শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

অর্থ ও বাণিজ্য সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশ

অর্থ ও বাণিজ্য সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশ
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান খাত ছিল পাট, চা ও চামড়া। পাকিস্তানী আমল হতে শুরু করে ১৯৮০ সন পর্যন্ত এই তিনটি কৃষিখাতই বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখত। কিন্তু নাইলন, পলিথিন ইত্যাদি বিকল্প বের হবার কারণে ও ভারতীয় পাটের সাথে প্রতিযোগিতায় কোনঠাসা হয়ে পড়ে আমাদের পার্ট শিল্প উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন এগুতে পারেনি। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের মুখে চা শিল্পের অবস্থা তেমনটি রমরমা নয়। দেশে কিছু কিছু লেদার ও সু ইন্ডাষ্টি গড়ে উঠলেও তা দেশ বিদেশের মার্কেট দখল করতে তেমন সমর্থ হয়নি।
১৯৭৬ সালের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানী শুরু হয়। পরবর্তীতে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানী দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক বিশেষ খাতে পরিণত হয়। একই সাথে দেশের বেকারত্বেরও যথেষ্ট সমাধান হয়। বর্তমানে আমেরিকা, বৃটেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ষাট লক্ষ বাঙ্গালী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। বিশ্বের বাণিজ্যেক রাজধানী লন্ডনে প্রায় ১ লক্ষ সিলেটি বাঙ্গালী ও জাতিসংঘের রাজধানী নিউইয়র্কে প্রায় ষাট হাজারের মত বাঙ্গালী বসবাস করছেন। তারা প্রতি বৎসর দেশে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা পাঠাচ্ছেন- যা বাংলাদেশের অর্থনীততে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমের বাজার পড়ে যাওয়ায় বর্তমানে আগের মত মধ্যপ্রাচ্য হতে রিমিটেন্স আসছেনা। বর্তমানে লন্ডনে বাংলা টাউন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিউইয়র্কেও বাঙ্গালীরা সংঘটিত হয়ে বাংলা টাউন গঠন করতে যাচেছ। কাজেই জনবহুল এই দেশে জনশক্তি রপ্তানী একটি উল্লেখযোগ্য খাত। এ খাত থেকে গরীব এই দেশের অর্থনীতি উপকৃত হতে পারে। প্রবাসী বাঙ্গালীদের অর্থ সুষ্ঠু বিনিয়োগের জন্য দেশে সরকারকে যথাযথ সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটিতে নানা অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে। অবৈধভাবে জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর কারণে মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে জনশক্তি রপ্তানীর নতুন নতুন দেশ অনুসন্ধান ও এই খাতকে আরও গতিশীল করণে সরকারের মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙ্গালীদের সংগঠিত করে এইসব দেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরসমূহে বাঙ্গালী সমাজ প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সহায়তা প্রদান প্রয়োজন। অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার কারণে সরকার কোটি কোটি টাকার আয়কর ও বৈদেশিক মুদ্রা হতে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত হচ্ছে তৈরী পোষাক। ১৯৮০ সালের পর পোষাক শিল্প দেশে দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠে। বর্তমানে দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের মত গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রী রয়েছে। এই শিল্পে প্রায় ১০/১২ লক্ষ লোক নিয়োজিত রয়েছেন। এই শিল্পের মাধ্যমে দেশের অসংখ্য মানুষ কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন এবং অসংখ্য অসহায় নর-নারী পাতে অন্ন যোগাচ্ছেন। গত বৎসর এই ব্যবসার টার্নওভার ছিল প্রায় ২৬০০ কোটি টাকা এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশে আরও কয়েকটি শিল্প যেমন টেক্সটাইল, এমব্রয়ডায়ী, রঞ্জক শিল্প ইত্যাদিও বিকশিত হবার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পোষাক শিল্প বাংলাদেশে সহজেই এই অবস্থায় এসে উপনীত হয়নি বরং এই শিল্প অতীতে বহু চরাই-উৎরাই পার হয়ে এ পর্যায়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। আমেরিকার কোটা প্রয়োগ, ধর্মঘট-হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতা অতীতে বহুবার এই শিল্পকে হুমকির মুখোমুখী করেছে। বর্তমানে ইউরোপীয়ান কমন মার্কেটের সাথে বি.জে.ই নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। ই.সি কর্তৃক নির্ধারিত শতাব্দির লক্ষমাত্রার ব্যাপারে তৈরী পোষাক ব্যবসায়ী ও সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। নতুবা ইউরোপের মত বিরাট বাজার হারালে এই শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে। তাছাড়া বিশ্বের আরও বাজার দখলের জন্য আমাদের সরকার ও ব্যবসায়ীগণের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
তৈরী পোষাকের পর আমাদের পরবর্তী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে হিমায়িত চিংড়ি। ১৯৯৬-৯৭ অর্থ বছরে এই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ ছিল ১৬০০ কোটি টাকা। দেশের বার্ষিক মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ১০ ভাগ হিমায়িত চিংড়ি থেকে অর্জিত হয়। দিন দিন এই ব্যবসার যখন উন্নতি হচ্ছিল এমনই এক মুহুর্তে সরকারী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে প্রচন্ড ক্ষতির মুখোমুখি হলো ব্যবসাটি। ইউরোপের বাজার আমাদের হাতছাড়া হলো। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাপান ও আমেরিকায়। হয়তো এভাবে মৃত্যুবরণ করবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের মোট ১২২টি হিমায়িত খাদ্য ফেক্টরী রয়েছে। তন্মধ্যে ২৫/৩০টি ফ্যাক্টরীর মান ভাল। অন্যগুলোর পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। তাদের পরিবেশিত চিংড়ি মান স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তবে বিগত তিন বৎসর ধরে ই.সি এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সর্তক করে আসছিল। রপ্তানীকারক ও সরকার পূর্ব থেকে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করলে এই ব্যবসা এভাবে হঠাৎ ধ্বংসের মুখোমুখী হতনা। তবে এখনও সময় একেবারে হাতছাড়া হয়ে যায়নি। দ্রুত ফ্যাক্টরীগুলোর মান উন্নত করে ই.সির সাথে আলোচনায় বসে এর একটা সমাধান প্রয়োজননতুবা চিংড়ির এই বাজার অন্যদের দখলে চলে যাবে। একবার বাজার হারালে তা পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বৎসর দেশে পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ কৃষকরা পাট বিক্রি করতে পারছেন না। পাট ও পাটজাতদ্রব্য বিদেশে রপ্তানীর ব্যবস্থা না করলে বাম্পার ফলনে কোন লাভ হবে না। পলিথিন, নাইলন ইত্যাদি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় বিভিন্ন দেশ এই সব সামগ্রী উৎপাদন কমানো ও নিষিদ্ধ করনের        চিন্তাভাবনা করছে। এ ব্যাপারে আমাদের সর্তক থাকতে হবে এবং এই সব দেশের বাজারে আমাদের পাটকে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
গত অর্থবছরে ৭০.২৫ মিঃ ডলার মুল্যের ক্রাস্ট ও ফিনিসড চামড়া বিদেশে রপ্তানী করা হয়। কিন্তু এই বৎসর কোরবানী ঈদে ট্যানারী ব্যবসায়ীগণ ব্যাংক ঋণ লাভে ব্যর্থ হওয়ায় তারা চামড়া কিনেনি। ফলে অত্যন্ত সস্তা দরে ২/৩ শত কোটি টাকার চামড়া সীমান্তের ওপারে চলে যায়। ফলে এ বৎসর চামড়া রপ্তানীবাবদ তেমন বৈদেশিক মুদ্রা আসবে না। বাংলাদেশে চামড়া শিল্প গড়ে উঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদেশের এক্সিলিয়র ও এপেক্স স্যু ইন্ডাষ্টি গত বৎসর বিদেশে ২ কোটি জোড়া স্যু’র অর্ডার লাভ করে। কাঁচা চামড়া বিক্রি না করে চামড়াজাত পণ্য শিল্প দেশে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
১৯৯৬-৯৭ সালে নীট ওয়ার সামগ্রীর মোট রপ্তানী ছিল ২৪৩.৯৬ মার্কিন ডলার। এই খাতে ব্যবসা আশাতীত সাফল্য অর্জন করছে। গত বৎসর প্রায় ৫০ কোটি টাকার ঔষধ বিদেশে রপ্তানী করা হয়। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ঔষধ শিল্পও বিদেশে বিরাট বাজার দখল করতে পারবে বলে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের সঠিক দিক নির্দেশনা থাকত, তবে দেশ অনেক এগিয়ে যেতে সক্ষম হত। এদেশের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের যথেষ্ট দায়িত্বহীনতা রয়েছে। তাদের কাছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য লাভ করে আসছে। দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতি তাদের কাছে যেন তুচ্ছ বিষয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা প্রতিকূলতা ও সংকট সৃষ্টি হয়-এগুলো সমাধানের দায়িত্ব সরকার, ব্যবসায়ী মহল ও দেশের বিরোধী দলগুলোরও। কিন্তু সংকটক্ষনে সমাধানের দিকে এগিয়ে না গিয়ে একে অন্যকে দশহাত দেখিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বিরোধের মধ্যে ঐক্য, শতমতের মধ্যে ঐক্যমত হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা জাতীয় স্বার্থে, জাতীয় ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারছি কই। আসুন দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।


[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ইং]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন