সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

কাজী মাষ্টার

কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
কাজি মাস্টার

কার্টুনের মত চেহারা লোকটির, কালো গাত্রবর্ণ, লম্বা নাক, সুউচ্চ ভ্রু, মাথার কালোচুল নেমে এসে ঢেকে ফেলেছে কপালের ডানদিক। কথা বলার সময় বেরিয়ে আসে লম্বা লম্বা সুপারী রাঙ্গা দাঁত। কথা বলার আগেই ওর কোটারাগত চোখযুগল যেন কথা কয়
সিলেট শহর থেকে দশবার মাইল দক্ষিণে হাকালুকির তীরবর্তী বিচ্ছিন্ন নির্জন এক পাড়াগায়ের জুনিয়র স্কুলের শিক্ষক সে। সম্ভবতঃ চাকুরি নামক সোনার হরিণের পিছু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বি.কম.পাস বেকার যুবক ভাগ্যন্নেষণে এসে যায় সিলেটের এই অজপাড়াগাঁয়ে। আস্তানা গড়ে সিলেটের এই ভার্টি এলাকায়। সহজ সরল মাটির মানুষগুলোর সাথে মিশে যায় রক্তে-মাংসে। একটা সতেজ চারাগাছ উর্বর মাটিতে গেঁথে দিলে যেমন বসিয়ে দেয় তার মূল-শাখামূল, পরিশেষে পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠে, লোকটিও তেমনি ধন ঐশ্বর্যে উর্বর সিলেটের এই প্রত্যন্ত এলাকায় গ্যাথে দেয় তার শক্ত শিকড় এবং দিনে দিনে সে পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে উঠে। আমাদের গ্রামের ব্যাংক অফিসে লোকটির সঙ্গে দেখা ঠোঁটের কোনে এক গোপন হাসি লুকিয়ে রেখে অনবরত কথা বলে যায় লোকটি। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি তন্ময় করে দেয় মজলিস। সবাই নীরবে শুনে যায় লোকটির গল্প। আসলেই এক অদৃশ্য সম্মোহনী শক্তি আছে ওর। সহজেই আপাদমস্তক ঢুকে যায় মানুষের মনে কিছুক্ষণ আলাপের পর লোকটি হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে, হ্যান্ডসেক করে বেরিয়ে যায়।
প্রতিদিন বৈকালিক আড্ডায় ওর সাথে দেখা হত ব্যাংক অফিসে। ক্রমে ক্রমে লোকটির প্রতি জন্মে যায় আকর্ষণ। ওর সাথে যে দিন আড্ডা ত না, সেদিন মনটা করত ছটপট। একদা কথা প্রসঙ্গে বললাম, “কাজি সাহেব, আপনি তো মন্ত্রী কাজি জাফরের চাচাতো ভাই। এত বড় প্রভাবশালী লোকের আত্মীয় হয়েও কোন সুযোগ নিচ্ছেন না কেন? ভাল ব্যবসাপাতির লাইসেন্স করুন। অথবা তাঁকে ধরে একটা ভাল চাকুরিতে ঢুকে পড়ুন। তাও সম্ভব না হলে উনার সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হয়ে কোন একটা উন্নত দেশে পাড়ি জমান। এভাবে সুদুর সিলেটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এসে অযথা আপনার মত শিক্ষিত স্মার্ট যুবকের সময়ক্ষেপণ করা কি ঠিক হচ্ছে। জীবনটাকে নষ্ট করছেন কেন? সত্ত্বর একটা বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
কাজি সফিকের উত্তর, আমিও ভাবছি তাই। দেখা যাক কী হয়। তবে একটা কথা আছে না- ঘরের ডাক্তার দিয়ে ঘরের রোগীর রোগ সারে না, বাইরে ডাক্তার খোঁজতে হয়। আমারও অবস্থাটা তাই। এখানকার লোকদের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে। তাদের মায়ার বন্ধনে বন্দি হয়ে গিয়েছি। তাই যাবো যাবো করেও সরা হচ্ছে না কী আর করব ভাই। তাই পড়ে আছি এখানে- লাভ লোকসানের হিসেবটা অনেকদিন হয় গোদাম ঘরে রেখে দিয়েছি
কাজি সফিক এখানে শিক্ষকতায় যোগদান করে লজিং হিসাবে বেছে নেন ভাটি এলাকার এক অবস্থাসম্পন্ন লন্ডনি বাড়ি। আব্দুল গফুর লণ্ডনি সাহেবের সন্তানদেরে সকাল বিকাল পড়ান তিনি মিষ্টি আচরণে বাড়ির মানুষগুলোর অন্তরে কেবল কাজি মাস্টার, আর কাজি মাস্টার লণ্ডনির পরিবারের একজন মাতব্বর সদস্য হয়ে যা কাজি মাস্টার। লন্ডনি বিলাত চলে গেলে যখন তখন ভিতর বাড়িতেও আসেন, লণ্ডনির প্রদত্ত চিটিপত্র পড়েন, ব্যাংকে লণ্ডনের ড্রাফট জমা দেন, চিঠিপত্রের জবাব লিখেন, এভাবে হাঁট-বাজারসহ সমুদয় কাজকর্মে ও পরামর্শে জড়িয়ে পড়েন কাজি মাস্টার। লণ্ডনির অবর্তমানে কাজি সাহেবের উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে যায় লন্ডনির পরিবার।আম্মু এসো, আব্বু এসোবলে লণ্ডনির ছেলেমেয়েদেরে প্রায়ই ডাকা ডাকি করতেন মাস্টার লণ্ডনির পৌঢ়া স্ত্রী হয়ে যান তার ভাবীসাব ভাবী সাহেবার কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তখন কাজি মাস্টার।
লন্ডনির স্বার্থরক্ষার তাগিদে মাঝে মধ্যে গ্রাম্য রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়তেন গ্রামবাসীর মাস্টার সাহেব। একবার লণ্ডনির জমির আল কেটে ফেলে, একজন দুষ্টলোক। ব্যাপারেও কাজি মাস্টার বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এভাবে কাজি মাস্টার লণ্ডনির পরিবারে তাদের ইষ্টিকুটুমের চেয়েও কাছের মানুষে পরিণত হন। লণ্ডনির আশ-পাশের আত্মীয়রাও তাকে ঈর্ষার করতে শুরু করে। সময়ে অসময়ে তার বিরুদ্ধাচরণ কুৎসা রটানো তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। কিন্তু ভাবী সাহেবা লন্ডনি তাকে এতই ভালবাসেন যে কারও বদনামে তাঁরা আমল দিতেন না। বরং উল্টো তার প্রতি তাদের মমতা আস্থা ক্রমান্বয়ে আর বাড়তে থাকে।
লণ্ডনির জ্যৈষ্ঠাকন্যা লাকি। ক্লাস টেনের ছাত্রী। তিনবছর পূর্বে মেয়েটিকে লণ্ডনে নিয়ে যান লণ্ডনি। মাইগ্রেশনের কাগজপত্র সব তৈরি হয়ে গেলে বাড়ন্ত মেয়েটিকে লন্ডনের নির্লজ্জ পরিবেশে না রেখে, নিয়ে আসেন দেশে। রক্ষণশীল বাবার উদ্দেশ্য এখানকার বাঙ্গালি পরিবেশে মেয়ে মানুষ হবে, শিক্ষালাভ করবে। তারপর উপযুক্ত বর পেলে জামাইসহ নিয়ে যাবেন লণ্ডনে। মেয়েটি তার অপরূপা না হলেও সুন্দরী। তবে বৃটিশ সিটিজেন। তাই উপযুক্ত বরের অভাব হবে না সুনিশ্চিত।
ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিন ভোর সন্ধ্যায় স্যারের রুমে পড়তে যায়। এই রুমে স্যারের খাট, ছোট আলমিরা, আর বৃহৎ পড়ার টেবিল টেবিলসংলগ্ন চেয়ারগুলোয় বসে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা। আর কাজি মাস্টার খাটে শুয়ে বসে চালিয়ে যান শিক্ষাদান কার্যক্রম।
লাকি এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। সঙ্গত কারণেই ওর প্রতি মাস্টার সাহেব অতিমাত্রায় ত্নশীল, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরে নির্ধারিত সময়ের আগেই ছেড়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লাকিকে নিয়ে বসে থাকেন পড়ার টেবিলে। কাজি মাস্টারের আম্মু আব্বু এবাড়ির ছেলেমেয়েরা সব। মাঝে মধ্যে লাকিকেমা লাকি, দিকে এসো, পড়তে বসোইত্যাদি বলতে শুনা যেত। সহজসরল গ্রামবাসীরা ধর্মের মা-বাবা, কিংবা ধর্মের ভাই-বোন সম্পর্ক অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখে। এই পবিত্র সম্পর্কের মাঝে কোন দুই নম্বরী কিছু ভাবতেও পারে না তারা। কিন্তু কাজি মাস্টার মানুষের এই বিশ্বাস মূল্যবোধকে হঠাৎ ধূলিস্যাৎ করে দেন।
কাকপঙ্খীও ঠাহর পায়নি, একদিন রাতে হাওয়া হয়ে যান লাকিসহ কাজি মাস্টার। সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতে পায় মাস্টার লাকির ঘরের দরজা বাইরের দিকে বন্ধ। আকাশটা ভেঙ্গে পড়ে বাড়ির উপর। বিদ্যুৎবেগে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। লণ্ডনে যাবার জন্য অনেকের দৃষ্টি ছিল মেয়েটির উপর। বউয়ের কাঁধে ভর করে লণ্ডনে যাবার ভরসায় ঘাপটি মেরে বসেছিল ওর এক চাচাতো এক মামাতো ভাই। তাঁদের কপাল পুড়লো।
অনেক অনুসন্ধানের পর জানা গেল লাকিকে নিয়ে কাজি মাস্টার চলে গেছে কুমিল্লায় অভিভাবকরা ছুটে যান চৌদ্দগ্রামে, গিয়ে আৎকে উঠেন মেয়ের চেহারা সুরত দেখে। সেখানে ভিন্ন দরিদ্র পরিবেশে হাফিয়ে উঠেছে লাকি। মাটির ঘর, কাঁচা লেট্রিন, মজা পুকুর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অসহ্য লাগে লাকির। ভিনভাষী মানুষের আচার আচরণ, কথাবার্তা, খাবার-দাবার কোন কিছুতেই মন বসে নি তার। লোকের সাথে কথা বলতনা, খাবারদাবারে আদৌ মন বসত না, সিলেটের ধনীর দুলালী লাকির। সব সময় অশান্তি দুশ্চিন্তা তাকে কাতর করে রাখত। বাপেরবাড়ির কলের চিন্তায় রাতে ঘুম আসত না চোখে। মেয়েটাকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান কাজিবাড়ির লোকজন।
কিশোর বয়সে নাকি মেয়েরা ভুল করে বেশি। তখন ওদের শরীর বাড়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠে না বুদ্ধিসুদ্ধি। মনের চিন্তা শক্তি রয়ে যায় অপরিপক্ক। জীবন সম্পর্কে ধারণা অভিজ্ঞতা থাকে নিতান্তই অল্প-স্বল্প, অথচ মনটা থাকে চঞ্চলা। নানা ধরণের যৌবন হরমুন নিঃসরণে এরা হয়ে যায় উত্তপ্ত কড়াই, একটা কিছু ছেড়ে দিলেই নিমিষে আলুসেদ্ধ ঋতুর আগমনে কখনও কখনও শরীরে আগুন লেগে যায়। পুরুষ সান্নিধ্য মাতৃত্বের আহবান পাগল করে দেয় তাদের। এসময় অভিভাবকরা অসতর্ক হলেই কিশোরীরা মারাত্মক ভুল করে বসে। কাজিস্যারের বাকচাতুর্যে সম্মোহিত লাকি পূর্বে এতকিছু ভাবে নি। এখন মনে মনে ভাবে কী ভুলটা সে করে বসেছে, যে ভুলের সম্ভবতঃ কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই। সিলেট অঞ্চলের কত শিক্ষিত অভিজাত ঘরের ছেলে বর হয়ে আসত তার। এখন তার মনে হয় কালো কাটুনাকৃতির লোকটা একটা অসৎ, লম্পট, প্রতারক। মামাকে চৌদ্দগ্রামে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে লাকি। মনে হচ্ছিল, সে যেন হাজার মাস ধরে বন্দি হয়ে আছে জেলে।
লাকির পাসপোর্ট দেশে রেখে যান নি গফুর লণ্ডনি। ওটা লণ্ডনে তার কাছে রক্ষিত ছিল। তাই বেকায়দায় পড়ে যান কাজি মাস্টার। পাসপোর্টটার জন্য এখন লাকির অভিভাবকগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। পাসপোর্টটা থাকলে কী যে সুবিধা হত। সোজা চলে যেত বৃটিশ এম্বেসি, তারপর লণ্ডন। মাস্টার ভাবলেন ঘটনা যখন ঘটেই গেছে তখন তাকে মেয়ে জামাই হিসাবে বরণ করে নিতে বাধ্য লাকির অভিভাবকরা। কাজি সাহেব ভাবে এই সত্যটাকে মেনে নেয়াটাই তো তাঁদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। কাজি মাস্টার আদৌ  বুঝতে পারে নি লাকির অভিভাবকরা যে তার মত এত  আক্কলবাজ  নয়।       
কন্যার দুর্ঘটনার খবর শুনে লণ্ডন থেকে ছুটে আসেন লণ্ডনি। মাস্টারকে সমুচিত শিক্ষা দেবার গোপন প্রস্তুতি নে তিনি। নতুন মেয়ে জামাইকে বরণ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে মেয়েসহ তাকে নিয়ে আসেন সিলেটে। মাস্টারকে সিলেট আসতে বারণ করেন তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই। কারো কথায় কর্ণপাত করে নি একগুয়ে মাস্টার। চলে আসে শ্বশুর বাড়ি। সবাই তাকে অত্যন্ত সর্তক থাকার পরামর্শ দেয় কিন্তু শ্বশুরবাড়ির আদর আপ্যায়নে একেবারে বুদ্ধিহারা হয়ে যান মাস্টার। তবে লাকিকে ওর রুমে দেয়া হয়নি, বলা হল বহুদিন পর মেয়ে বাড়ি এসেছে, মায়ের আদুরে কন্যে মায়ের কাছেই থাকবে একটি রাত। অশান্তিতে মনটা যেন কেমন কেমন করছে মাস্টারের, তাই ঘুম এলো অনেক দেরিতে, প্রায় মধ্যরাতের পর। কেমন করে কি হল বুঝতে পারলনা মাস্টার, হঠাৎ বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে ঢুকলো একটা লোক। দরজা খোলে দেওয়ামাত্র আরও চার-পাঁচ জন। সবাই, লাকির মামা, বাবা, চাচা, চাচাতো ভাইরা, ঘুম ভাঙ্গার আগেই মাস্টারের মুখে তারা ঢুকিয়ে দেয় কাপড়ের আটি।
মাস্টার চীৎকার করার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু কোন শব্দ বেরুল না। হাত-পা বেঁধে টানাহেঁচড়া করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল হাজিগঞ্জ  ফেঞ্চুগঞ্জের মধ্যবর্তী বিশাল হাকালুকি হাওরে। শুরু হয় অমানুষিক পিটুনী। ধুরন্ধর কাজি মাস্টারের বুঝতে বাকি নেই, মৃত্যু আসন্ন। এই বিশাল হাওরে চীৎকার মানে গহিন অরণ্যে রোদন। তাছাড়া চিৎকার করবেন কেমনে? মুখ বাঁধা।শেষবারের মত ক্ষমা চেয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করে সে বুকে শক্তি যোগায় এই ভয়ঙ্কর রাতেও মাস্টার বুদ্ধি হারায় নি। খুব সুন্দরভাবে মৃত্যুর অভিনয় করে সে। কলেমা পড়ে চোখ দুটি মেলে দেয় এবং চোখের তারা দু'টি এমনভাবে ঘুরাতে থাকে যে,  বুঝি তাঁর প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছে আকাশে। শ্বাস-প্রশ্বাসও ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। টর্চ মেরে সবাই দেখে চোখ স্থির হয়ে গেছে। বুকে হাত দিয়ে দেখে হৃদকম্প নেই। এবার তাঁরা নিশ্চিত কাজি মাস্টার আর নাই। লাশের নাকে খানিকক্ষণ হাত রেখে লন্ডনি বললেন, বাতাস নেই, হাওয়ার কল বন্ধ।
লাশের সাথে বেয়াদবি গোনাহে কবিরাহ, সসম্মানে লাশের সব বাঁধন খুলে দাও, বললেন লণ্ডনির বিজ্ঞ লোকজন। এবার প্রাণ বাঁচানোর পালা। গফুর লন্ডনি বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল, সবাই পালাও, যে যেদিকে পার পালাও। খবরদার কাক-পক্ষিও যেন টাহর না পায়। খুনীরা মৃতদেহের সব বাঁধন খোলে দিয়ে পালিয়ে রাতের আধারে গা-ঢাকা দিল। কাজিমাস্টার ঘাসে সঠান হয়ে শুয়ে সব শুনে মনে মনে বললেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ, দয়াল আল্লাহ তুমি প্রাণটা বাঁচালে। অপারেশন সমাধা করে সবাই পালিয়ে গেলে কাজি মাস্টার কিছুক্ষণ গড়াগড়ি যান হাওরে, হেঁটে হেঁটে পাশের মোগলাবাজার রেলস্টেশনে গিয়ে ভোরের ট্রেনে চলে যান ঢাকায়। গতরাতের মারের চুটে মাস্টারের জ্বর হয় ব্যথায় কাতর হয়ে দিনকয়েক রেস্ট নেন ঢাকায় বেশ কিছুদিন প্যারাসিটামল খেয়ে খেয়ে ভাল হন মাস্টার। এবার এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার পালা মাস্টারের
একজন জলজ্যান্ত মানুষ খুনের মানসিক যন্ত্রণা। সেইসাথে আইনের ভয়ে আসামিরা ছিল ভীতসন্তস্ত্র। লণ্ডনি বারবার অভয় দেন, যত টাকা লাগুক না কেন টাকা ঢেলে সব গায়েব করে দেবো তবুও মনে স্বস্থি ছিলনা কারো, কারণ এই কিছুদিন আগে পত্নী রিমা হত্যার দায়ে কোটিপতি মুনিরের ফাঁসি হয়। টাকা, ক্ষমতা, খুটির জুর কিছুই রক্ষা করতে পারেনি তাকে। 
কাজি মাস্টারের মৃতদেহ উদাও য়ে যেতে দেখে গতরাতের আতংকিত খুনীরা সবাই হতবাক, তবে আনন্দিত, যাক বাঁচা গেছে।মাস্টারটা নিশ্চয় মরেনি, পাজিটা মারা গেলে তাঁর লাশ পড়ে থাকত, পুলিশ আসত, কী বিপদ না হ। লাশ পালিয়ে যাওয়ায় বরং সবাই মনে মনে দারুণ খুশি।   
ঢাকার রাজারবাগ গিয়ে হারিয়ে যাওয়া লাশ কাজিমাস্টার পুলিশের আই.জি. খাম সংগ্রহ করেন। তাতে ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসিকে কড়া নির্দেশ প্রদান করা হয়, পত্রবাহক আমার চাচাতো ভাই। ওর সাথে কিছুলোক খারাপ ব্যবহার করেছে। ওদেরকে গ্রেপ্তার করে কড়া শাস্তি দেয়া হউক এবং ওর স্ত্রী লাকি বেগমকে ওর সঙ্গে চলে যেতে দেয়া হউক। পত্রের নীচে আই.জি’পি সীল ও স্বাক্ষর ঝলমল করছে। এমন কি ঢাকা থেকে আইজি টেলিফোনে ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসিকে মৌখিক নির্দেশও প্রদান করেছেন। পুলিশ প্রধানের দস্তখত হুবহু মিলেও যায়। আই.জি. টেলিফোন, হুঁশ হারিয়ে ফেলেন .সি সাহেব। ছুটে যান আসামিদের ধরতে, দুএকজন লুকিয়ে গেলেও আব্দুল গফুর লন্ডনিসহ প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসেন ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় সেই সাথে বৃটিশকন্যা লাকি বেগমকেও নিয়ে আসা হয় ফেন্সুগঞ্জ থানা হাজতে। উভয়সঙ্কটে পড়ে যায় লাকি। একদিকে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, অন্যদিকে কাজি মাস্টার। একবার মাস্টারের দিকে, একবার মা-বাবার দিকে দৃষ্টিবদল করে লাকি। লণ্ডনি দাবি করেন তার মেয়ের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি, মাস্টার তার নাবালিকা মেয়েকে ফুলসিয়ে নিয়ে কচি মেয়েটার সর্বনাশ করেছে। অন্যদিকে মাস্টার লাকি বেগমকে তার বিবাহিত স্ত্রী দাবি করে ফেরত পেতে চায়। দেরিতে হলেও লাকি নিজের ভুল বুঝতে পারে। দুর্ঘটনাটা ঘটার পর লাকির মনে হয় ভিনদেশী অসম বয়সী মাস্টারের সাথে এভাবে সংগোপনে পালিয়ে যাওয়া তার আদৌ ঠিক হয়নি। সে লণ্ডনির প্রথম সন্তান। ভাবে প্রথম সন্তানরা নাকি কিছুটা এমন হাবাগোবা হয়। প্রথম সন্তান হয়ে বংশের মুখে চুনকালি দিয়েছে। ভাবে কুমিল্লার মাস্টারটা তার কিনা সর্বনাশ করেছে। লাকির মন ক্রমশঃ ঝুঁকে পড়ে মা-বাবার দিকে। ওসিকে সরাসরি জানিয়ে দেয় মাস্টার তার কেউ নয়। দুষ্ট  কাজিমাস্টার ফস্টিনস্টি করে তার বারটা বাজিয়েছে। সে মাস্টারের সাথে যাবে না।
লাকির অভাবনীয় কাণ্ড দেখে ভেঙ্গে পড়ে মাস্টার। সে আশা করেনি যে মেয়েটা কয়েকদিন পূর্বে তার জন্য মা-বাবা, সংসার সব ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, আজ মেয়েটাই তাকে অস্বীকার করবে।
ওসি সাহেব উভয় সঙ্কটে পড়লেন একদিকে আই.জি নির্দেশ অন্যদিকে লাকির অস্বীকৃতি। শাঁখের করাতের চিপায় পড়ে ওসি পরামর্শ চেয়ে সিলেটের এসপি সাহেবের কাছে ফোন করেন এবং আসামিদের একরাত থানা হাজতে রেখে দেন।
এস.পির কাছে ফোন হচ্ছে দেখে ভয় পেয়ে যায় কাজি মাস্টারওর বুকে ধড়ফড়ানী শুরু হয়, না জানি জালিয়াতি ধরা পড়ে যায়। বিশেষ করে পুলিশের সঙ্গে জালিয়াতি, হাড্ডি একটাও আস্তো থাকবে না শরীরে।  রাতেই ফেন্সুগঞ্জ এলাকা ছেড়ে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে  পালায়  কাজি মাস্টার। 
পরদিন সিলেটের এস পি লোকটাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। কারণ এস.পি সাহেব ভালভাবেই জানেন আইজি তার সাথে যোগাযোগ না করে থানায় ওসিকে ফোন করতে পারেন না। তাতে প্রটোকল লংঘন হয় আইজির পদমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। 
জালিয়াতটাকে ধরে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। ওসি ওৎ পেতে বসে আছেন লোকটার অপেক্ষায়। এলেই ধরে সোজা খাচায় ভরবেন কিন্ত তার চেয়েও অনেক গুণ চালাক কাজি মাস্টার সে লাপাত্তা হয়ে গেছে। ওসি দুহাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে ছেড়ে দেন আসামিদেরে।
বেশ কিছু্কাল লাপাত্তা কাজি মাস্টার, তারপর আবার আবির্ভাব। ইতিমধ্যে স্কুলের চাকুরিটাও খতম হয়ে গেছে এবার ভাটি অঞ্চল ছেড়ে দুইতিন মাইল উত্তরে উজানে চলে আসে মাস্টার। বাড়ি  বাড়ি  গিয়ে ছাত্র পড়ানো এখন তা নতুন পেশা, নতুন কাজ। যেখানে  রাত  সেখানেই খাবার খেয়ে কাত হন মাস্টার 
এবার লাভজনক আদম ব্যবসায় নেমে পড়েন কাজি মাস্টার। চাচাতো ভাই কাজি জাফর নাকি এবার রাষ্ট্রীয় কাজে নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। তিনি কাজি মাস্টারকে সিলেট থেকে আমেরিকা গমন্চ্ছেুক লোকসংগ্রহ করতে বলেছেন। জনপ্রতি রেট তিনলক্ষ টাকা। 
কাজি মাস্টার পকেট থেকে মন্ত্রী কাজি জাফরের সাথে তুলা তাঁর একটা ফটো বের করে বারবার জনতাকে দেখায়। মানুষের বিশ্বাস জন্মে মাস্টার মহাশয় মন্ত্রী কাজি জাফরের নিকটাত্মীয়। যার যা আছে বিক্রি করে বেশ কয়েকজন আমলোক সরল বিশ্বাসে কয়েক লক্ষ টাকা তুলে দেয় মাস্টারের হাতে। খাবারের অভাব না হলেও থাকার সমস্যায় এবার পড়ে যান কাজি। লণ্ডনি বাড়ির ঘটনা এলাকায় জানাজানি হয়ে যাবার পর কেউই আর বাড়িতে আশ্রয় দিতনা তাকে। এবার সে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে ব্যাংকের নতুন ক্যাশিয়ার সহজপ্রাণ আব্দুল বারী সাহেবের সাথে, যার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। ক্যাশিয়ার বারী সাহেব থাকতেন ব্যাংকে। নানা অসুবিধার কথা বলে প্রায়ই মাস্টার রাতের ঘুমের পালা ব্যাংকে তাঁর দেশী ভাইয়ের বিছানায় সেরে নিত। একদিন ম্যানেজার সাহেব বিষয়টা জেনে যান এবং বারী সাহেবকে কড়া নির্দেশ দেন রাতে যেন ব্যাংকে বাইরের লোক না ঢুকে। বারী সাহেব তাকে বারণ করা সত্ত্বেও সে প্রায়ই রাতে হাত-পা ধরে ব্যাংকে ঘুমাতো। একরাতে ব্যবস্থাপক সাহেব তদন্ত করতে এসে মাস্টারকে ব্যাংকে পেয়ে নানান কটুকথা শুনিয়ে দেন। এক পর্যায়ে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। বারী সাহেবও ব্যবস্থাপকের পক্ষাবলম্বন করে একরকম জোর করে মধ্যরাতে তাকে ব্যাংক থেকে বের করে দেন। তারপর বেশ কিছুদিন লোকটি আর ব্যাংকের দিকে পা বাড়ায় নি।
অনেকদিন পর অফিস টাইমে কাজি মাস্টারের আবার আগমন। সে রাতের দুঃখজনক ঘটনার জন্য করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে আবার সে মিশে যায় সবার সাথে, গভীর অন্তরঙ্গতায় মজে যান বারী সাহেব রোজ রোজ আবার আড্ডার আসর। হাসিটাট্টা, হৈ চৈ। দুহাতে টাকা উড়াতো লোকটি। হাতে কাঁচা টাকার কোন অভাব নেই কারণ আমেরিকা গমনেচ্ছুক মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা তার দখলে। মানুষের তাগদা কবে যাবে তারা স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় সবাই অপেক্ষা করে করে অতিষ্ঠ। বারবার তাগদা, ধুরন্ধর মাস্টারের সান্ত্বনার বানী, শিঘ্রই হয়ে যাবে। পাসপোর্ট সংগ্রহ করুন, ওগুলো যাবে আমেরিকান এম্বেসি। তারপর ভিসা লেগে বের হয়ে আসবে পাসপোর্টগুলো।
কিন্তু না, এত দেরি হচ্ছে কেন? এত সময় লাগার তো কথা নয়। লোকের এত্তসব হৈ চৈ হাল্লা-গোল্লার মধ্যে আবার উধাও হয়ে যান কাজি মাস্টার। ঢাকার পত্রিকায় কাজিমাস্টারের ফটোসহ নিখোঁজ সংবাদ বেরুল- ওকে ধরিয়ে দিন। মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা বাগিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে সে। সন্ধানদাতাকে আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়া হবে আদালতে মামলাও হয়। কিন্তু মাস্টার নেই। মনে হয় অচিন কোন গ্রহ-নক্ষত্রে পালিয়ে গেছে সে। 
একদিন প্রত্যুষে ব্যাংকের অঞ্চলপ্রধানের আগমন ঘটে গ্রামের শাখায়, তিনি ব্যবস্থাপককে ডি.ডি ব্লক খোলার নির্দেশ দেন। আশ্চর্যের ব্যাপার ব্লকের মধ্যভাগের একটি পাতা নেই। আকাশটা ভেঙ্গে পড়ে ম্যানেজারের মাথায়। এটা গেল কোথায়। অনেক খোঁজখোজির পরও নেই। অনেকক্ষণ পর পাতাটা বেরিয়ে আসে অঞ্চলপ্রধান ডিজিএম সাহেবের পকেট থেকে। সেইসাথে বর্তমান আই.জির নির্দেশ ডি.ডি জালিয়াতির জন্য ম্যানেজারের চাকুরি খতম ক্যাশিয়ার আব্দুল বারীকে বান্দরবন বদলি করা হোক। ডি.জি.এম ভয়ে আতংকিত কী করবেন স্থির করতে পারছেন না
আপাততঃ নিজেকে বাঁচাতে হবে, তাই ম্যানেজার আমতা আমতা করে বললে- স্যারকুমিল্লার একটা লোক আব্দুল বারী সাহেবের সঙ্গে গার্ডরুমে থাকত। অফিসে থাকা নিয়ে ওর সাথে একরাতে ঝগড়াও হয়। সম্ভবতঃ বদলা নিতে গিয়ে সে এই অপকর্মটা করেছে। তাছাড়া ঠিক অনুরূপ পদ্ধতিতে জালিয়াতি করতে গিয়ে, কিছুদিন আগে সে ফেঞ্চুগঞ্জ থানায়ও ধরা পড়ে। এখানেই ইতি ঘটে ঘটনার। ক্যাশিয়ার আব্দুল বারী বদলি হয়ে চলে যান জগন্নাথপুরের এক প্রত্যন্ত শাখায়। 
জালিয়াতটার সমুদয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে মানুষ ছুটে যায় আই.জি অফিসে। পুলিশের আই.জি পাজিটাকে গ্রেপ্তারের কড়া নির্দেশ দেন। পুলিশ সারাদেশে জাল টেনেছে, কিন্তু সে ধরা পড়ে নি। পিচ্ছিল বাইম মাছের মত লুকিয়ে গেছে কয়েক হাত নরম কাদার তলায়।
রচনাকাল ঃ ১৯৮৮ সাল। রচনাস্থান ঃ দাউদপুর, দক্ষিণসুরমা, সিলেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন