যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- এক
যাত্রাঃ ৫জুন ২০১৯ ফেরাঃ
১৮জুন ২০১৯ বিদেশ অবস্থানঃ প্রায় ১৪ দিন
প্রতিবছর আমেরিকা যাত্রাকালে আমি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্য একটি দেশ ভ্রমনের চেষ্টা করি। এবার টার্কি নয়তো মিশর যাবো এমনটি ভেবেছিলাম। তুরস্ক যেতে হলে টার্কি এয়ারলাইনে যেতে হয় অথচ এই এয়ারলাইনের টিকেটের দাম দেড়গুণেরও বেশী। কুয়েত এয়ারলাইনের টিকেট বেশ সস্তায় পেয়ে যাই। আমরা তিনজনের সাথে একই যাত্রায় শরীক হন আমার ভাগ্লা ডাঃ মুফতি শামসের শ্বাশুড়ি। তিনি সাথে থাকায় ও টিকেটের উচ্চমূল্যের জন্য তৃতীয় কোন দেশে সফর এবার বাদ দেই। আমি অফিস হতে মাত্র বারদিনের সাধারন ছুটি নেই, সেইসাথে আগেপিছে সাপ্তাহিক ছুটির চারদিন যোগ হয়ে ষোলদিন সময় পেয়ে যাই।
৪ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার। দিনটি ছিল ২৯ রমজান। রোজা রেখেই সিলেট থেকে গ্রীনলাইনে ঢাকা আসি। আজিজ ভাইয়ের বড় গাড়ি আমাদেরকে রাজারবাগ হতে ধানমন্ডির বাসায় নিয়ে আসে। পরদিন ৫ জুন রাত ৩.৩০ মিনিটে আমাদের ফ্লাইট। প্রত্যাশিত ঈদের চাঁদ দেখা গেলনা। তাই পরদিন ৩০রমজান শেষ রোজাটি ধানমন্ডিতে সমাপন করে রাত সাড়ে বারটায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি। জীবনে এই প্রথম একটা আনন্দের ঈদ আকাশপথে নিরবে হারিয়ে গেল। মজার মজার নাস্তা করার কিংবা নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের জামাতে যাবার কোন সুযোগই হলনা।
কুয়েত এয়ারপোর্ট বেশ
আধুনিক কিন্তু দুবাই আবুধাবির মত এত ব্যস্ত নয়। কুয়েত এয়ার লাইনের গ্রাহকসেবা বেশ
মানসম্মত। এবারের আকাশযাত্রায় কোন নতুন দেশে যাবার সুযোগ না হলেও আল্লাহের
মেহেরবানীতে সীমিত সময় কুয়েত দেখার সৌভাগ্য হয়। মাত্র সাড়ে সাত হাজার বর্গমাইল
আয়তনের ছোট্ট দেশ কুয়েত। সিলেট বিভাগের সাথে ব্রাক্ষনবাড়িয়া জেলা যোগ করে দিলেই একটি
কুয়েত রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সারাটা দেশ মরুভূমি, তারি মাঝে একটি মাত্র জনপদ কুয়েত
সিটি। ইরাক ও সৌদি পরিবেষ্টিত দেশটির দক্ষিনে কেবল পারস্য উপসাগর। আমরা যখন
দেশটিতে পা রাখি তখন প্রচন্ড গরমে দেশটি পুড়ে যাচ্ছিল। বাহিরে চোখ মেলে দেখি ঘাস
গাছ জ্বলে খড়ের মত হলুদ হয়ে আছে। লোকে বলল এবছর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গরম পড়েছে
কুয়েতে, আকাশ বাতাস যেন রোদে ঝলসে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে সর্বপ্রথম
তৈলখনি আবিস্কার হয়। তখনকার দিনে পৃথিবীতে উত্তোলিত তরল সোনার শতকরা বিশভাগই এখানে
পাওয়া যেত। শেখ শাসিত দেশটি খুব দ্রুত উন্নতির উচ্চশিখরে চলে যায় এবং পরিনত হয়
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রে কিন্তু দেশটির এই বিশাল সম্পদ একসময়
বিপদের কারন হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমুহের শকুন দৃষ্টি পড়ে
ক্ষুদ্র এই মরুদেশটির উপর। দখলবাজ নেকড়েরা দেশটিকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত করে। তারা
সবগুলো তৈলখনি ও স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেশটাকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। আমি
আবুধাবি ও দোবাই সফরকালে সেথায় যে আধুনিকায়ন দেখি, তা কুয়েতে হয়েছিল অনেক আগে
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জ্বলে ছাই হয়ে আবার সেই ছাই থেকে ফিনিশ পাখির মত গড়ে
উঠেছে আমার নয়ন সম্মুখের এই ধুসর ফ্যাকাসে কুয়েত। উন্নয়নের সাপলুডু খেলায় আমাদের
ঘুরে দেখা স্বপ্নময় দেশ আরব আমিরাত কেবল মই-ই বেয়েছে, অথচ কুয়েতকে মই বেয়ে অনেক
উপরে উঠে পড়ে যেতে হয় অজগরের মুখে। সেই অজগর তাকে গোগ্রাসে গিলে পাঠিয়ে দিয়েছে
খনিযুগের আগের জায়গায়। আমাদের স্বাধীনতা লাভের চার বছর পর ১৯৭৫সালে জন্ম নেয়া নবীন
রাষ্ট্র কুয়েত দ্রুত আগায়, আবার পিছায়। ধ্বংসস্থুপ হতে আবার শিরতুলে দাঁড়ানো
কুয়েতকে দেখে মনে হল ফিনিস পাখিরা কখনও মরেনা, মরলেও ছাই থেকে আবার জন্ম নেয়।
কুয়েত এয়ারপোর্ট হতে
আমাদের উড়ালযান টেকঅফ করে প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা পর নিউইয়র্কের জে.এফ.কেনেডি বিমানবন্দরে
অবতরন করে। সিলেটে আমাদের একজন আত্মীয়া বেয়াইনকে আমাদের সাথে নিয়ে আসি। তিনি হাঁটতে
পারেন না, ইজিচেয়ার তাকে একজন বয়ে নিয়ে যায়। সুদীর্ঘ্য যাত্রায় ব্যথাগ্রস্ত হয়ে নুরজাহান
বেগম একটা ইজিচেয়ারে বসে পড়েন। আমাদের সাথে আসা আত্মীয়াকে ইজিচেয়ারে একাকি আলাদা
লাইনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে জেফারকে তার সাথে দিলাম। আমরা দুইটি ইমিগ্রশন চেকআপ দিয়ে
ঢুকার জন্য লাইন ধরি। সার্টপ্যান্ট পরিহিত আমাদের ইজিচেয়ার চালক ছিলেন একজন ভারতীয়
স্মার্ট মহিলা, তিনি পাসপোর্ট নিয়ে গিয়ে কোন চেকআপ ছাড়াই আমাদেরকে পার করে দেন।
আমরা খুব খুশী হই কোন ইন্টারভিউ ছাড়া এই প্রথম আমেরিকায় ডুকলাম। নূরজাহান খুশী হয়ে
এই মহিলার হাতে একশত ডলারের একটি নোট তুলে দেন যদিও এই চেয়ারের ভাড়া মাত্র দশ ডলার।
চলমান বেল্টের কাছে বসে লাগেজ এবং ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় ত্রস্তব্যস্ত
হয়ে ছুটে আসেন আমাদের আত্মীয়া, এসেই বললেন আমার মেয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে ব্যাগটা
এখনই দেন আমি চলে যাব। জেফার কোথায়? বলতেই জবাব দেন তাকে আটকে রেখেছে। তিনি তার
ব্যাগের জন্য এতই তাগদা শুরু করেন যে তাকেও যেন এখনই আটক করে ফেলবে। আমার মনে হল
তিনি খুব দ্রুত বিমানবন্দর হতে প্রান নিয়ে পালাতে চাইছেন। বিরক্ত নূরজাহান তার
ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে রাগের সাথে বললেন এই নেন আপনার ব্যাগ। ব্যাগটি পেয়েই তিনি এক
নিঃশ্বাসে এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে যান। খুবসম্ভব তিনি ভীত সন্তস্ত্র ছিলেন জেফারের মত ইউ এস ইমিগ্রেশন যদি তাকেও আটকে রাখে।
আমি জেফারের সাথে দেখা
করতে গেলে সিকিউরিটি যেতে বাঁধা দেয়। গ্লাস দিয়ে দেখি সে আর অনেক লোকের সাথে একটি
কক্ষে বসে আছে। এবার নুরজাহান ইজিচেয়ার চালক ইন্ডিয়ান মহিলাকে ৫০ডলার এনাম দিয়ে
জেফারের খোজ নিতে পাঠান। সে এসে বলল চিন্তা করবেন না, খানিক পরীক্ষা করেই ছেড়ে
দেবে। গ্লাস দিয়ে জেফারকে দেখছি সে বিমর্ষ হয়ে কোনদিকে না চেয়ে বসে আছে। আমি অনেক
চেষ্টা করেও তার দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারলাম না।
নুরজাহান এই ভারতীয় মহিলাকে আর ১০০ ডলার দেন। এমনি এমনি ২০০ ডলার আমাদের অযথা গচ্চা গেল। ইতিমধ্যে জেফারের মা পুত্রের মুক্তির জন্য একটি গরুও মানত করে বসেন। গচ্চাটা এভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পেরিয়ে গেল। জে.এফ.কে.তে প্রায় তিনচার ঘণ্টা আমাদের খুব অশান্তিতে কাটে, নুরজাহান পূত্রের চিন্তায় কান্নাকাটি জুড়ে দেন। মনে খুব আঘাত লাগে জেফারকে আমাদের সাথে রাখলে এই বাজে ঝামেলায় পড়তে হতনা। আমার মত গরীবকে বিনা অপরাধে পঞ্চাশ হাজার টাকা দন্ডসুদ দিতে হতনা। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন