সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড
এবং মালয়েশিয়া আসিয়ান জোটভুক্ত তিনটি পূর্ব এশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমার পরিচিত
অনেক লোকজন এসব দেশ সফর করেছেন, তাদের বর্ননায় এসব দেশের বিবরণ অনেক শুনেছি। এই
দেশগুলোর অনেক ছবি ও বর্ননা বইপত্র ও টেলিভিশনে দেখেছি। এভাবে এদেশগুলোর যে মনছবি
কল্পনায় অঙ্কন করেছি তা বাস্তবে মিলিয়ে দেখার একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়ায় বেশ
কিছুদিন হতে প্রার্থনায় মহান আল্লাহের দরবারে উক্ত দেশগুলো আমাকে বাস্তবে দেখানোর
আবেদন পেশ করি। হঠাৎ একদিন আমার ভাগনা রনকেলী নিবাসী ভাগনা জিন্নুন বখত চৌধুরীর সাথে
দেখা হয়। তিনি সিলেটের ওয়ালি সিটি আবাসনের চেয়ারম্যান ও সৌকিন পর্যটক। তিনি ভ্রমণের
অদম্য নেশায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, ভারত, নেপাল ইত্যাদি দেশ সফর করেছেন। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার তিনি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া সফর
করেছেন। আইটি এবং ইংরেজি ভাষায় দারুন দক্ষ একজন করিৎকর্মা লোক তিনি। একদিন তাকে
পেয়ে বললাম পূর্ব এসীয় এসব দেশে গেলে আমাকেও যেন সফরসঙ্গি করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতে হঠাৎ জিন্নুনের
ফোন পাই- মামু, আমরা তিনজন সিঙ্গাপুর যাচ্ছি, শরিক হতে হলে পাসপোর্ট পাঠিয়ে দাও। এই দেশগুলো ভ্রমণের জন্য আমি এতই উদগ্রীব ছিলাম যে আগপিছ না ভেবে সাথে সাথে ভিসার
জন্য পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেই। একমাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে তিনটি দেশের ভিসা পেয়ে যাই।
আমি পূবালী ব্যাংক
লিমিটেড বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক। সামনে ৩০ জুন ২০১৩, ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক
সমাপনী। ব্যাংকের প্রচুর কর্মকান্ড, এমতাবস্থায় ছুটি চাওয়াটা অস্বস্তিকর। তারপরও
ছুটি না নিয়ে উপায় ছিলনা। কারণ আমাদের সফরদলের সদস্য ব্যবসায়ী রাসেল আহমদ রমজানে
বিক্রির জন্য ব্যাংকক হতে মালামাল কিনবেন। তাছাড়া সামনে রমজান, রমজানের আগেই দেশে
ফিরে আসতে হবে।
২৭ জুন ২০১৩ রোজ
বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে দশটায় শাহজালাল উপশহরে ভাগনা জিন্নুনের বাসায় যাই। সকাল
১১টায় ওয়ালি সিটির মাইক্রোবাসে রনকেলী গ্রামের জিন্নুন বখত চৌধুরী, ইউনুস আহমদ
চৌধুরী খোকন, আব্দুর রহমান চৌধুরী দারা এবং আমি ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দরের
উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। সেদিন রাত ১১টার সময় সিঙ্গাপুর টাইগার এয়ারওয়েজের একটি
মধ্যম আকৃতির বিমানে আমরা ঢাকা ত্যাগ করে ভোর ৫টায় সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে অবতরণ করি।
সিঙ্গাপুর অবস্থানকারী
জিন্নুনের বন্ধু রিমন একটি হোটেল বুকিং দিয়ে রাখেন। হোটেলটির ঠিকানা- Hotel Star Asia, 44, Rowell
Street, Little India, Singapore. হোটেলটির ব্যবস্থাপনায় আছেন ভারতীয় তামিল লোকজন। চারজনের একদিনের ভাড়া মাত্র ২২
সিঙ্গা্পুরি ডলার, অর্থাৎ ২২x৬০=১৩৬০ বাংলাদেশি টাকা। হোটেল ভাড়া বেশ সস্তাই মনে হল। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর
হতে ভোর রাতে যে সুন্দর ও দামি কারটি আমাদেরকে হোটেলে নিয়ে আসে সে ভাড়া ৩০
সিঙ্গাপুরি ডলার। লিটল ইন্ডিয়াতে প্রচুর বাংলাদেশি ও ভারতীয় তামিল লোকজন বসবাস
করেন। ভোরে এক তামিল হোটেলে খাবার খাই। ম্যানুতে ছিল ভোনা খিচুড়ি, ডিম ও শাক সবজি।
এই প্রথম দেখি খিচুড়ির উপর কুচি কুচি সামুদ্রিক ছোট মাছের শুটকি, খিচুড়ির সাথে
শুটকি আমাদের দেশে পরিবেশিত হতে জীবনে কখনও দেখিনি। তবে খেতে বেশ ভালই লাগল। তারপর
আসে বড় বড় পেয়ালায় সুমিষ্ট চা।
২৮ জুন ২০১৩ রোজ
শুক্রবার। ১১ ঘটিকায় ঘুম হতে উঠে গোসল করে সবাই বের হই। লিটল ইন্ডিয়ার শাহি বিরিয়ানি হোটেলে দুপুরে খেয়ে ভূগর্ভস্থ মেট্রো ট্রেনে সন্তোষা দ্বীপে গমন করি। এটি
আমার জীবনের প্রথম ভূগর্ভস্থ ট্রেন ভ্রমণ। কখনও মাটির নিচ কখনও উপর দিয়ে ট্রেনটি
পথ চলে। উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার আমাকে হতবাক করে। এই পর্যটন দ্বীপে উত্তর কুরিয়ার একনায়ক কিম জং ঊন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুনাল্ট ট্রাম্পের মধ্যে পারমানবিক অস্ত্র উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সন্তোষা গিয়ে টিকেট করে
স্কাই ফ্লাইয়ারে চড়ে আমরা প্রায় হাজার ফুট উপরে উঠি। সুউচ্চ ফ্লাইয়ার হতে সমগ্র
সিঙ্গাপুর দ্বীপ ও দ্বীপের উপকূল রেখা দৃষ্টিগোচর হয়। মেরিনা বের পাশে তিনটি ৭০/৮০
তলা তিনটি ভবনের শিরোভাগে জাহাজ আকৃতির বিশাল স্টিলের কাঠামো চোখে পড়ে। সেখানে এত
উপরে সুইমিংপুল, পামবাগান, কুসুমবাগ দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ে। মনে হল এযেন প্রাচীন
বেবিলনের শূন্য উদ্যান। নিচদিকে চেয়ে দেখি সিঙ্গাপুর দ্বীপ হতে সেতু দ্বারা
সংযুক্ত বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট শ্যামল দ্বীপমালা। একটি দ্বীপে যাবার জন্য
অনেকগুলো খুঁটির মাথা সাগরে ভাসছে। খুঁটির মাঝখানে সাগরের উর্মিমালা খেলা করছে। এই
খুঁটিদের মাথায় পা রেখে রেখে পর্যটকগণ সাগর পারি দিয়ে পা রাখছেন এই সুন্দর বাগান
দ্বীপে।
স্কাই ফ্লাইয়ার হতে নেমে
ট্যুরিস্ট বাসে সাইট সিইং করতে বের হই। সিঙ্গাপুরের ট্যুরিস্ট বাস অতি উন্নত।
দুতলা বাসের নিচতলায় চালক বসেন। এখান থেকে যাত্রীদেরকে এয়ারফোন দেয়া হয়। লম্বা
গাড়ির পিছনে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত আসন কক্ষ। মধ্যভাগের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে উপর তলার
পিছন দিক ছাদে ঢাকা এবং সামনা খোলা। দুতলায় সিটে বসে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে সবগুলো
জায়গা ও স্থাপনার ইতিহাস ও বিবরণ ইংলিশে শুনে শুনে সারাটা শহর ঘুরে দেখি। মানুষ্য
সাজানো অসম্ভব সুন্দর দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর। ৫/৬ ঘন্টায় ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে এই
সুন্দর ক্ষুদে দেশটি দেখা হয়ে যায়। দেশটিতে সমতল ভূমিই বেশী, তবে বেশকিছু টিলা ও
প্রাকৃতিক বৃক্ষশোভিত ঘন বনভূমিও রয়েছে। রাত ৯টায় আমরা সিঙ্গাপুর সাফারি পার্ক
দেখতে যাই। খুব ধীরগতির তিন বগী বিশিষ্ট খোলা ট্রেনে যাত্রা শুরু হয়। টিলা ও
জঙ্গলাময় সুন্দর পার্কটিতে রাতের প্রাকৃতিক পরিবেশে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি দর্শন
করি। বাঘ, সিংহ, হরিণ, ময়ূর, বনগরু, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু কিছুই বাদ
পড়েনি। চিড়িয়াদের উপর ঘন বনের ফাঁক দিয়ে লাইটের আলো পড়ছে। কচ্চপ-গতি ট্রেনের অতি
কাছে বাঘ, ভালুক, সিংহ, বানর, গরিলার মত হিংস্র পশুরা চলাফেরা করছে। প্রাকৃতিক
পরিবেশে গভীর রাতের ভূতুড়ে আলোয় হিংস্র প্রাণীদের সহিত সহবস্থান সত্যিই এক বিরল
অভিঞ্জতা। রাত ১টায় সাফারি পার্ক দর্শন শেষ হয়। স্টেশনে নেমে বাহিরে এসেই পেয়ে যাই
কয়েকটি টিলার ঢালু ও উপত্যকা জুড়ে সার্কাস ভেন্যু। টিলার ধাপে ধাপে সিড়ি কাটা,
সিঁড়িতে বসার চেয়ার সাজানো। শত শত বিদেশি পর্যটক সিঁড়িতে বসে পশুপাখির নানা
বিচিত্র ধরণের খেলা দেখছে। হাতী এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আরেক পা তুলে সালাম দিচ্ছে। মিরক্যাট
ছোট ছোট বল কুড়িয়ে পাত্রে জমা করছে, বিশাল অজগর পাঁচ ছয় জন লোকের কাঁধে বসে আছে,
তারপর একজন লোককে পেছিয়ে ভয়ঙ্কর হা মেলে আছে। কুকুরদল বল খেলছে, ঘোড়া লাফ দিয়ে
উচ্চ দেয়াল পার হচ্ছে ইত্যাদি। রাত ২টায় সার্কাস হতে বের হয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড
ট্রেনে লিটল ইন্ডিয়া স্টেশনে নেমে হোটেল স্টার এসিয়ায় ফিরে আসি।
২৯ জুন ২০১৩ রোজ শনিবার।
ঐদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই একে একে গোসল করি। পরিচ্ছন্ন হয়ে বের হই এবং বাংলাদেশি হোটেলে খাবার খাই। হেঁটে একটু দূরে গিয়ে মোস্তফা প্লাজায় যাই। মোস্তফা প্লাজা
রাস্থার দুইদিকে সুউচ্চ দুটি টাওয়ার, মাটির নিচে চারতলা যাহা রাস্থার নিচ দিয়ে
এসে দুটি টাওয়ারকে সম্পুর্ণ যুক্ত করে রেখেছে। বেশ বড় মার্কেট, এখানে গাড়ি,
উড়োজাহাজ, ট্রেন, হাতী এধরনের পণ্য ছাড়া প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যায়। এক এক লেবেলে, এক এক দিকে, এক এক ধরনের পণ্যের সমাহার। এখানে
দ্রব্যমূল্য নিদৃষ্ট ও একদর। টোকেন গ্রহণ করে লাগেজ বাহিরে রেখে মার্কেটে প্রবেশ
করতে হয়। এখানে নগদে ও কার্ডে বেচাকেনা হয়। মোস্তফা প্লাজার মালিক একজন ধনী ভারতীয়
মুসলিম। এই মার্কেটে তুলনামূলক সস্তায় ভাল মালামাল পাওয়া যায়।
অতঃপর আমরা মেট্রো
ট্রেনে মেরিনা বে গমন করি। সেখানে সিঙ্গাপুর নদীর রিভার ভিউ পয়েন্ট হতে টিকেট করে
সুন্দর পর্যটন নৌকায় আরোহন করি। নৌকাটি কাষ্টনির্মিত শব্দহীন যান্ত্রিক জলযান।
সিঙ্গাপুর নদী, সিঙ্গাপুর দ্বীপের মধ্যবাগ দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট্ট সুন্দর নদী।
নদীটি কোথায়ও কোথায়ও প্রশস্থ লেকের আকার ধারণ করে আছে। নদীর মোহনায় মেরিনা বের
আয়তন ১০/১২ বর্গ মাইলের কম নয়। একটি ডাইক
নির্মাণ করে সাগর থেকে মেরিনা বে কে আলাদা করা হয়েছে। নদী এবং মেরিনা বের তটরেখা
কোথায়ও পাথর দিয়ে কোথায়ও কংক্রীট ব্লক দিয়ে সুন্দরভাবে বাঁধানো রয়েছে। নদী ও
হ্রদাকৃতির উপসাগরের তীরে তীরে গড়ে উঠেছে সুরম্য অট্টালিকার সারি। ভবনগুলোর কাচের
আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে নীলজলে। ভবনমালার দৃশ্য নয়নাভিরাম। অসংখ্য সুরম্য সেতুর
নিচ দিয়ে জলযানটি অগ্রসর হয়। একটি সেতুর নাম হলুদ গভর্নর সেতু। এটি বৃটিশ আমলে নিযুক্ত একজন চীনা গভর্নর কতৃক নির্মিত। জানলাম ইংরেজরা চিনাদেরে বলত হলুদ জাতি। বিভিন্ন যুগে নির্মিত সেতুগুলো সে যুগের চিহ্ন হিসাবে
যুগযুগ ধরে একই ডিজাইনে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নদীর তীরে কিছু বাগান বাড়ি দর্শন করি।
প্রতিটি বাড়িতে সুইমিংপুল রয়েছে। এক একটি বাড়ির মূল্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। নদীর
মোহনায় মেরিনা ব্যারেজ নির্মাণ করে সমুদ্রের সাথে নদীকে সংযুক্ত করা হয়েছে। (অসমাপ্ত)
কবি, লেখক, ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন