বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

বিশ্বশান্তি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় এবার সবার উপরে বাংলাদেশ

বিশ্বশান্তি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায়
এবার সবার উপরে বাংলাদেশ
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

বিশ্বশান্তি সূচকে আমাদের প্রতিবেশীতের তুলনায় আমরা যে অবস্থানে আছি তা খুবই আশাব্যঞ্জক। ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কারও ওপরে আমাদের অস্থান। অথচ কয়েক বছর পূর্বেও চরম রাজনৈতিক কোন্দল ও সংঘাত, জঙ্গীদের আক্রমণ ও তৎপরতা, চরমপন্থি সর্বহারাদের অপতৎপরতা, পাহাড়ে সংঘাত বাংলাদেশকে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় একটি অশান্ত ও অস্থির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতো। আজ ভোটের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সাফল্যে জঙ্গীরা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বল্প উন্নত দেশ। নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটি হাঁটিহাঁটি পা-পা করে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে দশ বার বছর পূর্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশটির কেবল নেতিবাচক সংবাদই প্রচার হত। তখন দেশটির পরিচয় ছিল প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভরা এক অনিশ্চয়তার দেশ হিসেবে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ দরিদ্র বস্তি দেশ হিসাবেই পরিচিত ছিল। দুর্নীতিতে দেশটির কুখ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, কয়েক বছর দেশটি দুর্নীতির আন্তর্জাতিক সূচকে প্রথম স্থান ধরে রাখে। বর্তমানে দেশটির মানুষের প্রচেষ্টা দেশটিকে নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। আমাদের ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা, বিশ্বের সর্বত্র সমাদর লাভ করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নভেল প্রাপ্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পরপর কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান, গণতন্ত্রকে রাজনীতির মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে উদার ও সৌহার্দপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা, প্রকাশনা ও বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে। কিছুদিন পূর্বে মুছা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়, সফলভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন, বিশ্বশান্তিতে জাতিসংঘে আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরবময় অবদান বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। আমরা বাঙ্গালীরা সব করতে পারি বা করতে পারবো এমন ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে- যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।

কিছুদিন পূর্বে পত্রিকায় পড়া একটি ছোট্ট খবর আমাকে বেশ উদ্দীপ্ত করে। খবরটি বিশ্বশান্তি সূচকে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বের ১৫৩টি দেশের ২৩টি সূচককে বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের তথ্য উপাত্ত বিচার করে যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস সম্প্রতি টানা পঞ্চমবারের মত এই বার্ষিক বিশ্ব শান্তি সূচক প্রকাশ করে। এই সূচক অনুযায়ী আগের দুই বছরের তুলনায় এ বছর এখনও পর্যন্ত কম সংঘাতপূর্ণ। যদিও উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত আরব বিদ্রোহ এবং সাম্প্রতিক সময়ে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে কিছুটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। সূচকে বলা হয় ২০০৯ ও ২০১০ সালে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের পরিমাণ এ বছরের তুলনায় বেশী ছিল। একই সময়ে বিশ্বজুড়ে দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক মন্দা এবং খাদ্য, জ্বালানি তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি আগের দুই বছরের তুলনায় কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। শান্তি সূচক তৈরীর ক্ষেত্রে ১৫৩টি দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চলমান সংকট, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন হস্তক্ষেপ ইত্যাদি উপাদানকে সূচক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সূচকে নেতিবাচক বিষয় হিসাবে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতা ও রাজনৈতিক সংঘাত। বাজেটের সামরিক খাতে ব্যয় সংকোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে স্থানান্তরও সূচক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসাবে দেখা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় সাফল্য বাংলাদেশকে ওপরে তুলে আনতে সহায়তা করেছে। তেমনি উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে হঠাৎ করে সংঘটিত আরব বিদ্রোহ-এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে গেছে নিচের দিকে।
বিশ্বের ১৫৩টি দেশের প্রাপ্ত তথ্যকে ২৩টি গুণগত ও পরিমাণগত সূচকের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে জরিপটি তৈরী করা হয়েছে। একটি দেশের ভিতরে বাইরে সামরিক ব্যয়, অন্য দেশের উপর খবরদারি, সামরিক আগ্রাসন ইত্যাদিকে সূচকে নেতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। তেমনি মানবাধিকার উন্নয়ন, গণতন্ত্র সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদিকে এখানে উন্নতির সূচক হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। 
২০১১ সালের প্রকাশিত বিশ্বশান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম। আমাদের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৯৫তম, শ্রীলঙ্গা ১২৬তম, ভারত ১৩৫ তম, পাকিস্তান ১৪৬তম। আমাদের নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের অবস্থান ১৩৩ তম। এই ১৫৩টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সুখ-  শান্তির দেশ হচ্ছে আইসল্যান্ড। পরবর্তী শান্তিময় দেশ হচ্ছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, জাপান, ডেনমার্ক ও চেকরিপাবলিক। অন্যদিকে তালিকার সর্ব নিম্নে রয়েছে সোমালিয়া। তার উপর যথাক্রমে ইরান, সুদান, আফগানিস্থান ও উত্তর কোরিয়া।
বিশ্বশান্তি সূচক ধারণাটির উদ্ভাবক স্টিভ কিলেলি নামের এক অস্ট্রেলীয় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। তার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি বিগত পাঁচ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করে আসছে।
বিশ্বশান্তি সূচকে আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমরা যে অবস্থানে আছি তা খুবই আশাব্যঞ্জক। ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কারও ওপর আমাদের অবস্থান। অথচ কয়েক বছর পূর্বেও চরম রাজনৈতিক কোন্দল ও সংঘাত, জঙ্গীদের আক্রমণ ও তৎপরতা, চরমপন্থি সর্বহারাদের অপতৎপরতা, পাহাড়ে সংঘাত বাংলাদেশকে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় একটি অশান্ত ও অস্থির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতো। আজ ভোটের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদল হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সাফল্যে জঙ্গীরা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি সর্বহারারা র‌্যাবের আক্রমণের মুখে অনেকটা নিস্ক্রিয় রয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি পাহাড়েও স্বস্থির সৃষ্টি করেছে। এই চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এক সময় সেখানেও শান্তি প্রতিষ্ঠার সক্ষম হবে আশা করা যায়। শান্তি হচ্ছে যে কোন দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত। সুখ মানুষের একান্ত কাম্য। আর সুখেরও পূর্বশর্ত হচ্ছে শান্তি। আমাদের এই বিশ্বশান্তির অবস্থান অবশ্যই ধরে রাখতে হবে ও আরও উন্নতির দিকে যাতে অগ্রসর হওয়া যায় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমাদের বাংলাদেশের শান্তি বিঘিœত হবার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, প্রথমতঃ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্বিতীয়তঃ জঙ্গীবাদের অপতৎপরতা, তৃতীয়তঃ চরমপন্থি সর্বহারাদের নাশকতা, চতুর্থতঃ পাহাড়ে উত্তেজনা।
বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকেও শান্তি বিঘিœত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বৎসর ছয় শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে। অথচ এই প্রবৃদ্ধির সুফল ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ধনী গরীবের বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক বিরাট বেকার ও হতাশ জনগোষ্ঠী কাজ ও অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে দালালী, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দরিদ্র ও বেকারত্বের যন্ত্রণায় এক সক্ষম জনগোষ্ঠী নানান নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। দরিদ্র ও অশিক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অতিদ্রুত বংশবৃদ্ধি সমস্যাটিকে আরও জটিল আকারে পরিণত করেছে। বাংলাদেশকে একটি শান্তির দেশে পরিণত করতে হলে আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে হবে। এবং প্রতি পরিবারে অন্ততঃ একজন লোককে উপযুক্ত পারিশ্রমিকসহ কাজ প্রদান করে দারিদ্রকে বিদায় জানাতে হবে। রাজনীতিকে পুরোপুরি আইনের কাঠামোয় নিয়ে আসতে হবে, যাতে আর কোন রাজনৈতিক সংঘাতে দেশকে পড়তে না হয়। সরকার প্রধানের পদ এক ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত যাতে কারো সারাজীবন ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার খায়েশ না হয়। বিচার বিভাগকে সংস্কার করে দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা উচিত। অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক, তারা যেন আইনের জাল কেটে বের হয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করা উচিত। গরীব ও অসহায়ের সহজে ও বিনা খরচে বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি। এভাবেই আমরা ষোল কোটি বাঙালীরা আমাদের বাংলাদেশকে পৃথিবীতে এক শান্তির আশ্রমে পরিণত করতে সক্ষম হব।

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৭ জুলাই, ২০১১ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন