আমার দেখা সৌদি আরব ও আরব সংস্কৃতি পর্ব- চার
অটোমেন সাম্রাজ্য হতে পৃথক হয়ে আজকের সৌদ রাজ্য গঠনের পূর্বক্ষণে আরবে এক ধর্ম সংস্কারকের আবির্ভাব হয়। তার নাম আব্দুল ওয়াহাব নজদি। তিনি তাঁর জন্মভূমি পূর্ব আরবের নজদে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ধর্মান্ধ ওয়াহাবি ধর্মযুদ্ধাদের তরবারী ব্যবহার করে ও ইংরেজদের সহায়তায় ইবনে সৌদ শক্তি প্রয়োগে প্রথমে নজদ অঞ্চল ও পরে হেজাজ অঞ্চল দখল করে সৌদি আরব গঠন করেন। আব্দুল ওয়াহাব নজদির দর্শনকে অনুসরণ করে বর্তমান সৌদি আরবের ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের তুলনায় সৌদি আরবের রাজনৈতিক উন্নয়ন অনেক পিছনে রয়েছে। সেখানে এখনও মধ্যযুগীয় চরম রাজতন্ত্র চালু রয়েছে। জাতীয় সংসদ, কিংবা স্থানীয় সরকারের কোন ধারনা সৌদিদের নেই। তাদের কোন রাজনৈতিক দলও নেই। সৌদিদের শিক্ষা নিম্নমানের। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান অনেকটা অনুপস্থিত। সেই শিক্ষায় তেমন উৎপাদনশীলতা নেই। তাই দেশ পরিচালনার জন্য রাজতন্ত্রকে বিদেশীদেরকে নিয়োগ করতে হয়। সৌদিদেরকে আমার মনে হয়েছে অলস ও আরামপ্রিয়। তাদের উচ্ছাকাঙ্খাও অল্প। দোকান, বাসা, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি বিদেশীদেরকে ভাড়া দিয়ে তারা আরাম আয়েশে দিন কাটায়। সৌদি নারীদের অধিকার আমাদের নারীদের চেয়ে অনেক কম। আমাদের মেয়েরা যেখানে জজ-ব্যারিস্টার, চিকিৎসক-ম্যাজিস্টেট হচ্ছেন, বিভিন্ন বাহিনীতে পুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন, বিমান বাহিনীর বিমান নিয়ে আকাশে উড়ছেন, সেখানে সৌদি আরবে এখনও মেয়েদের গাড়ি চালানোর অধিকার নেই, এমনকি নারীদের ভোটাধিকারও নেই। আরব সমাজে বহু বিবাহের প্রচলন রয়েছে- তাতে মেয়েদের বাঁধা প্রদানের কোন অধিকার নেই। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদের সন্তান সংখ্যা শতাধিক, স্ত্রী সংখ্যা অগণিত। তার পুত্র আব্দুল আজিজের পত্মীসংখ্যা অনেক সন্তানাদি অর্ধশত।
সৌদিরা টাকা হাতে এলেই বিয়ে করেন। ইয়ামেন, সিরিয়া, মিশর হতে বিয়ে করে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বউ নিয়ে আসেন। অথচ সৌদি মেয়েরা কোন বিদেশী পুরুষ বিয়ে করতে পারেন না। প্রচুর টাকার বিনিময়ে বিয়ের নামে নাকি সৌদিরা কন্যাকে বিক্রি করে দেন। ধনী বুড়োরা মেয়ে বিয়ে দিয়ে উক্ত টাকায় অল্প বয়স্কমেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে আসেন প্রাসাদে। অথচ সৌদি গরিব যুবকরা টাকার অভাবে দেরীতে বিয়ে করতে বাধ্য হন। সৌদিদের সংস্কৃতিও আমাদের চেয়ে নিম্নমানের। নাচ, গানবাজনার প্রচলন নেই। নাটকও অনুন্নত, নারী চরিত্র দুর্বল।
সৌদিদের বিচার ব্যবস্থাও পূর্বকালের প্রাচীন রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার সমাবেশ তেমন নেই। শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের নির্দেশনাই আইন হিসাবে কাজ করে। যেখানে সংসদই নেই সেখানে মানুষের বিচার বিবেচনা প্রসূত ও রচিত আইন আসবে কেমন করে।
তৈলখনি আবিস্কারের পূর্বে গরিব যুগে আরবদের মধ্যে আমাদের মত অনেক অনাচার ও ঠগবাজী ছিল। আরবরা যতই সচ্ছল হয়েছে ততই তাদের চরিত্র পরিবর্তন হয়ে তারা খুবই ভালো মানুষে পরিণত হয়। বর্তমান আরবদের দেখলে পূর্বকালের আরবরা যে দুর্দান্ত ও ভয়ঙ্কর ছিল- তা ভাবাই যায় না।
আরবরা বর্ণে কালো ও শ্বেত এই দুইভাগে বিভক্ত। ইউরোপ ও আমেরিকার মত আরবে সাদা ও কালো মানুষের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ নেই। পূর্বকালে আফ্রিকার কালোরা এসে শ্বেত সেমিটিক আরবদের সহিত মিশে যায়। উভয় বর্ণের আরবদের মধ্যে আন্তরিকতার বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়।
এতকিছুর পরও সৌদি নারীরা একটি অধিকার ভোগ করে যা আমাদের নারীদের নেই। তাহলো তারা মসজিদে পুরুষদের সাথে জামাতে নামাজ পড়তে পারে। প্রতিটি মসজিদে নারীদের জন্য আলাদা পর্দাঘেরা জায়গা রয়েছে, রয়েছে আলাদা বাথরুম ও অজুখানা। আমাদের ধর্মীয় হুজুররা কেন যে নারীদের মসজিদে ঢুকতে দিতে রাজি হন না- তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
আরবদের মসজিদ নির্মাণে আমাদের চেয়ে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখেছি। প্রতিটি মসজিদে ঠান্ডা খাবার পানি রাখা হয়। একটি মসজিদে মানুষ বসে ইবাদত করার জন্য চতুর্দিক ঘিরে চেয়ারের মত বসার জায়গা রয়েছে। একটি মসজিদে প্রতি সারিতে হেলান দিয়ে বসার জন্য পিছনে হাতা বসানো দেখেছি।
আরবদের মধ্যে পীরমুর্শিদ প্রথার প্রচলন নেই। আমরা খোদাকে পাবার জন্য চরমুনাই, আটরশী, মাইজভান্ডারী কিংবা এনায়েতপুরী ধরি। আরবরা সরাসরি আল্লাহকে ধরে- কোন পীরের আশ্রয় নেয় না। আমাদের দেশের অনেক পীররা দু’একটা মসজিদ-মাদ্রাসা, এতিমখানা দেখিয়ে মানুষের লিল্লাহ ও জাকাতের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে রাজকীয় আয়েশী জীবনযাপন করেন, গড়ে তুলেন সম্পদের পাহাড়। কিন্তু আরবরা কোন হুজুর কিবলার ধার কাছেও যান না। মানুষের লিল্লাহ নিয়ে হুজুরদের কোন ধর্ম ব্যবসা সৌদি আরবে নেই। সৌদিরা দলবদ্ধ ভাবে দুরূদশরীফ পড়ে না। নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত করেন না। নামাজের মধ্যে ছুরা ফাতেহা পাঠের পর তাঁরা উচ্চস্বরে ‘আমিন’ বলে উঠেন, তখন সারাটা মসজিদ আন্দোলিত হয়ে উঠে।
আরবদের লম্বা পরিস্কার আলখেল্লার মত জীবনটাও সহজ সরল পরিস্কার। তাদের দৃষ্টিতে সুন্নত হচ্ছে মাথার রুমাল ও মাথার উপরের কালো বেড়ি। আরব সমাজে আমাদের মত তাবিজ-কবজ বা পানিপড়ার প্রচলন নেই। আমাদের দেশে নামাজের সময় মানুষ সামনা দিয়ে চলে গেলে বাঁধা দেওয়া হয়। বাচ্চারা নামাজে ঢুকলে লাইনের দূরপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয় কিন্তু আরবদের মধ্যে এসব প্রথা নেই।
সৌদি আরবের প্রসিদ্ধির কারণ হচ্ছে এটি মহানবি হজরত মুহাম্মদ(স:) এর জন্মস্থান। এই নবিজির মোহব্বতে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই উসর মরুময় দেশটিতে ছুটে আসেন। মহানবির জন্ম না হলে দেশটির এত গুরুত্বই থাকিত না। কাজেই দেশটির নাম ‘মোহাম্মদি আরব’ অথবা শুধুই ‘আরব’ হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। অনুরূপভাবে পবিত্র মদীনায় রসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবিদের নামে কোন রাস্তাঘাট দৃষ্টিগোচর হয়নি। সবগুলোই ইবনে সৌদ বংশের লোকদের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কিছু কিছু শব্দ আমরা ইসলাম ধর্মীয় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি যেমন খোদা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি। কিন্তু এই শব্দগুলোর প্রচলন আরবে নেই। তারা নামাজকে সালাত ও রোজাকে সওম বলেন। খোদা শব্দটি মুহাম্মদ(স:) কখনও উচ্চরণ করেন নি। আমাদের ভাষায় এই শব্দগুলো খুব সম্ভব ইরান, আফগান ও মধ্যএশিয়া হতে অনুপ্রবেশ করেছে। আমাদের হুজুররা দয়াল্লিন ও যোয়াল্লিন নিয়ে রাজনীতি করেন। অথচ কাবা ও নবুবি মসজিদের নামাজে খুব পরিস্কার ভাবে ‘দয়াল্লীন’ শব্দটি উচ্চারিত হতে শুনেছি। আমাদের দেশে নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা ‘ফ’ এর উচ্চারণ ‘হ’এর মত এবং রংপুর অঞ্চলের মানুষ ‘র’এর উচ্চারণ ‘অ’ এর মত করে থাকে। ইসলাম খুব সম্ভব আরব হতে আমাদের দেশে আসার পথে কোন অঞ্চলের লোকজন আরবি অক্ষর দয়ালের উচ্চারণ প্রায় জোয়াল এর মত করে ফেলেন। যাহা বাংলাদেশের আলেমদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে।
আমি কোনদিন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের জন্য আল্লাহর শুকর গোজার করিনি। মনে হত এক অনিশ্চিত জীবনের দেশে আমার জন্ম হয়েছে, অথচ সৌদি আরবে গিয়ে বুঝতে পেরেছি- এত সুন্দর দেশ, এত প্রাণী বৈচিত্রের দেশ, এত তরুলতার দেশ, নদ-নদী সাগরের দেশ, পাখিদের গানের দেশ, শাপলা ফোটা জলার দেশ, পৃথিবীতে খুবই বিরল, আর আবহাওয়া তারতো তুলনাই হয় না। আমাদের বিদ্যুৎ না হলেও যে আবহাওয়া ও পরিবেশ বিরাজ করে তাহা এসব দেশের চেয়ে অনেক উত্তম। অথচ সেসব দেশে ১ ঘন্টা বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষের পক্ষে টিকে থাকা খুবই কঠিন। আরবরা আমাদের দেশে আসলে বিস্মিত হয়ে বলবে- এই তো বেহেশত। তাদের জীবন পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর আর আমাদের জীবন প্রকৃতি নির্ভর। প্রযুক্তির সাহায্যেই তারা বেঁচে থাকে।
আস্তে আস্তে সময় ফুরিয়ে আসে। কাবাঘর শেষবারের মত আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে তওয়াফ করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে চলে আসি হোটেলে। আসার তিন চার দিন আগে দেশে পরিচিতজনকে বিতরণের জন্য আমি সত্তুর/আশি হাজার টাকার তসবিহ, জায়নামাজ, ঝরের বাটি, শবাধারের ঢাকনা, কাপড়, চুলের বেনী, বোরকা, মাথা ঢাকনা হেন্ডব্যাগ ইত্যাদি ক্রয় করি। পনের কেজির মত জমজমের পানি বোতলজাত করি।
ষোল ডিসেম্বর ২০১০ইং সনে জেদ্দা বিমানবন্দরে আসি। বিমান ঠিক নির্দিষ্ট সময়েই ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ১লা নভেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ইং দেড় মাস সময় স্বপ্নের মত হারিয়ে যায় জীবন হতে অথচ দিয়ে যায় এক বিরাট অভিজ্ঞতা। এক রাত ঢাকায় ধানমন্ডিতে সমনদিক আব্দুল আজিজ চৌধুরীর বাসায় কাটিয়ে পরদিন তাদের গাড়িতে করে সিলেট চলে আসি। সৌদি আরবের এই ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা চির জাগরুক হয়ে আমার মননে বিরাজমান থাকবে। আরব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা অত্যন্ত রক্ষণশীল ও প্রাচীন রীতিনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তা হওয়া সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছে-আমাদের আধুনিক বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে অনেক বেশি নিরাপত্তা বিদ্যমান। মানুষের ইমান সুদৃঢ় ও খোদার ভয়ে তারা সবধরনের অপকর্ম হতে সম্পূর্ণরূপে দূরে অবস্থান করে।
কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার, ধর্ম বিভাগ ৪ মার্চ, ১১ মার্চ, ২৫ মার্চ ও ১ এপ্রিল, ৮ এপ্রিল, ২২ এপ্রিল, ২০১১ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন