বৃটিশ
বিরোধী আন্দোলনের
নেতা
শ্রী কৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আমি আমার একজন শ্রদ্ধাভাজন গুরুজনের কথা বলব, যিনি এই কিছুদিন
আগে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন ঈশ্বরের সান্নিধ্যে। তিনি আমার পিতা সফিকুর রহমান
চৌধুরীর একজন বন্ধু,
একজন হিতৈষী, একজন প্রিয়জন ছিলেন। আমার পিতা বিপদে আপদে, সুখে-দুঃখে সবসময় যার মূল্যবান পরামর্শ নিতেন।আড্ডায় কাটিয়ে দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা।
আমার পিতা ও তিনি
জন্মেছিলেন বৃটিশ উপনিবেশিক যুগে-বিগত শতাব্দির প্রথম পর্বে। তৎকালীন যুগে সমগ্র
রেঙ্গা পরগনায় দাউদপুর গ্রামে সাত ঘর মুসলিম চৌধুরী জমিদার ও উক্ত পরগনার নেগালে
তিন ঘর হিন্দু জমিদার পরিবার ধনে সম্পদে জ্ঞানে-গুনে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। দুই
ধর্মে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও এই দশটি জমিদার পরিবারের মধ্যে বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। এই
জমিদার পরিবারগুলো ঐ এলাকায় উন্নয়নেও যথেষ্ট অবদানও রাখেন। আমার পিতা-প্রায়
তিরানব্বই বৎসর বয়সে ২০০৭ইং সনের ২৪শে নভেম্বর ইহলোক-ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর
তার সমবয়স্ক লোক বলতে যে দু’একজন অবশিষ্ট ছিলেন, এরই অন্যতম শ্রীকৃপেশ
ভাট্টচার্য্য। পরিস্কার গাত্রবর্ণ,
চিকন, চাকন
শারিরিক গঠন, কথাবার্তায় পরিমিত একজন ধ্যানী
ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। পিতার কাছে প্রায়ই তাঁর প্রশংসা শুনতাম। তিনি
বলতেন ভট্টাচার্য্য মহাশয় নিজেকে নিয়ে ভাবতেন অল্প, তাঁর
ভাবনায় সবসময় বিরাজ করত মানুষ ও এলাকার উন্নয়ন। আমি আমার অফিসে বসে সিলেটের ডাকে
যখন ছবিসহ তাঁর মৃত্যু সংবাদ দেখি তখন দুঃখ অনুভব করি এই ভেবে- আমার পিতা চলে গেলেন
প্রায় তিন বৎসর আগে. আর আজ শ্রী কৃপেশ ভট্টাচার্য্যের বিদায়ে আমার পিতার যুগ যেন
পৃথিবী হতে চলে গেল চিরতরে। যেন শতাব্দির চির প্রস্থান।
শ্রী কৃপেশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন একজন সংগ্রামী নেতা। জীবনের
প্রারম্ভে জড়িয়ে পড়েন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে সাতবার
কারাবরণও করেন এই কংগ্রেসি বৃটিশ বিরোধী নেতা। আমার পিতা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে
শরিক হয়ে ইংরেজদের গান্ধীজির ডাকে চাকুরি ছাড়েন। কৃপেশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন সততা, দৃঢ়তা ও সরলতার প্রতীক। সাতচল্লিশের দেশ বিভক্তির পর এদেশের
হিন্দু জমিদারগণ এদেশ ছেড়ে দলে দলে চলে যান ভারতে। কিন্তু ভট্টাচার্য্য মহাশয় তার
সাতপুরুষের স্মৃতি বিজড়িত এই জন্মভূমি দেশমাতাকে ছেড়ে যান নি। পূর্বপুরুষদের
প্রতিষ্ঠিত রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয় ও পাঠশালাকে বুকে আগলে রাখেন নিজের সন্তানের
মত। দেশ ও আশপাশের মানুষ শিক্ষিত হোক,
উন্নত হোক-এটাই কামনা করে গেছেন সারাটা
জীবনভর। নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের ও মানুষের উন্নয়নে আনন্দিত হতেন বেশি। বৃটিশদের
বিদায়ের পর আর কোন রাজনীতিতে জড়ান নি তিনি।
তিনি সবসময় খদ্দরের কাপড়ের ধূতি ও পাঞ্জাবী পরিধান করতেন।
মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৃটিশদের তৈরি কারখানার কাপড় পড়া ত্যাগ
করেন যৌবনে। তারপর এই দেশপ্রেমিক মানুষটি আমাদের তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় ছাড়া কোন
ধরনের কারখানার তৈরি কাপড় পরিধান করেন নি কোনদিন। তাঁর প্রথম পুত্র তপন
ভট্টাচার্য্য আমার হাইস্কুল শিক্ষক,
তুষার দা আমার হৃদয়ের সন্নিকটবর্তী
গুরুজন, তাপস দাও সুহৃদ-প্রিয়জন। সবার ছোট তমাল
ভট্টাচার্য্য আমার হাইস্কুল জীবনের সহপাঠি বন্ধুজন। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে জীবন
সংগ্রামে লিপ্ত সবাই। কৈশোরের দিনগুলোতে রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে
স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রীকৃপেশ ভট্টাচার্য্য আসতেন। এমন সুন্দর বক্তব্য
রাখতেন যা বারবার শুনতে ইচ্ছে হত। তিনি ছিলেন বাগ্মি, বুদ্ধিদীপ্ত ছিল তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ। তাঁর এমনই এক
ব্যক্তিত্ব ছিল, তাকে স্মরণ হলেই মনটা তাঁর প্রতি
শ্রদ্ধায় উদ্বেলিত হত।
ডাঃ নূরজাহান বেগমের সঙ্গে আমার বিবাহ হয় ১৪ই মে ১৯৯৫। বিয়ের
পরই আমাকে এক পূঁজা অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক যাবার আমন্ত্রণ জানান। ছোটখাটো ঘরোয়া
অনুষ্ঠানে এক সন্ধ্যায় আমরা আনন্দে হারিয়ে যাই। আমাদেরকে তিনি কাপড়চোপড় উপহার দেন।
দারুণ বদান্যতায় ভরা ছিল তার মন।
শ্রীতমাল ভট্টাচার্য্যরে বিয়েতে সিলেট শহর থেকে এক বর্ষণসিক্ত
দিনে ঝড়ের মধ্যে স্ত্রীসহ মোগলাবাজার হয়ে নেগালে ভটবাড়িতে যাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে
শেষ প্রণাম করি তাকে। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি জীবনের কাজে। রেবতী রমন উচ্চ
বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে আশা করেছিলাম তার সাথে দেখা হবে। কিন্তু
শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেন নি। বর্ষায় গাড়ি ঢুকবেনা নেগালের মেঠোপথে, তাই অপেক্ষায় রইলাম শুকনো মৌশুমে দেখে আসব। বৃষ্টি থামতে না
থামতে চলে যাই হজ্জ করতে সৌদি আরবে। মক্কা থেকে ফিরে এসে জমানো কাজ পরিসমাপ্ত করার তাড়া। এভাবে
আর যাওয়া হলো না নেগাল। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন আমার বাবার সুখ-দুঃখের দিনের
বন্ধু, মানুষের দরদী, এলাকার উন্নয়নকারী এক সৈনিক শ্রীকৃপেশ ভট্টাচার্য্য। এক
শুক্রবার তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যাই। কিন্তু তিনি তো নেই। এক বুক জ্বালা নিয়ে
বেরিয়ে আসি। মহান ঈশ্বরের কাছে তার আত্মার মুক্তি কামনা করি।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ৭ জুন,
২০১১ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন