রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- দুই


চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- দুই

২১জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার। আজিজ ভাইজেফার ও আমি মেট্রোট্রেনে কয়েক স্টেশন পেরিয়ে টি ডি ব্যাংকে যাই। এখানে একটি কলমদানিতে প্রচুর বলপেন একটি পাত্রে প্রচুর চকলেট রাখা আছে।কাস্টমাররা কলম চকলেট ফ্রি নিয়ে যান। এখানকার মেট্রোট্রেন কম্পিউটারের মাধ্যমে অটোমেশনে পরিচালিত হয়। কোন ড্রাইভার টিকেট চেকারের দরকার হয়না। প্রতি স্টেশনে কেবল একজনমাত্র লোক টিকেট ইস্যু করে থাকেন। আমাদের চল্লিশজন লোকের কাজ হয়তো একজনেই করে থাকেন। উচ্চ প্রযুক্তির সহায়তায় খুব অল্প খরচে মেট্রোরেল পরিচালিত হওয়ায় এখানে জনগণ অতি সস্তায় ট্রেন ভ্রমনের সুযোগ পেয়ে থাকেন।  

ওজনপার্কের রাস্থার ফুটপাতে নানান ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন একজন বিয়ানীবাজারী ভদ্রলোক। গরমের রোদে ও শীতের বরফে দাড়িয়ে এই ফুটপাত ব্যবসা করে তিনি তার মার্কিনজীবন জীবন পার করছেন।সামনের মান্নান সুপার সপে প্রবেশ করলাম। জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জিপরা একজন লোক এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চিনতে সামান্য বেগ পেতে হল। তিনি কানাইঘাটের ফজল মিয়াযিনি এক সময়ের আমার চারতলার ডান ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ছিলেন। ফজল মিয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন কট্টর জামাতী। দেশে তার স্ত্রী জামাতীদের মহিলা মাহফিল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। ফজল মিয়া কোন এক প্রাইভেট কলেজে প্রভাষক ছিলেন। তিনি করতেন মস্য চাষের ব্যবসা। দেশে দেউলিয়া হয়ে নিদারুন অর্থকষ্টে দিন কাটাতেন। তিন সন্থান নিয়ে বেদ্বীনের দেশ আমেরিকা এসে খুব খুশি। মাসে ৫০০ ডলার ফুডস্টাম্প পান, ঘন্টায় ১৫ ডলার মজুরীতে চাকুরী করেন। তার স্ত্রীও এক মাদ্রাসায় পার্টটাইম আরবী পড়ান। ফজল মিয়ার দুঃখের দিন শেষ, তাই চেহারা সুরত বদলে গেছে, মনে হয় বয়স অনেক কমে গিয়ে তিনি যেন বয়সে তরুন হয়ে গেছেন।


নিউইয়র্কে সরকার নির্ধারিত নুন্যতম মজুরী প্রতি ঘন্টায় ১৫ ডলার। কিন্তু অদক্ষ ও অবৈধ অভিবাসীরা ঘন্টায় ১০/১২ ডলারেও কাজ করতে দেখেছি। এদেশে আয়ের সাথে প্রচুর ব্যয় এসে হাজির হয়। টেক্সস্বাস্থ্য ইন্সুরেন্স, গাড়ি ইন্সুরেন্স, গাড়ি ও বাসার ঋন কিস্তি, নানান ইউটিলিটি বিল ইত্যাদি। আমেরিকার লোকজন আমাদের মত এত কঠিন পরিশ্রম করেনা। মুঠে বওয়া, রিকসা চালান, ঠেলা টানা, ইটপাতর ভাঙ্গা, কোদালে মাটিকাটা, হালচাষ, লোহা পেঠানো ইত্যাদি অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ যুক্তরাষ্ট্রে নেই। তাদের সব কঠিন কাজগুলো মেশিন ও কম্পিউটার অটোমেশনে করে ফেলে। কাজের পরিবেশও আমাদের চেয়ে অনেক অনেক ভাল। তবে তারা চেয়ারবিহীন অফিসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাজ করে। দাঁড়িয়ে কাজ করার উপকারও আছে। অনবরত দাঁড়িয়ে হাঁটাহাঁটি করায় ব্যায়াম হয়, শরীর ভাল থাকে। উন্নত সফটওয়ারের জন্য এদেশে অফিস ও ব্যবসায় মানসিক শ্রমও তেমনটি নেই, সফটওয়ার অপারেইট জানলেই হল।যন্ত্রচালিত অলস জীবনধারার ক্ষতিকর দিক অপসারন করতে তারা সামান্য মাসিক চাঁদা পরিশোধ করে হেলথক্লাবের সদস্য হয়ে নানা আনন্দময় ব্যায়ামের আশ্রয় গ্রহন করেন।

আজ রাতে আমরা বাসার সবাই মিলে মেডিটরিয়ান মমস হোটেলে টার্কিস খাবার  খাই। এই দিনটি নিউইয়র্কে আমাদের এবারের শেষ দিন। কালকে আমিরাত সফরে নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাব। আমার বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী লন্ডন হতে সপরিবারে ক্যানাডার বোনের বাসায় এসেছেন। আগামীকল্য তারা নিউইয়র্ক আসবেন। মাত্র একটি দিনের জন্য ভাতিজা আজফার ও ভাতিজি নওশিনের সাথে দেখা হলনা। ইতিহাদ ও আমিরাত এয়ারলাইনে ভ্রমনকালে বেশ কয়েকবার দুবাই ও আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা পদচারনা করলেও দেশটির ভিতর প্রবেশ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। মনেমনে আনন্দ অনুভব করলাম মহান আল্লাহর অপার করুনা ও মেহেরবানীতে আমাদের ভ্রমণকাহিনীতে আরেকটি তৈলসমৃদ্ধ চাকচিক্যময় মরুদেশ যুক্ত হতে যাচ্ছে। রিটার্ন টিকেটে দুবাই হতে ছয়দিন পর ঢাকায় ফেরত যাত্রার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।

২২ জুন ২০১৮ সাল, শুক্রবার। সকাল ১০টায় বের হয়ে একটি হলুদ ক্যাবে নিউইয়র্ক জন এফ কেনেডী আন্তজাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি। সাথে ছিলেন আজিজ ভাই। ইতিহাদের ফ্লাইট নং ০১০২ বিমানবন্দরের চার নম্বর টার্মিনাল হতে বিকেল ২টা ৪০ মিনিটে আকাশ যাত্রা শুরু হয়।প্রায় তের ঘন্টা পর ২৩ জুন ২০১৮ সাল, বেলা সকাল ১১ টা ৪০ মিনিটে আমরা আবুধাবী আন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করি। ইমিগ্রেশন দিয়ে বের হতে চাইলে তারা পাশে ট্রানজিট ভিসা অফিস দেখিয়ে দিল। আমি চারদিনের ট্রানজিট ভিসার আবেদন করলে তারা একমাসের ভিসা প্রদান করে। তারা আমাদের তিনজনের ভিসা ফি বাবদ ৩৬২*= ১০৮৬ আমিরাত দিরহাম ক্রেডিট কার্ড মাধ্যমে জমা করতে বলে। আমাদের ক্রেডিট কার্ড নেই, আবার নগদ প্রদানের কোন সুযোগও নেই। আবার কাছের ইতিহাদ অফিসে ছুটলাম। ইতিহাদে কর্মরতা একজন স্মার্ট ভারতীয় সুন্দরী তার কার্ডের মাধ্যমে আমাদের ফি জমা প্রদানে রাজী হন। তার হাতে ১১০০ দিরহাম তুলে দেই। সাথে আনা প্রচুর খাবার খেয়ে আমরা পাশে বিছানো তুলতুলে নরম জায়নামাজে সব ওয়াক্ত কছরের নামাজ আদায় করে সোফায় বসে রই। তিন চার ঘন্টা পর ডাক পেলাম একমাসের ভিসা হয়ে গেছে। আবুধাবী আন্তজাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও নিরাপত্তা চেকিং পার হয়ে নিচের ব্যাগেজ বেল্টে এসে আমাদের ব্যাগদুটি সামনে পেয়ে যাই। বের হয়েই দুবাই যাবার টেক্সি খুঁজতে থাকি। আবুধাবী হতে দুবাই দুই ঘন্টার রাস্থা, যদিও আমাদের দেশে এতটুকু রাস্থা পার হতে অন্ততঃ চারপাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে।২৮০ দিরহামের কমদরে কোন ট্যাক্সি নেই। চারপাশে শুষ্ক গরম হাওয়া বইছে। এসি হতে বের হয়ে যেন কোন এক কারখানার আগুনে পড়লাম। আমি ভাড়া নিয়ে ইতস্ততঃ করছি দেখে একজন আরবী ভদ্রলোক এসে বললেন আপনি কি ইতিহাদের যাত্রি? আমি হ্যাঁ বললে তিনি একটু দূরে ইতিহাদের একটি বাস দেখিয়ে বললেন ঐ বাসে আপনি ইতিহাদের বিমানটিকেট দেখালে বিনেভাড়ায় দুবাই যেতে পারবেন। বের হয়েই আমার ৩০০ দিরহাম সেইভ হয়ে গেল। ইতিহাদের বাসে চড়ে জানলাম তাদের বাসে এখানে ফিরে আসাও ফ্রি হয়ে যাবে। আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে মোঠ ৬০০ দিরহাম ভাগ্যবলে খরচ না হয়ে বাজেটে বেঁচে গেল। মাত্র পনের বিশ জন নানাদেশী যাত্রি নিয়ে বাসটি দূবাইয়ের পথে রওয়ানা হল। রাস্থাটির নাম শেখ জায়েদ মহাসড়ক। বিভিন্ন স্থানে আরবী ড্রেসপরা শেখ জাহেদের ছবি শোভা পাচ্ছে। বাসের অর্ধেক আসনই খালি। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল এক একটা ঠান্ডা পানির বোতল। নতুন দেশ দেখবো তাই বসলাম বাসের সামনের সিটে জানালার পাশে। পারশ্য উপসাগরের পূর্বতীরের এই আরব দেশটি আসলে আরব উপদ্বীপের এক বালুপাতরের মরু অঞ্চল। এখানে বছরে মাত্র পাঁচসাত দিন বৃষ্টিপাত হয়। কিন্ত রাস্থার এত সবুজ দেখে মনেই হয়না দেশটি বৃষ্টিহীন মরুভূমি। নানা ডিজাইনের দৃষ্টিনন্দন ফুলে ফলে নুয়ে থাকা খেজুরগাছের সারি, সেইসাথে  নিম, কুল, ক্যাকটাস, কৃত্রিম বনবনানী এত ছড়িয়ে আছে যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সারিসারি রাস্থাগুলো উন্নত দেশগুলোর রাস্থাকেও হার মানাবে। রাস্থার হরি বৃক্ষমালার বাহিরে দৃষ্টি গেলে চোখে পড়ে বালুর হলুদ জমিনে ছিটা ছিটা সবুজের জলছাপ। এই সবুজ জলছাপে আছে ঘাস ও কাটাভরা মরুদ্যান। সারাটা মরুভুমি জুড়ে ছাপড়া ছাপড়া এসব সবুজের স্থুপে যুগে যুগে যাযাবরের দল তাদের উট ও দুম্বার পাল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু আজ এই আধুনিক যুগে এই সুদীর্ঘ্য পথে কোন উট দুম্বা কিংবা যাযাবর তাবুর দেখা পেলামনা। বালির ময়দানের সীমানা শেষ হয় বৃক্ষহীন রুক্ষশুষ্ক শিলার পাহাড়ে। দেশটা যেন উন্নত বালু ও পাতরের এক সুবিস্তৃর্ন খনি।

এবার দুবাই রাজ্যের সীমানায় গাড়ি প্রবেশ করে। আবুধাবির তুলনায় দুবাই রাজ্যে সবুজের প্রাবল্য খানিকটা কমই মনে হল। আবুধাবী দেশটির রাজধানী হলেও দুবাই সবচেয়ে বড় শহর ও বৃহত্তম বানিজ্য কেন্দ্র। পরিচ্ছন্ন ছিমছাম নগর দুবাই। সুপ্রশস্ত বহুলেইন রাস্থার দুইপাশে চকচকে কাঁচের আকাশছোঁয়া ভবন। রঙ্গীন গ্লাসে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে এসে রাস্থায় পড়ছে। শহরের বুকচুরে অগ্রসর হয়ে অনেকক্ষন পর সুপ্রসিদ্ধ দুবাইমলের বিপরীতে শেখ জায়েদ রোডের পাশে মাজায়া সেন্টারের ইতিহাদ অফিসে এসে বাসটি থামল। নেমে বড় সড়কে গিয়ে টেক্সিক্যাব ধরি। চালককে জুমায়রা বিচের পাশে চার তারকা হোটেল রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে নিয়ে যাবার ঠিকানা দেই। ড্রাইভার পাকিস্তানী পাঠান, নাম ইমতিয়াজ খান, বাড়ি পেশোয়ারের সন্নিকটের এক গ্রামে। এখানে কারে উঠামাত্রই মিটারে ৫ দিরহাম, আবার বিমানবন্দর গুলোতে ২০ দিরহাম কাটা পড়ে। গাড়ি চলামাত্র ৫ অথবা ২০ দিরহামের পর হতে বিল আসা আরম্ভ হয়। চালক জুমায়রা বিচরোডে বেশ খুজে হোটেলটি বের করেন। তিনজনের একটি ফেমিলি স্যুট নিলাম। দুবাইয়ে ডিসেম্বর হতে মার্চ পর্যটন সিজন। এই সময় ধনী শীতপ্রধান দেশ হতে এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। দুবাইয়ে এখন অফফ পর্যটন সিজন হওয়ায় হোটেল অনেক সস্তা। তিনদিনের ভাড়া বাবদ ২৪০ আমেরিকান ডলার পরিশোধ করে শেষদিন কয়টা বাজা পর্যন্ত অবস্থান করতে পারব জেনে নেই। সকালের বুফে নাস্তা  এই বিলে অন্তভূক্ত ছিল।এই রিসোর্টের ডিনারের ব্যবস্থাও আছে, তবে বিল এক্সট্রা পরিশোধ করতে হয়। এবার গরম পানিতে সবাই গোসল করে ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা নাগাদ ঘুম্ ভেঙ্গে গেলে আমরা রিজেন্ট হোটেলের ইন্ডিয়ান রেস্তুরায় গমন করি। শাড়িপরা স্টাইলিস্ট একজন ইংরেজি দক্ষ ইন্ডিয়ান সুন্দরী হোটেলটি পরিচালনা করেন। তার শাড়ি ও চুলের স্টাইল, মাথার সিদুর ও কপালের লালটিপ যেন পুরো ভারতীয় নারী সমাজকে  প্রতিনিধিত্ব করছে। ফিলিপিনো মেয়েরা খাবার পরিবেশন করেন। আমি তাদেরকে নেপাল কিংবা আসামের উপজাতি মেয়ে সন্দেহ করলে তারা বলল, অনেকেই এমনটি ভাবে তবে আমরা ফিলিপাইনের মেয়ে। মোরগ পোলাও, ডাল খিচুড়ি ও কোকের অর্ডার দেই। সাথে সাথে সামনে চলে আসে এক থালা পাপড়, সেই সাথে সস, আচার, টক দই ও মিনহাজ। আধা ঘন্টার মধ্যে সদ্য রান্না করা গরম খাবার ও সালাদ টেবিলে এসে যায়। বড় বাটির উপরে পোলাও এবং তলায় মোরগের ফ্রাই। অন্য বাটিতে অতি সুস্বাধু জাল ডাল খিচুড়ি। আন্তাজ করি এই খিচুড়িতে তিনভাগ চাল ও একভাগ ডাল রয়েছে। বাংলাদেশে এমন মজাদার খিচুড়ি তৈরি হতে দেখিনি। তিনজনের ভালভাবে ডিনার হয়ে গেল। বিল পরিশোধ করলাম ৮৫ দিরহাম।(চলবে)





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন