সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

ভাঙ্গলো শেষে ভুল



ভাঙ্গলো শেষে ভুল

মিরুনের সংসারে মাঝে মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলেও ওর প্রতি স্বামী বারী মিয়ার ভালবাসার অন্ত ছিলনা। এতদিন মিরুনকে অতিমাত্রায় ভালবাসলেও ইদানীং ওর স্বামীর আচরণ পাল্টে গেছে। কারণ ছাড়াই হঠাৎ রেগে উঠে সে। অযথা বকবক করে বাড়ীটা গরম করে ফেলে। গ্রামের লাজুক বধু মিরুন প্রথম দিকে সহ্য করলেও ক্রমে ক্রমে ধৈর্য্যরে সীমা পার হয়ে যায় তার। এখন মাঝে মধ্যে সে টুনটুনিয়ে জবাব দেয়।
মনের যন্ত্রণা সইতে পারেনা মরুন। একদিন সে বলে দেয়এত গরম আর সহ্য হয় না, আর গরম দেখালে এখানে থাকা সম্ভব নয়, আমি আমার বাপের বাড়ী চলে যাবআশপাশের লোকজনের সঙ্গেও হুমকি ধমকি চীৎকার বারী মিয়ার অভ্যাস। বাড়ী শুদ্ধ মানুষ অতীষ্ঠ প্রায়। মিরুন স্মৃতি অবগাহন করে। দুবছর পূর্বে ওর যখন বিয়ে হয় তখন সে কত যে ভাল লোক ছিল। কতনা আদর ত্ন করতো। ছমিরুনের কষ্টের হবে এমন কিছু ভুলেও করতনা বারী মিয়া। কপালের যে কি দোষ, আজ কোথায় সে দিনের সেই বারীমিয়া? বদলে যাচ্ছে, কেমন যেন উগ্র হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
কপালকেই বা দোষ দিয়ে আর লাভ কী। ওর সন্দেহ হয়, ওর সংসারের সুখ দেখে হয়ত সইতে পারছে না কেউ। শ্বাশুড়ী বউয়ে ঝগড়া হয় প্রায় প্রতিটি সংসারে। ওরতো শ্বাশুড়ীই নেই। তবে কোন সে মহিলা যে তার স্বামীকে তাবিজ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে তার চাচাতো বোনটির কথা। কমলা, বোনটা সুন্দরী হলেও মোখরা রমণী। স্বামী তালাক দিয়েছে, বোনটির সংসার টিকেনি, তাই বাপের বাড়ীর লোকজনের শুনতে হয় কটু শব্দাবলী। হয়তো ছোটবোন ছমিরুনের সুখ দেখে পুড়ে মরছে সঙ্গোপনে।
পাশের গ্রামটায় ছমিরুনের বাপের বাড়ী। কমলাটা আসার পরপরই যেন ঘরমুখো বারীমিয়া শ্বশুর বাড়ী মুখো হয়ে উঠে। আরও খবর এলো ওর স্বামী নাকি বাড়ী গেলে বাচাল কমলাটা ছুটে আসে, আড্ডা দেয়। মিরুন ভাবে স্বামীটা বুঝি কমলামুখী হয়ে ওর সাথে যচ্ছেতাই আচরণ শুরু করেছে। স্বামীহীন কমলার শরীরে এখন ভরা যৌবনের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে কমলা এতটা উচ্ছ্বল। সন্দেহ বশত অন্ধ হয়ে উঠে মিরুন। বাপের বাড়ীতেও রেড সিগন্যাল দেয়, অথচ বাপের বাড়ীর লোকজন হাসে আর বলে উঠে- পাগলী মেয়ে আর কত পাগলামী করবিরে তুই।
মিরুনের সন্দেহ দূর হয় না, কমলাকে পরীক্ষাচ্ছলে জিজ্ঞেস করে-
কমলাবু, আমার উনি সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? ওযেন কেমন রগচটা হয়ে গেছে আজকাল।
বলিস কী? দোলাভাইয়ের মত লোক হয় নাকি? কী ভদ্র লোকটা। যেমন বুদ্ধি রাখে তেমন তার আচার আচরণ। ওকে তো আমার খুব ভাল লাগে। বলেই হেসে উঠে কমলা।
তাহলে ওকে তোমার ভাল লাগে বুবু?
অবশ্যই, লাগবেনা কেন? খুব ভাল স্বামী পেয়েছ তো, তাই বুঝতে পারছ না। আমার মত ধন পেলে বুঝতে মজা, চোখ আর নাকের পানি বইত একই সাথে। আমার মত পালিয়ে বাঁচতে।
বুঝতে পেরেছি তাকে তোমার খুব ভাল লাগে, কমলাবু।
কমলা ছোট্ট করে বলে উঠে- ভাল লাগে, বৈ কী?
এই কথোপকথন সহজ সরল মিরুনের সন্দেহটা আরও দৃঢ় করে দেয়। পরের স্বামীকে কমলা বুর ভাল লাগবে কেন? ভিতরে ভিতরে তিনি যে এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। পল্লী গ্রামে বড় হয়েছে মিরুন। বিয়ের বয়স হবার পর পর-পুরুষের সাথে কথা বলতে ওর সাহস হয়নি। বুক ভয়ে কেঁপে উঠত। বুকে কথা এসেও আসত না ঠোটে। ঘোমটার ফাঁকে লুকিয়ে দেখে নিত পেশীবহুল পুরুষদের তাগড়া শরীর। কল্পনায় রাঙ্গাতো মন। যাব, যাব, করেও ব্যাটা মানুষের কাছে ভেড়া হতনা তার। আর কমলা বু কি বেহায়া, নির্লজ্জ্ব। ছোট বোনের স্বামীর সঙ্গে এতকিছু রংবাজি তার, ছিঃ ছিঃ বারী মিয়াকে হয়ত কাত্ করে ফেলেছে সে।
নতুন বিয়ে হবার পর বারী মিয়ার স্বভাবটা কিছুদিনের জন্য ঠান্ডা ছিল। অন্ততঃ নব্বধূ সাথে আচরণটা ভালই ছিল তার। বারী মিয়া একটু বেশী বয়সে বিয়ে করে। পুরুষেরা বেশী বয়সে বিয়ে করলে নাকি অতিমাত্রায় স্ত্রৈন হয়ে যায়। তাই এতদিনের বকবক ঝগড়াটে চরিত্রটা প্রকাশ হয়নি। বিয়ের বছর দিন পার হবার পর বউ বেচারী আস্তে আস্তে চানাস্তার মত সস্তামালে পরিনত হয়। তাই হয়ত বারী মিয়ার আগের  সেই  খাসলতটা আবার ওকে পেয়ে বসে।
বারী মিয়া ওর এক সম্বন্ধির সঙ্গে ছোটখাট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে কিছুদিন। তাই ঘনঘন যেতে হয় শ্বশুরবাড়ী। অথচ সমিরুন বড়ই সরলা কিছুই বুঝতে রাজী নয় সে।
বারী মিয়া শ্বশুরবাড়ী না গিয়ে পারছেনা অথচ এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘরে অশান্তির সীমা নেই। ধীরে ধীরে ছমিরুন বারী মিয়ার কাছে হারামজাদী, বজ্জাতনি, দাজ্জাল মহিলা ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত হয়। ছমিরুনও এখন গর্জে উঠে। গালীর বদলে গালী, কথার বদলে কথা বর্ষন করতে মোঠেও কুণ্ঠিত হয় না।
স্বামী যতই পাষান হচ্ছে ছমিরুন ততোই কমলাকে সন্দেহ করছে। কমলাকে জড়িয়ে এখন সে বারীমিয়াকে নানা ধরণের কটুক্তি ছেড়ে দেয়। একদিন বারী মিয়া রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বউয়ের চুল ধরে দুএকটা ঘা বসিয়ে দেয়। এমনি ছমিরুন কান্নাকাটি জুড়ে গাট্টি বেধে কাউকে কিছু না বলে বাপের বাড়ী চলে যায়।
সেদিন হতে গ্রামের লোকেরা বারী মিয়াকে দেখলেই 'কমলা কমলা' বলে ঠাট্টা করত। বারী মিয়াও রেগে গিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রতি তেড়ে আসত। হাতের কাছে যা পেত, ছুড়ে মারত বালকদের প্রতি। দুষ্ট বালকেরাও কমলা, কমলা করে তাকে নাচিয়ে আত্মতৃপ্তি পেত। দুষ্ট লোকেরা বলতো 'হায়রে বারী শেষমেষ বউয়ের সাথে আড়ি।'
বউ রাগ করে বাপের বাড়ী চলে গেলে বারী মিয়া প্রথমে তেমন কিছু হয়নি ভাব দেখালেও দুএকদিন পর তীব্র-জ্বালা অনুভব করল। বউকে মারধর করায় মনে ভীষণ দুঃখ লাগল, মনে মনে বলল, প্রিয় মিরুন, তোমাকে আর কষ্ট দেবনা, কটুকথা বলবনা, আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি। বেচারীর দোষ কী, সব দোষ তো আমার। এসব ভাবতে ভাবতে একাকী বিছানায় ঘুম আসতনা বারী মিয়ার চোখে।
সাপ্তাহ ছয়েক পর সব মান অভিমান ভুলে বারী মিয়া আবার রওয়ানা হয় শ্বশুরবাড়ী। কমলাদের বাড়ী পার হয়েই মিরুনদের ঘর। ছোট্ট পুকুর। পা-রাখা মাত্রই সেই কমলা, স্নান করতে এসেছে পুকুরে। বারী মিয়াকে দেখেই হেসে উঠে ডাক দেয়, ভাইসাবভাইসাবকেমন আছেন। এতদিন এলেন না যে, কারণটা কী? জানতে পারি? মনে হয় আমাদেরকে ভুলে যাচ্ছেন দিন দিন।
ভুলবো কেন? তবে তোমার সাথে আর কথা বলব না বু, মানা আছে- বলেই বারী মিয়া হন্ হন্ করে ছুটে যায় শ্বশুরের ঘরে।
কিসের মানা ভাইসাব, কিসের মানা-
বলে পিছু পিছু ঘরে ঢুকে কমলা।
কমলা বুবু, তুমি বড় বেশী বাড়াবাড়ি করছ, এত বাড়াবাড়ি সহ্য হয়না বলছি । বলেই ঘরের এক কোনে গর্জে উঠে মিরুন।
মিরুনের আচরনে স্থম্বিত হয়ে যায় কমলা। এসব কি করছিছ তুই। তর স্বামী কি বাজারের মাল যে, যে খুশী তুলে নিয়ে যাবে। আমি কি তর স্বামীকে চুরি করে ফেলবো, পাগলী?
চুরি করে ফেলবো না করেই ফেলেছো তুমি, সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো বুবু।
অগত্যা কমলা বেরিয়ে যায়। ওমনি বিগত দিনের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে ভীষন ঝগড়া লেগে যায়। মেয়েরা ধনুকের জ্যায়ের মত, যতই চাপ প্রয়োগ করা হোক না কেন সোজা হয়না। জোরপূর্বক সোজা করা গেলেও ছাড়া মাত্রই লাফ মেরে পূর্বাবস্থানে ফিরে যায়। যতই বুঝানোর চেষ্টা করছে বারী মিয়া ততোই বেঁকে বসছে ছমিরুন।
বলছে রেগে-
'ঝি নষ্ট হাঁটে, বউ নষ্ট মাঠে,
পুরুষ মানুষ নষ্ট হয় পাড়াপড়শীর ঘাটে।'
তুমি নষ্ট। নষ্ট না হলে কমলা বুকে গোসল-ঘাট হতে নিয়ে আসলি কেন?
আবার কমলা, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে মিরুন, বলে উঠে বারী মিয়া।
ছমিরুন রেগে ওঠে, 'চলে যাও এক্ষুনি, আমাকে দিয়ে তোমার হবেনা বলছি।'
একেতো বাপের বাড়ী, বাপের বাড়ীতে মেয়েদের সাহস হাজার গুন বেড়ে যায়। এখানে তারা স্বামী কেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকেও তোয়াক্কা করেনা। আর বারী মিয়া, সে তো সামান্য একজন। তাকে থোড়াই কেয়ার করে ছমিরুন।
বারী মিয়া রক্তমাংসের মানুষ। তদুপরি কিছুটা রগচটা। ছমিরুনের আচরণে তার মাথাটা বিগড়ে যায়। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে সে।
ছমিরুন চিৎকার করে উঠে, খবরদার বলছি, আর কোনদিন আমার কাছে আসবিনা তুমি। এক্ষুনি চলে যাও বলছি। আর আসলে ঝাড়ু মেরে বিদায় করে দেব। অনেক সইছি, আর নয়। তোমার ঘর করা আর সম্ভব নয় আমার।
রগচটা বারী মিয়া রাগে বগডুল হয়ে চিৎকার দেয়, আমি চলে যাচ্ছি হারামজাদি, যাবার আগে তোকে তালাক দিলাম, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক,   বাইন   তালাক  বলেই সে হন হন করে ছুটে যায় শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে, এই সেই শ্বশুরবাড়ী যা এতদিন ছিল বারীমিয়ার মধুরহাড়ি সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে স্ব স্ব স্থানে। 
সবেমিলে ঘটনাটা লুকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হল।
নিমিষেই সারাটা গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেল বারী মিয়া বউ তালাক দিয়েছে। এক তালাক নয়, একই সাথে তিন তালাক, তারপর বাইন তালাক। গ্রামের মোল্লা-মুন্সী ও মাতব্বরদের মধ্যে শুরু ল ভীষন কানাঘুষা হৈ চৈ।
এদিকে বউ তালাক দিয়ে বারী মিয়া ভাল নেই, তার অবস্থা শোচনীয় বউয়ের জন্য পাগল প্রায় সে। ছমিরুনের চিন্তায় আহার নিদ্রা সব বন্ধ হয়ে গেছে তার। গ্রামবাসীর কাছে গিয়ে বারবার ধর্না দেয়আপনারা আমার ছমিরুনকে এনে দিন। গ্রামবাসী বিরক্ত হয়ে বলল তুমি বললেই কি আমরা ছমিরুন এনে দিতে পারি? আমারদেরকে আগে দেখতে হবে শরিয়া কি হুকুম দেয়। গ্রামে সভা বসে বারী মিয়ার ব্যাপারটা কী করা যায়? মসজিদের ইমাম সাহেবও আসেন। হুজুর ফতোয়া দেন হিল্লা বিয়ে অর্থাৎ অন্য কোথাও ছমিরুনকে বিয়ে দিয়ে সেখান থেকে তালাক করিয়ে আনতে হবে, তবেই ছমিরুন আবার বারী মিয়ার জন্য হালাল হবে। এখন হিল্লাবিয়ে নাদিয়ে ছমিরুনকে এনে বারী মিয়ার হাতে তুলে দিলে যেনার পাপ হবে, যে যেনার পাপে সহায়তার দ্বায়ে আপনারা সবাই পাপী হবেন।   
আমার স্ত্রী অন্যের কাছে বিয়ে দেব, তারপর আনব। আবার কেমন কথা?দুশ্চিন্তার সমুদ্রে সাঁতার কেটে কেটে অর্ধপাগল বারী মিয়া একটা গতির জন্য এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। অনেক আলেমের কাছ গেল সবার একটাই জবাব, কিতাবের কথা তাকে হিল্লা করাতেই হবে। নতুবা ছমিরুনকে আনতে পারবে না। বারী মিয়ার মনে হয় মৌলভীরা কী যে ভীষন নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। কেউই তার মনের দুঃখ বুঝতে রাজী নয়।
তিন তালাক হয়ে যাবার পরও বারী মিয়া কমলাকে বিয়ে করছেনা দেখে ছমিরুন নিজের ভুল বুঝতে পারে। সারাদিন বাপের বাড়ীতে বসে কাঁদে, আর চোখের জলে বুক ভাসায়। সব হারানোর পর, বুঝতে পারে ছমিরুন, রাগারাগি করা, বকবক করা এই সহজ সরল লোকটার আসলে স্বভাব। তার প্রতি ঘৃণা বা কমলার প্রতি আসক্তি নয়।
ছমিরুন কাঁদে আর ভাবে এখন সে কী করবে। যে ভুলটা সে করেছে তাতো  সংশোধন  হবার নয়। বারী মিয়ার কোন দোষ নেই। সে তো নিতে এসেছিল, সে যদি এমন বোকামি না করত তবে এমনটা হত না। হঠাৎ যেন তাদের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল।
বারী মিয়ার এক বাল্যবন্ধু খবর দিলেন, দুরবর্তী চন্দরপুর গ্রামে একজন আলেম আছেন। দারুন জাদরেল। তিনি মাওলানা জালাল চন্দরপুরী। মালকড়ি পেলে তিনি নাকি কিতাব ঘেটে সহজ রাস্তা নিমিষেই বের করে দিতে পারেন। তার কাছে গিয়ে অনেক মানুষই উপকৃত হয়েছে। সাধারণ মৌলানাদের ফতোয়াকে অনেক সময় তিনি পাল্টে দিয়ে সিরাতুল মুসতাকিম বের করে দেন।
একদিন ভোরে বারী মিয়া মাওলানা জালাল চন্দরপুরীর দরবারে গিয়ে হাজির হয়। বেটে ধরণের মৌলভী কথা বলার স্টাইলে মনে হয় তিনি দারূন ধূর্ত। লণ্ডনী মেয়েদের ঘটকালি, ফতোয়াবাজী, ওয়াজ, টুটকা-তাবিজ এই সবকাজের কাজী মৌলানা টাকায় টইটম্বুর।
বারী মিয়া তার সমস্যার কথা জানালে মৌলানা মৃদু হেসে বললেন, এতো এক দারুন জটিল সমস্যা নিয়ে এলেন। সমাধান মিলবে, তবে সময় লাগবে, টাকাও লাগবে। ভাল এনাম পেলে কিতাবাদি ঘেটে দেখব কিছু করা যায় কিনা।
বারী মিয়া বলল, হুজুর আপনি আমার ছমিরুনকে হিল্লা থেকে বাঁচান। আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন, আমার ছমিরুনকে অক্ষত শরীরে এনে দেন। 
বারী মিয়া তুমি তোমার বউকে পেয়ে যাবে, তবে আমাকে নগদ বিশ হাজার টাকা দিতে হবে। তোমার কাজ করে দিতে অক্ষম হলে সম্পূর্ণ টাকা ফিরিয়ে দেবো।
বারী মিয়া বললো- হুজুর, হিল্লা টিল্লা ওসব লাগবে না তো।
ওসব লাগলেই কি আর তোমার কাছে টাকা চাইতাম। তুমি তোমার বউ এমনিই পেয়ে যাবে।
হুজুর কেমন করে সম্ভব? বারী মিয়ার প্রশ্ন। বিশ হাজার টাকা পকেটে পুরেই হুজুর বললেন- কেমন করে তা বলছি।
'আচ্ছা বারী মিয়া, একে একে চারটি কলিমা মুখস্থ বলতো দেখি।'
আৎকে উঠে বারী মিয়া- মাফ করুন হুজুর, শৈশবে মা-বাবা মারা যাওয়ায় ওসব শেখা হয়নি, যাও শিখেছিলাম চর্চার অভাবে কিছুটা এতদিন মগজে থাকলেও এখন আর নেই।
'বিলকুল ঠিক হায় বারী মিয়া, বিলকুল ঠিক'- মৌলানার মুখে ধূর্তের হাসি।
এত বছর যখন পেরেছো, আর কিছুদিন কলিমা ভুলে থাকতে পারবা বারী মিয়া? মৌলানার নির্দেশ।
পারবনা কেন? সব পারব, যা বলবেন তাই পারব হুজুর, যদি আমার ছমিরুনকে পেয়ে যাই।
মৌলানা চন্দরপুরী বারী মিয়াকে বললেন, যাওতোমার সাত গ্রামের পঞ্চায়েত জমা কর উক্ত সভায় নিয়ে যাও আমাকে। তুমি সব সত্য বলবে, এক বাক্যও মিথ্যা বলবে না। মিথ্যা বললে তুমি প্যাচে পড়বে, আমি তার দ্বায় নেব না। আমি তোমার উপকার করে দেব। অন্যথায় বিশ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দেব।
বারী মিয়া গ্রামে ফিরে এসে সাতগাঁয়ের পঞ্চায়েত ডাকল। গ্রামবাসী সভায় তাকে প্রশ্ন করল, বারি মিয়া তুমি কি তোমার বউকে তিন তালাক দিয়েছ। সে বলল, হ্যাঁ দিয়েছি। সভায় ঘুমটা-টানা ছমিরুনকে মাতব্বরগন একই প্রশ্ন করলে তার  কাছ থেকেও একই উত্তর এল, হ্যাঁ দিয়েছে
গ্রামবাসী ভাবল, বারি মিয়া বুঝি পাগল হয়ে গেছে। নতুবা এমন মিছামিছি আচরণ করছে কেন? তালাক দেওয়া বউকে তো হিল্লা ছাড়া কেউ কি ঘরে আনতে পার? তবে কেন সে এত মানুষ জড় করছে, দূরবর্তী গ্রামের আলেম সাহেবকে এনে কষ্ট দিচ্ছে। ছমিরুনকে বোরকাবন্দি করে এনে এত লোকের সামনে বেইজ্জত করছে। ওরা কেউ তো ছমিরুনকে হিল্লে ছাড়া ওর হাতে তুলে দিতে পারবে না।
নিদৃষ্ট দিনে সাত গেরামের লোকজন জমায়েত হন। সবাই বারি মিয়ার জন্য দুঃখ করল, কেউবা বলল, 'বউ যে কি জিনিস এখন বারটা বাজিয়ে তবে না বুঝল বারী মিয়া।' কেউবা বলল, 'মুখ ফসকে মুহুর্তেই তিন তালাক বলে দিল বারী, এখন মজাটা একটু বুঝে নিক।' মৌলানার তাগিদে উক্ত সভায় আবার ছমিরুনও উপস্থিত হল।
লম্বা পাঞ্জাবী ওয়ালা মাথায় পাগড়ীপরা বেটে মৌলানা জালাল চন্দরপুরী এলেন। মৌলানার আলখেল্লা দেখে সবাই শ্রদ্ধায় এক সাথে দাঁড়িয়ে যায়। সমস্বরে রব উঠে 'আস্সালামু আলাইকুম।' হুজুর আরেকটু লম্বা করে সালামের জবাব দেন, ওয়ালাইকুম ওয়াসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।  
মৌলানা সাহেব সবচেয়ে বড় চেয়ারে বসলেন, পাশের চেয়ারগুলোতে মাতব্বরের দল, সামনে আমজনতা। ধীর স্থির কন্ঠে হুজুর বললেন- এই গ্রামের বারী মিয়া আমার কাছে গিয়েছিল। সে নাকি তার বউকে তালাক দিয়েছে। সবার কাছে তিনি জানতে চাইলেনঘটনা কি সত্য?
গ্রামবাসী এক বাক্যে রায় দিল সত্য ছমিরুনকে এবার মৌলানার সামনে হাজির করা হল। মৌলানা তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি বারী মিয়ার বিবাহিতা স্ত্রী? বোরকার ফাঁক থেকে জবাব এলো হ্যাঁ আবার প্রশ্ন- সে কি তোমাকে তিন তালাক দিয়েছে? এবারও উত্তর এলোহ্যাঁ।মৌলানা আবার ছমিরুনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মা তো সাচ্চা মুসলমান? আচ্ছা চারটি কলিমা মুখস্থ বলতো? এবার ছমিরুন গড় গড় করে একে একে সব টি কলিমা মুখস্থ বলে গেল
এবার বারী মিয়ার পালা। বারী মিয়ার দিকে একই প্রশ্নবান ছুড়ে দিলেন মৌলানা চন্দরপুরী সাহেব। সব প্রশ্নের হ্যাঁ বোধক উত্তর এলেও কালেমার ব্যাপারে বারী মিয়া জালে আটকা পড়ে গেল। আম্তা আম্তা করে বলল- হুজুর মাফ করে দেন, আমাকে মাফ করে দেন। গ্রামবাসী তাজ্জুব হয়ে গেল, ছিঃ ছিঃ বারী মিয়া কালেমা জানেনা। মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও সে বেদ্বীন। সকলের মন ধিক্কারে ভরে গেল।
মৌলানা বললেন, সাত গ্রামের ভাইসব আপনারা ভালভাবে জেনে নিন, বারী মিয়া চার কলেমার কোন কালেমাই জানেনা।
এবার মৌলানা সাহেব আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ভাষণ দিতে শুরু করেন 'আমি এক সামান্য আলেম। মূল্যবান কিছু বলবার মত তেমন যোগ্যতাও আমার নেই। তবে জানিনা কেন লোকে আমাকে এত সম্মান দেয়। মানুষ ওয়াজ তফসীরে আমাকে খবর করে, ফতোয়ার জন্য নিয়ে যায়। আমি নাদানের পক্ষে যদি দ্বীনের একটু খেদমত হয় তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। খোদার হাজার শুকরিয়া তিনি আমাকে আপনাদের দরবারে নিয়ে এসেছেন এবং বারী  মিয়ার ফতোয়ার গুরুদায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। পাশে উপবিষ্ট ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন- মানুষ মাত্রেই ভুল হয়, কেবলমাত্র ফেরেশতারা নিষ্পাপ। আমি তো ফেরেশতা নই, রক্ত মাংসের মানুষ। আমারও তো ভুলভ্রান্তি হতে পারে। খোদা যেন এই নাদানকে উক্ত গুরুদায়িত্ব সঠিক ভাবে পালনের শক্তি দেন। সবাই বলুন আমিনসমবেত জনতা সমস্বরে বলল আমিন।
মৌলানা বলে উঠলেন, আমি ফতোয়া দিচ্ছি ছমিরুনের হিল্লার কোন প্রয়োজন নেই। সাথে সাথে সভায় তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। লোকে হৈ চৈ চিৎকার করল- শুনো, শুনো পাজী মৌলানাটা বলছে কি?
স্থানীয় ইমাম সাহেব গর্জে উঠেন- নাউজুবিল্লাহ মীন জালিক, কোন কেতাবে এমন উল্টো ফতোয়া পেয়েছেন আপনি? দেখছি আপনি একটা ফাছেক, একটা ভণ্ড মুর্তাদ।
মৌলানা জালাল উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন একটু ধৈর্য্য ধরুন। দয়া করে মুখ বন্ধ করুন। আগে আমার কথা শুনুন, তারপর ভণ্ড ফাছেক যা খুশী ইচ্ছে বলতে পারেন। 
কথা শুনে জনতা শান্ত হল, সভায় নেমে এলো পিনপতন নিরবতা।
বললেন হুজুর,  কেমন করে ফতোয়ার দিচ্ছি শুনবেন? তাহলে শুনুন-
আপনারাই তো দেখলেন বারী মিয়া কলেমা জানেনা, শুধু মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই মুসলমান হওয়া যায়না। মুসলমান হতে হলে কলেমা জানতে হয়। ওর দ্বীন নেই অর্থাৎ সে কলেমা নাজানায় এখনও মুসলমান নয়। শরিয়তের বিধানানুসারে একজন অমুসলিম পুরুষের সাথে মুমেনা মহিলার বিবাহ বৈধ নয়। কাজেই কলেমাহীন অর্থাৎ বেদ্বীন বারী মিয়ার সাথে মুমেনা ছমিরুনের পূর্বের বিয়েই হয়নি। যে বিয়ে হয়নি তা ভঙ্গ হওয়ায় কিছুই যায় আসেনা। হিল্লে বিয়ের ফতোয়াও এখানে অচল। 
এখনই আপনারা বারী মিয়াকে কালিমা পড়িয়ে দ্বীনে নিয়ে আসুন এবং কাজী ডেকে ছমিরুনের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করুন। তাদের আগের বিয়ে শরিয়া মতে অঠিক ছিল, এখন হবে সঠিক বিয়ে। 
স্থানীয় ইমাম সাহেব এবার সত্যটা বুঝলেন, তিনি বারী মিয়াকে কালিমা পড়ান এবং খুশিতে গদগদ বারী মিয়া মহা ধুমধামের সাথে  ছমিরুনকে আবার বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যায়।
ছমিরুনকে হারানোর ভয়ে বারী মিয়া এবার স্বভাবিক মানুষে পরিণত হয়। ওর বকবক রগচটামি আচরণ বন্ধ হয়ে যায়। ছমিরুনের বুঝতে বাকী রলনা বারী মিয়া কেবলমাত্র তারই, অন্য কারো নয়। অনর্থক রাগারাগি করা লোকটার আজন্ম স্বভাবমাত্র। 
ছমিরুন বারীমিয়ার ঘরে এখন আর তুফান নেই, যেন শেষরাতের নিরবতা। তারা  এখন একজোড়া  চিরসুখী কবুতর দম্পতি।          
রচনাকালঃ ১৯৮৬ খৃস্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন