শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত বাংলাদেশ চাই

 রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত বাংলাদেশ চাই
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

শান্তি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত দেশের কামনা সবার। কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি দেশের উন্নতিকে থামিয়ে দেয়, অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়। একবিংশ শতাব্দীকে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় তীব্রভাবে লিপ্ত। সবাই যখন জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে ব্যস্ত, তখন আমাদের এই হতভাগা দেশের নেতৃবৃন্দ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন পারস্পারিক কাঁদা ছুড়াছুড়িতে, অতীতের ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে যুক্তিতর্কে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দেশের রন্ধে রন্ধে প্রতিপালন করেন সন্ত্রাসী ক্যাডারগণকে। হত্যাকান্ডের শিকার হন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা- সেই সাথে নিরিহ জনগণও। দেশের প্রায় সর্বত্রই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার পরিচালিত হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। ৭১এ এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। এদেশের মাটি অনেক রক্ত দেখেছে। রাজনৈতিক কারণে আর কোন মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হোক তা আজ কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা আর সন্ত্রাস চাই না, চাই শান্তি।
স্থিতিশীল ও শান্তিময় সমাজ এবং দেশ পাবার জন্য এদেশের মানুষ অনেক সংগ্রাম করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ ও ৯৫ এর আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভোট ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। মানুষের মনে আশা ছিল, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আসবে রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত দেশ ও অর্থনৈতিক মুক্তি। থেমে যাবে ক্ষমতা দখলের অবৈধ পন্থাসমূহ, নীল নকশার নির্বাচন পদ্ধতি, হরতাল, সামরিক শাসন, হত্যা, ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ক্ষমতা লাভের একমাত্র ও বৈধ পন্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের রায়। কিন্তু দুঃখ হয়, যখন দেখি আমাদের নেতৃত্ব অস্থিরচিত্ত ও তীব্রভাবে অসহিষ্ণু। তারা গণরায় লাভ করলে মানেন, হারলে মানতে রাজী হননা। ক্ষমতা লোভে এতই মরিয়া হয়ে ওঠেন যে, কেউ কাউকে আর সময় দিতে রাজী নন। রাজনীতি চর্চার স্বাভাবিক রাস্তা ফেলে অস্বাভাবিক রাস্তাটার প্রতিই তাদের ঝোঁক বেশী দৃষ্টি গোচর হয়।

একথা সূর্যালোকের মত সত্য যে, স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যতিত এদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ আসবে না, বিদেশী বিনিয়োগ না হলে স্বল্প সম্পদ ও পুঁজির এদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ভাবে স্থিতিশীল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ও মোট জাতীয় উৎপাদন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করে এই দেশগুলো দারিদ্র ও বেকারত্বের কালো থাবা থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। আর আমরা ক্রমান্বয়ে দারিদ্রতা ও বেকারত্বের অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। মানুষ না খেয়ে আছে, কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন গাছতলায় ঘুমাচ্ছে, শীর্ণকায়া হাড্ডিাসার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট, গোলশান,বনানী, ধানমন্ডীর প্রাসাদোপম বাড়ী গুলোতে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এসব মানুষের কথা ভাবার সময় কোথায়? তাদের অনেকের দৃষ্টিতে এসব মানুষ রাজনৈতিক ল্যাবরেটরীর গীনিপিগ।
এইভাবে ফায়দা হাসিলের লড়াইয়ে যদি জনগণকে বলী হতে হয় তবে কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের ধারণা। কেন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের হৃদয়ের এত আকুতি। শান্তি ও র াজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মানুষ এতকাল এত ত্যাগ স্বীকার করেছেএরচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি এদেশে প্রবর্তন সম্ভব নয়। আরও নিরপেক্ষ পদ্ধতি আবিস্কার করতে হলে দেশে জাতিসংঘ, তথা বিদেশীগণকে ডেকে আনতে হবে। যা কোনমতে সম্ভব নয়। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত গণরায়কে মেনে নিয়ে আমাদের সাংবিধানিক নিয়মে ও ধারায় অবশ্যই নিজেদেরকে পরিচারিত করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক কিছুদিন আগে হুশিয়ার করে দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলটি নির্বাচনের রায় মেনে নিতে পারেনি, কাজেই তারা হরতাল-দাঙ্গা হাঙ্গামাসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
অতীতে খালেদা জিয়ার আমলেও আমরা লক্ষ্য করেছি, তার রাজত্বের ২ বৎসর শেষ হওয়া মাত্র বিরোধীদল সমূহ হরতালের রাজনীতি শুরু করে। এই হরতালের রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি করেন খালেদা নিজেই। কারণ তিনি ৯০এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী হন। অথচ ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা অস্বীকার করেন। বিরোধী দলসমূহের এই গুরুত্বপূর্ণ গণদাবি তিনি যথাসময়ে মেনে নিলে তার আমলে এত রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতো না।
দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন কিংবা জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ক্ষতিগ্রস্থ হবে এমন কোন কাজ কোন দেশ প্রেমিক বিবেকবান মানুষ করতে পারেনা। তাছাড়া কোন বিবেকবান মানুষের এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সার্বিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় পর্যটন শিল্পও। আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহনশীলতা ও সমঝোতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। ২০০১ সাল পর্যন্ত সবাইকে গঠনমূলক রাজনীতির মাধ্যমে নিজেকে তৈরী করে গণরায় অর্জনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। হরতাল-ধর্মঘট, দাঙ্গা-হাঙ্গামাকে পরিহার করে সবাইকে জনগণের সেবার মাধ্যমেই জনগণের হৃদয়ে যাবার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। মনে রাখতে হবে সুষ্ঠু ও সহনশীল রাজনীতি এবং গণরায়ই ক্ষমতা লাভের একমাত্র বৈধ পন্থা। 
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শনিবার, ২১ জুন, ১৯৯৭ইং]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন