পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে আমাদের পৃথিবী
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবী,
এক সময় ছিল গভীর অরণ্যে আবৃত অজস্র
প্রজাতির জীবজন্তুতে ভরা এক শ্যামল পৃথিবী। শত শত বৎসর এই গ্রহে মানুষের তেমন
আধিক্য ছিল না। ষোড়শ শতাব্দিতে অনুমান করা হয় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৫
কোটির মত যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ, আর
ভারতের এক চতুর্থাংশ মাত্র। অযাচার যুগ,
পাথরের যুগ, তামার যুগ,
লোহার যুগ পার হয়ে ১৮০০ সালে পৃথিবী
প্রবেশ করে যান্ত্রিক যুগে। সেইসাথে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় মানুষ সংখ্যা।
কৃষি যুগ হতে যন্ত্রযুগে প্রবেশ করে মানুষ। কল কারখানার চিমনি দিয়ে বের হতে লাগল
বায়ুমন্ডলে লক্ষ লক্ষ টন কার্বন। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাসে দূষিত হতে শুরু হলো
বায়ুমন্ডল। বায়ুমন্ডলের এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয় গাছগাছালী।
গ্রাচীনকালে গাছগাছালী ও গভীর অরণ্যে আবৃত ছিল পৃথিবী। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান, আফ্রিকার কঙ্গো ও নাইজার সহ সারা গ্রহই ছিল গহন অরণ্য। অথচ
মানুষের দ্রুত বংশ বৃদ্ধি,
উন্নত চিকিৎসার কারণে মানুষের গড় আয়ু
বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদি কারণে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অনুপাতে পৃথিবীর
বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেদের প্রয়োজনে শুরু হলো
বৃক্ষ নিধন। গভীর আরণ্যাদি হয়ে গেল বিরান ভূমি। কলকারখানার ধোয়া ও অত্যাধিক সংখ্যক
মানুষের নি:শ্বাসের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের জন্য যেখানে আরও বৃক্ষের প্রয়োজন, সেখানে বিভিন্ন দেশে বৃক্ষ কেটে সাবাড় করে ফেলা হল, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অত্যন্ত জরুরী উপাদান বনভূমি।
বর্তমানে বিশ্বের পরিবেশ দূষণ রোধে যেখানে মোট ভূখন্ডের অন্ততঃ ৩০ ভাগ ভূমিতে
বৃক্ষরোপন প্রয়োজন সেখানে রয়েছে অনেক কম। এ বৎসর যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিবেশ
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো কিন্তু কল কারখানার বায়ু দুর্ষণ রোধে যুক্তরাষ্ট্রের অনমনীয়
মনোভাবে কারণে শিল্পোন্নত জাতিগুলো পরিবেশ দূষণ রোধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে
ব্যর্থ হয়।
বাতাসে কার্বন বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে বায়ুমন্ডল। বিভিন্ন দেশে ঋতুচক্র তার নিয়ম হারাতে
বসেছে। সময়ে অসময়ে ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস বিশ্বকে আঘাত হানছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর দুই
মেরুতে লক্ষ লক্ষ বৎসরের জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে। মহাসাগর সমূহে পানিতলের
উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মালদ্বীপ,
সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ
বিভিন্ন অঞ্চল সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যেতে পারে। বর্তমানে যে হারে সাগরের পানিতল
বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০সালে নাগাদ
মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের চরাঞ্চল সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে-যা ভাবলে গা শিউরে উঠে।
এজন্য মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মালিক আব্দুল গাইউমকে পরিবেশের ব্যাপারে সতর্ক হতে
বিশ্বের কর্তাব্যক্তিদের কাছে ধর্না দিতে দেখা যায়। এদিকে, মানুষের সৃষ্টি দূষণের জন্য বায়ুমন্ডলের উপরস্থ ওজন স্তরে ফাটল
ধরছে। ওজন স্তর ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে অতিজাগতিক দূষিত রশ্মি আঘাত হানছে
পৃথিবীতে-ফলে পৃথিবীতে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্যান্সারের মত মারাত্মক রোগ।
ধারণা করা হয়,
আমাদের পার্শ্ববর্তী মঙ্গলগ্রহ এক সময়
বায়ুমন্ডল ছিল, জীবন ছিল ও বুদ্ধিমান জীবও ছিল। এই
বুদ্ধিমান জীব এক সময় পৃথিবীর মানুষের মত পরিবেশের উপর অত্যাচার ও অবহেলা শুরু
করে। ধীরে ধীরে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডল প্রাণীবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ঝড় তুফানে
ছেয়ে যায় মঙ্গলের বাতাস। অক্সিজেন নি:শ্বেষিত হয়। এভাবে একসময় মঙ্গলগ্রহতে
বুদ্ধিমান জীবেরা যে সভ্যতার সৃষ্টি করে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। গাছপালা, জীবজন্তু মরে বিবর্ণ মৃত এক পাথুরে মরুভূমিতে পরিণত হয় মঙ্গল
নামক গ্রহটি।
সুতরাং আসুন আমরা প্রত্যেকে প্রতি বৎসর অন্তুতঃ দু’টি করে গাছ
লাগিয়ে পৃথিবী ও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসি। কল কারখানার কার্বন রোধে দু’টি বৃক্ষ
লাগানো তো তেমন কিছু নয়। এভাবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী ও বংশধরগণের জন্য দায়িত্ব পালনে
সচেষ্ট হই।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শনিবার,
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন