রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- এক


চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা, এযাত্রায় নিউইয়র্ক, আবুধাবী এবং দুবাই সফরঃ পর্ব- এক

 সফরকালঃ জুন-২০১৮সাল         

চতুর্থবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রার প্রক্কালে আমি সিন্ধান্ত নিলাম এবারের ফিরতি পথে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করে আসব। ইতিহাদ এয়ার লাইন হতে পুত্র জেফার পত্নী নুরজাহান চৌধুরী আমার জন্য তিনটি  রিটার্ন টিকেট কিনলাম। ১৫ জুন শুক্রবার ছিল রমজান মাসের সর্বশেষ দিন। দুটি বড়ব্যাগ, দুটি হ্যান্ডব্যাগ ও সামান্য ইফতারী সাথে নিয়ে নবএয়ারের ফ্লাইটে সিলেট বিমানবন্দর হতে ঢাকা শাহজালাল আন্তজাতিক বিমানবন্দরে পৌছি। সিলেটে বৃষ্টি রেখে আসি অথচ ঢাকা মেঘহীন। ঢাকা বিমানবন্দরে তিনঘন্টা কাটিয়ে ইতিহাদের বর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করি। অফিস হতে ষোলদিনের ছুটি নিয়েছি তাই ষোলদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো। নিউইয়র্ক ছয়দিন, আমিরাত পাচদিন ও বাকী দিনগুলো যাত্রাপথের জন্য বরাদ্ধ রইল। ঢাকা হতে রাত দশটায় উড়ে পাঁচঘন্টা পর আবুধাবী আন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করি। এই বিমানবন্দরে স্থাপিত যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসে আমাদের ইমিগ্রেশন হয়, মার্কিন ইমিগ্রেশন অফিসার এহসান মালিক আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন আইন বুঝাতে একজন বাংলাদেশী দুভাষী লোক খুঁজেন কিন্তু নাপেয়ে ভগ্নমনে ছেড়ে দেন। তাই নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে নেমে আমাদের আর কোন ঝামেলা রইলনা। দুইঘন্টা পর আবুধাবী হতে নিউইয়র্ক অভিমুখি তেরঘন্টার সুদীর্ঘ্য যাত্রা শুরু হল। দুতলা উড়ালযানে প্রায় ছয়শত যাত্রি ছিলেন। ইতিহাদের খাবার মান খুব ভাল, যাত্রিসেবাও উন্নত।

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ই জুন শনিবার আমরা নিউইয়র্কের জে এফ কে বিমানবন্দরের চারনম্বর টার্মিনালে অবতরন করি। বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর আমার সমনদিক আজিজ এ চৌধুরী আমাদেরকে নিয়ে যেতে হাজির হন। তার পুত্র আরিক খেলতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়ে শয্যাগত থাকায় গাড়ি গ্যারেজ বন্দি, তাই একটি হলুদ টেক্সিক্যাবে দশবার মিনিটে তাদের ওজনপার্কের বাসা যেতে হয়।মিটারে ভাড়া আসে ২৩ আমেরিকান ডলার। আগের দিন ১৫ জুন আমরা প্লেনে অবস্থানকালে নিউইয়র্কে ঈদ হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম একটি ঈদের দিন আকাশে অসনাক্ত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নিউইয়র্কের দিন বাংলাদেশের রাত হওয়ায় চোখজুড়ে ঘুম আসে। দিনটা ঘুমিয়ে পার হয়। দুপুরে এক অদ্ভুদ ফল খাই, ফলটির নাম এভোকেডো ফ্রুট। অদ্ভুদ বললাম এই কারনে যে এটির স্বাদ না মিষ্টি, না টক। ফলটির রঙ সবুজ পরিপক্ক হলে কাল। ভিতর ঘিরং এবং খেতে ঘন ঘিয়ের স্বাধ। তার বীজ দেখতে গোলাকার ছোট লাল বল।

বিকেলবেলা আমার আত্মীয় ভ্রাতা রনকেলী গ্রামের সাহাদ ভাই আসেন। আমি সজাগ থাকলেও বাকীরা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় আমি ও আজিজ ভাই ছুটলাম সাহাদ ভাইয়ের বাসায়। সাহাদ ভাই কোরানের সুরা পড়ে অনুবাদ করে করে গাড়ি চালান। তিনি কোরানের প্রতিটি শব্দের অর্থ জানেন। তারা দুইজন এমসি কলেজের ১৯৭৬ সালের এইচএসসি(বিজ্ঞান) পরীক্ষার্থী ব্যাচের সহপাঠী ও একই সময়ের এই কলেজের আবাসিক হোস্টেলবাসীও ছিলেন। সাহাদ ভাই এখানে একত্রে জোড়বাসা ক্রয় করেন। মাঝের দুইবাসা একত্রকরে বেশ বড়সড় বাসাটিতে নিজে থাকেন। উপরে দুই বাসায় চার হাজার ডলার ও নিচের বেজমেন্ডের দুইবাসায় দুই হাজার ডলার ভাড়া পান। বাসাটির সামনে ও পিছনে প্রচুর খালি জায়গা ও বাগান রয়েছে। তার দুইটি ট্যাক্সীক্যাবের লাইসেন্স রয়েছে, এগুলো ভাড়া দিয়ে বিনাকষ্টে প্রচুর আয় করেন। এখানে ভাবীর হাতে তৈরী নানাপদের মজাদার নাস্থা খাই ও ছবি উঠাই। রাতে ফেরার পথে কুইন্সে বড়মামা ছাদ্দিক চৌধুরীকে দেখতে যাই। আচমকা আমাদেরকে দেখে তারা হতচকিত হন। কিছুদিন আগে ওপেনহার্ট সার্জারি করা মামাকে বেশ প্রশান্ত মনে হল। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক এসে আমরা কয়েকদিন এই সুন্দর ছিমছাম বাসায় ছিলাম। তিন বছর পর আবার আসলাম। ভাগ্নি নিয়ামা ও মুনিয়াতের সাথেও দেখা হল। এখানে মামী ও বোন রিপা এত নাস্তা টেবিলে এনে সাজালো যে রাতের খাবার প্রায় হয়েই গেল।


১৮ ও ১৯ জুন পাশের সপিংমল ও বাগানে হেটে ব্যায়াম করে পার হয়। বদ্ধঘরে গরম  মনে হলে বাহিরের ঠান্ডা বাতাসে হাঁটলে আরাম  অনুভূত হয়। রাতে বৃষ্টির পর পার্কে হেটে আসি। কাটের চেয়ারে বসে গল্প করি। ওজনপার্কে এত বাংলাদেশী বাস করেন যে মনে হল বাংলাদেশেই আছি। এইখানে বাংলাদেশীদের বেশীরভাগ সিলেটি ও এই সিলেটিদের প্রায়ই বিয়ানীবাজারের লোকজন। দোকানপাঠ, বাসাবাড়িফুটপাত সবখানে বাংলাদেশীদের ছড়াছড়ি। মান্নান সুপার মার্কেটের শাখাসহ অসংখ্য বাংলাদেশীদের মুদি দোকান, হোটেল রেস্টোরাওয়াসিং মেশিনসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্টান বড় রাস্থার পাশেপাশে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশী বুড়ো লোকজন মিলে পার্ক ও রাস্থাপাশের ব্রেঞ্চে বসে অলস আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। আজিজ চৌধুরী বললেন এসব লোকজন আরামে খাওয়াপরার নিশ্চয়তা পেতে এদেশে এসেছেন। বুড়ো বয়সে বার্ধক্যভাতা, ফ্রি চিকিৎসা সব পান। ডাক্তারের কাছে যাবার ট্রেন টিকেটও ফ্রি পান। তারাতো তাদের সব চাওয়াই এখানে পেয়ে যান, তাই তারা সবাই মসজিদে প্রভূধ্যানে ও পার্কে  খুশগল্প করে পত্রিকা পড়ে দারুন সুখে দিন কাটান। উন্নত এই দেশে সরকার তার জনগণকে নিজ সন্তানের মত আগলে রাখে। সব চিকিসা খরচ ইন্সুরেন্স কোম্পেনী বহন করে আবার সামথ্যহীন লোকজন জটিল চিকিসা সম্পূর্ন ফ্রি পেয়ে থাকেন। কেউ আয়হীন কিংবা প্রতিবন্ধি হলে তাদের ফুডস্ট্যাম্প ও বাসস্থানের দায়িত্বও সরকার বহন করে। এখানে মানুষের পুরো জীবনটা একটা সরকারী নিরাপত্তার চাদরে ডাকা থাকে। এদেশে জাকাত কিংবা ভিক্ষা গ্রহনের লোক খুজে মেলা ভারকারন সবার সব চাওয়া পাওয়া সরকারই পূর্ন করে দেয় তা খাবারবাসস্থানকঠিন চিকিসা খরচ যাই হোক না কেন।

এত সুযোগ সুবিধার দেশে আমাদের দেশের বড়লোকেরা কিন্ত আর লাভের আশায় এসে কিছুটা বিপদেই পড়েন। এখানে কোন প্রহরী নেই, গৃহকর্মি নেই, গাড়িচালক নেই। নিজহাতে যখন চাকরের কাজ করেন তখন টের পান বাংলাদেশ কেমন। বাংলাদেশের সব কালো দিক তখন তাদের চোখে সাদা হয়ে যায়। কল্পনার আয়নায় তখন ধরা পড়ে কত ধানে কত চাল।  যুক্তরাষ্ট্র পুজিবাদী কল্যাণ রাষ্ট্র। এখানে আসলে ফ্রি লান্স বলে তেমন কিছু নেই। এখানে ভাল অঙ্কের বার্ধক্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা পেতে হলে দীর্ঘ্যদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজকরার অভিজ্ঞতা দেখাতে হয়। অতীতে ভাল ইনকামটেক্স দাতা হতে হয়। যার রেকর্ড ভাল নয় তিনি সুযোগ সুবিধা সীমিতই পেয়ে থাকেন।  

২০শে জুন আরিকের ডাক্তার দেখাতে আলমাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে আমি ও জেফার ম্যানহাটান ব্যালাবু হাসপাতালে যাই। তিন বছর পর আমি আবার ম্যানহাটানের মাটিতে পা রেখেই হেটে হেটে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে যাই। ২ নং এভ্যিনিউ ৪৩ স্ট্রিটে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের গেটে সিকিউরিটিরা গেট বন্ধ রাখায় ভিতরে ডুকার সুযোগ পাইনি। পৃথিবীর সব দেশের পতাকার লাইনে আমাদের লাল সবুজ পতাকা সগৌরবে উড়তে দেখলাম। গ্লাসের সুউচ্চ ভবনের সামনে জলের ঝর্নাধারা, পাশে ইউ এন ও এভ্যিনিউ। সামনে আবার হার্ডসন নদীর তরঙ্গমালার সাথে দেখা হয়ে গেল। সময় নেই, তাই সেন্ট্রাল পার্ক এবার দেখা হলনা।(চলবে)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন