সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

দুবলারচরের উপাখ্যান

দুবলারচরে কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
দুবলারচরের
উপাখ্যান

আজ ২০১২ সালে যখন লোকমুখে শুনে দুবলারচরের উপাখ্যান লিখছি, তখন  আমার মনে প্রশ্ন উদয় হচ্ছে এই ভয়ংকর আফ্রিকান যাযাবর রাক্ষুষে পিপড়া বাংলার  দক্ষিণের এই দ্বীপে এলো কেমন করে। উত্তরটি সহজ। ফিরিঙ্গিরা দক্ষিণ আফ্রিকার সাগর  উপকূ ঘেষে  আসার সময় তাদেরই অজান্তে দু'চারটা পিপড়ে হয়ত উঠে যায়  তাদের জাহাজে এবং সুবিধামত সময়ে ওরা নেমে পড়ে  দ্বীপে, তারপর দ্বীপের এক  কোনে বংশ বৃদ্ধি করে একসময় চেঙ্গিস খানের অপরাজেয়  নিষ্টুর মোঙ্গর বাহিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সমগ্র দ্বীপে।
 মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দেয় মানুষসহ দ্বীপের প্রাণিজগত।এই বড় বড় অগ্নি-পিপড়ারা পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র প্রাণিখাদক পিপীলিকা। এরা জাতিতে যাযাবর। তাঁর ভয়ংকর সাহসী এবং নৃশংস যোদ্ধা। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে এক  জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করে সবকিছু খেয়ে ফেলে যখন লক্ষ লক্ষ পিপীলিকা সৈনিক বাহিনী কয়েক মাইল এলাকা জুড়ে দল বেঁধে রওয়ানা হয় খাবারের সন্ধানে তখন যাত্রাপথে সামনে পড়লে কারও রক্ষা নেইবাঘ হরিণ সিংহ মানুষ সবাইকে খেয়ে কংকাল ফেলে চলে যায়। এরা অনেক সময় পানিতে ঝাপিয়ে পড়া শিকারকে জলে সাঁতরে ধাওয়া করেতাদের  আত্মঘাতি বাহিনী আগুনে ঝাপ দিয়ে আগুনও নিভিয়ে ফেলে। আফ্রিকার  সব দুর্দান্ত  প্রাণীরা এদের উপস্থিতি টের পেলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। কেউ প্রশ্ন করতে  পারে দুবলারচরের ধারের দ্বীপ থেকে এখন ওরা গেল কোথায়। এর উত্তরটি আরো সহজ। হয়ত কোন সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে তারা সমুদ্রে তলিয়ে গেছে চিরতরে, এদের বংশধররা আর উঠে আসতে পারেনি বাংলার সবুজ ডাঙ্গায়তাইতো রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ
বেশ কয়েক প্রজন্ম আগেকার কাহিনি। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের সম্পূর্ণ বেলাভূমি তখন সুন্দরবনের অংশ ছিল। মনগ্রোভ অরণ্য জুড়ে ছিল হরিণ বানর মৌমাছি নানা পাকপাখালীর অবাদ বিচরণ ক্ষেত্র। ডাঙ্গায় ভয়ংকর সব বাঘ আর জলে লুকিয়ে থাকা কুমিরের ভয়ে মানুষ বন পেরিয়ে সাগর পর্যন্ত পৌছানোর সাহস করত না। দক্ষিণের সুন্দরবন সংলগ্ন সাগর মানুষের মনে ভয় জাগাতো। সুন্দরবন  জুড়ে সেকালেও ছিল  জলদস্যুদের উৎপাত। জীবন জীবিকার তাগিদে দরিদ্র লোকজন বনে ঢুকে সেকালেও অবাধে প্রাণ হারাতো। কেউ একটু অসাবধান হলেই চালান হয়ে যেত বাঘ কিংবা কুমিরের পেটে। জলদস্যুরা অনেককে ধরে নিয়ে মুক্তিপন আদায় করত কিংবা ক্রীতদাস হিসাবে বাহিরে বিক্রি করে দিত। সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামবাসীর জীবন ছিল কৃষি বনকেন্দ্রিক। বন ছিল তাদের জীবিকার উৎস অথচ এই বনই তাদের উপর প্রায়ই চাপিয়ে দিত নানান অনাকাংখিত বিপদ। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বয়ে অসংখ্য নদীনালা  নেমে গেছে সাগরে, আর বয়ে আনা উর্বর পলি মোহনায় জমে জমে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য চরাঞ্চল দ্বীপ। এমনই একটি চরের নাম দুবলারচর। প্রাচীনযুগের কিছু সাহসী জেলে খালবেয়ে দুর্গম বন পার হয়ে চলে আসে এই দুবলারচরে। উত্থাল সাগর আর নির্জন জঙ্গলের সঙ্গমস্থলে তারা কঠিন জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সাগর অরণ্য হতে তারা সংগ্রহ করত সব জীবন উপকরণ। তাদের পরিশ্রমে গড়ে উঠে এক জেলে পল্লী। বনদেবীর সন্তুষ্টির জন্য গড়ে তোলা হয় মন্দির বছরারম্ভে হত রাসমেলা। আজও এই মেলায় জড় হয় অসংখ্য মানুষ এবং বঙ্গপোসাগরে পূন্যস্নান করে পাপকে ধুয়ে মুছে বিসর্জন দেয়।
দুবলারচরের উর্বর মাটিতে এসে আশ্রয় নিতে থাকে অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষ। বন সাগরের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদকে আশ্রয় করে বাড়তে থাকে জনপদ। কোন রাজা বাদশাহকে তাদের খাজনা দিতে হতনা, কারণ তখনকার দিনের রাজার লোকদের দুর্গম স্থানে পৌছানোর সাধ্য ছিল না। বনের সবচেয়ে পরাক্রমশালী জলদস্যু সরদারকে তারা হাতে রাখতো। দস্যু সরদারই তাদেরকে নিরাপত্তা দিত। স্থানীয় দস্যুরাও নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জন্য দুবলারচরবাসীর কাছে নির্ভরশীল ছিল একটি বাংলা প্রবাদ প্রচলিত আছেডাকাতের ঘাটে কখনও নৌকা ডুবেনা। তাই চরবাসীর প্রতি স্থানীয় দস্যুরা ছিল যথেষ্ট সদয় এখানে তারা খুব একটা অনাচার করতনা।
তখনও ইউরোপিয় বনিকরা ভারত মহাসাগরে আসেনি। আরব বনিকরা সাগরের উপকূল ঘেষে ঘেষে পালের জাহাজে পণ্য বুজাই করে নিয়ে যেত মসলা দ্বীপপুজ্ঞে। বাগদাদ বসরা জেদ্দা এডেনের আরব বানিজ্য নৌবহর ভারত মহাসাগরের সৈকত ঘেষে ঘেষে পালতুলা জাহাজ চালিয়ে আরব সাগর, মান্নার প্রণালীবঙ্গোপোসাগর দূরের সিঙ্গাপুর  চ্যানেল পার হত, এমন কি ইন্দোনেশিয়া হয়ে তাঁরা সুদূর  চীন পর্যন্ত যাতায়াত করত। হজের মৌসুমে মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পূর্বাঞ্চলের হাজিগণের পালতুলা জাহাজ চলে যেত পশ্চিমদিকে আরবদেশে, ফিরে আসত আবার হজ্জ সমাপনের পর উপকূল ঘেষে ঘেষে। আজিকার মত শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা আসত, তাদের কিচির মিচিরে জেগে উঠতো নীরব বনবীথি চরাঞ্চল। শীত শেষে তারা আবার ফিরে যেত দেশে। জলদস্যুরা আল্লার মেহমানদের জাহাজে কখনও আক্রমন করতনা। তারা বলত হাজিদের জাহাজে হামলা করে আল্লার গজব হতে কেউ রেহাই পায়নি। ফলে হাজিদের জাহাজ এপথে নিরাপদেই চলাচল করত।
ইতিমধ্যে শকুনের ছুলানো গলার মত রক্তিমাভ গাত্রবর্ণের বিচিত্র ধরনের লোকের আবির্ভাব হলো সাগরে, তাদের পাটের মত সোনালি চুল, মার্বেলের মত নীল পিঙ্গল ঘোলা চোখ। লম্বালাটির মত কি একটা জিনিসে চোখ রেখে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যায় দুর সাগরে। এদের আগমনের পরই দুবলারচরে এক অশান্তির সূত্রপাত  হয়। কিছুদিন পরপর মানুষ গুম হওয়া শুরু হয় দুবলারচরে। স্থানীয় লোকজন এদের অপয়া ভাবত এবং তাদের নাম দেয় ফিরিঙ্গী। এই ভিনদেশী ফিরিঙ্গিরা বানিজ্য করত, সেইসাথে গোপনে মানুষ ধরে নিয়ে দাসবাজারে বিক্রি  করে দিত। সময়ে সুযোগে সমুদ্র উপকূলে দস্যুবৃত্তি করে বেড়াত, যদিও দুবলারচরবাসীর ঐক্য সাহস তাদেরকে এদিকে পা বাড়াতে বাঁধা দিত। আরবরা যুগযুগ ধরে জাহাজে বানিজ্য করলেও তারা জলদস্যুতা করতে কখনও কেউ শুনেনি। তারা ছিল ন্যায়নিষ্ঠ  ধর্মপরায়ণ। বানিজ্য ধর্মপ্রচারের বাহিরে অন্য কোন অনৈতিক কাজে তারা কখনও জড়ায়নি।
দুবলারচরের দক্ষিণে উত্থাল সমুদ্রের মধ্যে এক অজানা জঙ্গলা দ্বীপে ফিরিঙ্গিরা তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলে। ফিরিঙ্গরা সমুদ্রচারী জাতি। এরা হঠাৎ দানবের মত এসে মুহূর্তের মধ্যে লোটতরাজ করে দূর সাগরে অদৃশ্য হয়ে যেত। এদের অত্যাচারে বাংলার দক্ষিণ উপকূল দিয়ে আরব স্থানীয়দের নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন এই দস্যুদেরে বলত হার্মাদ। এই হার্মাদ শব্দটি এক সময় বাংলার লোকমুখে এক ঘৃণ্য গালীতে পরিণত হয়।   
দুবলারচরে একজন আরবদেশীয় লোক বসবাস করতেনতার নাম মোহাম্মদ ইবনে বদর। তিনি নৌপথে এসে এখানে অবস্থান করেন। সুফি ধরনের এই আলোকিত লোক এখানে ধর্মচর্চা হেকিমি চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে মানুষের মন জয় করেন। রহস্যময় এই মানুষটি মাঝে মধ্যে হারিয়ে যেতেন, আবার কিছুদিন পর আবিভূত হতেন। লোকে মনে করত তিনি মাছের পিঠে ছওয়ার হয়ে এসেছেন, তাই তারা তাকে মাহিছওয়ার নামে ডাকত। তার কাছে এখানকার জেলেরা প্রথম আল্লাহ-নবির নাম শুনে  ইসলামের দিকে পা বাড়ায়। দুবলারচরে কয়েকঘর মানুষ মুসলমান হয় একটি মসজিদ গড়ে উঠে। মাওলানা শাহবদর মাহিছওয়ার হয়ে যান দুবলারচরবাসীর পীর ইমাম তিনি চরবাসীকে চিকিৎসা সেবা বিতরণের জন্য সুন্দরবনের ভিতরে ঢুকে নানা ঔষধি লতাপাতা খোঁজে বেড়াতেন। হজরত মাওলানা মাহিছওয়ার একদিন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। পূর্বে তিনি চলে গেলেও কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসতেন কিন্তু এবার ফিরে এলেন না। দুবলারচরবাসী বিষ্ময়ের সহিত লক্ষ্য করে মাওলানা বদর দুরাচার ফিরিঙ্গিদের অভিশাপ দিতে দিতে একসময় নিখোঁজ হয়ে গেছেন। মাওলানার মুর্শিদরা পীরের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে দিন কাটাতে থাকে। তারা বিশ্বাস করত তাদের পীর অত্যাচারী ফিরিঙ্গি হার্মাদদের তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসবেন কিন্তু বহুদিন চলে গেলতারপরও তিনি এলেন না। প্রশ্ন হলো তাহলে তিনি গেলেন কোথায়। লোকেরা বলাবলি করে হুজুর আবার মাছের পিঠে ছওয়ার হয়ে আল্লাহনবির বাড়ি আরবদেশে চলে গেছেন।
বহুদিন অধীর অপেক্ষার পর একদিন দুবলারচরবাসী দেখে হুজুর মাহিছওয়ার একটি বড়সড় ডিঙ্গি বেয়ে সাগরের ঢেউভেঙ্গে তীরের দিকে আসছেন। হুজুরের সাথে আরও দুইজন কংকালসার লোক নৌকার বৈঠা টানছে। মনে হচ্ছে তারা অসুস্থ পুষ্টিহীন। তাদের গায়ে কাপড় নেই, কেবল লজ্জা ঢাকার মত কোমরে কিছু কাপড় জড়ানো রয়েছে। দুবলারচরে হৈচৈ পড়ে গেল। সবাই দৌড়ে সাগরপারে চলে গেল। হুজুরের সাথি দুইজনের পরিচয় বেরিয়ে আসে। এরা মানিক ভেড়াই মাঝি। এই দুবলারই বাসিন্দা। একসময় তারা এই উত্থাল সাগরে সুন্দরবনের খালে মাছ ধরত। পোষা ভোদড় নিয়ে মাছ শিকারে বের হয়ে বছর কয়েক আগে তারা গুম হয়ে যায়,
খালপারে তাদের পোষা ভোদড় খালি জালনৌকা পড়ে আছে। স্বজনরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সবাই মনে করত এরা হয়ত বাঘ মামার পেট মোকামে চালান হয়েছে, নয়তো হার্মাদরা ধরে নিয়ে ভিনদেশে বিক্রি করে দিয়েছে। দুজন মাঝির পত্নীরা হয়ে যায় বাঘবিধবা। তাঁদের ভাগ্যে জুটে অপয়া অপবাদ। মানিক ও ভেড়াই সৈকতে এলে দুবলারচরবাসী অবাক হয়ে দেখে তিনজনের পায়ে লোহার জিজ্ঞির পরানো। মানিক ভেড়াই মাঝি অত্মীয় স্বজনের গলা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাতে দুবলারচর মসজিদে জলসা বসে। জলসা লোকে লোকারণ্য। মানুষ হজরত শাহবদর মাহিছওয়ারের অন্তর্ধাণ রহস্য মানিক ভেড়াইয়ের উদ্ধার কাহিনি শুনতে উদগ্রীব। হুজুর বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন  তাঁর প্রতি শোকরগোজার করেন। তারপর রসুলের প্রতি দুরূদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য আরম্ভ করেন। হুজুর বয়ান করছেন আর লোকেরা একমনে শুনছে।
সেদিন শীতের ভোর ছিল। মসজিদে ভোরের নামাজে ইমামতি সেরে একাকী হাঁটতে বের হই। গাঢ় নীল আকাশ। পায়ের কাছে আছড়ে পরছে একটার পর একটা সাগরের ঢেউ। পাতলা কুয়াশা শিরশির ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ঔষধি গাছের খোঁজে খোঁজে লোকালয় ছেড়ে সৈকতরেখা বরাবর বহুদূর চলে যাই আমি। পশ্চিম সাগরে লাল থালার মত অপূর্ব সুন্দর সূর্যের মুখ ভেসে উঠে তখন 
হুজুর বললেনএমন সময় বন থেকে বেরিয়ে আসে একদল জলদস্যু হার্মাদ। মুহূর্তের মধ্যে হাত বেঁধে  নিয়ে যায় মাইলখানেক পশ্চিমে তাদের কাটের জাহাজে। আমি অর্থাৎ এই শিকারের প্রাণীটিকে নিয়ে জাহাজটি দ্রুত গভীর সাগরে ধাবিত হয়। আমি অনবরত খতমে ইউনুসের দোয়া পড়তে থাকি। সারাদিন জাহাজ চালিয়ে বাদআসর সাগরে একটি ছায়া দেখা দেয়। জাহাজ সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয় ছায়াটি ততোই স্পষ্ট হয়,  যে এক  গহীন অরণ্যময় দ্বীপ। একটি ছোটনদী এসে পড়েছে সাগরেএই নদীপথে জাহাজটি ঢুকতে শুরু করে। ইতিমধ্যে রাত নেমে এসেছে। 
মশাল জ্বেলে জলদস্যুরা আমাকে তাদের আস্থানায় নিয়ে যায়। বজ্জাত লোকগুলো যখন দেখে আমার মত প্রৌঢ় লোককে বিক্রি করে তেমন অর্থ পাওয়া যাবেনা তখন তারা আমাকে তাদের ঘাটির একজন কৃতদাস বানালো। ইতিপূর্বে আরব বনিকদের জাহাজে চড়ে ইসলামের দাওয়াতি কাজে অনেক উপকূলীয় মুলুক গিয়েছি অনেক ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক পথে চলাচল করেছি। কিন্তু তেমনটা বিপদে পড়িনি। আজ বিপদে পড়ি, ভয়ঙ্কর বিপদওরা আমার পায়ে জিজ্ঞির পরিয়ে দিল যাতে পালিয়ে না যাই। সারাদিন জিজ্ঞির পরা অবস্থায় কঠিন কঠিন কাজ করাত, সামান্য ভূলভ্রান্তি হলে গায়ে পড়ত চাবুকের ঘা। খেতে হত তাদের বাসী উচ্ছিষ্ট খাবার। অনেক সুন্দরী মেয়েমানুষ এবং লোকজনকেও দস্যুরা বন্দি করে রেখেছে। সবার অবস্থা সঙ্গীন। মেয়ে মানুষগুলো চাবুকের ঘা খেয়ে প্রাণভয়ে ওদের জৈবিক পাপাচারের সঙ্গি হতে বাধ্য হচ্ছে।
ভেড়াই মাঝি সহজ সরল লোকমানিক মাঝি বেশ বুদ্ধিমান। এবার মানিক জলসার লোকজনকে বলতে শুরু করে, দুবলারচরের সম্মানীত ঈমাম সাহেবকে তারা চরম তুচ্ছতাচ্ছিল্ল্য করে। সেখানে হুজুরের সাথে দেখা হয় আমি ভেড়াই মাঝিরযে আমরা অনেক আগে হারিয়ে গিয়েছিলাম দুবলারচর হতে। সর্বক্ষণ জিজ্ঞিরপরা আমি ভেড়াই কান্নাকাটি করে হুজুরের দোয়া কামনা করতাম, প্রভু যেন এই দুঃসহ জীবন থেকে আমাদেরকে মুক্ত করেন। দস্যুদের জন্য জ্বালানী কাট সংগ্রহ, বুনো পশু শিকার, নাপাক শুকর পালন, মাছ ধরা, রান্না-বান্না কত কিছুইনা করতে হত আমাদের। স্বজনদের জন্য বুকটা হাহাকার করে, নীরবে চোখের জল ফেলে ফেলে আমরা কেবল অমানুষিক কাজ করে যেতাম। এভাবে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। হুজুরের আগমনে আমাদের মনবল বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হুজুরের দোয়ার জন্যই আমরা রক্ষা পেলাম। 
জলসায় পিনপতন নীরবতা। হুজুরের কারামতি শক্তি কেমন করে মানিক ভেড়াই মাঝিকে মৃত্যুগোহা থেকে বের করে নিয়ে এলোতা জানতে সবাই উদগ্রীব। মানিক বলে যাচ্ছে আর ভেড়াই - বলে সায় দিয়ে যাচ্ছে।
ফিরিঙ্গিদের অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেল। আমরা বন্দি-বন্দিনীরা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চিন্তা করতাম। আত্মহত্যা মহাপাপ, তাই খোদার ভয়ে বিরত হতাম। একদিন এই নৌকায় করে আমরা তিনজন মিলে দস্যুদের  খাবারের জন্য মাছ ধরতে যাই। সেদিন সমুদ্রে তেমন মাছ ধরা পড়েনি। আমরা ভীত হই। শূন্যহাতে ফিরে গেলে হার্মাদদের হাতে মার খেতে হবে। মাছের সন্ধানে আমাদের ডিঙ্গি দ্বীপটির দূর-প্রান্তরে চলে যায়। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিশ্রামের জন্য তীরে উঠি। মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য পিপড়া আমাদেরকে আক্রমণ করে। আমরা প্রাণ বাঁচাতে সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ডিঙ্গিতে উঠে আত্মরক্ষা করি। সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত মাছ নিয়ে না আসায় এক হার্মাদ দস্যু আমাদেরকে ভীষণ পিটুনী দেয়। পরদিন আবার আমরা সেদিকে যাই। এবার দেখতে পাই ঐপ্রান্তে লক্ষ লক্ষ রাক্ষুসে পিপড়া খিলবিল করছে। এই পিপীলিকারা দ্বীপের প্রান্তের কচ্ছপ সাপ শৃগাল এমনকি রোদপোহাতে তীরে ওঠা কুমিরটিকে মেরে সাবাড় করে ফেলেছে, পড়ে আছে কুমির হরিণের কংকাল। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে আমরা কাঁপতে থাকি। দ্রুত ডিঙ্গি বেয়ে এইপ্রান্ত হতে প্রস্থান করি। তৃতীয় দিন মাছ ধরতে বের হই। ঐ দিন কোন মাছ ধরা যাচ্ছিলো না। কোন মাছ নিয়ে ফেরতে না পারলে বজ্জাতরা আমাদের পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে। মাছধরার প্রাণান্ত চেষ্টায় দিন পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় ভয়ে ভয়ে দস্যুদের আস্থানায় ফিরে এসে ডিঙ্গিতে বসে এক অভাবনীয় দৃশ্য আমরা দেখতে পাই কোটি কোটি ভয়ংকর মাংসাশী রাক্ষুষে বড়বড় অগ্নি-পিপড়া ডাকাতদের আস্থানা ঘেরাও করে প্রচন্ড আক্রমণ রচনা করেছে। দস্যুরা আগুন জ্বালিয়ে পিপীলিকা তাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দলে দলে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ গাছের মগডালে উঠেও প্রাণ বাঁচাতে পারছেনা, সেখানেও আক্রমণ করছে। নদীতে নেমে পড়া একজন দস্যুকে পিপড়েরা সাঁতরে আক্রমণ করে পানিতেই মেরে ফেলে। ডাকাতদের নোঙ্গর করা সবকটি জাহাজ নৌকায় উঠে পরেছে হাজারে হাজার পিপড়ে। বজ্জাত হার্মাদরা বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। কিন্তু মাংসাশী পিপীলিকারা তাদেও রক্ত মাংশ নাড়িভুড়ি খেয়ে ফেলছে। একে একে ডাকাতদের কংকাল পড়তে দেখা যাচ্ছে। আরবি হুজুর বললেন এই পিপড়া আসলে পিপড়া নয় আল্লার সাক্ষাৎ গজব, আফ্রিকার ভয়ংকর যাযাবর যুদ্ধা পিপীলিকা মনে হচ্ছে। এই পিপীলিকার দলকে দেখে বাদশা সুলায়মান নবিও একদা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এই পিপড়া বাহিনী সামনে যা পাচ্ছে সব খেয়ে মেসাকার করে ফেলছে। সম্ভবত ডাকাতদের   একজনও পালাতে পারেনি।
হজরত শাহবদর মাহিছওয়ার সাত সাগর পশ্চিমের লোক, সমুদ্রে অনেক ভ্রমণ করেছেন। তিনি জানতেন উত্তর দিকে ডিঙ্গি চালাতে থাকলে একসময় খোদার মর্জিতে তীর পাওয়া যাবে। তিনি বললেন হার্মাদদের পাপাচারে এই দ্বীপে আল্লার গজব নেমেছে। এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক হবেনা, নতুবা এই ঐশী গজব আমাদেরকেও গ্রাস করবে। হুজুর বললেনআকাশের শোকতারা নিশানা করে উত্তরদিকে বৈঠা টানো। উত্থাল সমুদ্রে তোমরা ইসমে আজম জপ কর, 'লাইলাহা ইল্লাআন্তা সোবহানাকা ইন্নিকুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন'। জেনে রেখো, এই ইসমে আজম পড়ে মাছের পেঠ হতে মুক্তি পান ইউনুস নবি 
আমরা তিনজন ইসমে আজম জপে জপে সারারাত দাড় বেয়ে যাই। আল্লাহের অপার মেহেরবানিতে পরদিন সৈকতের দেখা পেলে হুজুর বললেন আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমরা তার সাথে গলা মেলাই আলহামদুলিল্লাহ্।‌ হুজুরের আদেশে উপকূল বরাবর পশ্চিমদিকে নৌকাবেয়ে এসে দুবলার বেলাভূমি পেয়ে যাই তিনজনের পায়ে তখনও জিজ্ঞির অথচ আজ হল আমাদের দাসত্বের অবসান।
হজরত শাহবদর মাহিছওয়ারের কারামতি দেখে তাজ্জব দুবলারচরবাসীহজরত ফিরে এসেছেন দস্যু ফিরিঙ্গি হার্মাদদের বদ করে। তারা দেখলো হজরতের অভিশাপে হার্মাদেরা মরে ভূত হয়ে গেছে, আর কোনদিন হানা দিতে আসেনি দুবলারচরেএবার  দুবলারচরের লোকেরা দলে দলে তাঁর মুরিদ হয় চলে আসে ইসলামের ছায়াতলে। আজও মানুষ দুবলারচরে এসে শ্রদ্ধাভরে জেয়ারত করে হজরত শাহবদর মাহিছওয়ারের(রঃ) পবিত্র মাজার। তিনি তাদের জলের খিজির, তিনি নদীর পীর, সাগরের পীর, বদর পীর। এখনও মাঝিমাল্লারা যখন সুন্দরবনের নদীতে কিংবা সাগরপানে নৌকার পাল টেনে হাল ধরে, তখন সুর তুলে গেয়ে উঠে "বদর বদর বলি, কিনারে কিনারে চলি, ভাটি গাঙে ভাটিয়ালী গাইও,/ ওরে থাকিলে জোয়ার বেশি, লগি মাইর তাড়াতাড়ি বেলাবেলি ঘাটে ফিরা আইও।।" 

রচনাকালঃ ২০১২ সাল, আমি তখন ব্যবস্থাপক, পূবালী ব্যাংক লি্মিটেড, বরইকান্দি শাখা, সিলেট।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন