প্রাচীন মিশরীয় সম্রাট তুতান খামেনের হারিয়ে যাওয়া মমি রহস্য
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
নীলনদের দেশ মিশর। বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতারও দেশ মিশর।
মিশরের কথা বললেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল আকৃতির পিরামিডগুলি। এগুলোর ইতিহাস
যেমন রহস্যময় তেমন চমকপ্রদ। নীলনদের তীরেই সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে প্রাচীন
থেবেস নগরীকে কেন্দ্র করে যে উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তারই কালজয়ী ফসল এই সুউচ্চ
পিরামিডগুলি। এই সভ্যতার মধ্যমনী ছিলেন যে রাজারা তাদের বলা হত ফারাও (বা ফেরাউন)।
এই ফারাওরা তাদের মৃতদেহ মমিরূপে সংরক্ষণ করার জন্যই নির্মাণ করেছিল পিরামিডগুলি।
কেননা প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পরও মৃতব্যক্তি আবার বেঁচে উঠবে এবং
নতুন জীবন শুরু করবে। মৃত ফারাওদের মমি রাখার জন্য ভূগর্ভস্থ কক্ষ বা কবর ব্যবহার
করা হত। আর এ ধরণের কবরকে বলা হত ‘মাস্তাবা’। এ ধরণের অসংখ্য মাস্তাবা ছড়িয়ে আছে
মিশরের বর্তমান রাজধানী কায়রোর আশে পাশে মরুভূমির মাঝে।
কায়রো থেকে নীলনদ দিয়ে পাঁচ শত মাইল উজানে গেলে দেখা যায় একটি
মরুময় সুন্দর পার্বত্য উপত্যকা। এই সুন্দর উপত্যকার মাঝেই গড়ে উঠেছিল মিশরীয়
স্বর্ণযুগের রাজধানী থেবেস। বর্তমানে এই নগরীর ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে উঠেছে দুইটি
আধুনিক শহর কারণাক ও লুক্সার। নীলনদের পশ্চিম তীরে লুক্সার শহরের কাছেই প্রাচীন
থেবেসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবরখানা। এখানে পাওয়া যায় প্রাচীন ফারাওদের ২৮ জনের
কবর ও মমি। কিন্তু পাওয়া যায়নি তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ ও রহস্যময় বালক ফারাওয়ের কবর, যার নাম তুতান খামেন। খৃষ্টপূব ১৩৫২ থেকে খৃ: পূ: ১৩৪৩ এই নয়
বৎসর মিশরের রাজা ছিলেন তিনি। বড় ভাই আখেনাতেন অকালমৃত্যু বরণ করায় তুতান খামেন
মাত্র নয় বৎসর বয়সেই ফেরাত্তত্ব লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মাত্র ১৮ বৎসর বয়সেই
তাঁর মৃত্যু হয়।
আর্ল জর্জ হার্বাট ও তার সাহায্যকারী প্রতœতাত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ১৯০৬ সালে মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে
এই তুতানখামেনের হারিয়ে যাওয়া কবর খুঁজতে আরম্ভ করেন। তুতানখামেন সম্বন্ধে ইতিহাস
বলতে গেলে একেবারেই নিরব। ফলে শুধুমাত্র অনুমান আর সামান্য কিছু তথ্যের সাহায্যে
তাদের এই অনুসন্ধান শুরু হয়। প্রথমেই সমস্যা দেখা দেয় এতবড় উপত্যকার কোথায় তারা
খুঁড়তে শুরু করবেন। কার্টার আগেও এখানে এক আমেরিকান প্রত্মতাত্বিকের সাথে কিছু দিন
কাজ করেছিলেন। তাই তিনি জানতেন যে বেশ কিছুদিন আগে আবিস্কৃত ফেরাও রামাসিসের কবর
খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটি কুড়ে ঘর এবং ঘরগুলি একগাদা চকমাকিনূড়ি পাথরের
উপর তৈরী করা হয়েছিল। এই সব কুড়েঘরে হাজার হাজার বছর ধরে কবর তৈরী করত যে সব মজুর
তারা থাকত। সুতরাং কার্টার অনুমান করলেন,
এই কবরের ধারে কাছেই নিশ্চয়ই আর একটা
কবর আছে। এটাকে তুতানখামেনের কবর ধরে নিয়ে কার্টার ষষ্ঠ রামাসিসের কবরের কাছেই খনন
শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এর ফলে আগের কবরটির প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
আবার ষষ্ঠ রামেসিসের কবরটি মিশর ভ্রমণকারীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। সুতরাং তিনি ঠিক
করলেন ভ্রমনকারীদের আসবার সময়টা পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। সেই অনুযায়ী
১৯২২ সালের ১২ অক্টোবর খনন কাজ আরম্ভ হলো। তাদের এ কাজ শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণ অনুমানের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু ৩ নভেম্বর খননকারীরা একটি সিঁড়ির ধাপ
আবিস্কার করলেন তখন কার্টার বুঝলেন,
তার অনুমান একেবারে মিথ্যে হয়নি। খনন
কাজ চলতে থাকলো এবং কয়েক দিনের মধ্যেই বের হলো ১র্০ উঁচু, র্৬ চওড়া পথের মধ্যে ১৬ ধাপের একটি নীচে নেমে যাওয়া সিঁড়ি এবং
এর নীচপ্রান্তে সিল করা একটি দরজা। এই দরজার সামনে যখন কাটার দাঁড়ালেন তখন আনন্দে ও উত্তেজনায়
তার বুক কাঁপছিলো। এসময়ও তিনি জানতেননা তার ইস্পিত বস্তুটি তিনি পেয়েছেন কিনা।
মমিভরে কবরগুলি যখন বন্ধ করা হত তখন দরজায় দু’টি সিল ব্যবহার করা হত। একটি রাজদরবারের সিল ও অপরটি ফেরাও’র
ব্যক্তিগত সিল। কিন্তু এই কবরের দরজায় কেবলমাত্র ১ম ধরণের রাজকীয় সিলটি খুঁজে
পাওয়া গেল। সুতরাং এটা বুঝা গেল যে,
এই কবরটি কোন রাজকীয় ব্যক্তির কিন্তু
তিনি তুতানখামেন কিনা তা জানা গেলনা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর সেই মুহুর্তে
লর্ড কার্ণারডন ছিলেন লন্ডনে। তাই কার্টার সিদ্ধান্ত নিলেন লর্ড কার্ণারডন ফিরে না
আসা পর্যন্ত তিনি কবরের দরজা খুলবেন না। সুতরাং তিনি প্রবেশ পথটা মাটি দিয়ে আবার
ডেকে দিলেন। ২৩ নভেম্বর লর্ড কার্ণারডন ও তার মেয়ে লেডী ইডেলিন নীলনদ বেয়ে
লুক্সারে পৌঁছান। তারা আসার পর পুনরায় কবরের প্রবেশ পথ খোলা হয় এবং এবার দরজার
গায়ে তুতানখামেনের নিজস্ব সিল খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু তাদের হাতাশ হবার মত অনেক
নিদর্শনও পাওয়া গেল। প্রবেশ পথের সম্পূর্ণটাই পূর্ণ ছিল ফেরাওর নাম সম্বলিত ভাঙ্গা
মাটির পাত্র, বাস্ক ইত্যাদিতে। ফলে মনে হতে লাগল যে, এটা বোধ হয় ফেরাও তুতানখামেনের সময়কার কোন ভূগর্ভস্থ গুদামঘর।
এছাড়া প্রবেশদ্বারটি খোলার পর বুঝা গেল যে,
হাজার বছর পূর্বেও কবর চোর বা লোক
প্রবেশ করেছিল। ফলে কবরের ভিতরের মূল্যবান জিনিসপত্র পাবার সম্ভাবনা অনেকখানি ফিকে
হয়ে যায়। কিন্তু কবরে ২য় দেয়াল ফুটো করে কার্টার যখন ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। দেয়ালের ফুটো দিয়ে মোমবাতি ঢুকিয়ে
তিনি প্রথমে আবছাভাবে ও পরে পরিস্কারভাবে দেখলেন। যা আধুনিক জগতের কোন মানুষ আজ
পর্যন্ত দেখেনি। তিনি হতবাক হয়ে দেখলেন ভিতরে সব কিছুই সোনালী দেখাচ্ছে। প্রথমে
ভাবলেন এটা মোমবাতির আলোর প্রতিফলনের ফল। পরে বুঝলেন না ভিতরে সবকিছুই সোনার তৈরী।
ফলে কিছুক্ষণের জন্য বিস্ময়ে তিনি মূর্তির মত নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। দরজা সরিয়ে
তারা কক্ষে প্রবেশ করে অসংখ্য মূল্যবান জিনিষ আবিস্কার করলেন। এর মধ্যে ছিল
ফারাওয়ের নিত্য ব্যবহার্য্য সব জিনিষপত্র-সোনার তৈরী সিংহাসন, বেড়াবার ছড়ি,
রুমাল, তোয়ালে, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি। প্রাচীনকালের দস্যুরা ভিতরে প্রবেশ করলেও
এত ভিতরে ডুকেনি। এগুলো নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। এ কক্ষের শেষ প্রান্তে ছিল আর
একটি বন্ধ দরজা যার দু’পাশে দু’টি বিশালকৃতির সোনার মূর্তি পাহারাদারের মত দাঁড়িয়ে
ছিল। কার্টার তখনই এই দরজা খুললেন না। দরজার ওপাশে যে রহস্য লুকিয়ে আছে তা অজানাই
রয়ে গেল। প্রত্মতাত্ত্বিকদের খুবই সতর্কতার সাথে কাজ করতে হয়। কাজেই কার্টার পুরো
ফেব্র“য়ারী মাসটাই কাটিয়ে দিলেন ১ম কক্ষের জিনিষগুলো পরীক্ষা করার কাজে।
১৯২৩ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারী কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে
কার্টার অত্যন্ত শংকাযুক্ত মনে তৃতীয় দরজাটি খোলবার কাজে হাত দিলেন। দরজার পাথর
কিছুটা সরাবার পর দেখা গেল ওপাশে মাত্র র্৩ দূরে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ সোনার তৈরী
এক দেয়াল। দরজাটি সম্পূর্ণ খোলার পর বোঝা গেল এটা একটা মন্দিরের দেয়াল। তখন
উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে,
এটাই ফেরাও তুতান খামেনের সমাধী মন্দির।
কিন্তু মন্দিরের দরজায় কোন সিল ছিলনা। অত্যন্ত শংকাযুক্ত মনে তারা দরজার হাতল খুলে
ভিতরে প্রবেশ করে দেখলেন আরেকটি দরজা,
কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সিল করা। সংগে সংগে
কার্টার স্থির নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে,
এই বন্ধ দরজার ওপাশেই রয়েছে তুতান
খামেনের শবদেহ এবং এর আগে কেউ ওখানে প্রবেশ করেনি। কিন্তু সম্পূর্ণ রহস্য উম্মোচিত
হতে আরও অনেকটা সময় লেগে গেল। ইতিমধ্যে অভিযানের মূল উদ্যোক্তা লর্ড কার্ণারডন
অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে মারা যান,
আর কার্টারের সাথে মিশরীয় সরকারের বেশ
কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। দু’টি বৎসর কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকলো।
১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে কাজ পুনরায় শুরু হয়। এবার অবশ্য
উম্মোচিত হতে আর সময় লাগলনা। মন্দিরের ২য় দরজাটি খুলে কার্টার ভিতরে গিয়ে দেখলেন
একটি বিরাট ভারীপাথরের শবাধার। এই শবাধারের ডালাটির ওজন ছিল ১ টনের বেশী। সেই
ডালাটি সরাবার পরও তাদের পরিশ্রম শেষ হলো না। ভিতরে পেলেন অপূর্ব কারুকাজ করা একটি
সোনার শবাধার। এই শবাধারের মাথার দিকে ছিল অবিকল রাজার মুখের মতন একটি মুখোশ। এই
মুখোশের কপালে ছিল উত্তর মিশরের প্রতীক কোবরা সাপ আর দক্ষিণ মিশরের প্রতীক শকুনের
মূর্তি। তাদের উপর ছিল এক ছড়া ছোট ফুলের মালা। কিশোরী রাণী তার প্রিয়তম স্বামীর
উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন এ ফুলের মালা- যা সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও তার রং ও
গন্ধ দিয়ে একালের মানুষকে উদ্বেলিত করলো।
১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে কিছু নামকরা বিজ্ঞানী ও মিশরীর
সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে চমৎকার কফিনটি খোলা হয়। এর পরেও ছিল
পরপর দু’টি মানুষের আকৃতির কফিন। প্রথম কফিনটি ছিল কাটের তৈরী ও সোনার পাতে মোড়া
আর কাঁচ ও লেপসি লাজুলী পাথর দিয়ে খোদাই করা। আর দ্বিতীয় কফিনটি ছিল এক চতুর্থাংশ
পুরু সোনার তৈরী। এর ভিতরেই ছিল ফেরাও তুতান খামেনের সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরানো
সম্পূর্ণ অক্ষত মমি। যা এর আগে কোন রাজার ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। আপনি কখনও কায়ারো
যাদুঘর গেলে প্রাচীন মিশরীয় সম্রাট তুতান খামেনকে দেখতে পাবেন।
এ অভিযানের জন্য কিন্তু অনেকখানি মূল্য দিতে হয়েছে- যা আবার
খুবই রহস্যজনক। অভিযান কালেই মৃত্যু হয় মূল উদ্যোক্তা লর্ড কার্নার ডনের। অত্যন্ত
অদ্ভূতভাবে মরতে হয়েছিল তাকে। কায়রোর এক হোটেলে তার গালে মশা কামড়ায়। সেই কামড়
থেকে সেপটিক ঘা এবং তার ফলে রক্ত দৌর্বল্য থেকে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু। ঠিক একই সময়
ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে কার্নারডনের কুকুরটা বিনা রোগে হঠাৎ মারা যায়। এই দুই
মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে সমাধীর কাজের সংগে জড়িত আর ৮ জন পর পর মারা যায়Ñ এদের কারো মৃত্যু ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন
ব্যক্তিরা বলেন, ফেরাওর কবর খুঁড়ে পবিত্রতা নষ্ট করার
জন্য নাকি দেবতার অভিশাপে এদের মৃত্যু হয়। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এসব
ভৌতিক ব্যাপারেগুলো পড়তে যতই মজা লাগুক না কেন বিশ্বাস না করাই ভাল। এই মহান বৃটিশ
প্রতœতাত্বিকগণও যদি এই সব কুসংস্কারে ভীত
হয়ে পড়তেন কিংবা দমে যেতেন তাহলে মানবজাতি প্রাচীন মিশরের এক রহস্যময় অধ্যায়
সম্পর্কে কিছু জানতে পারত না ও প্রাচীন বালক সম্রাট তুতান খামেনের অমূল্য মমি লাভে
সক্ষম হত না।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শনিবার,
২ আগস্ট, ১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন