শহরের এক প্রখ্যাত আইনজীবী ইমরান চৌধুরী। দামি গাড়ি, সেই সাথে আলিশান বাড়ি। ড্রাইভার, বাবুর্চি ছাড়াও বাসার কাজ সম্পাদনে পাঁচ-ছয়জন বাসাকর্মী সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করে। বাড়ির সর্বত্র আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। বাংলোর মত ডিজাইন করা এই বাড়ির মূল বাসিন্দা ইমরান চৌধুরী, বেগম ইমরাম চৌধুরী এবং তাদের দুই পুত্র ও দুই কন্যা। বড় ছেলেটি ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেছে। ছোট ছেলেটি কোন এক অজ্ঞাত কারণে লেখাপড়ায় মাধ্যমিক স্তর পার হতে পারেনি। ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক উপরে উঠানোর স্বপ্ন দেখতেন উকিল সাহেব। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কি আর পূরণ হয়। ছেলেরা মাঝপথে থেমে গেলে বাবা ইমরান চৌধুরী মেয়েদেরে শিক্ষিত করতে মরিয়া হয়ে যান। ইন্টারমেডিয়েট পাস করার পর দুই মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি করে দেন তিনি।
ইমরান চৌধুরীর ছোট মেয়েটি এই গল্পের নায়িকা। আমি ওর নাম দিলাম টিনা চৌধুরী, এ নামটি যদিও তার আসল নাম নয়।
মেয়েটিকে
আমি দেখেছি ওদের বাসায়। তখন সে ক্লাস টেনে পড়ে। প্রথমদিন দেখে মনে হল সে যেন পৃথিবীর কেউ নয়, একদম স্বর্ণ প্রতিমা, যেন বেহেস্তের হুর। আত্মীয় হলেও তাঁদের বাসায় খুব একটা যাওয়া আসা নেই আমার।
টিনার সাথে কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আবার দেখা হয়। বহুদিন পর এই দেখা। সে এখন আরও বদলে গেছে, যেন প্রস্ফুটিত ব্রাজিলিয়ান পদ্ম। অবর্ণনীয় সুন্দরী, হাসলে মুক্তা ঝরে। গায়ে গোলাপের রঙ্গ, দীঘল কালোকেশ, অপূর্ব দেহসৌষ্ঠভ। চেহারায় কি যে মায়া জড়িয়ে আছে, মনে হয়, মানব কেন আকাশের ফেরেশতারাও বুঝি লাজলজ্জা ভূলে তাকিয়ে রবে ওর সুন্দর মুখখানির পানে। যে কোন যুবকের মাথা পাগল করে দেবার মত এক রূপবতী মেয়ে সে। ওর রূপসৌন্দর্য্য নিয়ে সবাই কানাকানি করছে। ঠিকানা পরিচয় সংগ্রহ করে অনেকে হতাশ এই ভেবে, ওতো শহরের এক প্রখ্যাত ধনাঢ্য আইনজীবীর মেয়ে। ওর কাছে ভিড়াতো চাট্টিখানি কথা নয়। এযেন বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার বিলাসী স্বপ্ন, ছেঁড়াকম্বলে শুয়ে সাত তলা ভবন হাতের মুঠোয় দেখা।
টিনা চৌধুরী। নম্রভদ্র মেয়ে। কথা বলে অল্প অল্প, কিন্তু প্রতিটি উচ্চারণে বুদ্ধির দীপ্তি। অযথা হৈ হিল্লোড়, হট্টগোলে আদৌ অভ্যস্থ নয় মেয়েটি। তাই মেয়েটির প্রতি মা-বাবার ছিল নিখাদ স্নেহ আর অগাধ বিশ্বাস। কৌশরের সূচনালগ্ন থেকেই মেয়েটির আচরণ এতই সুন্দর ও সাবলীল ছিল যে কেহ ভাবতে পারেনি কোন অনাকাংখিত প্রজাপতি ওর কাছ ভিড়ে যাবে। কিংবা মেয়েটি পিতামাতার অবাধ্য হয়ে এক লংকাকান্ড করে বসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী টিনা চৌধুরী প্রথম থেকেই সতর্ক ও সাবধানী মেয়ে, ওর বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ শুনেনি। সুন্দর চালচলনের জন্য শিক্ষক ও সহপাঠী সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাবারও পূর্ণ আস্থা ছিল তার এই গুণী মেয়ের উপর।
উকিল সাহেব মেয়েকে নিয়ে গর্ব করতেন। বলতেন, মা আমার বড় হয়ে শিল্পী হবে, নাচ শিখবে, অভিনয় করবে। আমার ঘরের সুনাম ও সুখ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে দেবে।
মেয়েকে গান, নৃত্য ও অভিনয় শিখানো হয় বাসায় শিক্ষক রেখে। বালিকা বয়স হতে না হতেই ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইত, নৃত্য করত। অজস্র দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে হাততালী দিয়ে তাকে উৎসাহিত করত। সে স্টেজে গিয়ে নাচগানের আসর জমিয়ে রাখত। আনন্দে ওয়ান মউর, ওয়ান মউর বলে লোকজন চিৎকার দিত ।
মিসেস ইমরান চৌধুরী একজন করিৎকর্মা মহিয়সী নারী। শহরের বিভিন্ন মহিলা সংঘটন ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে তিনি নানা ভাবে জড়িত। শহরের সুধী মহলে খুব সুপরিচিত এই পরিবার। পিতামাতা তাদের অতি আদরের মেয়েটিকে নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় বেড়াতে যান। বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে মেয়েটি। এমন একটা মেয়ের গর্বিত জীবনসাথী হবার জন্য উতলা হন দেশী ও বিদেশী অনেক ধনী ও প্রতিভাবান ব্যক্তি। লন্ডন ও নিউইয়র্কে পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারী কতিপয় ব্যক্তিবর্গ মেয়েটির জন্য বিয়ের আলাপ দেন। ভাল ভাল পয়গাম আসছে দেখে মেয়ের বাবা উচ্চবিলাসী হয়ে উঠেন। তার সর্বগুনান্বিতা কন্যার জন্য খোঁজতে শুরু করেন আসমানের পূর্ণচাঁদ।
বাবা খোঁজছেন আকাশের চাঁদ। আর সেই ফাঁকে লাজনম্র এ সুন্দরী মেতে উঠে এক লাভহীন গোপন খেলায়। আকাশের চাঁদ ফেলে মেয়ে তার খেলা শুরু করল মাটির এক প্রদীপ নিয়ে, যে প্রদীপে তেমন আলো নেই, উজ্জ্বলতা নেই, নেই কোন জগৎমোহনী গুণ। যা মেয়েটির পাশে একেবারেই বেমানান। বংশের আভিজাত্য ঐশ্যর্যের প্রতাপ, সুনাম সুখ্যাতি, শিক্ষাদীক্ষা, শিল্পী স্বত্ত্বা, সবক্ষেত্রেই ছেলেটি নিস্প্রভ।
যুবকটির আসল নাম আমার জানা নেই। তবে ডাক নাম টিপু। বি.কম পাশ করে ভাল কিছু না পেয়ে ইন্সুরেন্সে দালালি করে। একেবারে সাধারণ অখ্যাত পরিবারে জন্ম। অনেক ভাইয়ের এক বিরাট জঞ্জাটময় সংসার। আর্থিক দিক থেকেও ওরা একেবারে নিম্নমধ্যভিত্ত ধরণের। দেখতে ছেলেটিকে সুদর্শন বলা যায়। টিপু তেমন প্রতিভাবান না হলেও সে ছিল খুবই স্মার্ট ও বুদ্ধিমান। সুন্দর সুন্দর বাক্যবানে অভ্যস্ত টিপু অতি সহজেই মিশে যেতে পারত যেকোন মেয়ের সাথে, যাকে বলা যায় লেডিকিলার।
কৌশর পার হয়ে ওই যুবকটি অসংখ্য মেয়েকে পটিয়েছে। যেখানে কেউ সাহস করছেনা এমন শিকারই তাঁর বেশি পছন্দ। সুনিপুন এ প্রেমশিল্পী মজনু যুবক যে লাইলির প্রতিই তার প্রেমের ভুজঙ্গ তীর ছুড়েছে তাকেই অনায়াসে বদ করতে পেরেছে। বন্ধুরা বলে ওর তীর নাকি নির্ভূল লক্ষ্যভেদী।
তার তীরের নিশানা একদিন হয়ে যায় ইমরান চৌধুরীর অনিন্দসুন্দরী মেয়ে টিনা। বিষাক্ত শর বিদ্ধ হতে খুব একটা সময় লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী টিনা চৌধুরীর সহিত অবাধে প্রেম অভিনয় করে যায় শিকারী যুবক। কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেনি এই অভিসার। লাজনম্র সুন্দরী মেয়েটি নিজের অজান্তে অন্ধ হয়ে সপে দেয় মনপ্রাণ, শিকারী বিড়ালও সযতনে জালে বন্দি করে ফেলে শিকারের পাখিটাকে। সেই পাখির মানসিক রোগ হয়, ওকে নেশা ধরে। আর সে প্রলাপ বকে যায় টিপু, টিপু ও আমার চিরদিনের ভালোবাসা ...।
একদিন সআদরে টিনা বললো, প্রিয় টিপু। এভাবে আর কত। এসোনা প্রিয়তম, এবার ঘর বাধি। টিপু বললো- কি দিয়ে বাঁধব ঘর। আমার তো চাল চুলো কিছুই নেই। আমার তো ভয় হয় তোমার বাবা আমাকে তাড়িয়ে দিবেন। এখন না হয় তোমার সাথে মিশছি। হয়তবা তাও বন্ধ হয়ে যাবে তখন। বড়লোক বাবার আদুরে কন্যে তুমি, তাইতো তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ায় সারাক্ষণ।
টিপু টিনার হৃদয় পুরোটা দখল করে নিলেও ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর সাহস নেই তার। ক্রমে ক্রমে টিনা টিপুকে বিয়ের জন্য তীব্র পীড়াপীড়ি শুরু করে দেয়। টিপু বলল- তোমার বাবা আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তার চেয়ে তো ভালই আছি। সাথে সাথে টিনার ্সুদৃড় উচ্চারণ, বাবা ফিরিয়ে দিলে কি হবে, আমি তো ফিরিয়ে দেবনা। তিনি রাজী না হলে আমিই চলে আসব তোমার কাছে। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো প্রিয়তম, আমি তোমার আছি, তোমারই থাকব।’
যথাসময়ে টিপুর বড়ভাই ও ভাবী মিষ্টি হাতে হাজির হন ইমরান সাহেবের বাসায়। বিয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করামাত্রই ইমরান সাহেবের প্রশ্ন করেন ছেলে কি করে? জবাব ইন্সরেন্সে চাকুরি করে। ওর শিক্ষা? জবাব বি.কম। বাড়ি কোথায়? বিশ্বানাথ, ভাই? আটজন। শহরে বাসা আছে? গাড়ি আছে? জবাব না, কিছুই নেই।
ইমরান চৌধুরী ও বেগম সাহেবা তাদের প্রিয় মেয়ের পূর্ব প্রেমের কথা আদৌ জানতেন না। লাজুক ও স্বল্পভাষী এ মেয়েটি যে গোপনে গোপনে এতদুর এগিয়ে গেছে মা-বাবা তা কল্পনাও করতে পারেন নি। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন- আপনাদের বেশ তো সাহস, আপনারা কি ভেবে আমার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, ওর বিয়ের জন্য অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রবাসী পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারী ভদ্রঘরের পাত্ররা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। ইন্সুরেন্সের চাকুরি দিয়ে আমার মেয়ের তো কসমেটিকসের খরচও জুটবে না।
গাছে ফুল ফুটলে যে কোন প্রজাপতির তাতে বসার অধিকার রাখে। এ কথাটি অনুচ্চসুরে উচ্চারণ করে অপমান গায়ে মেখে ফিরে আসেন টিপুর ভাই ও ভাবী। টিপুর প্রতি খুব রাগ হয় তাদের। বেশ শক্ত বকুনীও দেন। টিপু তার ভাই ও ভাবীকে বলল, আমাকে আপনারা বকুন, আর মারধর যাই করুন না কেন, দেখবেন টিনাকে নিয়ে আসব, তাঁকে ঘরে তুলেই নেব এই অপমানের পূর্ণ প্রতিশোধ।
কিছুদিন পর সমগ্র শহরে রাষ্ট্র হয়ে যায় উকিল সাহেবের মেয়ে টিনা একেবারে সাধারণ ঘরের এক সাধারণ ছেলের সাথে উদাও হয়ে গেছে। পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন কেউই বিশ্বাস করতে পারে নি, সবাই ভাবে গুজব, মিথ্যা গুজব। ইমরান চৌধুরী ও মিসেস চৌধুরী এই ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। বাসার গেইটে তালা মেরে কিছুদিন পড়ে থাকেন বিছানায়। লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারেন নি অনেকদিন।
মাস দু’এক পরের ঘটনা। ইমরান সাহেবের কন্যারত্ম টিনা তার স্বামী টিপুকে নিয়ে এসে হাজির বাবার বাসায়। টিপু ছায়ামূর্তির মত দাড়িয়ে আছে বাসার সামনে। টিনা ভিতরে ঢুকেই মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। বহুদিন অপেক্ষার পর কন্যাকে পেয়ে মা বেশিক্ষণ মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন নি। মেয়েকে নিয়ে যান বিছানায় শুয়ে থাকা ইমরান সাহেবের কাছে। রাগে অগ্নিশর্মা চৌধুরী সাহেব গর্জে উঠেন, তুই আমাকে মেরে ফেলেছিস, আমার বাসা হতে এক্ষুণি বের হয়ে যা। তোর জন্য আমার মানসম্মান সব ধূলায় লুটেছে। এমন বদেরহাড়ি মেয়ে আমি চাইনা। মনে করব টিনা নামের মেয়েটি আমার মারা গেছে। এ নামের কোন মেয়ে আমার ছিলনা, নেই। খবরদার আমার সামনে তুই আর আসবিনা কোনদিন।
সুদীর্ঘ্য দু’এক ঘন্টা মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মেয়ের রোদনে বাবার মনের জমাটবাধা কঠিন বরফ গলতে শুরু করে। বাবার মনটা হয়ে যায় তরলবৎ ঠাণ্ডা জল। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেন ইমরান চৌধুরী, চোখের জলে সিক্ত হয়ে মেয়েকে গভীর উষ্ণতায় টেনে নেন বুকের কুঠরে। বলে উঠেন, কাঁদিসনে মা, আয়, বাবার বুকে আয়।
শত হোক টিনা তাঁর নিজ সন্তান। নিজ কন্যাকে আর কতক্ষণ সরিয়ে রাখা যায় দূরে দূরান্তরে।
রচনাকাল ঃ ১৯৮৬ সাল। রেঙ্গা দাউদপুর, দক্ষিণসুরমা, সিলেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন