শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

বিশ্বজনসংখ্যা দিবস ও বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা

বিশ্বজনসংখ্যা দিবস ও
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমানে বিশ্বের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে বিবেচিত। উন্নত বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নীচে রয়েছে ও অনেকগুলো উন্নত দেশেই জনসংখ্যা কোন সমস্যা হিসাবে গণ্য করা হয় না। কানাডা আমাদের তুলনায় আয়তনে ৭৫গুণ ও অস্টেলিয়া প্রায় ৫৫ গুণ বৃহৎ দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের জনসংখ্যা আড়াই কোটির বেশী নয়। এই সংখ্যা আমাদের এক পঞ্চমাংসের চেয়েও কম। প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ জনশক্তির অভাব এসব দেশে প্রকট। পক্ষান্তরে আমাদের মত দরিদ্র দেশগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় তথা সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান কোনমতেই সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদেরকে এক পা এগুলে তিন পা পিছু হটতে বাধ্য করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে শুধু আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে তা নয়- বরং তা আমাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও পারিবারিক উন্নয়নকেও দারুণভাবে ব্যাহত করছে। জনসংখ্যার এ চাপে স্বল্প সম্পদ বিভক্ত হচ্ছে, কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, ছিন্নমুল মানুষের হার বৃদ্ধি করছে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই জাতিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে। ৫৫৫৫৮ বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটিকে ১৯৪৭ সালে জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি। ২৪ বৎসর পর দ্বিগুণ হয়ে ১৯৭০ সালে সাড়ে সাত কোটিতে উপনীত হয়। ১৯৯১ আদমশুমারী অনুযায়ী ১০ কোটি ৭০ লক্ষ এবং বর্তমানে অর্থাৎ ’৯৭-এ এই জনসংখ্য প্রায় সাড়ে বার কোটি বলে ধারনা করা হয়। আগামী ২০০০ সালের সূচনায় দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটিতে দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.০১%। তবে আশার কথা এই বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করছে। এবং বর্তমানে এই হার হচ্ছে ১.২%। তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার ০ অথবা (-) নেগেটিভ পর্যায়ে নিয়ে আশা অবশ্য প্রয়োজন।

১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতিবর্গমাইলে জনসংখ্যা ঘনত্ব হচ্ছে ১৬১৭ জন। বর্তমানে প্রায় ২০০০ এ উত্তীর্ণ হয়েছে। এই জনসংখ্যার ঘনত্বই হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধিক হার। দেশের আয় রোজগারী জনসংখ্যার ২০ ভাগ শিল্প শ্রমিক, ৪০ ভাগ কৃষি শ্রমিক, অবশিষ্ট ৪০ ভাগ বেকার অথবা অকৃষি শ্রমিক, দিনমজুর ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লক্ষাধিক। এদেশের জনসংখ্যার গড় বয়স ১৭ বছর। দেশের অর্ধেকের বেশী জনসংখ্যা ১৭বছরের নীচে। ৪৬ ভাগেরও বেশী জনসংখ্যার বয়স ১৫ বছরের নীচে রয়েছে। এই বিশাল জনসংখ্যার মাত্র ৩৩.৫০% কে স্বাক্ষর বলে দাবী করা হয়। বাকী ৬৬ ভাগ মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকার রাজ্যের বাসিন্দা। দেশের জনসংখ্যার ১% মানুষ ছিন্নমুল। দেশে শতকরা ৫৪ ভাগের বেশী ঘরবাড়ী বাঁশ খড়ের। ১১ ভাগ ঘর ঢেউটিনের ও মাত্র ২ ভাগ ঘর পাকা। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ ভাগ পরিবার টিউবওয়েলের পানি পান করে।
আমাদের দেশে উচ্চ জন্মহার, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা ও দারিদ্রতা দ্রুত জন্মহার বৃদ্ধিতে অগ্রনী ভূমিকা রাখছে। জীবন ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এদেশে ৯১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি হাজারে বছরে জন্মহার ৪৩.২৫ জন। মৃত্যু প্রতি হাজারে ২৬.৭৫ জন। অর্থাৎ প্রতি হাজারে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০.৪০ জন।
অন্যদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূূত পূর্ব সাফল্যে দ্রুত মৃত্যু হার কমে আসছে। দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচী ও শিশুরোগ সচেতনতা বৃদ্ধি কারণে শিশু মৃত্যুর হারও দ্রুত কমে যাচ্ছে। তাছাড়া, গর্ভকালীন জটিলতায় মা ও শিশুর মৃত্যুর হার আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। যদিও তা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক নীচে রয়েছে। দেশে মানুষের গড় আয়ুও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এককালে কলেরা, গুটিবসন্ত ইত্যাদিকে মানুষ ভয় পেত। গ্রামের পর গ্রাম মড়কে উজাড় হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে মানুষ এসব মহামারীকেও জয় করতে সমর্থ হয়েছে। ম্যালাথাসবাদ অনুসারে, কোন অঞ্চলে খাদ্যের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি হলে মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে জনসংখ্যা কমে আবার স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজকাল জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তা আর কার্য্যকর হচ্ছেনা। ফলে মৃত্যুহারের তুলনায় জন্মহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্র“তিতে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা।
বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হচ্ছে অপরিকল্পিত জনসংখ্যা। অধিক জনসংখ্যার কারণে আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ২৫০ ডলার, যেখানে ধনী দেশগুলোর মাথাপিছু আয় ১০,০০০/= ডলারেরও বেশী। ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ১ ঃ ১২১১৯। হাসপাতালে ৫৪৭৪ জন মানুষের জন্য মাত্র ১টি বেড ও ৫৯৫৬৬ জন ১জন করে নার্স রয়েছেন। অত্যাধিক জনসংখ্যার কারণেই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ হিসাবে গণ্য করা হয়। এদেশের মানুষের জীবনমানও নিম্নতালিকায় রয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের সুযোগ সুবিধা নিম্নে রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার কারণেই কিছুদিন পূর্বে সরকারী ব্যাংক সমূহে ১৮০০ অফিসার পদের জন্য প্রায় আড়াই লক্ষাধিক আবেদন পত্র জমা পড়েছে। এদেশে ১ কোটি শিক্ষিত বেকার সহ প্রায় ২ কোটিরও অধিক বেকার রয়েছেন। ক্রমাগত বেকারত্বে হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ। অন্ধকার ভবিষ্যত তাদেরকে নেশাগ্রস্থ করছে। ক্রমে ক্রমে তারা ধাবিত হচ্ছে ছিনতাই, খুন, চুরি, মস্তানী, চাঁদাবাজীসহ অপরাধের অন্ধকার জগতে। কর্মসংস্থানের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি এদেশের যে শুধু অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে তা নয় বরং এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, আইন-শৃংখলা, যানজট ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে।
আজ বাংাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ‘০’ অথবা (-) নেগেটিভ হারে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজনে কঠিন আইন প্রনয়নও করা উচিত। ১ অথবা ২ সন্তানধারী পরিবার সমূহকে চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকুরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা সম্বলিত কোটা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল অথবা নিম্নহারে নিয়ে আসতে সমর্থ না হই তা হলে জাতি হিসাবে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার ও বিশ্বে এক সম্মানী জাতি হিসেবে মাথাউঁচু করে দাাঁড়ানো অসম্ভব। আসুন ২০০০ সালের মধ্যে আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ‘০’ এর কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য একযোগে কাজ করি ও জাতিকে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন রাজ্যে নিয়ে যাই। 

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ১৯৯৮ইং]
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন