চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- চার
পথে আল এলিসাইট বিল্ডিং দেখলাম। এখানে নিচে মল ও উপরে বিশ্ব বানিজ্য কেন্দ্র। ইবনে বতুতা মল বেশ বড় বানিজ্য কেন্দ্র। ডুবাইয়ের লুলু মার্কেটে সস্থায় ভাল পন্য বিক্রি হয়, এযেন আমাদের হাসান মার্কেট। উন্নত এই দেশে প্রায় নির্মানকাজ এত শক্তভাবে করা হয় যে কয়েক যুগ আর সেখানে কাজের দরকার হয়না। খরচটা বড় হয় এবং একবারই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টো, এখানে অল্প বাজেটে দ্বায়ছাড়া গোছের নির্মান কাজ হয়, প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়। বছর বছর টাকা ঢালতে হয়। চট্টগ্রামের পতাঙ্গা বিচের কথা মনে হল, সেখানে প্রতি বছর পাতরের ব্লক বসান হয় ও প্রতি বছর ভেঙ্গে সাগরে তলিয়ে যায়। অথচ ডুবাইয়ে কৃত্রিম দ্বীপ ও উপসাগরে যে শক্ত বাঁধ নির্মিত হয়েছে তা শতবর্ষেও কিছু হবেনা। এ যেন এক স্থায়ী বিনিয়োগ।
চালক সালমান বললেন ডিসেম্বর হতে ফেব্রুয়ারী এদেশে পর্যটনের উপযুক্ত সময়। তখন এখানে আবহাওয়া এত গরম থাকেনা। এই সময় ইউরোপের শীতপ্রধান ধনী দেশসমূহে বরফ পড়ে, তাই ঠান্ডা এড়াতে এসব দেশের লোকজন ডোবাই এসে ভীড় জমান। দোবাইয়ের সাগরপারের বিচসমুহে বিদেশীদের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠে। হোটেল রেস্তুরা ও সপিংমলে গিজগিজ করেন বিদেশী ক্রেতারা। সালমান বললেন বোম্বের মাফিয়া ডন ভারতের মোষ্ট ওয়ান্টেড আসামী দাউদ ইব্রাহীম ডোবাইয়ে সংগোপনে বসবাস করেন। তিনি এখানকার রাজপরিবারের বন্ধু ও ব্যবসা পার্টনার। তিনি এখানকার একজন টাকার খনি, এখানে কেঊ তাকে ধরার ক্ষমতা রাখেনা। সারাদিন ডুবাই ঘুরে সালমানকে ৩০০ দিরহাম ভাড়া পরিশোধ করি। আমি লিখি জানতে পেরে যাবার বেলা ড্রাইভার সালমান বললেন আমার কথা স্মরণ রাখবেন, আমার কথা লিখবেন। আমি কথা দিলাম আমার একদিনের পাকিস্তানী বন্ধুকে অবশ্যই মনে রাখব। রিজেন্ট বীচ রিসোর্টে কিছুক্ষণ ঘুম দিয়ে বিকেলে জুমাইরা বিচে চলে যাই। এখানে আবহাওয়া গরম কিন্তু অনাদ্র। চারপাশে এলোমেলো বাতাস, ঘামহীন শুস্ক শরীরে গরম তেমন বিরক্তকর নয়। বরং বাতাস ও ঢেউ মনে তৈরি করে আনন্দের বন্যা। রাতে হেটে হেটে চলে চলে যাই ইন্ডিয়ান নওয়াব হোটেলে। চিকেন রাইছ, ফিস রাইছ, কোক, টক দই, সালাদ ও সস খেয়ে ৮৬ দিরহাম বিল পরিশোধ করে ফেরে আসি রাতের ঠিকানায়।
২৫ জুন ২০১৮ খ্রীস্টাব্দ, এই সোমবার দিনটি সুমাইয়া সীবিচের জলে সাতরে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেই। সুমাইয়া সীবিচে আমরা পাজামা পরে নামতে চাইলে বীচ কতৃপক্ষের নিযুক্ত শ্রীলঙ্কান পরিদর্শক এসে বললেন এই বিচের জলে হাফপেন্ট পরে নামতে হবে, পাজামা কিংবা ফুল প্যান্ট চলবেনা। হাফপেন্ট ও টাইট সর্টবসনে নতুবা বিকিনি পরে সাগরে নামা আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের পক্ষেও সম্ভব নয়, তিনি নিরবে সরে পড়লেন। আমার পূত্র বলল আমরা ডুবাইয়ের কিছুতেই ডুকিনি, কেবল বাহির হতে দেখেছি। এই সুন্দর বিচে সাঁতার কাটার সুযোগ ওকি মিছ করব। কাছের দোকানে ছুটলাম দুটি হাফপ্যান্ট কিনতে, কিন্তু দাম শুনে চক্ষু হল চড়কগাছ। দুটি হাফপ্যান্টের দাম বলল সাত হাজার টাকা। জেফার বলল, আব্বা বাদ দেন, দরকার নেই সাগরে সাতরাবার। আমি হাল ছাড়লাম না, ছুটলাম দুরের জুমায়রা বীচ মলে, সেখানে এই দোকানের সবচেয়ে সস্তায় সাড়ে তিন হাজার টাকায় দুইটি হাফপ্যান্ট কিনলাম। মনে হল এই টাকাগুলো যেন সাগরে সাতারে নামার খাজনা বাবদ খসে গেল। এই বীচটির অবস্থা এতই নগ্ন ও উদোম যে এটাকে কোন মুসলিম দেশের সীবিচ মনে হয়না। দেখলাম এখানে প্রচুর পশ্চিমা নরনারীরা নগ্নদেহে সমুদ্রস্নান করে সোনালী বালিতে গড়াগড়ি করছেন। আমরা থাইল্যান্ডের ফুকেট সিবিচে পাজামা পরে নামলেও এখানে হাফপেন্ট পরে নামতে বাধ্য হই। সৈকতে একদল সরকারী পরিদর্শক ও দক্ষ সাতারু টিম নজরদারী করেন। তারা সৈকতের আইন কানুন তদারকি করেন ও কেউ বিপদগ্রস্ত হলে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করেন। সৈকত হতে প্রায় দুইশত ফুট সাগরের গভীরে বেলাভুমির সমান্তরালে একটি দড়িটানা রয়েছে। দড়িটি ভাসিয়ে রাখে আনেকগুলো বড়বড় রাবারের বায়ুভর্তি বল। দড়ি ও বলের এই নিরাপত্তা রেখা সাতরে অতিক্রম করা নিষেধ। কেউ সমুদ্রে নেমে ভেসে গেলে এই দড়ি ধরে ভাসে থেকে প্রান বাঁচাতে পারেন। এই দড়িটি ঢেউয়ের তালে তালে জলের উপর নীচ উঠানামা করে। বেশিক্ষন সাগরে থাকার জন্য আমরা সিন্ধান্ত নিলাম চোখ জলে ভিজতে দিবনা, গরম মনে হলে মাথায় পানি ডেলে পিছনদিকে ফেলে দেব। পাশের ওয়াটারপার্কে জলের নলদিয়ে পিছলে পড়া বাচ্চাদের চিৎকার আসছিল। সুমাইয়া সিবিচের একদিকে নেমে সাতরে দড়ির বল স্পর্ষ করে এসে অন্যপ্রান্তে ছুটলাম, প্রায় এক ঘন্টা সাতরে শেষ সীমারেখা ছুইলাম। কয়েকবার সাতরে নিরাপত্তা বলের কাছে দড়িতে বসে উদ্দাম বাতাসে জিরিয়ে নিলাম। এত বড় বল যা একজন মানুষের পুরোভার বহনে সক্ষম। অন্যপ্রান্ত হতে সাতরে ফিরে এসে দেখলাম প্রায় তিনঘণ্টা পার হয়ে গেছে। বিকেল ৫টা বেজে গেছে। জেফার সাঁতার কেটে কেটে পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। আমার সাগরে থাকার স্টেমিনা থাকলেও তার আর নেই। এবার সমুদ্র হতে উঠে সাগরপারে স্থাপিত মিষ্টজলের ফ্রিঝর্নার নিচে গোসল করে সাগরপারের ফ্রি ড্রেসিংরূমে পোষাক পাল্টে পরিপাঠি হয়ে রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে ফিরে এলাম।
২৬জুন ২০১৮সাল, মঙ্গলবার। রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে আজ ২টা পর্যন্ত আমাদের থাকার অধিকার থাকা সত্তেও আমরা এখানে ফ্রিলান্স সমাধা করে সকাল ১০টায় আবুধাবীর উদ্দেশ্যে বের হলাম। ইতিহাদের ফ্রি বাস ধরতে টেক্সিক্যাবে ছুটলাম মাজায়া সেন্টারের ইতিহাদ অফিসে। যাবার বেলা ভাড়া ৩৫ দিরহাম দিলেও এবার সেই জায়গায় এসে দিলাম মাত্র ১৫ দিরহাম। নিশ্চয়ই আগের দুষ্টচালক ঘুরপথে গিয়ে মিটারে বেশী বিল তুলেছে। মাজায়া সেন্টারে এসে টিকেট দেখিয়ে বাস পেলাম। ভারি সুন্দর এই মাজায়া সেন্টারে ঘন্টা দেড়েক হাঁটাহাঁটি ও অপেক্ষার পর ১২-৩০টায় বিনে ভাড়ার ইতিহাদের বাসটি যাত্রা শুরু করে ২-৩০মিনিটে আবুধাবী বিমানবন্দরের টার্মিনালে এসে থামল।
আবুধাবী দেশটির রাজধানী শহর। একটি টেক্সিক্যাব থামিয়ে চার তারকা ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হোটেলের ঠিকানা আল সালাম রোড দিতেই চালক চিনে ফেলেন। জায়গাটি শহরের গুরুত্বপূর্ন আল নাহিয়ান ক্যাম্প এরিয়া। গাড়িটি শনশন করে শহরের বড় রাস্থার সারি দিয়ে ছুটল। পথে এই শহরের প্রায় সব স্থাপনা দেখা হয়ে গেল। এক ঝলকের জন্য তাজমহলের মত দেদীপ্যমান শেখ জাহেদ গ্রেন্ড মসজিদ দেখলাম। এই মসজিদের বিশালতা দেখে সিন্ধান্ত নিলাম হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আজ বিকেলে এই সুন্দর মসজিদ দেখতে আসবই। কারন কালকে সময় নেই, ঢাকার ফ্লাইট ধরতে সকাল ৯টায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। প্রায় চল্লিশ মিনিটে পূরো শহর ঘুরে এবার সাগরপারের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হোটেলে নামিয়ে ক্যাবচালক চলে যান। কিছুলোক দৌড়ে আসলেন ব্যাগেজ নিতে, আমরা সুযোগ না দিয়ে নিজেরাই বয়ে নিলাম। আমি রেসিপশনে গিয়ে বললাম আমরা অন লাইনে দেখে এসেছি, এখানে তিনজনের ফেমিলি স্যুট ৬৫ আমেরিকান ডলার। তারা বলল, হ্যাঁ, আপনাদের অনলাইন বুকিং রিসিপ্ট দেন। আমি বুকিং করিনি বলতেই বলল অন লাইন বুকিং হলে ৬৫ ডলারে থাকতে পারতেন কিন্তু এখন ৪৫০ ডলার লাগবে। এই চার তারকা হোটেলে তাদের গাড়িতে ফ্রি শহর ভিজিটের সুযোগও অন্তভূক্ত ছিল। অবাক হলাম অনলাইনে বাংলাদেশ হতে বুকিং করা থাকলে যেখানে লাগত মাত্র ৬৫ ডলার, তা এখন হয়ে গেছে ৪৫০ ডলার, অথচ আমরা থাকব মাত্র বার তের ঘন্টা। মনে হল এটা কাষ্টমারকে কাবু করা, সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের অন্যায় কাবুতে পড়বনা, এই চার তারকা হোটেলে থাকবনা। তাদের কাছে আশপাশের হোটেলের ঠিকানা চাইলে দিলনা, বলল, অনলাইনে খোঁজে নিন। গেটে যেতেই পাকিস্তানী প্রহরীরা বলল আপনারা ফিরে আসলেন কেন? আমরা বুঝিয়ে বললে তারা একটি ট্যাক্সি ডেকে ‘সেন্ট্রাল ভিল’ নামক কাছের এক হোটেলে পাঠাল ও বলল সেখানে ১০০ ডলারের মধ্যে আপনারা থাকতে পারবেন। ১০০ ডলার পরিশোধ করে ও ১০০ দিরহাম জামানত দিয়ে চারতলার রুমে ডুকলাম। একশত দিরহাম জামানতের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানালে হোটেলের চীনা রেসিপশনিষ্ট বললেন এটা তাদের হোটেলের নিয়ম, হোটেল ত্যাগকালে এই ১০০ দিরহাম ফেরত দেওয়া হবে। এখানে রুমটি দোবাইয়ের হোটেলের চেয়ে আর বড় ও হাইফাই। গরম জলে গোসল করে একটু ঘুমিয়ে নেই।
বের হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবুধাবীর বিখ্যাত কিং জাহেদ গ্রেন্ড মসজিদ দেখতে ছুটলাম। একটি ভবনে নেপালী প্রহরীরা আমাদের নিরাপত্তা চেকিং করেন ও পরে মেটাল ডিটেকটিভ নিরাপত্তা লাইন পার হয়ে আমরা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করি। তখন বিকেলের রোদের তেজ কমে এসেছে। একটি সুবিশাল টিলার উপরিভাগ সমতল করে বিশাল এক বাগান ও কয়েকটি জলাশয়ের মাঝে অতিকায় মসজিদটির অবস্থান। মসজিদ আবর্তনকারি জলাধার সমুহে পানির গভীরতা হবে মাত্র দুই তিন ফুট। জলাধার আবর্তন করে আছে পুষ্প উদ্যান ও খেজুর সহ নানা বৃক্ষের অপূর্ব সমাবেশ। বাগানটি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে। মসজিদের সামনে তিনটি চত্বর জুড়ে পানির ফোয়ারায় জলের চন্ডাল নৃত্য বইছে। মসজিদটির সুউচ্চ চার মিনার সারাটা আবুধাবী শহর হতে দৃষ্টিগোচর হয়। এই মসজিদের মিনার ও গম্বুজের চুড়ায় বসান টন টন সোনা সুর্যের কিরনে চকচক করতে দেখা যায়। উপরের বিশাল সুরম্য মিনার ও গম্বুজগুলো ইসলামের স্বর্নযুগকে স্মরন করিয়ে দেয়। শত শত বিদেশী বিধর্মী লোকজন মসজিদে ও বাহিরের চত্বরে মহানন্দে ঘুরে বেড়ান। শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় ও চীনা নারীরা মসজিদের প্রবেশকক্ষে রাখা নীলাভ বোরকা পরে সারা মসজিদ ঘুরে বেড়ান ও সেলফি উঠান। মনে হল এসব বিধর্মী নারীরা জীবনে প্রথমবারের মত বোরকা পরার মজা বেশ ফুর্তি করে উপভোগ করছেন। অনভ্যস্ততার কারনে কারো লাল ও সফেদ পা, কারো কাল লাল ও সোনালী কেশধাম বোরকা বেদ করে বেরিয়ে আসছে।
মসজিদের ডানদিকের বাগানের শেষসীমায় একটি তিন গম্বুজ এবাদাতখানার সামনে একটি সাদামাঠা কবরে ঘুমিয়ে আছেন কিং জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতির জনক। কবরগাহ পরিবেষ্টন করে আছে গ্রীলের বেড়া। একজন প্রহরী এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বেড়ার ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কবরটির চারদিকে অনুচ্চ পাকা দেওয়াল, শিরোভাগে কবরফলক, কবরের উপর হলুদ বালির আস্থরন। এই ছোট্ট এবাদাতখানা হতে সব সময় ক্যেসেটে কোরান তেলাওতের মধুর সুর ধ্বনিত হয়। তবে কাউকে কবরটি জেয়ারত করতে দেখিনি, খুবসম্ভব এদেশে কবর জেয়ারতের তেমন প্রচলন নেই।
ক্ষুধা লাগলে পাশের স্নেক্সবারে ঢুকে গরম চিকেন বার্গার কিনে তিন জন মিলে খেয়ে বের হই। বেরিয়ে এই মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায়ের জন্য তৈরী হই। এখানে বিচরণকারী লোকজনের মাত্র বিশ পচিশ শতাংশ লোক মুসলিম, বাকিরা বিধর্মী। মক্কা মাদিনার মত সুললিত কন্ঠে আজান হল। আমরা মাটির নিচের অপূর্ব ডিজাইনের শীতল অজুখানায় অজু করে পিছনের বড় মসজিদে ছুটলাম। মসজিদের ডানদিকে নারীরা ও বামদিকে পুরুষরা আলাদা অজু খানায় অজু করে বড় মসজিদে ডুকে মধ্যে পর্দা টেনে জামাতে একই লাইনে দাড়িয়ে নামাজ পড়েন। জামাত চলাকালে অজস্র বিদেশী নরনারী মসজিদের ভিতর ও বাহিরে বিচরন করে মুসল্লীদের নামাজ পরার দৃশ্য অবলোকন করেন। মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়ে বেরহয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমরা মসজিদের ঝমকাল আলোকসজ্জা উপভোগ করে বাহিরে এসে হোটেল সেন্ট্রাল ভিলে ফিরলাম। তখন রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। কাছে কোন ইন্ডিয়ান হোটেল পেলামনা। নিতান্ত বাধ্য হয়ে একটি সিফুডের হোটেলে ডুলাম। থাই নারীরা এই হোটেল পরিচালনা করছেন। কয়েক প্রকার সীফিস সহযোগে রান্না করা পোলাও খেতে খুব মজাদার, সাথে আসল সালাদ, পাপড়, ডুমুর, ক্যাপ্সিক্যাম, গাজর, সস, আচার, টকদই ইত্যাদি। ইন্ডিয়ান হোটেল খোঁজে না পাবার হতাশা নিমিষেই কেটে গেল। প্রচুর খাবার রয়ে গেলে তারা প্যাক করে দিয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত খাবারে পরদিন ব্রেকফাস্ট হয়ে যায়। সকাল ১০টায় হোটেল সেন্ট্রাল ভিল ছেড়ে আবুধাবী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৪নং টার্মিনাল দিয়ে প্রবেশ করি। তিন ঘন্টা পর ইতিহাদের বিমান ঢাকায় যাত্রা শুরু করে পাঁচ ঘন্টা পর ঢাকায় রাত ৯টায় অবতরন করে। সমনদিক আজিজ ভাইয়ের ড্রাইভার খোকন তার কালগ্লাসের দামি গাড়িতে করে আমাদেরকে ধানমন্ডির লেকপারের বাসায় নিয়ে যায়। আমরা আজিজ ভাইয়ের নিউইয়র্কের বাসায় ছিলাম। দেশে এসে আবার দুইরাত তার খালিবাসায় বিশ্রাম নিয়ে গ্রিনলাইনের দুতলা বাসের উপর তলায় বসে সিলেট ফিরলাম।
সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বংশগত শেখতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দেশ। সাতটি রাজ্য শাসন করেন সাতটি শেখ পরিবার। তারা প্রেসিডেন্ট ও প্রধাননন্ত্রি নিয়োগ করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জাহিদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান এবং প্রধান মন্ত্রি মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম। দেশটি আয়তনে আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ছোট, মাত্র ৩২,৩০০ বর্গমাইল। রাজ্যগুলোর নাম আবুধাবি, ডুবাই, সারজাহ, ফুজাইরা, আজমান, রাস আল খাইমাহ ও উম আল খোয়াইন। দেশটির তিনদিকে কাতার, সৌদি আরব ও ওমানের সীমান্তরেখা ও পুর্ব দিকে রয়েছে পারশ্য উপসাগরের সুদীর্ঘ্য তটরেখা।
আমিরাতের মোঠ জনসংখ্যা মাত্র ৯২ লক্ষ ৭০ হাজার, কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল এই জনসংখ্যার মাত্র ১২% স্বদেশী আরব নাগরিক, বাকী ৮৮% মানুষই বিদেশের লোকজন। এখানে ভারতীয়দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ২৭*৮০%, তাছাড়া পাকিস্তানী ৯*৫০%, বাংলাদেশী ৬*১০%, ফিলিপাইনী ২*২০%, চীনা ২*২০% এবং অন্যান্য দেশের ১৫*১০% লোকজন বসবাস করেন।
এখানে সরকারী ভাষা আরবী ও ইংরেজী। তবে হিন্দির প্রচলন রয়েছে। এখানকার বানিজ্যে ভারতের মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের প্রবল দাপূটে আধিপত্য। ভারতীয়রা এই দেশের সব কিছু দিকভাল করেন। চীনারা এগজিকিউটিভ লেবেলে কাজ করেন। পাকিস্তানীরা প্রহরী ও গাড়ি চালক এবং বেশিরভাগ বাংলাদেশিরা পরিচ্ছন্নতা কর্মি, বাগান ও নির্মান শ্রমিক। ফিলিপিনো মেয়েরা করে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত নানা ধরনের ভাল আরামদায়ক চাকুরী। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির লোকজন এখানে স্বাধীনভাবে নিজেদের মত অবাধে চলাফেরা করেন। দোবাইকে মনে হয় পশ্চিমা ও ভারতীয় সংস্কৃতির লীলাভূমি। আরব সংস্কৃতির মানুষ অল্পই দেখা যায়। এই দেশটিতে সমানতালে আমিরাত দিরহাম ও আমেরিকান ডলারে লেনদেন হয়। দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৮,৪৩৬ আমেরিকান ডলার। মুসলিম দেশ হলেও এখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্ম নিয়ে কোন হৈ চৈ নেই। আইন শৃংখলা প্রায় সিঙ্গাপুরের মত উন্নত। এখানে মানুষ সুখী সুন্দর এক সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করেন। (শেষ পর্ব)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন