বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

সিলেটের উন্নয়ন ও কিছু ভাবনা

সিলেটের উন্নয়ন ও কিছু ভাবনা
সি.আই.আর. কুরেশী সেফাক ও ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরী

নিজের দেশ ও আশপাশ অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে কার না ভাল লাগে। সব মাসুষই নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে। আমাদের স্বপ্নের শহর এই সিলেট। এই শহর ও শহরের আশপাশে আমরা বড় হয়েছি। হয়তো সারাটা জীবন কাটাবো। কাজেই এই শহর ও শহরের উপকণ্ঠ এলাকা নিয়ে ভাববো না, তা'তো হয় না। আজ এই শহরটা পৌরসভা থেকে মেট্রোপলিটন কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে। পূর্বের আয়তন ৫ বর্গমাইল থেকে শহরটির আয়তন প্রায় ২৬ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা এক লক্ষ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচলক্ষে পৌঁছেছে। ধারণা করা হয়, সিলেট বিভাগের মোট জনসংখ্যা আশি লক্ষ। তাহলে ১৬ জন সিলেটির মধ্যে গড়ে ১ জনের বসবাস এই শহরে। তাছাড়া প্রতিদিন আশপাশ অঞ্চল হতে প্রায় ৩০/৪০ হাজার মানুষ বিভিন্ন কর্ম উপলক্ষে এই শহরে প্রবেশ করে এবং রাত হবার আগেই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যায়। নতুন এই মেট্রোপলিটন শহরের বর্ধিত বিশাল এলাকাকে শুধু শহরভুক্ত করলেই চলবেনা বরং বর্ধিত অংকের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কর্র্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্ধ করতে হবে।
ব্যক্তি উদ্যোগ ও সরকারী উদ্যেগে উভয় পর্যায়েই সিলেট শহরের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগে মার্কেট হচ্ছে। শিশুপার্ক হয়েছে। দু’টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ (নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ ও রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কজে হয়েছে। ডাঃ শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীর পরিচালনায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে হিলালপুরে অত্যাধুনিক পার্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে। সিলেট শহরের উত্তরে নগরবাসীর জন্য একটি সুন্দর অবসর বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে পর্যটন মোটেলকে কেন্দ্র করে। উক্ত মেটোলের উত্তর-পূর্ব দিক চারপাশে পাহাড় ঘেরা বিশাল নিম্নভূমি রয়েছে। উত্তরের দু’টি পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করে মোটেল সংলগ্ন এলাকায় চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকের মত সুন্দর মনোরম লেক নির্মাণ করা যেতে পারে। যা এক সময় কর্মক্রান্ত নগরবাসী ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। উক্ত হ্রদে নৌ-ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষা ও জীব বৈচিত্র রক্ষায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে। সিলেটে বন-বনানীর অনেক জীবজন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা লেক স্থাপন করে, তীরবর্তী টিলাগুলোতে সীমিত আকারের চিড়িয়াখানায় স্থাপন করতে পারি। সেখানে সিলেটের প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রাণী সজারু, কাঠবিড়ালী, খুপী বাঘ, বানর, শিয়াল, গেঁছো বিড়াল সাপ সহ নানা ধরণের পাখি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে পারি। এ ব্যাপারে আমরা সিলেটের ডি.সি. মেয়র এবং বন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সিলেট শহরের পশ্চিমদিকে একটি নতুন সেতু সুরমা নদীর উপর তীরে করা হচ্ছে। একই সাথে বর্তমানে ক্বীনব্রীজ অপসারণ করে ঐ স্থানেই বৃহৎ সেতু নির্মাণ যুক্তিযুক্ত।

ভারতের বাঙ্গালেরে ও আহমদাবাদকে কেন্দ্র করে ‘সফটওয়ার’ নগরী (ব্যবসাকেন্দ্র) গড়ে উঠেছে। কারণ ঐ রাজ্যগুলো প্রবাসী অধ্যূষিত। বাংলাদেশের প্রবাসী অধ্যুষিত নগরী হচ্ছে সিলেট।
সিলেটের লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনী, মন্ট্রীল ইত্যাদি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নগরগুলোতে। কাজেই সিলেটকে কেন্দ্র করে কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা সুন্দরভাবে গড়ে উঠার অপার সম্ভবনা রয়েছে। এই ব্যাপারে সরকার ও উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান স্থান পরিদর্শন করে গেছে। সরকার উদ্যোগী ভূমিকা পালন করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সিলেট অঞ্চল আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে সক্ষম হবে। সিলেট বি.এসসি. ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি গ্রেজুয়েশন কলেজ আজও স্থাপিত হয়নি। অথচ সিলেট বিভাগের চারটি জেলার শত শত ছাত্রের অধ্যয়নের জন্য বি.এস.সি ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন অত্যন্ত জরুরী। একথা সত্য যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মুখী শিক্ষা ছাড়া এই দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সিলেটে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিবেশ ও চাহিদা রয়েছে। অত্যন্ত চাহিদা নির্ভর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেমন, এম.বি.এ কম্পিউটার সায়েন্স, সি.এ মাস্টার অব ফার্মাসী ইত্যাদি পেশা ভিত্তিক সাবজেক্টকে কেন্দ্র করে একটি সচল ও সুন্দর বেসরকারী বিশ্বদ্যিালয় এই শহরে গড়ে উঠতে পারে। এ ব্যপারে উদ্যোক্তরা সুযোগ নিতে পারেন। বাংলদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, মংলা, ঈশ্বরদি ইত্যাদি নগরীতে ই.পি.জেড প্রতিষ্ঠন হয়েছে। সিলেটেও ই.পি.জেড প্রতিষ্ঠার সুযোগও সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এখন সিলেট শহরের বাহিরে আমাদের নিজ এলাকা দাউদপুর ইউনিয়নের কথা বলছি-বন্দর পয়েন্ট থেকে দাউদপুর চৌধুরী বাজারস্থ ইউনিয়ন অফিসটির দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। মোগলা বাজার হয়ে ঢাকা দক্ষিণ পর্যন্ত প্রসারিত রাস্তাটি ‘পাহাড় লাইন’ নামে পরিচিত। বর্তমানে খালোমুখস্থ দাউদাবাদ স্টেশন হতে দাউদপুর চৌধুরী বাজার পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ অত্যন্ত ঢিলেতালে চলছে। উক্ত রাস্তাটি নির্মিত হলে চৌধুরী বাজার দূরত্ব ৩/৪ কিলোমিটার কমে যাবে। কাজেই উক্ত রাস্তার নির্মাণ কাজ যত দ্রুত সমাধান হবে ততোই জনগণ ও এলাকাবসীর মঙ্গল হবে। সহকর্মী ইকবাল ও জয়নাল সাহেবের বাড়ী কানাইঘাটে। শহর থেকে মাত্র ১০/১২ মাইল পূর্বে সুরমা নদীর উত্তর পারে তাদের গ্রাম। অথচ ‘সাত সাগর তের নদী’ পার হয়ে দরবস্থ হয়ে অথবা জকিগঞ্জ সড়ক হয়ে তাদেরকে সিলেট আসতে হয়। অথচ এরশাদ আমলে শহরে মেহদীবাগ থেকে উত্তর সুরমা বরাবর কানাইঘাট পর্যন্ত যে বুরহানউদ্দিন সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল এত বৎসরেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এই রাস্তা নির্মাণ কানাইঘাটবাসীর প্রাণের দাবী। এ ব্যপারে উক্ত অঞ্চলের এম.পি. হাফিজ আহমদ মজুমদার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গ্রহণ করা একান্ত জরুরী। নতুবা পরবর্তী কয়েক যুগেও উক্ত রাস্তা নির্মিত হবে কি-না এ ব্যপারে এলাকাসী সন্দিহান। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা চেঙ্গের খালের সেতু উদ্বোধন করেছেন বেশ কিছুদিন পূর্বে। গোয়াইনঘাটবাসী সারিঘাট হয়ে ৩৩ মাইল দূরত্ব ঘুরে সিলেটে আসেন। অথচ গোয়াইনঘাট হতে সিলেটের দূরত্ব ১১ মাইল কমে যাবে। অর্থাৎ ২২ মাইল দাঁড়াবে। এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া প্রয়োজন। দক্ষিণ সুরমার নতুন সড়ক সংযোগ সহ সবগুলো নতুন সড়কে মাটি ভরাটের সময়ই বৃক্ষ রোপন করা প্রয়োজন। কারণ নতুন মাটিতে চারা গাছ দ্রুত বর্ধিত হয় এবং মানুষের চলাচল না থাকায় চারাগুলোও ধ্বংসে শিকার হয় না। ঢাকার, ধানমন্ডি, গুলশান ও কলকাতায় সল্ট লেক এলাকায় লেক বেষ্টিত সুন্দর অভিজাত আবাসিকএলাকা গড়ে উঠেছে সিলেট মোগলাবাজার রোডের দ্পুাশে নিম্নাঞ্চলে অনুরূপ লেক নির্মাণ করে তীরে তীরে মনোরম অভিজাত আবাসিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ ব্যাপারে হাউজিং ব্যবসায়ীর উদ্যোগী হলে লেকগুলোতে মৎস্য খামার হিসেবে রেখে লেকের তীরে প্লট বরাদ্ধ পূর্বক ঢাকা, কোলকাতার অনুরূপ সুন্দর আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব। শহরের নিকটস্থ এই জলাভূমিতে জমির দাম এখনও অল্প রয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবসীদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৫ এপ্রিল, ২০০১ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন