বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০

সিঙ্গাপুরের ডায়রিঃ পর্ব- তিন

সিঙ্গাপুরের ডায়রিঃ পর্ব- তিন

তারপর সিঙ্গাপুর জুরাসিক পার্কে প্রবেশ করি। এখানে কোটী কোটী বৎসর আগে বিলুপ্ত হওয়া নানা প্রজাতির পশুপাখির ফসিল ও ভাস্কর্য্য রয়েছে। সিঙ্গাপুর রোলার কোস্টার বেশ বিখ্যাত। অন্যরা ভয়ে বিরত থাকলেও জিন্নুন এবং আমি দুই ধরনের রোলার কোস্টারে আরোহন করি। কোমর ও গলায় ব্যাল্ট পরানো হয়। ভয়ঙ্কর গতি নিয়ে রোলার কোস্টার হেলেধূলে দৌড় দেয়। মনে হয় আছাড় মেরে ছাতু বানিয়ে ফেলবে। একসময় মাথা নিচে এবং পা উপরের দিকে চলে যায়। মানুষ পরাণ সপে চিৎকার দেয়। আমরাও গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে ভয়কে তাড়াই। এখানে রোলার কোস্টার চড়া এক সাহসী এডভেঞ্চার। রোলার কোস্টার হতে প্রতিবার নেমে অনুভব করি মাথা গরম হয়ে গেছে। প্রচন্ড কেন্দ্র বিমুখি বলের প্রভাবে হাতের আঙ্গুলের অগ্রবাগে রক্ত জমে লাল হয়ে আছে। 

তারপর আমরা প্রাচীন মিশরীয় মৃত্যুপুরী ও ভূতের দেশ পিরামিডে প্রবেশ করি। এক ভূতুড়ে রাস্থা দিয়ে মানব কংকাল স্থূপ পার হয়ে মমির দেশে প্রবেশ করি। এক অন্ধকার গা-শিউরে উঠা সুরঙ্গ খালপথ। পানির উপর নৌকা ধরণের ট্রেনে চড়ে সুরঙ্গ পথে প্রবেশ করি। ঘিসঘিসে অন্ধকারে মাংস খসেপড়া কংকালাকৃতির ভূত তেড়ে আসে। পথে পথে ভয়ঙ্কর গরিলা, বানর, নরখাদক ভয় দেখায়। হঠাৎ একটি দেয়ার এসে রেলপথ আটকে দেয়। ভয়ে আঁতকে যাই রেলটি বুঝি প্রচন্ড বেগে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সংঘর্ষ ঘটার আগ মূহূর্তে রেলগাড়ি পিছনদিকে ছুটে যায়, মনে হয় একটুর জন্য বাঁচলাম। এবার দেয়াল সরে যায়, রেলগাড়ি ভয়ঙ্কর নরকে প্রবেশ করে। আগুন প্রজ্জলিত নরক, ভয়জাগা তার রূপ। তারপর পুতুলাকৃতির প্রাণিজগত পেরিয়ে শুরুর পিরামিড স্টেশনে এসে নেমে পড়ি।

দেশবিদেশের পাঁচ ছয় শত মানুষের সাথে এবার একটি সুরম্য অডিটরিয়ামে প্রবেশ করি। লাল নীল বাতি জেলে উঠে রঙ্গমঞ্চে। একজন শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা কৌতুক অভিনয় করেন, হাস্যরসে উপচে পড়ে হল। মঞ্চের পাচটি দরজা দিয়ে আট দশ জন অভিনেতা এবং গায়ক গায়িকা এসে হাজির হন। অভিনয়ের সহিত পশ্চিমা সঙ্গীতের এক উচ্ছল মুচ্ছনা দর্শকদেরকে অপার আনন্দ দান করে।     

এই অডিটরিয়ামে সুন্দর অনুষ্ঠান উপভোগ করে আমরা এক সুরম্য থিয়েটারে প্রবেশ করি। স্পেশাল কালোগ্লাসের চশমা চোখে দিয়ে থ্রি-ডায়মেলশন সিনেমা দেখি। সাপ, মাকড়াসা, বিচ্ছু ইত্যাদি মনে হয় এসে গায়ে পড়ে যাচ্ছে, দর্শকরা ভয়ে চিৎকার করেন। সাধারণ টিভি পর্দায় ছবির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আসে কিন্তু থ্রি-ডায়মেলশন ছবিতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সাথে উচ্চতাও চলে আসে। ফলে মনে হয় ছবি যেন ছায়া নয়, বাস্তব ও জীবন্ত ঘটনা সামনে ঘটছে। 

সিঙ্গাপুর কার্নিভাল দর্শনের জন্য এবার আমরা একটি মার্কেটের নিচতলার রাস্থা পার হই। মার্কেটের গ্রাউন্ড লেবেলে নদী ধরনের সুইমিংপুল, যার বাউন্ডারি কাঁচঘেরা। এই সুইমিংপুলে শিশুরা নেমে প্লাস্টিকের নৌকা চড়ছে। প্রতি রবিবার সিঙ্গাপুর কার্নিভালের বিচিত্র মিছিল ও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আজ রবিবার আল্লাহের মেহেরবানীতে আমরা সিঙ্গাপুর কার্নিভাল উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করি।

সিঙ্গাপুরের চকচকে পরিস্কার রাস্থায় ও ফুটপাতে শত শত নর-নারী-শিশু পাশাপাশি বসে যান। বেশ কয়েক ধাপে কার্নিভাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম মিছিলে আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যেসব পশুপাখি বিচরণ করেছে এসব প্রাণীর মুখোশ পরে শতাধিক মানুষের মিছিল যায়। চাকাওয়ালা গাড়ির উপর বিভিন্ন প্রাণীর যান্ত্রিক বড় বড় পুতুলের নৃত্য সহকারে এই মিছিল পার হয়।

তারপর আসে প্রাচীন রোমান সভ্যতার মানুষের মিছিল। সেযুগের রোমান পোষাকে সুসজ্জিত বল্লমধারি সৈনিক এবং অভিজাত শ্রেণির লোকজন এগিয়ে যান। সেনাদলের মাঝে সে যুগের কাটের চাকার ঘোড়ার গাড়িতে দেখা পাই অভিজাতদের অবস্থান। 

প্রাচীন মিশরীয়দের মিছিল আমার মন কাড়ে। ঘোড়ার গাড়িতে বসা ফারাওয়ের মুকুটে ঈগলের মুখ, লাটিগুলোর অগ্রভাগে সাপের উদ্ধত ফনা। দুই লাটির মধ্যভাগে দু’পা রেখে প্রায় পনের ফুট উঁচু মানুষের মিছিল। পিরামিড আকৃতির গাড়িতে করে মমি কবরে নিয়ে যাওয়ার মিছিল মিশরকে ফুটিয়ে তুলে। আফ্রিকার জংলী অর্ধনগ্ন কালো মানুষের বিচিত্র নৃত্যসহ মিছিল মন কেড়ে নেয়। 

তারপর পাশ দিয়ে যায় নাঙ্গা তরবারি হাতে মুসলিম সুলতানকে ঘিরে ৭০/৮০ জন সৈনিকের মিছিল। এরা সবাই টুপি পরা এবং মুসলিম পোষাক পাজামা পাঞ্জাবি শেওয়ানি সজ্জিত। তাদের চেহারায় এক বেপরওয়া ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। মিছিলের শেষ পর্বে আধুনিক সভ্যতা এবং সিঙ্গাপুরের কৃষ্টি ও জীবন ফুটিয়ে তুলা হয়। সিঙ্গাপুর কার্নিভাল দর্শন আমার জীবনের এক বিচিত্র অভিঞ্জতা, ইতিমধ্যে তিনঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, বিকেল শেষে সন্তোষা পর্যটনদ্বীপে রাত নামছে।

এবার আমরা সামুদ্রিক প্রাণী দর্শনের জন্য এক বিশাল ফিস একুরিয়ামে প্রবেশ করি। ভূগর্বস্থ প্রবেশ পথের দেয়াল জুড়ে গ্লাসের একুরিয়ামে বিশ্বের সব ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, ঝিনুক, চিংড়ি, কাকড়া, শৈবাল, অক্টোপাস ইত্যাদি দেখা হয়। এমন কি পথের মেঝে স্থাপন করা গ্লাসের নিচে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সোনালি ইত্যাদি নানা বর্ণের অপূর্ব সুন্দর সামুদ্রিক মাছ বিচরণ করতে দেখি। অসংখ্য মাছকে জুনাকী পোকার মত জ্বলে নিভে আলো বিতরণ করে সাতার কাটতে দেখে মুগ্ধ হই। আমরা এক জায়গায় একটি বিশাল কাঁচের দিঘি আকারের একুরিয়ামে যাই। এই একুরিয়াম দিঘির চারপাশে স্টেডিয়ামের মত ধাপে ধাপে বসার জায়গা। এই দিঘি একুরিয়ামে সাতার কাটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমি মাছ। প্যাভেলিয়নে বসে এই তিমির দলকে দেখে মনে হল কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসলে এরা ক্ষণিকের মধ্যে আমাদেরকে খেয়ে সাবাড় করে দেবে। সমুদ্রের এত সব বিচিত্র ধরনের মাখলুকাত দর্শনের সুযোগ দানের জন্য দয়াময় আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া জানিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসি। ১৩৯ ডলারে টিকেট কেটে মনে করেছিলাম অনেক খরচ হয়ে গেছে কিন্তু সারাদিনের এত এত অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করে সান্তনা পেলাম টিকেটের ৮০০০/-টাকা পুরোটাই সার্থক হয়েছে।   

সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের একটি অত্যাধুনিক সুন্দর স্থাপনা। এটি দামি নির্মাণসামগ্রী দ্বারা নিখুঁতভাবে নির্মিত। রয়েছে চলন্ত বেল্টে চলার ব্যবস্থা। রয়েছে আর্কিড ও কুসুমবীথি সমৃদ্ধ বাগান। বাগানের মাঝখানে সুদৃশ্য রঙ্গীন মৎস্য একুরিয়াম, তার মাঝে এপাশ ওপাশ সেতু। সেতুর দুদিকে বসার সোফাসেট।

মালায়ান 'সিঙ্গা' শব্দের অর্থ ‘সিংহ’ এবং 'পুর' শব্দের অর্থ ‘দেশ’। তাই সিঙ্গাপুরের বাংলা অর্থ দাড়ায় ‘সিংহদেশ’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি রাষ্ট্রবিঞ্জানে মাস্টার্স অধ্যয়নকালে শত শত বছর টিকে থাকা গ্রীসের প্রাচীন স্বাধীন সার্বভৌম নগর রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে অবহিত হই। প্লেটো ও এরিস্টেটলের গবেষণায় উদ্ধৃত গ্রিক নগর রাষ্ট্র এথেন্স, স্পার্টা, থেবেস ইত্যাদি অধ্যয়ন করে কোন এক নগর রাষ্ট্র পরিদর্শনের ইচ্ছে জাগ্রত হয়। নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর সফর করে আমার সেই ইচ্ছে কিছুটা পূর্ণ হয়। (চলবে)

কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন