শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

স্বৈরাচার পতন দিবসে ভাবনা

স্বৈরাচার পতন দিবসে ভাবনা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মরণীয় দিনগুলোর একটি। এই দিনটি বিজয়ের দিন, স্বৈরাচারী শাসকের পতনের দিন। ১৯৯০ সালের এই দিনে স্বেচ্ছাচারী, সংবিধান লংঘনকারী, দুর্নীতিবাজ সামরিক শাসক জনতার প্রবল প্রতিরোধের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়। বিজয় ঘোষিত হয় গণতন্ত্রের, গণতন্ত্রমনা মানুষের।
বাংলার মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সাংবিধান ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী অথচ স্বাধীনতার পর থেকেই ক্ষমতালিপ্সু, কায়েমী স্বার্থবাদী দুর্নীতিবাজ কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ ও সামরিক অফিসার বারবার এদেশের ক্ষমতা দখলের জন্য সংবিধান ও আইনকে পদদলিত করেছেÑ বন্ধুকের নল উচু করে, জনতাকে ভয় দেখিয়ে এদেশে তাদের অপশাসন কায়েম করেছে। নির্বাচনের নামে নীল নকশার নির্বাচন দিয়ে জনতার ভোট চুরি করে নিজেদেরকে বৈধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর হত্যা, ক্যু ও রক্তপাতের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাদখল ও সামরিক শাসন জারী ও একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে আরেক সেনাপ্রধান এরশাদ অস্ত্রবলে জননির্বাচিত সরকারকে অপসারিত করে অবৈধভাবে বাংলার মানুষের বুকে চেপে বসে। এসব সেনা প্রধানদের জোরপূর্বক ক্ষমতাদখলের আইনগত কিংবা সাংবিধানিক কোন বৈধতা ছিলনা। কাজেই এটা সুস্পষ্ট যে এসব জেনারেলরা আইন লংঘনকারী, সংবিধান লংঘনকারী। ৭৫-এ যে সামরিক স্বৈরাচার যাত্রাশুরু করে ১৫ বৎসর পর ৯০ এর ৬ ডিসেম্বর জনতার প্রবল প্রতিরোধে তার পতন ঘটে।

ক্ষমতাদখল করেই এরশাদ অনুসরণ করেন স্বৈরাচারী এহিয়া খান, আয়ুব খান, ইসকন্দর মীর্জা প্রমুখ সামরিক পূর্বসূরীদের মত অনির্দিষ্ট কালের জন্য জারী করেন সামরিক শাসন। হরণ করেন পত্র পত্রিকার স্বাধীনতা, বারবার নিষিদ্ধ করেন প্রকাশ্য রাজনীতি। কেউ তার প্রতিবাদ করলেই তাকে জেলে পুরতেন। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষের মুখোমুখী দাঁড় করান। যে সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের প্রতীক, যে সেনাবাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন করেছে, সেই সেনাবাহিনীকে এসব ক্ষমতালিপ্সু জেনারেলরা নিজেদের কায়েমী স্বার্থে রাজনীতিতে নামিয়ে কলুষিত করেন।
গণতন্ত্র হচ্ছে আইনের শাসন, জনগণের রায়প্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। উন্নত বিশ্বের সব কটি দেশ গণতন্ত্রের মাধ্যমে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, এবং এর মাধ্যমে সুন্দর স্থিতিশীল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে সব দেশে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাদখল অকল্পনীয় ব্যাপার। দেশ শাসনের অধিকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। সেনাবাহিনী হচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় যা সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরই একটি। এই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ক্ষমতা দখল নয়। সরকারের কোন মন্ত্রনালয় কর্তৃক ক্ষমতাদখল করে সরকার হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন সূত্রেই বৈধ বলে স্বীকৃত নয়। তা ছাড়া সামরিক শাসন কোন স্থায়ী ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নয়। এক কথায় রাজনীতি সেনাবাহিনীর কোন বিষয় নয়।
জিয়া ও এরশাদ দু’জনই সেনাব্যারাক হতে এলেও দু’জনের মধ্যে যেমন যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তেমন মিলও রয়েছে। সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যাক জুনিয়র অফিসার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলে ৪ নেতা হত্যা, সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা এমনই এক অনুকুল সুযোগে রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়া। আর স্বৈরাচারী এরশাদ আসেন ঠান্ডা মাথায় এক নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে। উভয়েই সেনানিবাসে বসে বিভিন্ন চরিত্রের লোকদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একজনেরটি জাতীয়তাবাদী দল আর অন্যজনের জাতীয় পার্টি। উভয় দলের ১৮ দফা ও ১৯ দফার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। উভয়েই আমাদের মহান সেনাবাহিনীকে বারবার রাজনীতিতে জড়িয়ে বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করেন। উভয়েই ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন।
এরশাদ আমলে এদেশে গণতন্ত্র চর্চা সব চেয়ে বিঘিœত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সামরিক আইন জারী করে ছাত্র ও জনতাকে ধরে নিয়ে সেনাবাহিনী দিয়ে পেটানো, বিরোধীদলকে দমন পীড়ন, অবাধ রাজনীতি বারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা স্বৈরাচারী এরশাদের প্রাত্যহিক কাজ ছিল। অতীত জেনারেলদের মত সুবিধাবাদী, দলছুট লোকদেরে ব্যবহারে এরশাদও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। যখনই তার বিরুদ্ধে বিরোধীদল গুলোর আন্দোলন তুঙ্গে উঠত, তখনই তিনি রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিতেন।
এরশাদ আমলে পত্রিকার স্বাধীনতা ছিলনা। পত্রিকার স্বাধীনতা হরণকারী এরশাদের সেন্সরবোর্ড এরশাদের স্বার্থবিরোধী কিছুই ছাপা হতে দিতনা। অসংখ্য পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ‘যায় যায় দিন’ এর সম্পাদক শফিক রেহমান লন্ডনে চলে গেতে বাধ্য হন।
১৯৮৮ সালে এরশাদ কোন বিরোধীদল ছাড়াই আ.স.ম রবকে নিয়ে নীল নকশার নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় পুতুল সংসদ গঠন করেন। নিজের অবৈধ মসনদকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক ও ফ্যাসিষ্ট এক নায়কদের মত শেষ অস্ত্র হিসাবে ধর্মকে ব্যবহারের জন্য ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এই সংসদের মাধ্যমে পাশ করান। এরশাদ বকধার্মিক সেজে ফতোয়াবাজদের মাধ্যমে ক্ষমতা স্থায়িত্বের প্রচেষ্টা চালান। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দুর্নীতির সাগরে হাবুডুবু খান। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, পত্রিকার স্বাধীনতা, অবাধ রাজনীতির স্বাধীনতা তথা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জন্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে। এই অভ্যুত্মানে অংশ নেয় ছাত্র, সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমিক সহ শিল্প সাংস্কৃতিক সাথে জড়িত সর্বস্তরের মানুষ। ক্ষমতাচ্যুত হয় স্বৈরাচারী এরশাদ। পতন ঘটে সামরিক স্বৈরাচারের। বিজয় হয় জনতার।
১৯৯৬ সালে আরেক আন্দোলনের মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি। ৯০ এর ৬ ডিসেম্বর হতে শুরু হয়েছে গণতন্ত্রের পুর্নযাত্রা। স্বাধীনতার পর এটিই হচ্ছে এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অগ্রগতি। তারপরও থেকে গেছে জিজ্ঞসা-শহীদ নূর হুসেন, ডাঃ মিলন সহ এত আত্মত্যাগের পরও আজও কেন এদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়নি? আজও কেন স্বপ্নের সেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি? এত আত্মত্যাগের পরও কেন আমরা আজ এক বিকৃত গণতন্ত্র দেখতে পাচ্ছি? আমরা বাংলাদেশের গরীব দু:খী মেহনতি মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্র পাচ্ছিনা, পাচ্ছি গণতন্ত্রের এক বিকৃত রূপ। এজন্য দায়ী এদেশের হটকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকারী ও বিরোধীদলের নেতিবাচক ও অসিহষ্ণু রাজনীতি চর্চা, বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা, ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং নীল সাংবাদিকতার অপদংশন তথা হিংসা-বিদ্বেষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টিতে উস্কানী দান ইত্যাদি।
আর যেন কোন স্বৈরাচারী শক্তি বাঙ্গালীর কাঁধে অবৈধভাবে চেপে না বসে, আর যেন কোন সামরিক জান্তার অভ্যুদয় এদেশে না হয়, গণতন্ত্র যেন এদেশে প্রাতিস্ঠানিক রূপ লাভ করে ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে গতিশীলতা দান করে, সরকারের প্রতিষ্ঠা কিংবা পতন যেন জনরায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। স্বৈরাচার পতন দিবসে এই-ই আমাদের কামনা।

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ইং]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন