আমাদের জাতীয় কবি নজরুল
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ইং। এই দিনটিতে আমাদের প্রিয় বিদ্রোহী কবি কাজী
নজরুল ইসলাম বাঙ্গালী জাতিকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। এই দিনটি তার
পবিত্র আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করে তার মহান জীবন ও সাধনা সম্পর্কে
খানিকটা আলোকপাত করবো। ১৯৮১ সনে এস.এস.সি টেস্ট পরীক্ষায় ‘তোমার প্রিয় কবি’ রচনায়
আমি আমার এই প্রিয় কবিকে সেই কিশোর মনের রঙ্গীন মাধুরী দিয়ে এঁকে ছিলাম। আজ তার
অন্তর্ধান দিবসে তার প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানিয়ে এই রচনা লিখতে আমি অনুপ্রাণিত হই।
চুরুলিয়া,
বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলায় এক
অখ্যাত পল্লীগ্রাম। এই অখ্যাত পল্লীতেই দুই বাংলার জনপ্রিয় বিদ্রোহী কবি নজরুল
ইসলাম ১৮৯৯ সনের ২৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। চুরুলিয়ার কাজী বংশ ইসলামী শিক্ষা ও
সংস্কৃতির জন্য ঐ অঞ্চলে বিখ্যাত ছিল। এই বংশে কাজী ফকির আহমদের ঔরষে কবির জন্ম
হয়। কবির বাল্যকালে অবস্থা সচ্ছল ছিলনা। তিনি শৈশবে গ্রামের মক্তবে বিদ্যাশিক্ষা
করতেন। এই মক্তবে তিনি বাংলা ভাষা ও আরবী শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র দশ বৎসর বয়সে
তিনি লেটো গানের দলে যোগদান করেন। বর্ধমানের লেটোগান আমাদের কবি গানের অনুরূপ। কবি
লেটোগানে যোগ দিয়ে প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করলেও সংসারে অভাব দূর করতে সক্ষম হননি।
অভাবের তাড়নায় আসানসোলের একটি রুটির দোকানে মাসিক ছয় টাকা বেতনে কাজ নেন। এই
পরিবেশে থেকেও কবি যেটুকু সময় পেতেন তা পুঁথি পুস্তক ও পত্রিকা পড়ে কাটাতেন।
আসানসোলে থাকাবস্থায় ময়মনসিংহের ত্রিশালের জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর নজরুলের প্রতিভার
প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে তিনি তাকে স্বগ্রামে নিয়ে এসে ত্রিশাল হাইস্কুলে ভর্তি
করে দেন। ত্রিশালে এসে কবি দুষ্ট ছেলের সাথে মিলে মিশে তামাক সেবন, মাছ ধরা ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়েন। লেখাপড়া তেমন হয়নি। তিন বৎসর পর
নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করলে আত্মীয়-স্বজন তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন।
১৯১৬ সালে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে কবি বৃটিশ সেনাবাহিনীর
বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করে প্রথম মহা সমরে অংশগ্রহণ করেন এবং সাধারণ সৈনিক হতে
হাবিলদার নায়ক পদে উন্নীত হন। ভারতের বাইরের কিছু স্বাধীন দেশে অবস্থান করে কবি
স্বাধীনতার স্বাধ পান এবং পরাধীন ভারত ভূমিকে স্বাধীন করার স্বপ্নে কবিতা ও
সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তার লেখায় বেজে উঠল শিকল ভাঙ্গার গান, বিদ্রোহের গান। এই বিদ্রোহ পরাধীনতার বিরুদ্ধে, পশ্চিমা সাম্রাজ্য বাদের বিরুদ্ধে ও সংকীর্ণ সম্প্রদায়িকতার
বিরুদ্ধে।
১৯১৯ সন। কবি ফিরে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি
‘ধুমকেতু’ নামে এক পত্রিকা বের করেন। ধুমকেতুতে রাজবিদ্রোহের গন্ধ পেয়ে ইংরেজ
সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় ও কবিকে সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করে। কারাগারে বসে
কবি বিদ্রোহ সৃষ্টিতে আত্মনিমগ্ন হলেন। ইতিপূর্বে কবির ‘অগ্নিবীনা’ ও ঝিঙ্গেফুল’
নামে দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অগ্নিবীনার দাহন সুরে বাঙ্গালীরা
প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। জেলে বসে কবি ‘ভাঙ্গার গান’ ও ‘বিষের বাঁশী’ নামে দু’টি
কাব্যগ্রন্থ লিখেন। কিন্তু ইংরেজরা তা বাজেয়াপ্ত করে দেয়। গণ স্বাধীনতার
দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এই সময়কার তার স্মরণীয়
কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘জিঞ্জীর’ ‘বুলবুল’ ‘ছায়ানট’ ইত্যাদি।
যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে আত্মজীবনী ও রোমাঞ্চকর
কাহিনী সমন্বয়ে তিনি ‘বাধনহারা’ ও ‘ব্যথার দান’ নামক দু’টি পত্র উপন্যাস রচনা করে
নতুন এক গদ্যধারা সৃষ্টি করেন। এসময়ে কবির ‘আলেয়া’ ও ‘ঝিলমিল’ রূপক নাটকও প্রকাশিত
হয়। ছোট গল্পেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।
একমাত্র সঙ্গীতই কবি নজরুলকে অমর করে রাখতে যথেষ্ট। তিনি প্রায়
তিন হাজার সঙ্গীত রচনা করেন ও নিজেই সুরারোপ করেন। নজরুলের সঙ্গীতে প্রাচীন ভারতের
ক্লাসিকেল সূর ও দক্ষিনাত্যের অনেক বিলুপ্ত সূর আবার সজীব হয়ে উঠে। নজরুল সঙ্গীতের
যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।
কবির জীবন ছিল ভবঘুরে ও ছন্নছাড়া। ভবিষ্যত জীবন ও স্বাস্থ্য
সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদাসীন। তিনি সাংসারিক ছিলেন না। শেষ বয়সে তিনি তীব্র
অর্থকষ্টে নিপতিত হন। এমতাবস্থায় হঠাৎ দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে বাক ও
চেতনাশক্তি হারিয়ে শর্য্যাশায়ী হন। পশ্চিম বঙ্গ সরকার কবিকে মাসিক অর্থ সাহায্য
বরাদ্ধ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু সরকার কবিকে ঢাকায়
নিয়ে এসে কবির চিকিৎসা সহ যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বেশ কয়েক বৎসর কবি
শয্যাশায়ী ছিলেন ও ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকাতেন। কবির জন্মের পূর্বে তার চারভাই
জন্মলাভ করে শৈশবে মারা যান। তাই তার বাবা কবির ডাক নাম রাখেন ‘দুখু মিয়া’।(দু:খের
পর পাওয়া) বড়ই দু:খ ও দুভার্গ্যরে ইতিহাস তার। দুঃখ ও দৈন্য তাকে তাড়া করেছে
সারাটা জীবন। দারিদ্রতা,
রোগ ব্যাধি, রাজরোষ কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তার কালজয়ী প্রতিভার জ্যোতি
উজ্জ্বল করেছে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে। কবি আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের সামনে শায়িত রয়েছেন। তিনি
চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙ্গালীর চিন্তা ও চেতনায়।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার,
২৯ জুলাই, ১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন