শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ

পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

পর্যটন বর্তমান বিশ্বের একটি প্রধান ও দ্রুত বিকাশমান শিল্প। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে, যাদের আয়ের প্রধান অথবা অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে পর্যটন। আমাদের সার্কভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে নেপাল ও মালদ্বীপের আয়ের সর্বপ্রধান উৎস হচ্ছে পর্যটন। ভারত, শ্রীলঙ্কা সহ সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ পর্যটনের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছনে পড়ে আছে। শিল্প হিসাবে পর্যটন এখনও বাংলাদেশে তেমন বিকশিত হতে পারেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। মানুষ আজ আর কোন এক অঞ্চলে বন্দি হয়ে থাকতে রাজী নয়। ভ্রমন আজ মানুষের এক অদম্য নেশা। পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো আজ মানুষের এক প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ আজ ঘুরে ঘুরে দেখতে চায় বৈচিত্র ভরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। দেখতে চায় বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও ঐতিহাসিক স্থান সমূহকে ভোগ করতে চায় নতুন নতুন দেশের আবহাওয়া, ঋতুচক্র ও বসন্তকে। উন্নত বিশ্বের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২,০০০ ডলারের বেশী, যেখানে আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ২৫০ ডলার। কাজেই উন্নত দেশগুলোর মানুষেরা তাদের আয়ের সামান্য সঞ্চয় থেকে প্রতি বৎসর অনায়াসে ঘুরে আসতে পারে নতুন কোন দেশ। তাই তারা প্রতি বৎসর ছুটি কাটাতে যায় দূর কোন অজানা দেশ মন্থনে। হিমালয় কন্যা নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চেয়ে তেমন ভাল না হলেও দেশটিকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে সেদেশের সরকার ও জনগণ। তাইতো বছরের সব সময় হাজার হাজার বিদেশী পর্যটকের ভীড় জমে থাকে নেপালের সর্বত্র। মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দ্বীপময় দেশটির বেলাভূমিও সবসময় মুখরিত থাকে বিদেশী পর্যটকদের পদচারনায়। অথচ মালদ্বীপের মত অসংখ্য সুন্দর দ্বীপাঞ্চল (যেমন-সেন্টমার্টিন) আমাদেরও দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে।

একটি দেশকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় করে তুলতে হলে নিম্নলিখিত উপাদান সমূহ অবশ্যই প্রয়োজন। যথাঃ (১) সমুদ্র সৈকত (২) উজ্জ্বল আবহাওয়া ও সূর্য কিরণ (৩) সুরম্য বনাঞ্চল (৪) ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান (৫) পাহাড় ঘেরা হৃদ (৬) জলপ্রপাত (৭) নয়ন ভুলানো পাহাড়ি দৃশ্য (৮) নদনদী দৃশ্যাবলী, (৯) মানুষের জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতি। এগুলোর পরও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা। যেদেশে মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নেই। ধর্মঘট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান, এমন সব দেশে পর্যটকরা আসতে একদম উৎসাহী হয়না। আর প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মানুষের থাকা খাওয়ার উন্নত সুব্যবস্থা। আমাদের বাংলাদেশে পর্যটকগণকে আকর্ষণ করার মত উপরের প্রায় সবক’টি উপাদান রয়েছে। এদেশে রয়েছে সুন্দরবনের মত সুরম্য নদী মেঘলা বনাঞ্চল, অভয়ারণ্য, কাপ্তাই ও ফয়েজ লেকের মত পাহাড় ঘেরা হৃদ, মাধবকুন্ডের জলপ্রপাত, কেওকেরাডাঙ্গের মত সুউচ্চ পাহাড় চুড়ো, জাফলংয়ের পাহাড় নদীর মিতালী দৃশ্য, বৌদ্ধযুগের বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, (যা ২০০০ বৎসরের পুরাতন) বৌদ্ধযুগের আরও নিদর্শন পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, বৈচিত্রময় উপজাতি সমাজ ও তাদের সংস্কৃতি সিলেটের শ্যামল চা বাগান, শ্রী কৃষ্ণের জন্মস্থান (হিন্দুদের পবিত্র স্থান)। তাছাড়া মহান দরবেশ হযরত শাহজালালের (রঃ) দরগা শরীফ। যে দরবেশের সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তাছাড়া এই বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের সর্বদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। তাছাড়া নদনদীর দৃশ্য ও সবুজের মনমাতানো সমারোহতো রয়েছেই। এত কিছুর পরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও পর্যটন কর্পোরেশনের দক্ষতার অভাবে এদেশে পর্যটন তেমন উন্নত আয়ের উৎসে পরিণত হতে পারছে না। শ্রীলঙ্কার আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের চেয়ে অধিক ভাল নয়, অথচ সে দেশে আমাদের চেয়ে বহুগুন বেশী পর্যটকের আগমন ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের ২৬ বৎসর অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। অথচ অন্ততঃ প্রতিবেশী দেশগুলোর মত বিন্যস্ত করে আমরা পর্যটন শিল্পকে গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য যে সব বিদেশীর আগমন ঘটে তাদেরকেও পর্যটক হিসাবে ধরে পর্যটকের সংখ্যা ও এই শিল্পের আয় বাড়িয়ে দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষ বাংলাদেশে পর্যটকের আগমন সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। পর্যটন যে একটি দেশের শুধু আয়ের উৎস তাই নয় বরং তাহা দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, সৌন্দর্য্য বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলে। পর্যটনের মাধ্যমে মানুষের মন-মানসিকতা উদার হয়। মানুষ আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতি বিদ্বেষ ইত্যাদির দুষ্টচক্র হতে বের হয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মানবতাবাদের দিকে অগ্রসর হয়। কাজেই পর্যটন শিল্পকে অবশ্যই গুরুত্ব প্রদান প্রয়োজন। বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের বিকাশের প্রতিবন্ধক ও এগুলোর প্রতিকার কিভাবে করা যায় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
আমাদের পর্যটন শিল্পের প্রধান অঞ্চল সমূহ হচ্ছেÑ ঢাকা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন ও দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি অঞ্চল শান্তিবাহিনী নামধারী দুর্বত্তদের সন্ত্রাসে জর্জরিত। এই অঞ্চল সমূহকে এই দুর্বৃত্তগণের হাত হতে পুরোপুরী মুক্ত করে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও উপজাতীয় সংস্কৃতির উন্নতি সাধন করতে হবে। নেপালের মত গড়ে তুলতে হবে সুউচ্চ সুরম্য শৈলাবাস। ১১৫ বর্গমাইলের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। মালদ্বীপের চেয়েও সুরম্য ও বৃহদাকার অনেক দ্বীপাঞ্চল আমাদেরও রয়েছে। এই ধরণের কিছু দ্বীপাঞ্চলকে মালদ্বীপের মত করে সাজাতে হবে যাতে ঐ অঞ্চল বিশ্বের পর্যটকগণের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এদেশে বিরামহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে আসছে। হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদি কারণে বার বার এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তো। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেত। কাজেই বহিবিশ্বে এই দেশের পরিচিতি হয়ে আছে-রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দারিদ্রতা ও অপরিকল্পিত জনসংখ্যার দেশ হিসাবে। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোতে বারবার প্রচারিত হয়েছে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগগ্রস্থ মানুষ সরকারী খয়রাত গ্রহণের চিত্র রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামার চিত্র, বস্তিবাসী মানুষের দুরাবস্থার চিত্র।
বাংলাদেশ পর্যটন কার্পোরেশনে আরো দক্ষ ও উদ্যমী লোক নিয়োগ করতে হবে। পর্যটন খাতে ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহী করতে হবে। কারণ বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তি উদ্যোগ ব্যতিত কোন শিল্প ও বাণিজ্যই বিকশিত হচ্ছে না। পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায়, ব্যক্তিমালিকানায় অথবা কর্পোরেশনের সাথে শেয়ার মালিকানার ভিত্তিতে দেশে মোটেল, শৈলাবাস, সৈকতে পিকনিক স্পট, নৌবিহার জাহাজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিদেশী বিনিয়োগকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, বৃটেন, নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর সহ যেসব দেশ পর্যটন খাত থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করছে, সেসব দেশের পর্যটন কর্পোরেশনের সাথে আমাদের পর্যটন কর্পোরেশনের সমন্বয় সাধন করতে হবে ও আমাদের কর্মকর্তাদের এসব দেশে ভিজিট ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দক্ষতা বাড়াতে হবে। এভাবে একসময় ক্রমান্বয়ে পর্যটনও বাংলাদেশ তৈরী পোশাকের মত এক স্থায়ী লাভজনক শিল্পে পরিণত হবে।

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, বুধবার, ২১ মে, ১৯৯৭ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন