শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০২০

আমার দেখা সৌদি আরব ও আরব সংস্কৃতি পর্ব- দুই


আমার দেখা সৌদি আরব ও আরব সংস্কৃতি পর্ব- দুই


মদিনার মানুষকে আমার অত্যন্ত সজ্জ্বন মনে হয়েছে। নামাজে যাবার সময় লোক দেখলেই গাড়িগুলো থেমে যায়। সালাম দেয় ও হাজিগণ রাস্তা পার হবার পর তারা রাস্তা অতিক্রম করে। ফুটপাতে আফ্রিকার গরীব-সুদানি-সুমালি কালো মহিলারা সামান বিক্রি করেন। আসরের পর সব দল বেঁধে বাসমতি পোলাও ও মোরগের রোস্ট রাস্তার ফুটপাতে বসে একত্রে খায়। মদিনাবাসী যেন মানুষের জন্য কোন ধরনের খেদমত করতে পারলেই আনন্দ পান। মাগরিবের আজানের পর তারা মসজিদে খেজুরকিমা ও পানীয় বিতরণে নেমে পড়েন। সকালে ও রাতে ট্রাকে করে খাবারের দামি প্যাকেট পানীয় শরবত এনে রাস্তায় বিতরণ করেন। মদিনা এমন একটি স্থান- যেখানে কোন মানুষ না খেয়ে থাকবে না। সেখানে মানুষ আসলেই মানুষের জন্য এমনটিই মনে হয়েছে। মদিনার যেদিকে আমাদের হোটেলঐ দিককে বাংলাদেশী এলাকা বলা হয়। চট্টগ্রামের বাংলাদেশী ভাইয়েরা এখানে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক দোকানে বাংলাদেশী সাইবোর্ডও রয়েছে। তাবু আকৃতির বিশাল ব্যবসা কেন্দ্রে প্রচুর বাংলাদেশী মানুষ খেজুর জায়নামাজসহ প্রচুর মালামাল বিক্রি করছেন। নানা দেশের লোকেরা কিনে নিচ্ছেন। আমরা মসজিদে নবুবির যাবার পথে অবস্থিত উক্ত বাজার হতে প্রচুর ভাল খেজুর ক্রয় করি। সোনার মদিনায় এভাবে কেটে যায় আমাদের বারটি দিন। তারপর আসে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য মক্কা যাত্রার পালা। রসুলের রওজা শেষবারের মত জেয়ারত করি দীর্ঘ সময় নিয়ে। তারপর কি যেন তীব্র বিরহ ব্যথা নিয়ে হোটেল ফখরানিতে ফিরে আসি।
দুইটি বড় গাড়িতে করে মক্কায় রওয়ানা হই আমরা সবাই। রাস্তা ঐ মদীনা জেদ্দা রোড। রাস্তায় দূরত্ব প্রায় ছয় শত কি.মি.। এক সময় মহাসড়কের পাশে একই সাইবোর্ড দেখা যায় লিখা-মক্কা রোড। বাম দিকে মোড় নিয়ে মক্কা রোড ঢুকে পড়ে গাড়ি দেড় দুই ঘন্টা পরই চোখে পড়ে কাবাঘরের সামনের বিশাল মিনার ও মিনার ঘড়ি। যাত্রীরা সবাই ‘লাব্বায়েকআল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ উচ্চস্বরে পড়তে থাকেন। যাত্রীদের সবাইকে এ সময় চোখ মুছতে দেখা যায়। এই সেই পবিত্র নগরী মক্কা যেখানে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবনের বায়ান্ন বৎসর অতিবাহিত হয়। এই শহরে ইসলামের জন্ম হয়। এই শহরে পৃথিবীর প্রাচীনতম আল্লাহর ইবাদতখানা কাবাগৃহ অবস্থিত। উল্লেখ্য যেআমরা মদিনা হতে বের হয়ে ত্রিশ চল্লিশ মাইল দূরে যুল হুলাইফা নামক স্থানে আলী মসজিদে নামাজ পড়ে এহরাম বাঁধি। এই মসজিদের হজ্জ করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এরহাম পরতেন। মদীনা হতে আগত হজ্জ যাত্রীদের ঐ মসজিদে এহরাম বাঁধা সুন্নত।


মক্কার ঢুকার সময় মক্কা শহরে প্রচন্ড মানুষের ভীড় লক্ষ্য করি। যানবাহনও প্রচুর। রাস্তাঘাট মদীনা কিংবা জেদ্দার মত এত প্রশ্বস্ত নয়। অসংখ্য সুউচ্চ ভবন ও পাথুরে পাহাড়ে শহরটি পরিপূর্ণ। কাবাগৃহের পাশ দিয়ে গাড়ি চলে গেল বেশ দূরে হাইয়্যাল হিজরা নামক স্থানে। এখানে একজন পাকিস্তানি আরব নাগরিকের চারতলা বাসা ভাড়া করা হয়েছে। এখানে একদিন একরাত অবস্থানের পর ছুটে যাই মিনার ময়দানে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য। মিনার তাবুতে তিন দিন তিন রাত অতিবাহিত করে আরাফাতের দিন বিকালে আরাফাতের ময়দানে হাজির হই। আরাফাতের ময়দানে অসংখ্য গাছের ছড়াছড়ি। আনন্দদায়ক বাতাসে গাছের ডালগুলো দুলছিল। আরাফাত হতে ফিরে মুজদালিফার খোলা চত্বরে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পাঁচ ছয় মাইল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। লক্ষ লক্ষ নর-নারী, জোয়ান-বৃদ্ধ-শিশু হেঁটে হেঁটে মুজদালিফার প্রান্তরে ছোটে আসেন রাতভর। মানুষের এই চলমান গতি আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এই হজ্জ্ব এনথ্রপোলজি বা মানববিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতার জায়গা। এখানে এই পৃথিবী নামক গ্রহের সৃষ্টির সেরা প্রাণী মানুষের সব নৃ-তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ও ভাষাভাষি মানুষের সমাবেশ ঘটে। কেউ কালোকেউ সাদাকেউ কয়লা কালোকেউ বেগুনী কালোকেউ দুধে আলতাকেউ বা পীত বর্ণের। চেহারার বৈচিত্রও রয়েছে। এমন সুন্দর নর-নারী রয়েছেন- আমাদের বাংলাদেশে তাদের একজনের মত সুদর্শন মানুষ হয়তো বের করা সম্ভব হবে না। আবার কালোদের মধ্যে এমন বিকট আকৃতির লোকও রয়েছেন যাদের বাংলাদেশের রাস্তায় সন্ধ্যার পর নামানো হলে মানুষ ভূত মনে করে ভয়ে পালাবে। পোশাক পরিচ্ছদের বৈচিত্রতো রয়েছেই। কেউ মাথায় ভারি পাগড়ীকেউ রুমালকেউ বা নানাধরনের টুপি পরে আছেন। বেশীর ভাগ মানুষের লম্বা জোব্বা-পাজামাই পরিধান করতে দেখা গেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন কালো মানুষের জোব্বায় তাদের দেশের ও অঙ্গরাজ্যের নামও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমাদের দেশের কিছু পীর সাহেব তাদের মুরিদ নিয়ে হজ্জ্বে যান। তাদের কাপড়ে পীরদের নাম ও পীরদের ট্রেভেলসের নাম রয়েছে।
কোন কোন মানুষের চুল কুকড়ানো কালোকারো পাটের মত সাদাকারো ক্ষেতের ধানের গোছার মত গুচ্ছ গুচ্ছ। আফ্রিকার চাঁদ দেশের কিছু লোককে কাবাঘরে দেখেছি যারা লম্বা পাগড়ির রুমাল দিয়ে চোখ ছাড়া সারাটা মুখ ঢেকে দেয়। খুব সম্ভব সাহারা মরুভূমি ভীষণ বালি প্রবাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই পোষাকের প্রচলন হয়েছে। ভারতীয় মুসলমানদের ধূতি ও লুঙ্গি। পাকিস্তানিরা শেরওয়ানি পাঞ্জাবিনারীরা সেলোয়ার কামিজবাংলাদেশীরা লুঙ্গি ও পাজামাইন্দোনেশিয়ার  পুরুষরা রঙ্গিন লুঙ্গি ও শার্ট ও মেয়েদের সাদা প্যান্ট ও কামিজ পরতে দেখেছি। ইন্দোনেশিওয়া প্রায়ই অল্প বয়স্ক মনে হয়েছে।
আরাফাতের পরদিন মক্কায় প্রচন্ড বৃষ্টি হয়। এধরনের মুষলধারে বৃষ্টি বাংলাদেশেও খুব কম হতে দেখা যায়। সেই সাথে প্রচন্ড বজ্রধ্বনী। জামারাতে মাগরিবের আগে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। কাজেই প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে মক্কা হতে তওয়াফে জিয়ারত শেষ করে জামারাতে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হই। মাথায় একটি প্লাস্টিকের টুকরা ধরে বৃষ্টির মধ্যে ২/৩ ঘন্টা দৌড়ে জামারাতে গিয়ে পাথর বর্ষণ করি। বাংলাদেশে বিগত ২০ বৎসরেও আমি এত বৃষ্টিতে ভিজি নাই। মক্কায় হাইয়্যাল হিজরায় ফিরে রাত্রি কাটিয়ে পরদিন কাবাঘর হতে প্রায় একশত হাত দূরে মিছফালার ‘মদীনা প্যালেস হোটেলে উঠি। তীব্রভাবে জ্বরাক্রান্ত হয়ে ২ দিন কেটে যায়। কাবাঘরের এত কাছে হোটেলটি যেআমরা আজান শুনে বের হয়ে কাবাঘরে ঢুকে জামাতে শরিক হতে পারতাম। কাবাঘরের সামনের গেট হতে হোটেলটির দূরত্ব বড়জোড় একশত/দেড়শত হাত হবে। এখানেও বাংলাদেশী লোকদের অনেক ব্যবসাপাতি রয়েছে।


কাবাঘর অত্যন্ত সম্মানিত আল্লাহর ঘর। প্রায় সত্তর লক্ষ লোক সমবেত হয়েছেন এখানে। এই ঘরটি পৃথিবী সৃষ্টির পর আল্লাহ তাঁর পবিত্র  উপাসনা গৃহ হিসাবে নির্ধারণ করেন। দুইজন আরবি শাসক উক্ত গৃহে হামলা করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একজন আবরাহা আল হাবসি-যিনি আবাবিল পাখি কর্তৃক হস্তীবাহিনীসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। অন্যজন ইয়াজীদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। যার বাহিনী কাবাঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে সাতাশ দিনের মাথায় রাজধানী দামেস্কে হঠাৎ মারা যান। প্রাক ইসলামি যুগ হতেই মানুষ প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনে এই পবিত্র গৃহটি তাওয়াফ করে আসছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)হযরত ইসমাইল (আঃ) ও হাজেরার (রাঃ) পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে এইখানে। হযরত ইব্রাহীমের পত্নী মা হাজেরার দোয়ায় কাবাগৃহের নিচ হতে বেরিয়ে আসছে জমজমের পানি। সারা পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে হাজিগণ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই পানি-অথচ এর কোন ঘাটতি নেইশেষ নেই। বৃষ্টিহীন এ মরুশহরে আল্লাহর এক অশেষ নিয়ামত এই জমজমের পানি। হয়তো বা এই পানিকে কেন্দ্র করে এই শহরটি মরুভূমিতে টিকে রয়েছে যুগের পর যুগ। কাবাকে কেন্দ্র করে আরবে যত লোক ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশ করে তা হয়ত বাংলাদেশের মত একটা ছোট্ট গরিব দেশের বাজেটে অধিক হবে।
পৃথিবীর দুইশত ত্রিশ কোটি মানুষের সেজদা ও জিকির আজকার এসে পড়ে এই কিবলা কাবাঘরে এবং তা পৌঁছে যায় পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে। কাবাকে আমার মনে হয়েছে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার যোগাযোগ টাওয়ার হিসাবে। কাবার কাছাকাছি গিয়ে আমি ভীত হতাম আবার খোদাপ্রেমে উদ্দীপ্ত ও হতাম। মনে হত আমার মত একজন ক্ষুদ্র তুচ্ছ সামান্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর একদম সামনা সামনি।

কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন