চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- দুই
২১জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার। আজিজ ভাই, জেফার ও আমি মেট্রোট্রেনে কয়েক স্টেশন পেরিয়ে টি ডি
ব্যাংকে যাই। এখানে
একটি কলমদানিতে প্রচুর বলপেন ও একটি পাত্রে প্রচুর চকলেট রাখা আছে।কাস্টমাররা কলম
ও চকলেট ফ্রি নিয়ে যান। এখানকার মেট্রোট্রেন কম্পিউটারের মাধ্যমে অটোমেশনে পরিচালিত হয়। কোন ড্রাইভার ও টিকেট চেকারের দরকার হয়না। প্রতি স্টেশনে কেবল একজনমাত্র লোক টিকেট ইস্যু করে থাকেন। আমাদের চল্লিশজন লোকের কাজ হয়তো একজনেই করে থাকেন। উচ্চ প্রযুক্তির সহায়তায় খুব অল্প খরচে মেট্রোরেল পরিচালিত হওয়ায় এখানে জনগণ অতি সস্তায় ট্রেন ভ্রমনের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
ওজনপার্কের রাস্থার ফুটপাতে নানান ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন একজন বিয়ানীবাজারী ভদ্রলোক। গরমের রোদে ও শীতের বরফে দাড়িয়ে এই ফুটপাত ব্যবসা করে তিনি তার মার্কিনজীবন জীবন পার করছেন।সামনের মান্নান সুপার সপে প্রবেশ করলাম। জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জিপরা একজন লোক এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চিনতে সামান্য বেগ পেতে হল। তিনি কানাইঘাটের ফজল মিয়া, যিনি এক সময়ের আমার চারতলার ডান ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ছিলেন। ফজল মিয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন কট্টর জামাতী। দেশে তার স্ত্রী জামাতীদের মহিলা মাহফিল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। ফজল মিয়া কোন এক প্রাইভেট কলেজে প্রভাষক ছিলেন। তিনি করতেন মৎস্য চাষের ব্যবসা। দেশে দেউলিয়া হয়ে নিদারুন অর্থকষ্টে দিন কাটাতেন। তিন সন্থান নিয়ে বেদ্বীনের দেশ আমেরিকা এসে খুব খুশি। মাসে ৫০০ ডলার ফুডস্টাম্প পান, ঘন্টায় ১৫ ডলার মজুরীতে চাকুরী করেন। তার স্ত্রীও এক মাদ্রাসায় পার্টটাইম আরবী পড়ান। ফজল মিয়ার দুঃখের দিন শেষ, তাই চেহারা সুরত বদলে গেছে, মনে হয় বয়স অনেক কমে গিয়ে তিনি যেন বয়সে তরুন হয়ে গেছেন।
আজ রাতে আমরা বাসার সবাই মিলে মেডিটরিয়ান মমস হোটেলে টার্কিস খাবার খাই। এই দিনটি নিউইয়র্কে আমাদের এবারের শেষ দিন। কালকে আমিরাত সফরে নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাব। আমার বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী লন্ডন হতে সপরিবারে ক্যানাডার বোনের বাসায় এসেছেন। আগামীকল্য তারা নিউইয়র্ক আসবেন। মাত্র একটি দিনের জন্য ভাতিজা আজফার ও ভাতিজি নওশিনের সাথে দেখা হলনা। ইতিহাদ ও আমিরাত এয়ারলাইনে ভ্রমনকালে বেশ কয়েকবার দুবাই ও আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমরা পদচারনা করলেও দেশটির ভিতর প্রবেশ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। মনেমনে আনন্দ অনুভব করলাম মহান আল্লাহর অপার করুনা ও মেহেরবানীতে আমাদের ভ্রমণকাহিনীতে আরেকটি তৈলসমৃদ্ধ চাকচিক্যময় মরুদেশ যুক্ত হতে যাচ্ছে। রিটার্ন টিকেটে দুবাই হতে ছয়দিন পর ঢাকায় ফেরত যাত্রার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।

এবার দুবাই রাজ্যের সীমানায় গাড়ি প্রবেশ করে। আবুধাবির তুলনায় দুবাই রাজ্যে সবুজের প্রাবল্য খানিকটা কমই মনে হল। আবুধাবী দেশটির রাজধানী হলেও দুবাই সবচেয়ে বড় শহর ও বৃহত্তম বানিজ্য কেন্দ্র। পরিচ্ছন্ন ছিমছাম নগর দুবাই। সুপ্রশস্ত বহুলেইন রাস্থার দুইপাশে চকচকে কাঁচের আকাশছোঁয়া ভবন। রঙ্গীন গ্লাসে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে এসে রাস্থায় পড়ছে। শহরের বুকচুরে অগ্রসর হয়ে অনেকক্ষন পর সুপ্রসিদ্ধ দুবাইমলের বিপরীতে শেখ জায়েদ রোডের পাশে মাজায়া সেন্টারের ইতিহাদ অফিসে এসে বাসটি থামল। নেমে বড় সড়কে গিয়ে টেক্সিক্যাব ধরি। চালককে জুমায়রা বিচের পাশে চার তারকা হোটেল রিজেন্ট বিচ রিসোর্টে নিয়ে যাবার ঠিকানা দেই। ড্রাইভার পাকিস্তানী পাঠান, নাম ইমতিয়াজ খান, বাড়ি পেশোয়ারের সন্নিকটের এক গ্রামে। এখানে কারে উঠামাত্রই মিটারে ৫ দিরহাম, আবার বিমানবন্দর গুলোতে ২০ দিরহাম কাটা পড়ে। গাড়ি চলামাত্র ৫ অথবা ২০ দিরহামের পর হতে বিল আসা আরম্ভ হয়। চালক জুমায়রা বিচরোডে বেশ খুজে হোটেলটি বের করেন। তিনজনের একটি ফেমিলি স্যুট নিলাম। দুবাইয়ে ডিসেম্বর হতে মার্চ পর্যটন সিজন। এই সময় ধনী শীতপ্রধান দেশ হতে এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। দুবাইয়ে এখন অফফ পর্যটন সিজন হওয়ায় হোটেল অনেক সস্তা। তিনদিনের ভাড়া বাবদ ২৪০ আমেরিকান ডলার পরিশোধ করে শেষদিন কয়টা বাজা পর্যন্ত অবস্থান করতে পারব জেনে নেই। সকালের বুফে নাস্তা এই বিলে অন্তভূক্ত ছিল।এই রিসোর্টের ডিনারের ব্যবস্থাও আছে, তবে বিল এক্সট্রা পরিশোধ করতে হয়। এবার গরম পানিতে সবাই গোসল করে ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা নাগাদ ঘুম্ ভেঙ্গে গেলে আমরা রিজেন্ট হোটেলের ইন্ডিয়ান রেস্তুরায় গমন করি। শাড়িপরা স্টাইলিস্ট একজন ইংরেজি দক্ষ ইন্ডিয়ান সুন্দরী হোটেলটি পরিচালনা করেন। তার শাড়ি ও চুলের স্টাইল, মাথার সিদুর ও কপালের লালটিপ যেন পুরো ভারতীয় নারী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ফিলিপিনো মেয়েরা খাবার পরিবেশন করেন। আমি তাদেরকে নেপাল কিংবা আসামের উপজাতি মেয়ে সন্দেহ করলে তারা বলল, অনেকেই এমনটি ভাবে তবে আমরা ফিলিপাইনের মেয়ে। মোরগ পোলাও, ডাল খিচুড়ি ও কোকের অর্ডার দেই। সাথে সাথে সামনে চলে আসে এক থালা পাপড়, সেই সাথে সস, আচার, টক দই ও মিনহাজ। আধা ঘন্টার মধ্যে সদ্য রান্না করা গরম খাবার ও সালাদ টেবিলে এসে যায়। বড় বাটির উপরে পোলাও এবং তলায় মোরগের ফ্রাই। অন্য বাটিতে অতি সুস্বাধু জাল ডাল খিচুড়ি। আন্তাজ করি এই খিচুড়িতে তিনভাগ চাল ও একভাগ ডাল রয়েছে। বাংলাদেশে এমন মজাদার খিচুড়ি তৈরি হতে দেখিনি। তিনজনের ভালভাবে ডিনার হয়ে গেল। বিল পরিশোধ করলাম ৮৫ দিরহাম।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন