যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- চার
অসুস্থ শরীর নিয়ে নুরজাহানের পক্ষে ডিজনীওয়াল্ডে অবস্থান
করা আর সম্ভব নয় দেখে এবার বেরিয়ে আসি। হলুদক্যাবে ফিরে যাই সেরালাগো হোটেল
স্যুটে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, তিন দিনের মধ্যে প্রথম দিনটাই বরবাদ। কিছুই দেখা
হলনা, অথচ হেরে গেল তিনজনের একদিনের টিকেট ৩৭৫ ডলার। যাক তবে আল্লাহের মেহেরবানীতে
দিনটা অন্য কাজে ব্যয় হল। নুরজাহান এবার দেশে ফোন করে ফুফুতো সেলিম ভাইয়ের কাছ
থেকে তার শালিকা নাসু বোনের মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করেন। নাসু বোনকে ফোন করতেই তার
স্বামী দেওয়ান ফয়জুল হক গাড়ি চালিয়ে
স্যুটে হাজির হন। আমাদেরকে নিয়ে যান কিসিমি এলাকায় তার বাসায়। দেওয়ান ফয়জুল হকের
বাড়ি আমার নানাবাড়ির পাশে পাতারিয়ার পুর্বগাও। একসময় বাংলাদেশ বিমানে চাকুরী
করতেন। অনেক অনেক আগে চাকুরী ছেড়ে আমেরিকায় এসে স্থিত হন। সদ্য কেনা তার বাসাটি
খুব সুন্দর ও শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত। বাসার পিছনে বাগানসহ সুইমিংপুল। এখানে নাসু আপার
রান্নাকরা নানাপদের মজাদার খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পুতুলের মত একটি শান্তশিষ্ট ফিলিপিনো
শিশু এবাসায় সারাদিন থাকে। আমরা স্নেহ করলে রাগ দেখায়, কেবল নাসু আপার সাথে তার
সদ্ভাব। বিকেলে তার মা এসে নিয়ে গেলে আমরা বেড়াতে বের হই।
আমেরিকা নাসু আপাদেরকে সব দিয়েছে। ঢাকায় তাদের একটি ফ্ল্যাট
আছে, এখানে আছে আর তিনটি বাসা। প্রতিটি বাসা হতে প্রচুর ভাড়া আসে। কারে করে
অরলান্ডোর কিসিমি এলাকার বাসাগুলো নাসু আপা বিকেলে ঘুরে দেখান। বাংলাদেশের মত
তাদের বাসায় লাগানো আছে আম জাম ও লিচু গাছ। রাস্থা দিয়ে যেতে প্রচুর ওক এবং ম্যাপল
গাছের দেখা পাই। বাংলাদেশের মত রয়েছে ছন ও বাদা বন। এ যেন সুদূর আমেরিকায় আরেক
বাংলাদেশ। শেষে জানলাম কেবল আবহাওয়া কিংবা বৃক্ষলতা নয়, আয়তনেও ফ্লোরিডা উপদ্বীপ
একটি বাংলাদেশ। ফ্লোরিডার উত্তর ও পুর্বদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিনে মেস্কিকো
উপসাগর এবং পশ্চিম সীমানা কেবল আমেরিকার সাথে সামান্য জোড়া লেগে আছে। নাসু আপা
বললেন, আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করে এলে ভাল হত। হোটেলে না উঠে এখানে থাকতে পারতে
এবং ডিজনীতে কর্মরত কাউকে সাথে দিলে ভালভাবে সব দেখাতে পারতো। আসলে ডিজনীওয়াল্ড এত
বড় এবং জটিল যে জানা একজন গাইড ছাড়া সময়কে যথাযত ব্যবহার করে এখানে সবকিছু ঘুরে দেখা
সম্ভব নয়। আমরা তৃতীয় বিশ্বের লোকজন জানিনা, এখানে কি কি আছে। কোনটি দেখা বেশী
জরুরী কিংবা কোনটি কম জরুরী। কোনদিকে গিয়ে কি দেখতে হবে ও কোন ইভেন্টে কি আছে।
কোনটায় বেশী সময় বা বেশী মনযোগ দেয়া দরকার। আমাদের হাতে এখনও দুইদিন বাকী আছে।
নাসু আপার মেয়ে ডিজনীতে চাকুরী করতো। তাদের কাছ থেকে উপদেশ নিয়ে বাকি দুইদিন যথাযত
কাজে লাগানোর সিন্ধান্ত নেই। ডিজনীওয়াল্ডের ম্যাপ ও গাইড বুক আমার হাতেই ছিল। এই
হ্যান্ডবুকের সাহায্য ছাড়া ডিজনীওয়াল্ড যথাযত ঘুরে দেখা আদৌ সম্ভব নয়।
সাজেদা খালা, আমার শ্বাশুড়ি মলিকা খাতুন চৌধুরীর চাচাত বোন।
সাজেদা খালার জৈষ্ট্য পুত্র শামিম চৌধুরী কিসিমির বাসিন্দা। কিসিমি মসজিদের কাছেই
তার বাসা। এখানে এসেছেন প্রায় বার বছর হয়ে গেছে। তাদের ট্রিপ্লেক্স বাসায় এসে খুব
আদরযত্ন পাই। বড় বাসায় পুত্র, নতুন পুত্রবধু এবং তারা থাকেন। দেওয়ান ফয়জুল হক পাতারিয়ার
জমিদার বংশের লোক, তার মনটাও জমিদারের মত বিশাল। সারাদিন আমাদেরকে নিয়ে ঘুরাফেরা
করে গাড়ি চালিয়ে তিনি বেশ রাতে আমাদেরকে সেরালাগো হোটেল স্যুটে পৌছে দেন।
১২ জুন ২০১৯। আমরা তিনজন সেরালাগোর লবীতে গিয়ে লুফ, জেলী,
কলা ও ডিম সহযোগে ব্রেকফাস্ট করি। নুরজাহান বললেন ডিজনীওয়াল্ড যাবার তার কোন ইচ্ছে
নেই। আমার মনে হল তাকে রেখে যাওয়াই ভাল, সেখানে গিয়ে গতকালের অবস্থা হলে এই দিনটাও
মাটি হবে। তের হাজার মাইল দূর হতে ডিজনীওয়াল্ড দেখতে আসার শ্রম, অর্থ ও আনন্দ সব
ধুলায় লুন্ঠিত হবে। আমি ও জেফার লাইন ধরে ডিজনীওয়াল্ডের বাসে চড়ে বসি। নাসু আপার
সাথে ফোনে আলাপ করে পরিকল্পনা তৈরি করি। এই দিনটি সম্পুর্ন কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই।
একটির পর একটি ইভেন্টে লাইন ধরে প্রবেশ করি। ইভেন্টগুলোর বিবরন দিচ্ছি। স্পেসশিপ
আর্থে উঠে সারাটি পৃথিবী প্রদক্ষিন করে আসি। চোখের সামনে বিভিন্ন দেশের মানচিত্র ও
সেসব দেশের দর্শনীয় স্থান ও বিষয় ভেসে ওঠে। লিভিং উইথ দা ল্যান্ডে গিয়ে
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত ভুমির ব্যবহার ও ধাপে ধাপে কৃষি
উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করি। সয়ারিন এরাউন্ড দা ওয়াল্ড চড়ে পৃথিবীর প্রাচীন ও মধ্যযুগের
সপ্তম আশ্চর্য যেমন ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, রুমের কলাসিয়াম, মিশরের পিরামিড,
ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, তাজমহল, চীনের প্রাচীর, পেরুর
মিচুপাচু, উত্তরমেরুর হিমবাহ, এভারেস্ট শৃঙ্গ ইত্যাদি দেখা হয়। এপকটের পিছনের
লেকপারে গড়ে তুলা মেস্কিকো, নরওয়ে, চীন, জার্মানী, ইটালি, জাপান, মরক্কো, ফ্রান্স,
বৃটেন, ক্যানাডা ইত্যাদি দেশের নামে এসব দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক
স্থাপনা ও সংস্কৃতিধারক এক একটা ছোট এলাকা। এইসব ছোট্ট এলাকায় ডুকলেই সেখানে ঐ
দেশটার ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং বিশেষত্বকে সংক্ষেপে দেখা যায়। সকাল হতে গরমের
মধ্যে একটানা হাঁটা আমি ও জেফারকে অবসন্ন করে দেয়। বারবার পানি ও খাবার আমাদেরকে শক্তি
দিলেও আর যেন হাঁটা যাচ্ছেনা। ভিনদেশি আবহাওয়ায় অনাভ্যস্থতা সহজেই আমাদেরকে কাবু
করে ফেলে। আমার সংকল্প ছিল রাত এগারোটা পর্যন্ত একটার পর একটা ইভেন্টে অংশ নেবো।
কিন্তু বিকেল চারটার পর আর পারলাম না। একটি ক্যাবে চড়ে ফেরে আসি সেরালেগো স্যুটে। আমাদের
সাথে না গেলেও স্যুটে নুরজাহান বেগমের দিন ভালই গেল। তাকে এসে হাসিখুশিই পেলাম। হোটেলের
পরিস্কার কর্মি শ্বেতাঙ্গিনী বুড়ির সাথে তার বেশ ভাব জমে যায়। প্যান্টসার্ট পরা এই
মহিলার সাথে তার খাবার ও সৌজন্য বিনিময় হয়। বুড়ি আমাদের দেশী খাবার খেয়ে বেজায়
খুশী। তিনি আমাদের জানালার পর্দা ও কার্পেট পাল্টিয়ে দেন, সেইসাথে প্রচুর সাবান,
টিস্যু, ক্রিম এবং স্যাম্পু দিয়ে যান। দিনের হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত থাকায় বিকেলে
চোখজুরে নেমে আসে প্রশান্তির ঘুম। বিকেলে সারেলাগো পেরিয়ে ওপাশের রাস্থায়, বাগানে,
লবীতে ঘুরেফিরে রাত দশটা হয়। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পাড়ি, পরদিন সকাল ৯টায় আমাদেরকে যেতে
হবে ডিজনী অভিযানে।
১৩ জুন ২০১৯। গতকাল পিতাপুত্র মিলে বিঞ্জানের এতএত বিস্ময়কর লীলাখেলা দেখি যা আমরা আগে কখনও কল্পনা করতে পারিনি। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সিমুলেশনে যে এত কিছু আধুনিক বিঞ্জান ও টেকনোলজী তৈরি করতে পারে তা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে ধারনাতীত। তাহলে এই সিম্যুলেশন দিয়ে পৃথিবীতে কৃত্রিম স্বর্গ-নরকও তৈরী করে ফেলা সম্ভব। আমি ও জেফার চাইলাম নুরজাহান বেগম যেন এই চমৎকার রত্নাবলী দর্শন হতে বঞ্চিত না হন। গতকাল আমরা অপার বিষ্ময় নিয়ে একটার পর একটা ইভেন্ট দেখেছি আর সেই সাথে পসতাই আমাদের সাথি একজন এত টাকা খরচ করে এসে এত টাকার টিকেট করেও এসব দেখতে পারছেন না। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে। জেফার ও আমি বললাম, আজ এসো, আমরা ইজিচেয়ারে বসায়ে তোমাকে ইভেন্টে ইভেন্টে নিয়ে যাবো। তার জবাব না আমি যাবনা। এখানে দেখার কি আছে? তারচেয়ে এই স্যুটেই আমার আরাম।
সেরালাগো হোটেলের লবিতে হাঁটছি। স্যুট-কোট-টাইপরা রাজপুত্রের
মত স্মার্ট ও সুদর্শন একজন স্পেনিশ তরুণ আসেন। ভাবলাম তিনি হয়ত হোটেলের কোন
বড়কর্তা হবেন। ওমনি তিনি ঝাড়ু নিয়ে মেঝে ঝাড়ু দিতে লেগে যান। আসলে তিনি কেউকেটা
কেউ নন, একজন সামান্য পরিস্কার কর্মি। এখানে ছোট সাহেব বড় সাহেব বলে কিছু নেই।
সবাই মিস্টার ও সম মর্যাদার অধিকারী। হোটেল ডাইনিঙয়ে ব্রেকফাস্ট করে শেষমেশ আমরা বাপ-পুত
দুইজন নুরজাহান বেগমকে আরামে রেখেই ডিজনীর ট্যুরবাসে চড়লাম।
ম্যাজিক কিংডমের গেটে দেখি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মোমের পুতুলের
মত অপরূপ সুন্দর কিছু শ্বেতাঙ্গ তরুণ তরুনীকে নেচে নেচে গান গাইছে। এই গাড়ির চারপাশে
একঝাক সুসজ্জিত সুন্দরী আমেরিকান পোষাক পরে নেচেগেয়ে স্বল্পগতির ঘোড়ারগাড়িটিকে
আবর্তন করছে। ম্যাজিক কিংডম হেঁটে হেঁটে আমরা দেখতে থাকি। এখানে সব ইভেন্ট
বাচ্চাদের জন্য তৈরী। অদ্ভুদ সুন্দর ফোর-ডি ছবিগূলো শিশুদের জন্য সাজানো। কয়েকটি
ছবি সিনেমাহলে ডুকে পরখ করি। আমরা দুজনের কেউ শিশু নই। দোলনা, চরকা, খেলনাযান,
কার্টুন ইত্যদিতে সময় নষ্ট না করে ম্যাজিক কিংডম হতে ট্রেনে আমরা ছুটে গেলাম হলিউড
স্টুডিও। ম্যাজিক কিংডমের রাতের আতশবাজি ভূবন বিখ্যাত। ভাবলাম রাত ৮টার ফিরে এসে এখানকার
বিখ্যাত আতশবাজি উপভোগ করে নেবো।
হলিউড স্টুডিওতে বিশ্বের বিস্ময় জাগানোর মত অনেক অনেক ৪-ডি,
৫-ডি অত্যাধুনিক ফিল্ম এবং এডভেঞ্চার রয়েছে। এখানে বিশটি ইভেন্ট রয়েছে। আমরা বেশ
কয়েকটি ইভেন্ট উপভোগ করি। টাইম ইন ফরেভারে আমরা প্রাগৈতিহাসিক হোমোসেপিয়ান্স যুগ
হতে পাতর তামা লোহার যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন
চোখের সামনে যেন বাস্তবেই সংঘটিত হতে দেখি। স্টার ওয়ারের মহাকাশ যুদ্ধযান চড়ে
ভিনগ্রহের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহন করি। আমাদের রবোট ও
যুদ্ধারা চোখের সামনে মরনপর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সামনে ফ্রন্টলাইনে প্রচন্ড গোলাগুলী
ও লেজার যুদ্ধ হচ্ছে। কালোধুয়া এবং আগুনের লেলিহান শিখা আকাশকে জ্বলিয়ে দিচ্ছে।
গরমের হলকা এসে গায়ে লাগছে। আমরা ভীত হয়ে কখনো কখনো দমবন্ধ হয়ে যাই, না জানি কখন
যেন বোমায় বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। আমাদের যুদ্ধারা অতি সাহসিকতার সাথে লড়াই
করে শেষ পর্যন্ত দুষ্ট এলিয়ানদেরে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। রক্ষা পায় আমাদের এই
প্রিয় পৃথিবী। স্টার ট্যুরে বিগব্যাং হতে শুরু করে এখন পর্যন্ত ষোলশত কোটি বছরে
সংঘটিত তারা জগতের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ প্রত্যক্ষ করি।
একসময় একটি রাস্থা দিয়ে মানুষের স্রোত ধাবিত হতে দেখি।
ভাবলাম এত মানুষ যখন যাচ্ছে নিশ্চয় এদিকে ভাল কিছু হবে। আমরাও ছুটে গেলাম। পিছনে
এক পাহাড়ের ধাপে পাঁচটি দর্শক গ্যালারী এ, বি, সি, ডি এবং ই। প্রতিটি গ্যালারীতে
সাত-আট শত বসার সিট রয়েছে। এখানে দেখানো হবে ইন্ডিয়ানা জোন্সের এপিক স্ট্যান্ট
স্পক্টাকুলার। সামনে বিশেষভাবে নির্মিত বিশাল কাঠামো এবং মাঠে স্ট্যান্ট অভিনয়
মঞ্চস্থ হবে। বন্যার মত এগিয়ে আসা পশ্চিমা জনতায় গ্যালারীগুলো কানায় কানায় পূর্ন
হয়ে গেল। আমাদের সামনে এসে হাজির হন হলিউডের একজন সেলিব্রিটি নায়িকা। এই নায়িকার
নাম আমার মনে নেই, তবে মানুষ হাততালি দিয়ে যেভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করেছে তাতে সন্দেহ
নেই যে তিনি একজন বিখ্যাত নায়িকা। অনেকক্ষণ অভিনয় করলেন তিনি, আমি কিছুই বুঝিনি
তবে সবার হাসির ঝড় দেখে বুঝলাম রম্যরসের নদে উতলে উঠেছে জোয়ারের বান।
স্ট্যান্ট অভিনয় শুরু হল। মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসা অজস্র
বল্লমের আঘাত হতে নিজেকে রক্ষা করে এগিয়ে যান একজন অভিনেতা। সামান্য ভুল হলে একটি
বল্লমের আঘাতই তাকে এফুড় ওফুড় করে দেবে। উপর হতে নেমে আসা একটি বিশাল গোলাকার পাতর
ঠেলে আটকে দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন আরেকজন স্টান্ট। শ্ত্রুর আক্রমন হতে
রক্ষা পেতে তিনতলা, চারতলা ভবনের ছাদ হতে লাফিয়ে পরছেন নায়িকা, এসব ভয়ঙ্কর কান্ড
দেখে মনে হয় এই চিকন নায়িকা বুঝি আমাদের মত রক্তমাংশের মানুষ নয়, যেন রবারের তৈরি
বিড়ালী। প্রচন্ড গোলাগুলীর মধ্যে আত্মরক্ষা করে স্ট্যান্টদের এগিয়ে যেতে দেখে
গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। শত্রুর আক্রমনে প্রচন্ড বোমা বিস্ফোরণে সৈনিক ভর্তি গাড়ী
ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার দৃশ্যদেখে আফগান ও সিরীয় যুদ্ধের বিভৎস্যতা মনকে ক্ষনিকের
জন্য বিষন্ন করে দেয়। যখন ভাবছি বিস্ফোরিত গাড়ির সবাই নির্ঘাত মারা গেছে, ওমনি এই
জ্বলন্ত জীপ থেকে বেরিয়ে আসেন উচকো কুচকো স্টান্ট অভিনেতার দল। সামনের মঞ্চের এই
ভয়ঙ্কর স্ট্যান্ট অভিনয় কিন্তু পঞ্চ ইন্দ্রীয়ের সিমুলেশন নয়, এটি বাস্তব। হলিউডের
একদল স্টান্টের যথারীতি অভিনয় করা একটি শ্বাসত বাস্তব প্রদর্শন। হলিউডের একটি স্টান্ট
ছবি যেন আমাদের সামনে নির্মিত হতে দেখে অভিঞ্জতার ঝুড়ি পূর্ন করে নেই। বিগত তিনদিন
এতকিছু দেখে মনে মনে ভাবি, আমেরিকানরা আমেরিকানই, তারা কত কিছুইনা করতে জানে।
বাহিরের পৃথিবীর সাথে তাদের তুলনা হয়না, তারা অতুলনীয়। এক নিঃশ্বাসে প্রায় দুইতিন
ঘন্টা শেষ হল। সময় যে কিভাবে নিঃশেষ হল টেরই পেলাম না। বৈঞ্জানিক আইনস্টাইনের
আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে সময় ছোট কিংবা বড় হয়ে যেতে পারে যদি বস্তু আলোর গতিতে ছুটে।
সেদিন দেখি কর্মব্যস্ততার তীব্রগতি মানুষের সময়কেও দ্রুত বহায়ে ছোট করে দেয়।
ডিজনীওয়াল্ডে আমাদের সময়ের প্রবাহ যেন সজুরে বইছিল। এত এত কিছু দেখার, শেখার, কিছুই
বাদ দেবার নয়। কিন্তু সময় কোথায় ? বেরিয়েই জেফারকে বলি, চল ছুটে যাই এনিমেল কিংডম
নইলে এই থিমপার্কটি আমাদের ভ্রমন তালিকা হতে বাদ পড়ে যাবে।
এনিমেল কিংডমের গেটে গিয়েই আমরা আফ্রকান লাইভ কনসার্টের
সামনে পড়ি। একঝাক কালো নর্তক নর্তকি নেচেগেয়ে এলাকাটিকে উৎসবমুখর করে রেখেছেন। তাদের
সাথে সাদারাও নেচে গেয়ে একাকার। একটি সুবিশাল বৃক্ষের সামনে দাড়াই। অজস্র ডালপালার
বৃক্ষ দানবটি পল্লবঘন পুস্পে ভরা, ডালে ডালে বসে আছে প্রচুর বুনো পাখি। এতবড় বৃক্ষ
আমি জীবনে আর কখনও দেখিনি। লাইন ধরে মানুষ এই বৃক্ষের তলায় যেতে দেখে আমরাও গেলাম।
গিয়ে দেখি ওমা গাছটির কান্ডে দরজা আটা, দরজা দিয়ে ডুকে অনেকগুলো অফিসকক্ষ। আরে এটা
যে ঢালাই করে মানুষ্য নির্মিত একটি প্রকান্ড গাছ, বুঝার কোন উপায় নেই এটি বাহিরে
বৃক্ষ ভিতরে ভবন। এ যে বেহেশতের কল্পিত বহুতল বৃক্ষ ভবন। এখানকার অনেক ইভেন্টের
মধ্যে আফ্রিকান কিলিমাঞ্জারো সাফারি সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রচুর মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে
আছেন। আমি ও জেফার লাইনে দাড়াই। সারাদিন হাটাহাটি করে হাটু ও কোমরে ভীষন ব্যথা
নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ লাইন এগুচ্ছে অতি ধীর গতিতে। একটার পর একটা ট্রাক এসে
সামনের স্টেশন হতে লাইনের লোকজনকে নিয়ে যাচ্ছে। এখানকার কাটের কাজ, বাড়িঘর, রাস্থাঘাট,
ভবনছাদ সব আফ্রিকার ধাঁচে নির্মিত। এমনকি যে খোলা ট্রাকে আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে আরোহন
করি সেটির চালকও কালো আফ্রিকান এবং ট্রাকটির বসার চেয়ার ও ছাদ আফ্রিকান দড়ি দিয়ে
নির্মিত। ট্রাকটি এবড়ো তেবড়ো পথে উঁচুনিচু ঢালু বেয়ে মেটো পথে ধীর গতিতে চলতে শুরু
করে। এখানে মাটি লাল, শিলাময় পাহাড়ি এবং গাছপালা আফ্রিকা মহাদেশীয়। কোন কোন স্থানে
রাস্থার উপর দিয়ে বন্যার পানি বইছে। ট্রাক পানি ভেঙে এদিক ওদিক ঝাকুনি দিয়ে আগায়।
শৈশবে আমাদের দেশের রাস্থার এমন দশা প্রায়ই দেখেছি। ট্রাকটি যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমরা
আফ্রিকা মহাদেশের কোন এক পাহাড়ি বনভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। পথে পথে খোলা মাঠে
বিচরণরত বানর, সিংহ, উটপাখি, জেব্রা, জিরাফের পালকে খোলা বনে বিচরন করতে দেখি।
জলাভূমিতে কুমির এবং জলহস্থির পাল চোখে পড়ে। প্রায় দেড় ঘন্টা আফ্রিকার জঙ্গল ঘুরে
ট্রাকটি যখন স্টেশনে ফিরে এলো তখন বিকেল হয়ে গেছে।
আমরা সারাদিনের অবিশ্রান্ত পথচলায় ক্লান্ত শ্রান্ত। আমাদের
তিনদিনের ডিজনীর টিকেটের মেয়াদ আজ রাত ১২টায় শেষ হয়ে যাবে। ডিজনীওয়াল্ডে অনেক কিছু
দেখার ছিল। প্রথম দিনটি ডাঃ নুরজাহান বেগমের অসুস্থতায় বেস্তে যায়। দ্বিতীয় এবং
তৃতীয় দিনদুটি আমরা সাধ্যমত ব্যবহার করি। এখানে সংখ্যাতীত বিস্ময়কর ইভেন্ট রয়েছি
যা দুইতিন দিনে দেখা কোনমতেই সম্ভব নয়। আমরা গিয়েছি ফ্লোরিডার গ্রীষ্মকালে, এই
গরমে হেঁটে হেঁটে এক ইভেন্ট এলাকা হতে অন্য এলাকায় যেতে দেহমন ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই
সম্ভব নয় সকাল দশটা হতে রাত বারটা পর্যন্ত একটানা ঘুরে দেখা। অনেক ইভেন্ট তাই
দেখার বাকি রয়ে গেল। নাসু আপার সাথে ফোনে আলাপ হল। তিনি বললেন রাত আটটায় ম্যাজিক কিংডমে
অগ্নিবর্ষন ও আতশবাজির প্রদর্শন বিশ্ববিখ্যাত। একঘন্টার এই প্রদর্শনী যেন কোনমতে
মিস না করি।
আমরা এত ক্লান্ত হই যে বিশ্রাম প্রয়োজন। একটি ক্যাব ভাড়া
করে ছুটে গেলাম আমাদের অস্থায়ী নিকেতন সেরালাগো হোটেলে। ভোর পাঁচটায় অরল্যান্ডো
বিমানবন্দর হতে আমাদের প্লেন টেকঅফ করবে। একটি ক্যাব ভাড়া করি, রাত ৩টায় এসে
আমাদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাবে। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে রাত ৮টায় এসে ম্যাজিক
কিংডমের আতশবাজি অনুষ্টান দেখার সিন্ধান্ত নেই। কিন্তু স্যুটে গিয়ে দেখি ডাঃ
নুরজাহান বেগম খুব চিন্তিত, এমন কি অস্থিরতায় ভূগছেন। সারাদিন তিনি বাহিরের বাগানে
ও সুমিংপুলে হাটাহাটি এবং হোটেলের লোকজনের সাথে গল্পসল্প করে পার করেছেন। তিনি
স্যুটের টেলিভিশনে খবরে শুনেছেন ফ্লোরিডায় সামুদ্রিক ঝড় আসছে। এই খবরই তাকে ভীষন
চিন্তায় ফেলে দেয়। বিকেলে বৃষ্টি হয়, ঝড়ো বাতাস বয়, চারদিকে আমাদের কালোবৈশাখীর মত
একটা অন্ধকার নেমে আসে। রিসোর্টের পার্কিং খানিকটা গাড়িশুন্য হয়ে যায়। তিনি
মালামাল সব স্যুটক্যাসে ভরে নেন। আমি বলি রাত ৩টায় আমরা এয়ারপোর্ট যাব, তিনি বলেন,
না না এখনই চলো। ঝড় এসে গেলে যাওয়া যাবেনা, প্লেন মিস হয়ে যাবে। তাকে কোনমতে
বুঝাতে পারি নাই বিমানবন্দর মাত্র পাঁচচল্লিশ মিনিটের রাস্থা, চালক অবশ্যই তিনটায়
এসে বিমানবন্দর পৌছে দেবে।
এই ক্যাবচালককে ফোন দিলে সে ১০টায় এসে আমাদেরকে অরল্যান্ডো বিমানবন্দর পৌছে দেয়। মনটা খারাপ হয়ে গেল, ম্যাজিক কিংডমের রাতের আতশবাজি গোল্লায় গেল, অনেক অনেক মজার ইভেন্ট দেখা হলনা। প্রায় ছয় হাজার ডলার খরচ করে একটা গভীর অতৃপ্তি নিয়েই ফিরলাম। তবে ডিজনীওয়াল্ডের প্রতিষ্টাতা স্কট ওয়াল্টার ডিজনীর একটি অমব বানী সাথে করে নিয়ে এলাম ‘যদি তুমি স্বপ্ন দেখতে পারো, তাহলে তুমি সেটা করতেও পারবে’। অরল্যান্ডো বিমানবন্দর ঠান্ডা, সেইসাথে নির্জন এবং নিস্থব্ধ। সোফার নরম গদীতে ঘুমিয়ে গেলাম। এখানে মশা মাছি নেই, তাই চোখজুড়ে নেমে এলো শান্তির ঘুম। তিনটায় নুরজাহান বেগমের ডাকে আমরা বাপ-পুত জেগে উঠে বর্ডিং পাশের জন্য লাইনে দাড়াই। এখানে জেফারকে আলাদা করে নিয়ে কি যে পরীক্ষা নিরীক্ষা। স্পীট এয়ারের যানটি আকাশে ওড়ার খানিক আগে গিয়ে আরোহন করি। নিউইয়র্কে আর কিছুদিন কাটিয়ে ১৮ জুন ফিরে আসি বাংলাদেশে।(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন