চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- তিন
হোটেল হতে রাত ৮টায় বেরিয়ে রাতের জুমায়রা বিচের রূপসুধা পান করতে ছুটলাম। বিচটির দূরত্ব মাত্র চারপাচ মিনিটের হাঁটার রাস্থা। বিশ্বের সেরা স্থপতিরা হয়ত জুমায়রা বিচদুটি সৈকতের সুসজ্জিত উপশহরসহ ডিজাইন করেছেন। দুইটি জুমায়রা বিচের মধ্যখানে মানব সৃষ্ট একটি ছোট উপদ্বীপ, দুটি বিচের অন্য দুদিকে পাতরের জমাটবদ্ধ বাধে পারস্য উপসাগরের ঢেউমালা আচড়ে পড়ে। আর প্রবলশক্তি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে প্রতিটি খানিক বৃত্তাকার বিচের স্বচ্ছ বালির বেলাভূমির দৈর্ঘ্য হবে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার। বিচপারের উপশহর রাতে এক রঙ্গীন স্বর্গরাজ্যের রূপ ধারন করে। এই দুই জুমায়রা সৈকত যেন অপূর্ব সুন্দর ঘুঙ্গুর হয়ে সেজে আছে পারশ্য উপসাগর নামক কোন এক অপরুপা রমনীর রাঙ্গা দুটি পায়। স্তরে স্তরে সাজানো রাস্থামালা, রাস্থার উপর জুড়ে মশারির মত বর্নিল লাইটের জাল রাতকে যেন দিনের মত উদ্ভাসিত করে তুলে। দুইরাস্থার মাঝঘিরে পরিপাঠি ফুলবাগ ও বৃক্ষসজ্জায় সুসজ্জিত বার,সপিং মল, রেস্তুরা, ব্যায়ামাগার, গেইম স্পট, নানান দেশের খাবার হোটেল, এমুজমেন্ট পার্ক, পোষাক গহনাসহ নানা পন্য বিক্রয়কেন্দ্র ও পাঁচ তারকা আজস্র আবাসিক হোটেলের মিলন মেলা। খেজুর গাছ পেছিয়ে টপ পর্যন্ত সজানো লাইটিং বেশ মনমুগ্ধকর। মৃদু মধুর মুর্চনায় বাজছে হিন্দি আরবী ও পশ্চিমা সঙ্গীতের সুর লহরী। বিচের আবছা আলোয় মৃদুমন্দ হাওয়ায় আমার দৈনন্দিন চল্লিশ মিনিটের হাটার পর্বটা সেরে নিলাম। সৈকতে অনেকক্ষন আমরা তিনজন হাঁটাহাঁটি করে রাত ১১টায় রিসোর্টে ফিরে এলাম।
২৪জুন ২০১৮সাল। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙ্গল। ডাঃ নুরজাহান ও জেফার তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। জানালায় পর্দা সরিয়ে বাহিরে চোখ রাখলাম। পাশে চারটি সমউচ্চ খেজুরগাছ জানালার সমতলে হলুদ ফলে ছেয়ে আছে। এক একটি গাছে অন্ততঃ দুইমন করে খেজুরফল ঝুলে আছে। এই খেজুর বৃক্ষদেরে খুটি করে তেরপালের ছাদ তৈরি করে নিচে একটি আরবী খাবারের হোটেল। ছাদের উপরে ফল ফুল পাতা মেলিয়ে চার খেজুরবৃক্ষ যেন ফ্যাশন স্যুর মডেলদের মত নিজের সব রূপ সৌন্দর্য্য উজাড় করে তুলে ধরেছে। এই খেজুর গাছে অনেক পায়ুলাল বুলবুলি, চড়ুই, ঘুঘু, ময়না ইত্যাদি পাখিরা ফল খেয়ে খেয়ে কিচির মিচির করছে। কিছু পাখি রস মুখে করে নিয়ে মাতৃস্নেহে বাচ্ছাদের মুখে ডেলে দিচ্ছে। মনে পড়ল শৈশবের একটি ছড়া “বুলবুলি গো বুলবুলি, তোমার পায়ু কেন লাল আল্লায় বানিয়ে দিছেন, গুয়া খাওয়ার গাল"।
রিসোর্টের রিসিপশন হতে তিনদিনের ব্রেকফাস্টের টোকেন এবং তাদের ইন্টারনেট লাইন ব্যবহারের পাশওয়ার্ড পেলাম। টোকেন নিয়ে সকাল ৮টায় রিসোর্ট সংলগ্ন আলীবাবা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। বুফে খাবার পদ্ধতি, আইটেমের পর আইটেম খাবার তাকে তাকে সাজানো। রান্না ব্লাঙ্কেটের নিচে বার্নার লেমে আগুন জ্বলছে। সব খাবারই গরম ও সুস্বাধু। মেশিনে টিপ দিলেই আঙ্গুর, আপেল, আনারাস, কমলা ও আপেল জুসে গ্লাস ভরে যায়। পরের টেবিল চা, কফি, গ্রীন টি, গরম জল, দুধ, কনপ্লেক্স, চিড়ে, কুকারিজ ও উইটাবিচ। পরের টেবিলে এক গামলা ভরা কুচি কুচি নানান ফলের মিশ্রন, একটি পাত্রে কালো ভারতীয় মিষ্টি যা প্লেটে নিয়ে দেখলাম আসলে মিষ্টি নয় একধরনের উন্নত বিচিবিহীন নরম সুস্বাধু খেজুর। পাশে লাল গম ও চালের লোফ। মেশিনে রাখলেই গরম হয়ে বেরিয়ে আসে। কাছে রাখা পনীর, মাখন, জেলি ও সিদ্ধ ডিম। সব শেষে চার ব্লাঙ্কেট ভরা গরম পোলাও, জালফ্রাই, চৌমিন, মাটন, পরটা, মাংসের সমুচা, চিংড়ি, বিফ, সবজি, ডাল ইত্যাদি। কিছু আইটেম খাওয়ার পর উদর পুর্ন হয়ে যায়, বাকী সব আইটেম কেবল চোখে দেখে আসতে হয় মাত্র।
আজকের
দিনটি আমরা দুবাই মহানগর ঘুরে দেখার জন্য বরাদ্ধ রাখি। ব্রেকফাস্টের পর একটু সীবিচ ঘুরে শহর ভ্রমনে বের হলাম। কোন
বাংলাদেশী ট্যাক্সিক্যাব খুজে নাপেয়ে এবার পড়লাম আরেক পাকিস্তানী চালকের ঘাড়ে। এই ড্রাইভারের নাম সালমান, বাড়ি
পাকিস্তানের পাঞ্জাব। তিনি ভাল উর্দু ও হিন্দি জানেন। বিদেশীদের সাথে চালিয়ে যাবার
মত তার যথেষ্ট ইংরেজী জ্ঞানও রয়েছে। ইন্টারনেট হতে ডুবাইয়ের ভিজিট স্পটগুলোর
তালিকা বের করে সালমানের হাতে দেই। একে একে স্পটগুলোতে নিয়ে গিয়ে ড্রাইভার সালমান এগোলার বিবরন দেন। তিনি আমাদেরকে ছবি উঠাতেও
সহায়তা করেন। তিনি প্রথমে ডাউন টাউনে আমিরাতের সেরা নির্মান কোম্পেনী আমায়ার
বিল্ডিং বন্সট্রাকশন এর অনেকগুলো বহুতল ভবনের অফিসরাজ্যে নিয়ে যান।
তারপর নিয়ে যান বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুরুজ আল খলিফায়, যার উচ্চতা ৮২৮ মিটার। এর চারপাশে বাগান ও কয়েকটি ফোয়ারায় জলের ছন্দময় উদ্দাম নৃত্য বইছে। মৃদু জলের শব্দের ঝংকারের সাথে জলকনা ভেসে যাচ্ছে। বুরুজ আল খলিফার অর্ধেকে উঠার আরোহন ফি ২৫০ দিরহাম ও চুড়ায় আরোহন করতে হলে ৫০০ দিরহাম গুনতে হবে। লাইনে দাড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ করে চূড়ায় উঠতে গেলে দিন শেষ হয়ে যাবে, আমাদের হাতে এত সময় নেই। তাছাড়া ইতিপূর্বে বিশ্বের অনেক সুউচ্চ ভবনে আমার উঠা হয়ে গেছে। তারপর বুরুজ আল আরব যাই।
দুবাই
ওয়াটার পার্ক পার হয়ে আভিজাত এলাকা ডেরাদুবাই চলে আসি।
দুবাইয়ের আমিরের বাড়ি দেখা হল। এখানে ধনী ধনী আরব শেখদের
বড় বড় বাগান বাড়ি, প্রতিটি বাড়ি কয়েক একর জায়গা দখল করে আছে। বাড়িগুলোর সামনে বড় রাস্থা ও
পিছনে পারশ্য উপসাগরের বায়ু ও ঢেউ। গেটে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা।
এবার
গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে ছুটল পাম আইল্যান্ড বা খেজুরগাছ দ্বীপে। খেজুরগাছ দ্বীপপুঞ্জ
পারশ্য উপসাগরে আমিরাত সরকারের তৈরি একটি ছোট ছোট দ্বীপের কৃত্রিম সজ্জা যা সাগরে
একটি খেজুরবৃক্ষ আকৃতির দ্বীপসমষ্টি তৈরী করেছে। কোটি কোটি পেট্রো ডলার ডেলে হাজার
হাজার কর্মি, নির্মান শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারগন বিশ্বের সেরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বেশ
কয়েক বছরে এই পাম আইল্যান্ড নির্মান করেন। রিকেইভিং
মেশিনে সমুদ্র খনন করে পাহাড়ের পাতর কেটে ফেলে পানির নিচে বিশেষ প্রযুক্তিতে জমাট
বাধান হয়। পাতরের
বড় বড় খন্ড জমাট বাধিয়ে শক্ত ড্যাম তৈরি করে মরুভূমির বালু দিয়ে ভরাট করে
দ্বীপগুলো নির্মান করা হয়েছে। খেজুর পত্রাকার দ্বীপগুলোকে পরিবেষ্টন করে আর কিছু লম্বা
বৃত্তাকারের দ্বীপের মালা চারপাশ পেছিয়ে আছে।
পাম আইল্যান্ড জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নয়নাভিরাম অট্টালিকা, এসব অট্টালিকায় ফ্ল্যাট কিনে ধন্য হন বিশ্বের নামী দামী অভিনেতা, ব্যবসায়ী, কোম্পেনী সি ই ও, রাজনীতিবিদ ও বরেন্য ব্যক্তিবর্গ। এখানে একটি ছোট্ট দ্বীপের মালিক বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। এই দ্বীপে তিনি গড়ে তুলেছেন সুরম্য বাগান বাড়ি। এই পাম আইল্যান্ডে আছে উন্নত রিসোর্ট, বহুস্টার রেস্টিন হোটেল, বিখ্যাত আটলান্টাস হোটেল, মিডিয়া সিটি ও মেরিনা মল। এখানে পাতরের বাধে যে বিশাল কৃত্রিম পাম সীবিচ তৈরী করা হয়েছে তার কোন তুলনা হয়না। এই বিচে ঢেউয়ের কাছে আমরা ছবি তুলি। দূরের জাহাজে, গগনে বিমান ও হ্যালিকপটারে পর্যটকেরা ঘুরাফেরা করছেন। মেরিনা মলের কছে একটি ওপেন বিচ ক্লাবে যাই। ক্লাবটির নাম বারাস্তি। এটি পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে পরিচালিত একটি অভিজাত ক্লাব। এই পাম সি বিচে একজন আমেরিকান কাল বিদগুটে চেহারার নিগ্রো ভদ্রলোক তার অনিন্দ্য সুন্দরী অর্ধনগ্ন শ্বেতাঙ্গিনী পত্নীকে নিয়ে ফটো তুলছেন, আর আমাদের পাকিস্তানী যুবক চালক সালমান কাল চশমার ফাক দিয়ে চোর-চোখে অবাক হয়ে দেখছেন। এযেন দুধ এবং আলকাতরা মাখামাখি ও গলাগলি।
এবার ড্রাইভার সালমান দূরের আউটলেট ভিলেজে। শহর হতে অনের দূরে মরুর বুকে গাড় শ্যামল বৃক্ষ লতা পাতা ঘেরা এক অনন্য পর্যটন শহর এই আউটলেট ভিলেজ। কুসুম কানন, ফাকে ফাঁকে হোটেল, বার, রিসোর্টের মেলা। সুইমিংপুল এই গরম মরুদেশে পরম আদর ও বিলাসের বস্তু। এখানে মাটির নিচদিয়ে মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরার মত নল-উপনল বসিয়ে বৃক্ষের মুলে পানি সরবরাহ করা হয়। আউটলেট ভিলেজ আমাদের প্রাকৃতিক গ্রামের মত এক অপুর্ব গ্রাম, যাহা কোটি কোটি ডলার খরচ করে নির্মান করা হয়েছে। এখানে স্থাপিত দুটি ঘোড়ার ভাস্করর্য্যের সামনে ফটো উঠাই।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন