা বসনা কয়েকজন ভিক্ষু পাশের ভবনে নড়চড়
করছেন। মন্দিরের সামনে বিশাল আকারের আরসিসি নির্মিত শোয়ে ও বসে ধ্যানরত
লাল-সোনালি-সাদা কারুকাজ করা কয়েকটি বৌদ্ধমূর্তি। আমি খানিক এগিয়ে গেলে একজন বালক ভিক্ষু
আমাকে জুতা নিচে রেখে আসতে বলে। নিচ বলতে অনেক নিচ, নেমে জুতা রেখে আসা বেশ
কষ্টসাধ্য। কিন্তু তাঁরা নাছোড়বন্দা। আবার জুতা হাতে করে নিতে চাইলেও তাঁরা বাঁধা
দেয়। বিষয়টা নিয়ে যীশুর সাথে ভিক্ষু বালকদের খানিক ঝগড়াও হয়।
স্বর্ণ-প্যাগোডা চত্বরে খানিকক্ষণ
হেঁটে নিচে নেমে আসি। গাড়ি এবার খানিক এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের পাশে নিরিবিলি জায়গায়
থামে। আমরা দৌড়ে একটি গেট দিয়ে আলুটিলা পাহাড়ি পর্যটন স্পটে ঢুকে যাই। অনেক ভিতরে
গিয়ে এক গিরিখাদের প্রান্তসীমায় পৌছি। পাহাড়ের শিরোভাগে পর্যটন স্থাপনা। দর্শকরা
দলে দলে পাহাড়ের খাড়া ঢালুর প্রান্তে নির্মিত নিরাপত্তা দেয়ালযুক্ত স্থাপনায়
দাঁড়িয়ে অনেক নিচে নেমে যাওয়া সবুজ পাহাড়ি ঢালের দৃশ্য দেখছেন মনোমুগ্ধ হয়ে। এই
বিশাল ঢালু পাহাড় নিচের উপত্যকায় নেমে দুই মাইল দূরে আবার উপরে উঠে এসেছে আরেক
উচ্চ ভূমিতে। সেই উচ্চ ভূমিতে পার্বত্য জেলাশহর খাগড়াছড়ি গড়ে উঠেছে। বিশাল
এলাকাজুড়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে খাগড়াছড়ি শহরের সুদৃশ্য ভবনমালা দেখা যাচ্ছে। খানিকটা
নগরকোটের দৃশ্য, তাই জায়গাটাকে মিনি নেপালই মনে হল। এই স্পট থেকে আলুটিলা
পর্বতগোহা দেখতে আমরা তিনজন সিড়ি বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে শুরু করি। অনেক নিচে গিয়ে
একটি ঘিসঘিসে অন্ধকার গোহামুখে হাজির হই। গোহা হতে নালাপথে চুষে চুষে খানিক পানি
বেরিয়ে আসছে। আমরা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে বেশ ভিতরে গেলাম। বাহিরে গরম লাগলেও
গোহার ভিতর ঠান্ডা, এসির বাতাসের মত শীতল বায়ু বেরিয়ে আসছে। কাছে একটি বিপদজনকভাবে
খাড়া পাহাড়ে টেকিং করে ফিরে আসি। এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ে অনেক পর্যটক নর, নারী ও
বাচ্চাদের সাথে ঘুরাঘুরি করে আবার গাড়িতে ফিরে আসি। খাগড়াছড়ি শাখার ব্যবস্থাপক মো: আজিজুর রহমান চট্টগ্রামে ব্যবস্থাপক সম্মেলনে চলে গেছেন। তিনি শাখার
অফিসার হেলাল উদ্দিনকে আমাদের সহায়তায় পাঠান। চট্টগ্রামের জাতক হেলাল উদ্দিন পরদিন
রাতে আমাদের ঢাকাফেরার জন্য গ্রিনলাইনের টিকেট কেটে দেন। আলুটিলা দেখা হয়ে গেছে
শুনে হেলাল সাহেব আমাদেরকে খাগড়াছড়ি পার্বত্যজেলা পরিষদ হার্টকালচার পার্কে নিয়ে
যান। শহরের উপকন্ঠে বাংলাদেরশের একটি সেরা পার্বত্য পর্যটন স্পট এটি। বিদেশেও এমন
সুন্দর পরিপাটি নয়নাবিরাম পর্যটন স্পট আমি তেমন দেখিনি। এখানে আছে সুন্দর পাহাড়ি
লেক, লেকের পারে পারে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় পুস্প উদ্যান, ভাস্কর্য্য, লতাফুলের গেট, লেকের উপর দিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজে এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ে
যাবার ব্যবস্থা। লোক চলাচলের সময় ঝুলন্ত সেতু দোলনার মত দোলতে থাকে। খাগড়াছড়ি গিয়ে
কেউ এই হার্টকালচার পার্ক না দেখে এলে বিরাট ঠকা খাবেন। এই পার্কে বিকেল ও
সন্ধ্যায় ছবি তুলে দোলনা চড়ে গিরিখাদের অপূর্ব দৃশ্য দেখে মহানন্দে কেটে গেল। হৃদয়
প্রতিকের ভালোবাসা মঞ্চে ছবি তুলে যখন বেরুলাম, তখন চারপশে রাতের অন্ধকার।
খাগড়াছড়িতে আমাদের আবাস হোটেল গাইরিং। গাইরিং একটি টিপরা শব্দ, যার অর্থ ‘পাহাড়ি
টংঘর’। পাহাড়ি জীবনের নানা তৈলচিত্রে সুসজ্জিত পাঁচতলা এই হোটেলের মালিক বিকাশ টিপরা। তিনি একজন ট্রিপুর ব্যবসায়ী। আমাদের
পূবালী ব্যাংকের একজন ভিআইপি কাস্টমার তিনি
। ভদ্রলোক উপজাতীয় হলেও ভাল ব্যবসা জানেন এই
হোটেলে ঢুকেই বুঝা গেল। থাই চেহারার উপজাতীয় সুদর্শন তরুণরা
এই হোটেল পরিচালনা করেন। তাঁদের সেবা যত্নে আমরা বিমুগ্ধ হই।
পরদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েই
পাশের প্যাগোডায় যাই। বুদ্ধমুর্তির সামনে দাড়িয়েই যীশুকে বলি, তিনি গৌতম, তিনি
ঈশ্বর বিষয়ে কোন ধারণা দেন নি, অথচ তাঁর অনুসারীরা তাঁকেই ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছে। এবার
আমরা দুইজন এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে হেঁটে হেঁটে জেলাপ্রশাসকের বাংলোয় হাজির হই। একজন
প্রহরী পাহারা দিচ্ছেন। তাঁর বাড়ি চাঁদপুর। পাহাড়ের ধাপে ধাপে পাশাপাশি অনেকগুলো
অফিস এখানে। সিড়িকাটা পাহাড়ে জেলা জজের বাংলো বেশ বিলাসবহুল। গণপূর্ত অফিস
কমপ্লেক্সকেও আবাসিক এলাকা মনে হয়েছে। একটি জেলাশহরে যত ধরনের অফিস, আদালত, স্কুল,
কলেজ, হাসপাতাল যা কিছু থাকে সবই এই পার্বত্য শহরে সুসজ্জিত আছে।
দেড়দুই ঘন্টা ঘুরে এসে নাস্তা
করি। খাগড়াছড়ি হতে প্রকাশ হওয়া সব স্থানীয় পত্রিকা কিনে নেয় যীশু। কুচি কুচি করে
কেটে লবন মরিচ মিশানো মধ্যম সাইজের একটি
আনারাস এখানে মাত্র দশ-বার টাকা। সস্তায় পস্তাতে হয়না, তাই আমরা প্রচুর আনারয়াস
কিনে কিনে খাই।
জগত চন্দ্র স্যার খাগড়াছড়ির
স্পেশাল খাবার বাশ-পোলাও খেতে চাইলেন। আমি সায় দিলাম, কারণ আমি যেখানেই যাই সেখানে
স্পেশাল খাবার খুঁজি। গাইড হেলাল আহমদ আসার পর আমরা মহাজনপাড়ার কলেজ রোডে উপজাতীয়
ঐতিহ্যের হোটেল ও ফুড ওয়াল্ড Bamboo Shoot এ দুপুরের খাবার খেতে
যাই। দু’তলায় স্থানীয় উপজাতীয় রঙ্গে ঢঙ্গে সাজানো রেস্তুরা। ছাদে ঝুলছে বাঁশের
নানা কারু সামগ্রী। কুলা, ঝুড়ি, খাচা ইত্যাদি। উপজাতীয় শিল্পীদের আঁকা জুমক্ষেত
এবং পাহাড়ি গ্রামের নিসর্গের তৈলচিত্র।
এই ব্যাম্বু সোট হোটেলের ঐতিহ্যবাহী
রেসিপি বাশ-পোলাও। অর্ডার দেবার অনেকক্ষণ পর এল লাকড়ির চুলায় রান্না করা গরম গরম
বাশপোলাও। খাবার হতে ধুয়া বেরুচ্ছে, সাথে মজার ঘ্রাণ। আমাদের চুঙ্গাপূড়ার মত করে এখানে বাঁশের ভিতর
চিকন চাল ঢুকায়ে পোলাও রান্না করা হয়। সেইসাথে বাঁশের ভিতর রান্না করা গরম মোরগের
জালফ্রাই আসে। চাকমা সেফরা বিশেষ নিয়মে এই মোরগ জালফ্রাই রান্না করেন, তাতে মেশানো হয় শুটকি, কাচা কাটাল
ও ঢেরেস। পাহাড়ি নাগা মরিচ দিয়ে এই তরকারি খুব জ্বাল করা হয়। জ্বালের জ্বালায় জিব
পুড়লেও বাঁশ পোলাও খেতে খুবই মজাদার। এখানে হাতে প্রস্তুত আরেক স্পেশাল রেসিপি
তেতুলের শরবত খাই। কাচা তেতুলে প্রস্তুত ঈষৎ সবুজ শরবত খেতে বেশ মজাদার। প্রতি
গ্লাস তিরিশ টাকা।
পূবালী অফিসার হেলাল আহমদ এবার
আমাদেরকে নিয়ে ছুটলেন পানছড়ি মায়াবিনী লেকে। জেলাশহর খাগড়াছড়ি হতে দশবার মাইল দূরে
পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের কাংচাইরি পাড়ায় এক পাহাড়ি নিসর্গ মায়াবিনী লেক।
একটি বেবিটেক্সি ভাড়া করে ছুটলাম মায়াবিনীর মায়ায়। রাস্থার দুপাশে পাহাড়, জনশূন্য
প্রান্তর, মাঝে মাঝে পাহাড়ি গ্রাম। থাই চেহারার গাগরাপড়া নারী, লুঙ্গি ও রঙ্গিন
সার্ট গায়ে উপজাতীয় পুরুষ চোখে পড়ে। বাঙ্গালি লোকজন নাই বললেই চলে। দু’পাশের
উপত্যকায় সবজিক্ষেত, আম্রপলি ও কলাবাগান, ইক্ষু ও ধানক্ষেত। মনে হল এলাকাটা মিনি
নেপাল। রাস্থার সমান্তরালে আঁকাবাঁকা বয়ে গেছে এক সুন্দর পাহাড়ি ছড়া, লোকে বলে
ভাইবোনছড়ি।
পাহাড়ি জনপদে জনপদে চোখে পড়ে
সুরম্য বৌদ্ধমন্দির। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা উপজাতিয়রা হাতে টাকা এলেই প্রথমে
মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁরা ভগবান বৌদ্ধকে রোজগারের একটি বড় অংশ করেন কঠিন চিবর
দান। রাস্থার পাশে ক্ষেতের কিনারে কিনারে কিছু ছোট ছোট সমাধি মন্দির চোখে পড়ে।
পাহাড়ি জনতারা এসব মন্দিরে তাঁদের প্রিয়জনদের দেহভস্ম রেখে দেন পরম মমতায়। পাহাড়ি
গ্রামে গ্রামে সুঠাম দেহের উপজাতি নরনারী দেখে মনে হল তাঁরা সুখেই আছেন।
আমরা পাহাড়ঘেরা মায়াবিনী লেকের
ঘাটে নামলাম। মায়াবিনী লেকে তখন বসন্তের মায়াবী রোদ মধু ছড়াচ্ছে, নাতিশীতোষ্ণ বাতাস বইছে।
এত ভিতরে পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্জন প্রান্তরে বিদ্যুৎ
আছে, আছে উন্নত পাকা রাস্থা। ভাবলাম ধীরপদে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একটি চাঘর চালান একজন স্বনির্ভরা উপজাতি নারী। আমরা তাঁর হাতের পরিবেশিত
চায়ে চুমুক দেই। লেকপারের রাস্থা দিয়ে হাঁটি, টিলায় হেঁটে সিলেটে পাহাড়ে ঘুরার
স্বাদ নেই। ওপারে মাইক বাজছে, মাইকের আওয়াজ নির্জন প্রান্তরে মানুষের বিচরণ জানান
দিচ্ছে। চেয়ে দেখি লেকের অপর পারে একটি স্থাপনায় হাউজি চলছে। হাউজিতে অংশগ্রহণ
করেছেন প্রায় ষাট সত্তুর জন নর-নারী ও শিশু। তাঁরা প্রায় সবাই উপজাতীয় লোকজন,
বাঙালি হাতেগুণা। হাউজির লটারি পরিচালনা করছেন বেশ বাকপটু একজন উপজাতীয় ঘোষক। তাঁর
প্রতিটি বাক্যে কৌতুক ও হাসির খোরাক রয়েছে। জনতা তাঁর রসালাপ বেশ উপভোগ করছেন।
লেকপারের গাছতলায় সজ্জিত
ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে নয়নাভিরাম প্রকৃতি দেখি। লেকের প্রমোদ নৌকায় পর্যটকরা ঘুরে
বেড়াচ্ছে। আমরা এবার লেকপারের আম্রপলি বাগানে প্রবেশ করি। এই আম বাগান মায়াবিনী
লেক গার্ডেনের একটি অংশ। আটদশ একর জায়গা জুড়ে আম বাগান। পেয়ারা গাছের মত মাঝারী
আকারের আম গাছ লাইন বিন্যাসে লাগানো। পল্লব ঘন প্রতিটি গাছের শাখায় শাখায় অজস্র আম
থোকায় থোকায় ঝোলে আছে। আমে নুয়ে পড়া গাছগুলো এত সুন্দর যে প্রাণ ভরে যায়। আম
বাগানের একদম উচ্চ পাহাড়ের শেষ সীমানায় পাহারাদারের টংঘর। এই টংঘর
একটি চা-দোকানও। নাদুসনুদুস থাই চেহারার একজন সুন্দরী উপজাতি যুবতী চা বিক্রি
করেন। তিনি এই আমবাগানের পাহারাদারের বউ। এই দম্পতির দুইজনের জীবন ও জীবিকার উৎস
এই আম্রকানন। এখানে পাহাড়ি সুন্দরীর তৈরি চা-পান করে আম বাগানের ভিতর হেঁটে হেঁটে
আম্রকাননের রূপ সুধা মেখে মেখে নিচের হাউজি ঘরে এসে যাই। মায়াবিনী লেকে সারাটা
বিকেল পার করি। অনেক অনেক ছবি তুলি। শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় আবার সেই নির্জন
পাহাড়ি পথে ফিরে এলাম খাগড়াছড়ির হোটেল গাইরিং।
শান্ত পাহাড়ি জনপদ, টিপরা ও
চাকমা জনতার মধুমাখা মুখ, নান্দনিক বৌদ্ধমন্দির, পাহাড়ি উপত্যকার ক্ষেত বন, সব
চৌম্বকের মত আকর্ষণ করে পর্যটক। চাকমারা বৌদ্ধ হলেও টিপরা উপজাতীয়রা সনাতন
ধর্মাবলম্বী। তাঁদের ভাষার মধ্যেও বেশ ভিন্নতা রয়েছে। তবে তাঁদের উভয় জাতির
নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য ও চেহারায় অদ্ভুদ মিল রয়েছে। তাঁরা দুই জাতই ইন্দোচিনা রূপ,
বর্ণ ও চেহারা ধারণ করে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন