আমার দেখা সৌদি আরব ও আরব সংস্কৃতি পর্ব- তিন
আমরা কিবলাকে সম্মান করে ঐদিকে পা রাখি না অথচ মক্কায় মানুষ অহরহ কাবার দিকে পা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ে ও এবাদাত বন্দেগি করে। মদীনায় মসজিদে নববিতেও মানুষ রওজার দিকে পা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি হঠাৎ লক্ষ্য করি আমার হোটেলের সিটটি এমনভাবে সাজানো ঘুমালে পা কাবাগৃহের দিকে হয়ে যায়, সাথে সাথে তা পরিবর্তন করে কিবলা শিয়রের দিকে নিয়ে যাই। আসলে ঐসব দেশের মানুষের কিবলা কিংবা রওজার দিকে পা রাখা নিয়ে কোন ধরনের আদবি-বেআদবির ধারনার প্রচলন নেই, যা আমাদের মধ্যে রয়েছে। নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষ আমাদের মত সুন্নত কিংবা নফল নামাজের গুরুত্ব দেয় না। তারা মসজিদে ঢুকে দুই রাকাত দাখিয়াতুল মসজিদ নামাজ পড়ে ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করে চলে যায়-প্রায় ক্ষেত্রেই সুন্নত নফল নামাজ পড়ে না। অনেকের সহিত আলাপ করে দেখেছি সুন্নত ও নফল নামাজ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এমনকি বিতির ওয়াক্তের নামাজ কেউ ১ রাকাত পড়ে, কেউ আদৌ পড়ে না। আমরা কাবাগৃহ হতে মাইল খানেক দূরে জান্নাতুল মাওলা কবরগাহ জিয়ারত করি-যেখানে অসংখ্য ছাহাবিগণের সহিত রসুলের(সঃ) প্রিয়তমা পত্নী হজরত খোদেজা(রাঃ) ঘুমিয়ে আছেন। হাইয়্যাল হিজরায় অবস্থানকালে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) হিজরতের সময় যে পাহাড়ের গর্তে তিন দিন তিন রাত আত্মগোপন করেছিলেন, সেই ছুর পর্বতে এক ঘন্টা বিশ মিনিট পাহাড় বেয়ে উঠি। গোহাটি প্রায় মাইল দেড়েক উপরে অবস্থিত। নীচের গাড়ি ও মানুষগুলোকে অত্যন্ত ছোট দেখায়, যেন মানুষ নয় পিপীলিকার সারি। পথে পথে পানি পান করে করে উপরে উঠতে হয়। এত উচ্চতায় আমি আমার জীবনে আর কোনদিন আরোহন করি নাই। মুহাম্মদ(সঃ) এতই বুদ্ধিমান ছিলেন যে শত্র“র চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য তিনি মদীনার রাস্তার বিপরীত দিকে এই গোহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মক্কায় অবস্থানকালে একদিন আমাদের রুমের বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিয়ানী বাজার গড়েরবন্ধের আবুল হাসান ও নজরুল ইসলামের একজন আত্মীয় আসেন আমাদের জেদ্দায় নিয়ে যাবার জন্য। নতুন দেশ ও জায়গা দেখার লোভ আমার জন্মগত স্বভাব। গাড়ি ভাড়া করে আমরা তিনজন ও ভদ্রলোক মক্কা হতে জেদ্দায় রওয়ানা হই। আশি মাইল দূরত্ব। সৌদি আরবে দেড় ঘন্টার রাস্তা। মধ্যভাগে এসে প্রচন্ড বৃষ্টি। রাস্তার উপর বাংলাদেশের মত পানি বয়ে যায়। পথিমধ্যে আলাপক্রমে জানতে পারলাম আমাদের মেজবান জেদ্দার ভদ্রলোক হচ্ছেন আমার এলাকার লোক, নাম তার আব্দুল মজিদ, তিনি মোগলাবাজারের নেগাল গ্রামের জনাব আরকান আলী সাহেবের পুত্র। অত্যন্ত সদালাপী ও উন্নত মনের মানুষ এই আব্দুল মজিদ। জেদ্দা শহরের এক প্রান্তে তার গাড়ি মেরামত ওয়ার্কশপ। আরও কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। উপরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কার্পেট মোড়ানো বাসা। ঠান্ডা ও গরম পানির লাইন রয়েছে বাসায়। স্ত্রী কলি বেগম, এক পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের লোহিত সাগরের পারে সুন্দরভাবে কাটিয়ে নিচ্ছেন জীবনের চাকা। ভদ্রলোক আমাদের খাওয়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। গাড়িতে করে মধ্যপ্রাচ্যের এই কম্পিউটার নগরী জেদ্দাকে ঘুরে দেখান সস্ত্রীক। আরবিতে কথা বলতে পারেন অনর্গল। দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধরণের নাম নাজানা ফল ও খাবার এতই পরিবেশন করেন যে আমাদের দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। বিশাল বিশাল রাস্তার শহর এই বন্দর জেদ্দা। লোহিত সাগরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রাস্তা। সেতুর মাধ্যমে সাগরের জলের উপর দিয়ে গিয়ে সমুদ্রে স্থাপন করা বৈঠকখানায় বসি। স্বচ্ছ পানিতে দৃষ্টিগোচর হয় নানা ধরনের মাছ। সমুদ্রে ভাসমান তাবু আকৃতির হোটেল ও বাড়িগুলোতে মানুষ অবকাশ যাপনের জন্য অবস্থান করে। কোথাও বা খালের মত নালা কেটে সাগরকে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে নগরীর ভূভাগে, গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। লোহিত সাগরে আমাদের বঙ্গোপসাগরের মত এত ঢেউ কিংবা বাতাস নেই। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের মত ছোট ছোট ঢেউ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কক্সেসবাজারের মত এত সামুদ্রিক গর্জনও নেই। মনে হয়েছে আরবিরা আমাদের কক্সবাজারের বেলাভূমি দেখলে লোহিত সাগরকে হয়ত সমুদ্রই বলত না। জেদ্দায় একটি মসজিদ রয়েছে যাকে আমাদের সিলেটিরা কল্লাকাটার মসজিদ বলে থাকেন। মসজিদটির সামনে যখন ট্রাক দিয়ে বালি ফেলা হয় তখন মানুষ ধারণা করে শিঘ্রই বাদ জুমুয়া এখানে কোন অপরাধির মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হবে। অপরাধীদেরকে এখানে এনে পিছন দিকে দুই হাত বেঁধে হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্যে জল্লাদ তরবারির এক ঘাঁয়ে দেহ হতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে বালিতে ফেলে দেয়। পরদিন বিয়ানীবাজারের গড়েরবন্ধ কুড়ার বাজার নির্বাসী হাজি আকবর আলীর ছেলে আলী হোসেন সাহেব তার বাসায় দাওয়াত করেন। ভদ্রলোক তীক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন। আরবদের সাথে বন্ধুত্ব করে খুব ভাল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন জেদ্দায়। থাকেন রাজকীয় বিলাসবহুল বাসায়, চালান অত্যন্ত দামি গাড়ি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে ভাবনায় তিনি। খাবারে বসে দেখি বাংলাদেশের সমুদয় খাবার চলে এসেছে। রান্নাও বাংলাদেশী। মনে হচ্ছিলো যেন বাংলাদেশের কোন বড়লোকের ঘরে নিমন্ত্রণ খেতে বসেছি। ফেরার সময় আমাদের প্রত্যেককে একশত রিয়াল করে দেন, আমি খুব কষ্ট করে ফেরত দেই। পরদিন মজিদ সাহেব গাড়িতে করে তার জরুরী সময় নষ্ট করে আবার মক্কায় নিয়ে যান। উপহার দেন দুইটি ভাল জায়নামাজ একটি আমাকে ও অন্যটি আমার স্ত্রীকে। আসার আগেও তিনি সস্ত্রীক মক্কা এসে আমাদের দেখে যান। আল্লাহ তাদেরকে সুখী করুন।
হজ্জ হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি ফরজ কর্মের একটি। হজ্জকে আমার মনে হয়েছে নতুন নিয়োগ সেনা অফিসারদের প্রশিক্ষণ। এখানে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দৌঁড়াতে হয় মাইলের পর মাইল। মুজদালিবায় ঘুমাতে হয় খোলা আকাশের নীচে, মিনায় তাবুতে। বাথরুম, গোসল, খাবার কেনায় লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। পদে পদে ভীড়ের মধ্যে ধৈর্য্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। হজ্জের মৌসুমে সবকটি ট্রেভেলস হজ্জের দালালে পরিণত হয় যদিও বেশীর ভাগের কোন লাইসেন্স নেই। এরা হজ্জ এজেন্টের দালালি করে কোন ধরণের কাজ ও পরিশ্রম ছাড়াই প্রতি হাজির ৪০/৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। কাজেই ঠিক হজ্জ এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন ট্রেভেলসের মাধ্যমে কাজ করা ঠিক নয়।
হজ্জের সময় প্রচন্ড ভীড়ে কাবায় নারী পুরুষ একত্রে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। ভীড় কমে আসলে কাবাঘরের ধর্মগুরুগণ নারী পুরুষ আলাদা করে দেন। কাবাঘরের সন্নিকটে গড়ফরহধ চধষধপব এ মোট আটাশ দিন অবস্থান করি। ভীড় কমে আসলে দিনে অসংখ্যবার তওয়াফ করি। ভীড়ের সময় ছাদে কিংবা ২য় তালায় সাতবার তওয়াফ করে সময় লেগে যায় ৫০/৫৫ মিনিট। ভীড় কমার পর নীচে সাত তাওয়াফ ১৫ মিনিটের মধ্যে হয়ে যেত। উক্ত সময়ে আমি ও আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম ছয়বার করে উমরা করে আসি। আমাদের সাথে অনেক হুজুরও যান, যারা একাধিকবার হজ্জ করেছেন। বদলা হজ্জে ছওয়াবতো হয়ই। সেই সাথে আর্থিক লাভও হয়। একজন বয়স্ক হুজুরের জ্ঞানের বহর দেখেও অবাক হই যিনি ১১/১২ বর্ষের ক্লাস শিক্ষক। কাবাঘরে নামাজ আদায়ের সময় হঠাৎ বলে উঠেন, কোরেশি সাব, এই কাবাঘরের ছাদ ধরে রেখেছে অসংখ্য খুঁটি অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আকাশকে ধরে রেখেছেন কোন খুঁটি ছাড়াই, সোবহান আল্লাহ্। অর্থাৎ পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র ও মধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। হজ্জ পালনকালে ২৪শে নভেম্বর ছিল আমার শ্রদ্ধেয় পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর তৃতীয় ইন্তেকাল দিবস। ঘুম থেকে উঠে তার কথা মনে পড়লে উমরা করি ও ছালাতুত তাছবিহ নামাজ আদায় করে তার জন্য দোয়া করি।
এখন আমি সৌদি আরব ও আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে একটা তুলানামূলক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব। সৌদি আরব, দেশটির আয়তন আট লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গমাইল। আমাদের দেশের চেয়ে পনের গুণ বড়। দেশটির লোক সংখ্যা অল্প। মাত্র দুই কোটি। দেশটির মানুষ তিন স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর হচ্ছে শাসক পরিবার বা সৌদি রাজবংশ। সংখ্যায় বিশ পঁচিশ হাজার জন। এরাই রাষ্ট্রের শাসক। রাষ্ট্রের সহায় সম্পদ ভূমি খনি সবকিছুর মালিক।
দ্বিতীয় স্থরে বাকী সৌদি নাগরিক। মূল আরব ও আরব নাগরিকত্ব গ্রহণকারী নাগরিকবৃন্দ। এরা ভূমি ও সম্পদ ক্রয়, একামা প্রদান, ব্যবসার অনুমতিপত্র সহ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। তৃতীয় স্থরে রয়েছেন এক কোটির মত বিদেশী মানুষ-যাদের শ্রমে ও ঘামে আজকের আধুনিক সৌদি আরব গড়ে উঠেছে। এই বিদেশীদের মধ্যে প্রায় বিশ লক্ষ বাংলাদেশী রয়েছেন যারা এককভাবে সবচেয়ে বড় বিদেশী জনগোষ্ঠী। কাবাঘর, মসজিদে নবুবী থেকে শুরু করে সারা আরবে বাংলাদেশীদের বিচরণ করতে দেখা যায়। খালেদা জিয়ার আমলে সৌদি সরকার বাংলাদেশীদের একামাভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কোন সরকারই সৌদিদের সহিত আলোচনা করে এখনও একামা-ভিসা চালু করতে পারে নাই। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্থানের ভিসা চালু থাকায় সৌদি আরবে আমাদের যেখানে জনসংখ্যা কমে আসছে অন্যদের তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সরকারের দুর্বল কুটনীতি আমাদেরকে আহত করে। ফলে দিন দিন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও কমে আসছে।
কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন