রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- তিন


যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- তিন 

১০জুন ২০১৯ অরলান্ডো বিমানবন্দর হতে বের হয়ে একটি ক্যাব ভাড়া করি। অর্ধঘন্টা পর আমরা Seralago Hotel & Suits পৌঁছে যাই। একটি পাচতলা সুন্দর হোটেল, নিচে লবী, কিচেন, ডাইনিং হল এবং কয়েকটি নিত্যপন্যের দোকান রয়েছে। গাছপালা ঘেরা পার্কিং এবং বাগান, বসার জায়গা সহ এই রিসোর্টের পরিবেশ বেশ মনোরম। আমরা সেরালাগো হোটেলের অফিসে গেলে তারা বলল আপনাদের বুকিং বিকেল ৪টায় কার্যকর হবে, কাজেই হোটেলের লবিতে কিংবা ডাইনিঙয়ে বসে সারাদিন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কোন পথ নেই। এখানে পিথজা, বার্গার, পাউরুটি, ফ্রেঞ্চফ্রাই, ডিম, কলা, আপেল এসব ছাড়া ভাত-মাছ-তরকারি জাতীয় কোন দেশী খাবার নেই। রাইসবিহীন এসব আমেরিকান খাবারে আমরা বাঙ্গালীদের চলেনা। ইপকের বউয়ের দেয়া খাবার তাই আমাদের খুব কাজে লাগে। খাবার এত বেশী ছিল যে সে খাবারে তিনজনের দুইদিন আনায়াসে চলে যায়। রাইসার ক্রেডিট কার্ডে আমরা হোটেল বুকিং করি। তারা কার্ডটি চাইলে আমরা দেখাতে পারিনি। আমাদেরকে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রেখে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে। তারপর পাসপোর্ট ও গ্রীনকার্ডের ফটোকপি রেখে আমাদেরকে বহিরাঙ্গনের ফেমিলি স্যুট বরাদ্ধ করে। স্যুট নম্বার-৬১১। আমাদেরকে হোটেল কতৃপক্ষ বললেন, আপনাদের ব্রেকফাস্ট বুকিং করা হয়নি। খুবসম্ভব রাইসা বুকিঙয়ের সময় এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তাদের একজন কর্মচারী একটি বাগান ও সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে আমাদের স্যুটে নিয়ে যায়।   

হোটেলের পাশে রয়েছে অসংখ্য খোলামেলা ফ্যামিলি স্যুট, প্রতি স্যুট কোয়ার্টারের সামনে রয়েছে পরিস্কার নীলজলের সুইমিংপুল, খোলা ময়দান, পুস্পবাগ এবং গাড়ি পার্কিং স্পেস। এই সেরালাগো রিসোর্টের বিরাট এলাকা জুড়ে দুই শতাধিক ফেমিলি স্যুট আছে। প্রতিটি স্যুটে দুই বিছানায় চারজন লোক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সোফা, ফ্রিজ, ওভেন, ইস্ত্রি, এসি, আলমিরা, ফোন ইত্যাদি সব লাইফ গুডসে এই ফেমিলিস্যুট সুসজ্জিত। রয়েছে ওয়াশ রুম ও গরমঠান্ডা পানির ব্যবস্থা।একটা লামসাম হিসাব করে দেখি এই রিসোর্টের দৈনিক আয় বিশ হাজার ডলারের কম হবেনা।

স্যুটের বাসিন্দা নর-নারী-শিশুরা দলবেঁধে সামনের সুইমিংপুলে সাতার কাটছেন। কোন এক উলঙ্গ শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীকে কাঁধে তুলে সুমিংপুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার স্পাউস একজন উলঙ্গ তরুণ। নুরজাহান তা দেখে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে বললেন এরা মানুষ, নাকি অন্য কোন গ্রহের লোক। আমি বললাম কেন ? বাংলাদেশে এরকম লাল টকটকে মোঠাসোঠা উলঙ্গ মানব মানবী কখনো দেখিনি। এদেরকে যে আমার ভিনগ্রহের মানুষই মনে হচ্ছে। বললাম এরা এইমাত্র স্বর্গ হতে বেরিয়ে আসা আদম এবং হাওয়া। তুমি তাদেরকে ভিনগ্রহের এলিয়ান মনে করলে কি হবে, এরাই যে বর্তমান পৃথিবীর আসল মানুষ। এই আধুনিক সভ্যতা এরাই গড়েছে।   

রাতে হোটেল লবি হতে ডিজনীওয়াল্ড দেখার জন্য ১১, ১২ ও ১৩ জুন এই তিনদিনে জন্য আমরা তিনজনের টিকেট কাটি। খরচ আসে ১২৫ ডলার x x ৩ = ১১২৫ ডলার। আমাদেরকে জানানো হল প্রতিদিন সকাল ৯টায় ডিজনীর গাড়ি এসে আমাদেরকে সারেলাগো হতে নিয়ে যাবে এবং রাত ১২ ঘটিকায় হোটেলে পৌঁছে দেবে।

ডিজনিওয়াল্ডে প্রবেশের আগে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এই বৃহত্তম আমেরিকান থিমপার্ক নিয়ে হালকাভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। পার্কটির আয়তন প্রায় ৪৫ বর্গমাইল যা ধারন করে আছে প্রায় ২৯০০০একর জমি। ফ্লোরিডার অরলান্ডো শহরের ধারে বে লেক এবং লেক বুয়েনা ভিস্তা এলাকায় এই পার্ক জন্ম নেয় আমাদের স্বাধীনতা বর্ষ ১৯৭১ সালের ১লা অক্টোবর। এই থিমপার্কের প্রতিষ্টাতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি, যার স্ট্যাচু আমরা পার্কের বাগানের একটি মঞ্চে দেখতে পাই। প্রতিষ্টানটি একদিনে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠতে সময় লেগেছে বছরের পর বছর। ডিজনিওয়াল্ডের বর্ধন, পরিবর্তন এবং সময়ের চাহিদার সাথে বিবর্তনের কাজ সব সময়ই বহমান আছে।  ডিজনিওয়াল্ডের প্রধান থিমপার্ক চারটি ১। ম্যাজিক কিংডম, এটি শিশুপার্ক ২। এপকট সেন্টার, এটি মহাকাশ ও বিঞ্জান পার্ক ৩। হলিউড স্টুডিও, এটি থ্রী ডাইমেনশন ছবি ও অভিনয় পার্ক ৪। এনিমেল কিংডম, এটি হল এশিয়ান, আফ্রিকান ও বৈশ্বিক সাফারি পার্ক ও গার্ডেন। প্রতিটি থিমপার্কে রয়েছে আড়াইহাজার গাড়ির পার্কিং মাঠ, চার পার্কের মধ্যে আছে আভ্যন্তরীণ বাস ও ট্রেন যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।

তাছাড়া এখানে আছে ৩টি ওয়াটার পার্ক, ২৭টি থিমহোটেল, বেশকিছু গলফ ময়দান, এন্টারটেইনমেন্ট ভেনু, আউটডোর সপিং সেন্টার, বিচিত্র বিচিত্র স্থাপনা, জলবাগান এবং স্থলবাগান এবং কয়েকটি নয়নাভিরাম লেক। এই বিশাল প্রতিষ্টানে কাজ করেন প্রায় পচাত্তুর হাজার কর্মি।  ১১ জুন ২০১৯ ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ি। এই হোটেলে খুব সম্ভব আল্লাহকে সেজদা করার মত লোকজন আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। পরে ভোরের আলোয় সেরালাগোর সুন্দর প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখি। হোটেলের ডাইনিঙয়ে বসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পিৎজা খেয়ে চা পান করি। এসময় হোটেলে বিপদ সংক্ষেত বেজে ওঠে। আমাদেরকে বের হতে বলা হলে গেটের বাহিরে এসে দেখি দুইটি ফায়ার সার্বিসের গাড়ি, সাথে রয়েছে ভারী অস্ত্রধারী পুলিশের দল। বিভিন্ন স্যুটের বোর্ডাররা এসে জড় হন। আমরা সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে আঁতকে যাই। কিন্তু পরে জানলাম বিষয়টা কিছুই না। হোটেল ভবনের কোথায়ও সর্ট সার্কিটের সংক্ষেত দিলে এত হৈ চৈ পড়ে যায়, যা আমাদের দেশে হলে কোন খবরই হতনা।

সকাল সোয়া ৯ টায় আলপনা আঁকা নীল কালারের একটি সুন্দর টুরিস্ট বাস আমাদেরকে নিতে আসে। বাসের গাঁয়ে লিখা ছিল ডিজনিওয়াল্ড। আমরা বিদেশীদের সাথে লাইন ধরে বাসে উঠি। কিসিমি এলাকার শ্যামল সবুজ পাহাড় ও জলাভূমি পেরিয়ে বাসটি অর্ধঘন্টা পর আমাদেরকে ডিজনিওয়াল্ডের এস্কট সেন্টারের বাসস্টেশনের ৪৮ নং টার্মিনালের নামিয়ে দেয় এবং সেরালাগো ফিরতে রাত ১১টায় এখানে এসে তাদের বাসে উঠতে বলে।

দিনটি ছিল বেশ গরম, যেন বাংলাদেশের এপ্রিল মাস। বৃক্ষের ছায়া দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। গেটে এসে আবার লাইনে দাড়াই। এখানে অজস্র মানুষের ভীড়, প্রথমে ব্যাগ দেহ পরীক্ষা, তারপর ভিতরে যাত্রা। আবার লাইন ধরে একটি মেশিনে টিকেট স্পর্শ করলেই সবুজ সংক্ষেত আসে। এবার স্বপ্নের ডিজনীওয়াল্ডে একটি থিমপার্ক এস্কট সেন্টারে আমরা তিনজন প্রবেশ করি। দিনটি ছিল গরম, মাথায় উপর সুর্যের চান্দিফাটা রোদ। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল কিছুটা ভিজে, শরীর ঘেমে যায়। কিন্তু ফ্লোরিডার গরমে গা ঘামছেনা, এই যা তফাৎ। প্রথম দিনেই আমরা হোঁচট খেলাম। ডাঃ নুরজাহান হাঁটতে পারছেন না, হাটুতে ব্যথা। ইজি চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলেও অচেনা জায়গায় খোঁজে বের করা যায়নি। এবার গরমে তার অবস্থা নাজেহাল। পথেপথে বৃক্ষছায়া আছে, রাস্থার পাশের বড়বড় ফ্যান জনতার উপর বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার পরও তিনি ব্যাঞ্চে বসে যান। তারপর পায়ের ব্যথায় শুয়ে যান। পানির বোতল শেষ করে স্বস্তি এলোনা। তাকে কোনমতে টেনে টুনে নিয়ে মঙ্গলগ্রহে যাবার স্পেসমিশনে নিয়ে যাই। আমরা তিন জনকে ব্যাল্টে বেঁধে নেই। পোষাকপরা রবুটিক পাইলটরা স্পেসশিপ স্টার্ট দেন। রকেট আমাদেরকে নিয়ে সুদূর আকাশে উড়াল দেয়। ধোয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন হয়ে আসে। রকেটটি আকাশ ফুড়করে অজস্র তারার মাঝদিয়ে মহাকাশে চলে যায়। বিশাল বিশাল গ্রহানুর কাছ দিয়ে উড়ে যায়। গ্রহানুর সাথে আঘাত লাগার ভয়ে গা শিউরে উঠে। লালমাটির উঁচুনিচু মৃত পাহাড় পর্বতঘেরা মঙ্গলের উপর দিয়ে স্পেসশিপ আবর্তন করে নিচের এক গিরিখাদের কিনারায় অবতরন করে। মঙ্গলের এক গভীর গীরিখাতের কিনারায় নামতে গিয়ে স্পেসশিপটি দুর্ঘটনায় পড়তে দেখে প্রান ভয়ে খাপছাড়া হবার উপক্রম হলেও পাইলটরা কোনমতে থামিয়ে দিতে সমর্থ হয়। এবার দরজা খোলে, আমরা বেরিয়ে আসি। এই মঙ্গলগ্রহ অভিযানের কোন কোন ইভেন্টে এতই ভীতিকর ছিল যে আমি দুচোখ বন্ধ করে আত্মরক্ষা করি। আর দুই একটা ইভেন্টে তিনজন অংশ নেই। এসকট সেন্টারে দুইঘন্টা অবস্থান করি। 

অসুস্থ শরীর নিয়ে নুরজাহান চৌধুরীর পক্ষে ডিজনীওয়াল্ডে অবস্থান করা আর সম্ভব নয় দেখে এবার বেরিয়ে আসি। হলুদক্যাবে ফিরে যাই সেরালাগো হোটেল স্যুটে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, তিন দিনের মধ্যে প্রথম দিনটাই বরবাদ। কিছুই দেখা হলনা, অথচ হেরে গেল তিনজনের একদিনের টিকেট ৩৭৫ ডলার। যাক তবে আল্লাহের মেহেরবানীতে দিনটা অন্য কাজে ব্যয় হল। নুরজাহান এবার দেশে ফোন করে ফুফুতো সেলিম ভাইয়ের কাছ থেকে তার শালিকা নাসু বোনের মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করেন। নাসু বোনকে ফোন করতেই তার স্বামী দেওয়ান ফয়জুল হক  গাড়ি চালিয়ে স্যুটে হাজির হন। আমাদেরকে নিয়ে যান কিসিমি এলাকায় তার বাসায়। দেওয়ান ফয়জুল হকের বাড়ি আমার নানাবাড়ির পাশে পাতারিয়ার পুর্বগাও। একসময় বাংলাদেশ বিমানে চাকুরী করতেন। অনেক অনেক আগে চাকুরী ছেড়ে আমেরিকায় এসে স্থিত হন। সদ্য কেনা তার বাসাটি খুব সুন্দর ও শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত। বাসার পিছনে বাগানসহ সুইমিংপুল। এখানে নাসু আপার রান্নাকরা নানাপদের মজাদার খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পুতুলের মত একটি শান্তশিষ্ট ফিলিপিনো শিশু এবাসায় সারাদিন থাকে। আমরা স্নেহ করলে রাগ দেখায়, কেবল নাসু আপার (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন