বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০

সিঙ্গাপুরের ডায়রি পর্ব- দুই

সিঙ্গাপুরের ডায়রি  পর্ব- দুই

স্কাই ফ্লাইয়ার হতে নেমে ট্যুরিস্ট বাসে সাইট সিইং করতে বের হই। সিঙ্গাপুরের ট্যুরিস্ট বাস অতি উন্নত। দুতলা বাসের নিচতলায় চালক বসেন। এখান থেকে যাত্রীদেরকে এয়ারফোন দেয়া হয়। লম্বা গাড়ির পিছনে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত আসন কক্ষ। মধ্যভাগের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে উপর তলার পিছন দিক ছাদে ঢাকা এবং সামনা খোলা। দুতলায় সিটে বসে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে সবগুলো জায়গা ও স্থাপনার ইতিহাস ও বিবরন ইংলিশে শুনে শুনে সারাটা শহর ঘুরে দেখি। মানুষ্য সাজানো অসম্ভব সুন্দর দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর। ৫/৬ ঘন্টায় ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে এই সুন্দর ক্ষুদে দেশটি দেখা হয়ে যায়। দেশটিতে সমতল ভূমিই বেশী, তবে বেশকিছু টিলা ও প্রাকৃতিক বৃক্ষশোভিত ঘন বনভূমিও রয়েছে। রাত ৯টায় আমরা সিঙ্গাপুর সাফারি পার্ক দেখতে যাই। খুব ধীরগতির তিন বগী বিশিষ্ট খোলা ট্রেনে যাত্রা শুরু হয়। টিলা ও জঙ্গলাময় সুন্দর পার্কটিতে রাতের প্রাকৃতিক পরিবেশে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি দর্শন করি। বাঘ, সিংহ, হরিণ, ময়ূর, বনগরু, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু কিছুই বাদ পড়েনি। চিড়িয়াদের উপর ঘন বনের ফাঁক দিয়ে লাইটের আলো পড়ছে। কচ্চপ-গতি ট্রেনের অতি কাছে বাঘ, ভালুক, সিংহ, বানর, গরিলার মত হিংস্র পশুরা চলাফেরা করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গভীর রাতের ভূতুড়ে আলোয় হিংস্র প্রাণীদের সহিত সহবস্থান সত্যিই এক বিরল অভিঞ্জতা। রাত ১টায় সাফারি পার্ক দর্শন শেষ হয়। স্টেশনে নেমে বাহিরে এসেই পেয়ে যাই কয়েকটি টিলার ঢালু ও উপত্যকা জুড়ে সার্কাস ভেন্যু। টিলার ধাপে ধাপে সিঁড়ি কাটা, সিঁড়িতে বসার চেয়ার সাজানো। শত শত বিদেশী পর্যটক সিঁড়িতে বসে পশুপাখির নানা বিচিত্র ধরনের খেলা দেখছে। হাতী একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, একপা তুলে সালাম দিচ্ছে। মিরক্যাট ছোট ছোট বল কুড়িয়ে পাত্রে জমা করছে, বিশাল অজগর পাঁচ ছয় জন লোকের কাঁধে বসে আছে, তারপর একজন লোককে পেছিয়ে ভয়ঙ্কর হা মেলে আছে। কুকুরদল বল খেলছে, ঘোড়া লাফ দিয়ে উচ্চ দেয়াল পার হচ্ছে ইত্যাদি। রাত ২টায় সার্কাস হতে বের হয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনে লিটল ইন্ডিয়া স্টেশনে নেমে হোটেল স্টার এসিয়ায় ফিরে আসি।

২৯ জুন ২০১৩ রোজ শনিবার। ঐদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই একে একে গোসল করি। পরিচ্ছন্ন হয়ে বের হই এবং বাংলাদেশী হোটেলে খাবার খাই। হেঁটে একটু দূরে গিয়ে মোস্তফা প্লাজায় যাই। মোস্তফা প্লাজা রাস্থার দুই দিকে সুউচ্চ দুটি টাওয়ার, মাটির নিচে চারতলা যাহা রাস্থার নিচ দিয়ে এসে দুটি টাওয়ারকে সম্পুর্ন যুক্ত করে রেখেছে। বেশ বড় মার্কেট, এখানে গাড়ি, উড়োজাহাজ, ট্রেন, হাতী এধরনের পন্য ছাড়া প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া যায়। এক এক লেবেলে, এক এক দিকে, এক এক ধরনের পন্যের সমাহার। এখানে দ্রব্যমূল্য নিদৃষ্ট ও একদর। টোকেন গ্রহন করে লাগেজ বাহিরে রেখে মার্কেটে প্রবেশ করতে হয়। এখানে নগদে ও কার্ডে বেচাকেনা হয়। মোস্তফা প্লাজার মালিক একজন ধনী ভারতীয় মুসলিম। এই মার্কেটে তুলনামূলক সস্তায় ভাল মালামাল পাওয়া যায়।

অতঃপর আমরা মেট্রো ট্রেনে মেরিনা বে গমন করি। সেখানে সিঙ্গাপুর নদীর রিভার ভিউ পয়েন্ট হতে টিকেট করে সুন্দর পর্যটন নৌকায় আরোহন করি। নৌকাটি কাষ্টনির্মিত শব্দহীন যান্ত্রিক জলযান। সিঙ্গাপুর নদী, সিঙ্গাপুর নদীর মধ্যবাগ দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট্ট সুন্দর নদী। নদীটি কোথায়ও কোথায়ও প্রশস্থ লেকের আকার ধারন করে আছে। নদীর মোহনায় মেরিনা বের আয়তন ১০/১২ বর্গ মাইলের কম নয়।  একটি ডাইক নির্মান করে সাগর থেকে মেরিনা বে কে আলাদা করা হয়েছে। নদী এবং মেরিনা বের তটরেখা কোথায়ও পাতর দিয়ে কোথায়ও কংক্রীট ব্লক দিয়ে সুন্দরভাবে বাঁধানো রয়েছে। নদী ও হ্রদাকৃতির উপসাগরের তীরে তীরে গড়ে উঠেছে সুরম্য অট্টালিকার সারি। ভবনগুলোর কাচের আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে নীলজলে। ভবনমালার দৃশ্য নয়নাভিরাম। অসংখ্য সুরম্য সেতুর নিচ দিয়ে জলযানটি অগ্রসর হয়। বিভিন্ন যুগে নির্মিত সেতুগুলো সে যুগের চিহ্ন হিসাবে যুগযুগ ধরে একই ডিজাইনে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নদীর তীরে কিছু বাগান বাড়ি দর্শন করি। প্রতিটি বাড়িতে সুইমিংপুল রয়েছে। এক একটি বাড়ির মূল্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। নদীর মোহনায় মেরিনা ব্যারেজ নির্মাণ করে সমুদ্রের সাথে নদীকে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুর নদী প্রশস্থতায় আমাদের চেঙ্গেরখাল কিংবা সারী নদীর মত একটি ছোট্ট নদী। সিঙ্গাপুরবাসী নদীর মধ্যে কয়েকটি লেক তৈরি করে করে নদীটিকে অপরূপ সুন্দরের খনিতে পরিনত করেছে। নদীর মিষ্টিপানি ধরে রাখার জন্য মোহনায় বাঁধ নির্মাণ করে পানিকে একই নাব্যতায় ধরে রাখা হয়েছে।ফলে সিঙ্গাপুর নদীতে তেমন স্রোত নেই এবং এই সিঙ্গাপুর নদী ও এর হ্রদগুলোকে কেন্দ্র করে সিঙ্গাপুরের প্রধান বানিজ্য ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। মেরিনা বে তে নৌকার খুব কাছাকাছি সিঙ্গাপুরের জাতীয় প্রতীক মেরলায়ন পরিদর্শন করি। মেরলায়ন উপরের অর্ধেক সিংহ ও নিচের অর্ধেক মৎস্য আকৃতির আজব মূর্তি। সিংহের মুখগহ্বর হতে পানির ফোয়ারা অনেক দূর পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। 

প্রাচীনকালে একবার সিঙ্গাপুর সাগরে প্রবল ঝড় হয়। সিঙ্গাপুরের মানুষ তখন সমুদ্রের দেবতা মেরলায়নের দেখা পান। তার আগমনে সাগর শান্ত হয়ে আসে এবং সিঙ্গাপুর রক্ষা পায়। সেই থেকে মেরলায়ন সিঙ্গাপুরের জাতীয় প্রতীক। প্রাচীন সিঙ্গাপুরবাসীদের বিশ্বাস ছিল, দেবতা মেরলায়ন তাদেরকে বিপদাপদ হতে রক্ষা করেন এবং তিনি এই দ্বীপের সৌভাগ্যের বরপুত্র।

পর্যটন নৌকা হতে যে সুদৃশ্য বস্তুমালা পরিদর্শন করি এগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর ফ্লাইওভার, বে-পয়েন্ট সাউথ, মেরলায়ন পার্ক, এস্প্লেনেড থিয়েটার, অনন্যা বে, ফুলারটন হেরিটেজ, ফুলারটন হোটেল, বেফ্রন্ট ইত্যাদি। ওইদিন লান্স করি মেরিনা হোটেলে, মাথাপিছু খরচ হয় বিশ সিঙ্গাপুরি ডলার। অথচ লিটল ইন্ডিয়ায় খরচ হত মাত্র চার সিঙ্গাপুরি ডলার। সেদিন আমরা মেরিনা বেতে মেরলায়ন মনুম্যান্ট দেখি। সন্ধ্যার পর রাত নেমে এলে সেখানে আতশবাজি হয়। পানির অনেক নিচ হতে আতশবাজির আলো বের হয়ে আকাশে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে কামান দাগা হয়। মেরিনা ব্যারেজ হতে রংবেরঙ্গের রিমোট কন্ট্রোল ঘুড়ি সাগরের আকাশে উড়তে থাকে। ঐদিন জিন্নুনের ঢাকাইয়া বন্ধু রিমন আমাদের সঙ্গি ছিলেন।

৩০ জুন ২০১৩ সাল, রোজ রবিবার। ঐদিন সকাল ১০টায় ফারের পার্ক মেট্রোরেল স্টেশন হতে আমি, জিন্নুন, দারা মিয়া এবং খোকন ভূগর্ভস্থ ট্রেনে সন্তোষা স্টেশনে গমন করি। ঐদিনটি ছিল আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। ছোট্ট পর্যটন দ্বীপ সন্তোষায় আমরা মাথাপিছু ১৩৯ সিঃ ডলার পরিশোধ করে ট্যুর প্যাকেজ টিকেট সংগ্রহ করি। স্কাই টাওয়ারে আরোহন করে স্কাই ক্যাবল কারে সন্তোষা ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে গমন করি। প্রায় দুইশত ফুট উপর দিয়ে ক্যাবল কার চলতে থাকে। যাত্রী আমরা চারজন। ক্যাবল কারের মেঝে ছাড়া চারপাশে গ্লাস, নিচে সিঙ্গাপুর নদী এবং মেরিনা বের পর্যটন জাহাজ দেখা যাচ্ছে। বড় বড় তিন-চার তলা পর্যটন জাহাজ তিন-চার শত যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সুইমিংপুল যুক্ত অনেক সুরম্য কটেজ। সমুদ্রের উপর দিয়ে এই ক্যাবল কারে আমরা সুন্দর ছোট্ট দ্বীপ সন্তোষায় যাই। এখানে ক্যাবল কার স্টেশনে নেমে লিফটে ১৫০ফুট নিচে নেমে আমরা ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে প্রবেশ করি। একজন মহিলা গাইড আমাদেরকে খেলনা ট্রেনে করে সিঙ্গাপুর স্কাই টাওয়ারে নিয়ে আসেন। অত্যন্ত হাসিখুশি অর্ধবয়স্কা এই মহিলা কৌতুকের মাধ্যমে চীনাসুরের ইংরেজিতে সবাইকে আনন্দ দেন ও সিঙ্গাপুর সম্পর্কে বিদেশীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। আমি পার ক্যাপিটা ইনকাম অফ সিঙ্গাপুরি পিপল জানতে চাইলে তিনি হেসে হেসে বললেন, আমাদের অর্থমন্ত্রীকে এই প্রশ্ন করলে ভাল হয়। তিনি এর উত্তর ভাল জানেন।

সিঙ্গাপুর স্কাই টাওয়ার প্রায় হাজার ফুট উচ্চ একটি মিনারাকৃতির বৃত্তাকার টাওয়ার, যে টাওয়ারটির নিচে গ্রাউন্ড লেভেলের চারদিক পরিবেষ্টন করে একটি কাচের চাক্তি রয়েছে। গোলাকার চাক্তির মধ্য বৃত্তাকারে চেয়ার বসানো। ৫০/৬০ জন পর্যটক চাক্তির ভিতর প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করা হয়। চাক্তিটি টাওয়ারকে কেন্দ্র করে ধীর গতিতে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে থাকে এবং হাজার ফুট উচ্চতায় টাওয়ারের চূড়া স্পর্শ করে। সারাটা সিঙ্গাপুরের নদী, সমুদ্র, কৃত্রিম লেক, বাগান বাড়ি, সান্টেক শহরের সুরম্য অট্টালিকার অপূর্ব দৃশ্যাবলী তখন নয়ন দুটিকে বিমোহিত করে দেয়। তারপর চাক্তিটি ধীরে ধীরে আবর্তন করে নিচে নেমে এসে ভূমি স্পর্শ করে।(চলবে)

কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন