শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানব হজরত মুহাম্মদ (সঃ)

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানব হজরত মোহাম্মদ (সঃ)
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময় মহানবি হজরত মোহাম্মদ(সঃ)। যার জীবনের মাত্র ২৩ বৎসরের সাধনার বিনিময়ে পাল্টে যায় ইতিহাসের ধারা। বর্বর গোত্রশাসিত আরব জাতি তারই নেতৃত্বে এক শ্রেষ্ঠ সুশৃংখল সভ্য জাতিতে পরিণত হয় এবং মাত্র ১০০ বৎসরের মধ্যে এই জাতি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের এক বিরাট অঞ্চল জয় করে সুবিশাল ইসলামি সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠা করে। এমনকি বর্তমান কালেও বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে তার মর্যাদা ও সম্মান প্রথম সারিতে প্রথম রয়েছে। বিশ্বের প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন হচ্ছেন এই মহামানবের অনুসারী। ১৩০ কোটি মুসলমান প্রতিদিন ৫ বার নামাজে তার প্রতি দরূদ জ্ঞাপন করছেন। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মসজিদে মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে ‘মোহাম্মদ রাসুলউল্লাহ” শব্দটি। বিগত চৌদ্দশত বৎসর ধরে এই গ্রহটিতে আর কোন মানব সন্তান এত স্মরণীয় কিংবা বরণীয় হতে পারেননি বিশ্বের মানুষের কাছে। তাইতো আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও পন্ডিত ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম হার্ট তার বিখ্যাত The hundreds বইটিতে যে ১০০ ইতিহাস শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানের জীবনী আলোচনা করেছেন, তন্মধ্যে ইসলামের নবি হজরত মোহাম্মদকে (সঃ) সর্বপ্রথম স্থান দিয়েছেন। তিনি তাঁর পুস্তক রচনায় মানবসভ্যতার বিকাশে ও উন্নয়নে সারাবিশ্বে যে ১০০ জন মানবশ্রেষ্ঠ সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন, তাদেরকে তাদের অবদান অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে স্থান দেন। একজন খ্রিষ্টান লেখক হওয়া সত্ত্বেও তিনি সত্যকে অস্বীকার করেননি। যা সত্য, অর্থাৎ মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে মহামানবের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁকেই তিনি তার পুস্তকের প্রথমেই স্থান দান করেন।
মোহাম্মদ(সঃ) আল্লাহরই নবি এবং ইসলাম আল্লারই মনোনীত ধর্ম। এই ধর্ম মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সঃ) মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ঠিক মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো আরব উপদ্বীপ এবং এই আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পবিত্র নগরী মক্কা। এই মক্কানগরীর সুবিখ্যাত কুরাইশ বংশে ৫৭০খ্রিস্টাব্দে ২০শে এপ্রিল, মোতাবেক ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার প্রত্যুষে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মোহাম্মদ(সঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
আরবের অধিবাসীগণ সে সময় বহু গোত্রে বিভক্ত ছিল। তন্মধ্যে কুরাইশ বংশই ছিল সর্বাপেক্ষা অধিক গণ্যমান্য। পবিত্র কাবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কুরাইশ বংশীয় লোকদের হাতে ন্যস্ত ছিল। এককালে হজরত ইব্রাহিম(আঃ) মক্কানগরী ও কাবাগৃহ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু কালক্রমে আরবের অধিবাসীগণ নিরাকার এক আল্লাহর এবাদত ভুলে যেয়ে দেবদেবীর, মূর্তিপূজা আরম্ভ করে। হজরত মোহাম্মদের(সঃ) আর্বিভাব কাল পর্যন্ত পবিত্র কাবাগৃহে মোট ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। এই ছিল আরবদের ধর্মীয় দিক। তখন সারা আরবের মানুষ হজ্জ করতে এসে এই ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি পূজা করত।
হজরত মুহাম্মদের(সঃ) পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ও পিতামহ ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল মুত্তালিবের পিতার নাম ছিল হাশেম। হাশেমের মৃত্যুর পর আব্দুল মুত্তালিবই ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকুরাইশ বংশীয় যাবতীয় গোত্রের মধ্যে বনি হাশেম গোত্রই ছিল তৎকালে শিক্ষা-দীক্ষায়, ধন-দৌলত ও মান-সম্মানে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই বনি হাসেম গোত্রেই জন্মগ্রহণ করলেন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা(সঃ)।
মুহাম্মদের(সঃ) নবুয়ত লাভ এবং ইসলাম প্রচার ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ও চিত্তাকর্ষক ঘটনা। ইতিহাস সচেতন মানুষের কাছে সর্বকালে এই ঘটনাটি একটি আলৌকিক ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসাবে পঠিত হয়ে আসছে। মাত্র ২৫ বৎসর বয়সে হজরত মোহাম্মদ(সঃ) মক্কার ধনাঢ্য মহিলা খোদেজাকে(র:) বিয়ে করেন। তিনি খোদেজার বিশাল সম্পদ মক্কার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিলাতে থাকেন ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন হতে মুক্ত হয়ে হেরা পর্বতের গোহায় গভীর ভাবে ধ্যান নিমগ্ন হন। খোদেজার(রঃ) দাসী প্রতিদিন এই নির্জন গোহায় মুহাম্মদকে(সঃ) খাদ্য পৌঁছে দিত।
হজরতের(সঃ) বয়স যখন ঠিক চল্লিশ বৎসর পূর্ণ হলো, তখনই স্বর্গীয় দূত জিবরাইল(আঃ) আসলেন মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে ‘ইকরা বিস্মি রাব্বিকাল লাজি খালাক, খালাকাল ইনসানা মিন আলাক।’ হজরত খোদেজাকে ঘটনাটি অবহিত করেন। সাথে সাথে মহিলাগণের মধ্যে সর্বপ্রথমই তিনি ইসলামে দীক্ষিত হন। হজরত মক্কাবাসীকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তুু বেশির ভাগ গোত্রই নিজেদের প্রাচীন ধর্ম ও নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে মোহাম্মদের(সঃ) বিরুদ্ধে তীব্র শত্র“তা শুরু করেন। মোহাম্মদ(সঃ) ও তার অনুসারীগণের প্রতি মক্কায় ভীষণ অত্যাচার শুরু হয়। বৃদ্ধ ইয়াসির(রাঃ) মহিয়সী মহিলা হজরত সুমাইয়া কোরেশ দলপতি জেহেলের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। হজরত বেলাল(রাঃ), হজরত ইকরামা(রাঃ) প্রমুখের প্রতি কোরেশদের অত্যাচারের কাহিনি পাঠ করলে এখনও মানুষের গা শিউরে ওঠে। হজরতের(সঃ) গোত্র ও তাঁর অনুসারীগণকে মক্কায় অন্তরীণ করা হয়। কোরেশদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হজরত(সঃ) তায়েফ যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানে টিকতে না পেরে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। তারপর তার অত্যাচারিত অনুসারীগণকে আবুসিনিয়া ও ইয়াসরিব হিজরত করতে পাঠান। ইয়াসরিব নগরী হজরতকে(সঃ) আশ্রয় দানের নিশ্চয়তা প্রদান করায় তিনি তার শিষ্যগণকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে সবশেষে নিজে গমন করেন। তার আগমনের পর নগরটির নাম হয় মদীনাতুন্নবি বা নবির শহর।
মদীনায়ও ইসলামের শত্র“রা হজরতকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। পরবর্তী বৎসর আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্যের এক কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য মদিনার দিকে অগ্রসর হয়। হজরত(সঃ) বদর নামক স্থানে তাদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন এবং তাদের প্রধান প্রধান দলপতিরা নিহত হয়। বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্য সহ আবার মদীনা আক্রমণে অগ্রসর হয়। মদীনার ৩ মাইল দূরে অহুদ প্রান্তরে হজরত মাত্র ৭০০ সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের মোকাবেলা করেন। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পরও শেষ পর্যন্ত মুসলমানরাই জয়ী হন। এভাবে মদীনার চারপাশে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) নেতৃত্ব প্রসারিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মক্কার কুরাইশরা যখন দেখতে পেল মুহাম্মদ(সঃ) মদীনায় এক অপ্রতিহত শক্তিতে পরিণত হচ্ছেন তখন তারা তাকে প্রতিহত ও উৎখাত করার জন্য এক ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা আরবের ইহুদি ও বেদুইনদের সাথে সম্মিলিতভাবে ১০০০০ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সহ মদীনা আক্রমণ করে। হজরত মদীনার সমতল দিকে বিরাট পরিখা খনন করেন। শত্র“রা পরিখা অতিক্রম করে মদীনা আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে মদীনা অবরোধ করে রাখে। এক মাস পর এক ভীষণ মরু ঝড়ে কুরাইশদের তাবু ও সাজ সরঞ্জাম লন্ডভন্ড হয়ে গেলে তারা অবরোধ উঠিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর আরব উপদ্বীপে খুব দ্রুত গতিতে ইসলাম প্রসার লাভ করে। আরবের বিভিন্ন গোত্র হজরতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির আড়ালে ইসলাম আরবের সর্বত্র প্রসার লাভ করে। কুরায়শগণ কর্তৃক হুদাইবিয়ার সন্ধি লংঘিত হলে হজরত (সঃ) মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পরবর্তী বৎসর ১০০০০ মুসলমান সহ হজরত বীরের বেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করেন। হজরত মক্কায় তার শত্র“দেরকে ক্ষমা করে দেন। মক্কার মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর প্রতি খোদার দেওয়া দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন।
হজরত (সঃ) তাঁর জীবনের শেষ হজ্জ্ব অর্থাৎ বিদায় হজ্জ্বে লক্ষাধিক মুসলমানের সম্মুখে তার সর্বশেষ উপদেশ মূলক ভাষণ দান করেন। ইতিমধ্যে আয়াত নাজেল হল “যখন আল্লাহর সাহায্য আর বিজয় আসবে এবং যখন তুমি দলে দলে লোককে দেখবে আল্লাহর ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণ করতে, তখন আল্লাহর গুণ-গান করে ক্ষমা চেয়ো। কারণ তিনি ক্ষমাশীল” আল ক্বোরআন।
হজরতের (সঃ) বুঝতে বাকী রইলো না-তিনি আর বেশি দিন এ ধরায় থাকবেন না। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে প্রত্যুষে এই মহামানব ইন্তেকাল করেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম এই মহামানবকে পবিত্র মদীনা নগরীতে সমাহিত করা হয়। মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর মাত্র ৬৩ বৎসরের স্বল্প পরিসর জীবনে বিশ্বের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন এবং মানুষকে সত্য ন্যায় ও খোদার মনোনীত পথে পরিচালনার দিক নির্দেশনা দিয়ে যান। বিশ্বের মানুষ ও সভ্যতার কাছে তাঁর দান অবর্ণনীয়। আমরা এই মহামানবের প্রতি হৃদয়ভরা ভক্তি শ্রদ্ধা এবং হাজার দুরুদ ও সালাম পেশ করছি।
কবি শেখ সাদীর ভাষায় শ্রদ্ধা জানাচ্ছ 'বালাগাল উলা বি কামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বিজামালিহী। হাসানাত জামিয়্যূ ফিসালিহী, সল্লিআলাইহী ওআলিহী'।

ছবিঃ মহান আল্লাহের নবি হজরত মোহাম্মদের(সঃ) রওজা মোবারক

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, রবিবার, ২০ জুলাই, ১৯৯৭ইং]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন