মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- এক

 


তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- 
সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর    পর্ব- এক

যাত্রাঃ ১৭জুন ২০১৭ ফেরাঃ ৭জুলাই ২০১৭ অবস্থানঃ ২০ দিন।

১৭ জুন ২০১৭ সাল। সিলেটে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। লাল কারটি চালিয়ে ভরা বর্ষনের মধ্যে পুত্র জেফার ও ডাক্তার নুরজাহানকে নিয়ে আমি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসি। ৬টা ১০ মিনিটে বিমানটি আকাশে ডানা মেলে। সারাটা পথ সাদা ও ঘন মেঘমালার উপর দিয়ে অতিক্রম করে পাঁচচল্লিশ মিনিট পর ঢাকায় অবতরণ করি। ঢাকায় ইমিগ্রেশন ও চেকিং শেষে সকাল ১০ টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশালাকার উড়ালযানে আবার আকাশে ভাসি। যাত্রি অল্প, অসংখ্য সিট খালি। আমি, পুত্র জেফার ও গিন্নী ডাঃ নূরজাহান প্রত্যেকে তিনটি করে সিটে আরামে শুয়ে বসে আকাশ পথ পার হই। বিমান ভারতের পাঞ্জাব হয়ে পাকিস্থানে যায়। একটু পর আফগানিস্থানে প্রবেশ করামাত্র মনে হল বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোলযোগপূর্ন নরগোষ্টির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছি। এবার বিমানটি উত্তরদিকে মধ্য এসিয়ায় প্রবেশ করে। নৃশংস খুনী যুদ্ধা তৈমুর লঙ্গের রাজধানী সমরখন্দ ও তাসখন্দের ভিতর দিয়ে আমরা রাশিয়ায় প্রবেশ করি। তারপর পোল্যান্ড, জার্মানী ও নেদারল্যান্ড পার হয়ে নর্থসিতে আসি। ঘন্টাখানেক সময়ে নর্থসি অতিক্রম করে আমরা লন্ডন শহরের উপরে চলে আসি। তখন লন্ডন শহরের আকাশে ধুঁয়ার মত মেঘমালা উড়ে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ হিথ্রোতে ট্রাফিক জ্যামের জন্য অনেকক্ষন লন্ডনের আকাশে চক্রাকারে আবর্তন করে বিমান এল এইচ আরে অবতরণ করে এবং আমাদের নয়-দশ ঘন্টা ভ্রমনের অবসান ঘটে। শুয়ে বসে পার হওয়া যাত্রাটি বেশ আনন্দময় ছিল, কোন ধরনের ক্লান্তি শ্রান্তি আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। সিলেট থেকে বাসে বা ট্রেনে ঢাকা গমনে যে ক্লান্তি বা কষ্ট সইতে হয়, তার বিন্দুমাত্র অংশও এখানে সইতে হয়নি। বিমানের খাবারো দেশী ও মজাদার। সার্ভিস নিশ্চিত আন্তর্জাতিক মানের। বেশ কয়েকবার চা, কফি ও পানীয় পরিবেশন করা হয়। মনে হল আমাদের বিমান শীঘ্রই বিশ্বের এক উন্নত সংস্থা হিসাবে পরিগনিত হবে।

ট্রলিতে করে মালামাল নিয়ে বের হয়েই অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর দেখা পাই। তিনি ১৯৯৪ সাল হতে লন্ডনে আছেন। গত রমজানে বাংলাদেশে তার সাথে দেখা হয়। এক বছর পর আবার লন্ডনে এসে দেখা হলো। আমাদেরকে নিয়ে যেতে দুটি গাড়ি এসেছে, একটি অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী ও অন্যটি আমার মামাত ভাই আফজল নিয়ে এসেছে। দুটি কারের বেনেটে মালামাল পূর্ন করে ইস্ট লন্ডনে রওয়ানা হই। জেফার তার আফজল চাচার কারে বসে। আমরা দুইজন ভাইয়ের গাড়িতে চড়ি। ভাতিজা আজফার বিমানবন্দরে চাচা ও চাচিকে সালাম করে কার স্টার্ট করে। আমাদের গন্তব্য বড়ভাইয়ের বাসা। Address: Tahmid Chowdhury. 23, Dewey Road, Assex, London, U.K.

আজফার নতুন ডাইভার, সে জেফারের এক বছরে বড়। তারা বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পৃথিবীতে আসে। হিথ্রো বিমানবন্দরের অবস্থান পশ্চিম লন্ডন। বাসা প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব লন্ডন। প্রায় দুই ঘন্টা লন্ডন শহরের ভিতর দিয়ে আজফার কার চালিয়ে আমাদেরকে তাদের ইস্ট লন্ডনের বাসায় নিয়ে যায়। ঘন বনবনানী ও কুসুমসজ্জিত রাস্থা দিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌছি। বাসায় ঢুকে মামাতো বোন নিপা ও তার স্বামী বাদশা ভাইকে পাই, তারা আমাদের জন্য অপেক্ষায়। সন্ধ্যায় ইফতার পার্টিতে অনেক নিকটাত্মীয় শরীক হন। ভাগনা লবিদ, হুদহুদ, ভাগ্নি লিজা, পপি ও লিজার স্বামী রোমন। আসেন দুই ভাগ্না বউ, ভাতিজা জাহিদ তার পত্নী ছেলে মেয়ে নিয়ে আসে। সেদিন ৩৫/৪০ জনের এক জমজমাট ইফতার পার্টি হয় অগ্রজের বাসায়। ভাবী বিলকিস চৌধুরী ও ভাতিজী নওসীন সারাদিন পরিশ্রম করে ৩০/৩৫ আইটেমের ইফতার তৈরী করেন। চার/পাচ ধরনের শরবতই ছিল। আমি চিনিবিহীন কেলগেরী জুস নেই। ফল ছিল কয়েক ধরনের, তবে পাকিস্থানের সুমিষ্ট আমই আমার সেরা মনে হয়েছে। ইফতারের পরিমান এত বেশী ছিল যে সবাই কার্টুন ভরে ভরে নিয়ে যান। দুতলা সুন্দর ও সুবিধাময় ডুপ্লেক্স বাসা, সামনে ড্রাইভওয়ে ও ফুলের সারি। নিচতলায় ড্রয়িং, কিচেন ও বাথরুম। উপরের তলায় তিনটি বেডরুম ও একটি বড়সড় বাথরুম।

নিচতলায় ডাইনিং সংলগ্ন একটি কাচের কক্ষ যাহা পিছনের সুসজ্জিত পুস্প উদ্যানে ঢুকে আছে। এই কক্ষে সোফা সেট ও ব্যায়াম মেশিন রয়েছে। বাগানের মধ্যে একটি বড় ছাতার নিচে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল রাখা বৈঠকখানা। বাগানে কাপড় শুকানোর রড-তারের সুন্দর স্থাপনা। বাসাটি আমাদের দেশের সুসজ্জিত হোটেল স্যুটের মত। বাসার সামনে ড্রাইভওয়েতে বিলাসবহুল দামী গাড়ী খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়।

আজফার লন্ডনের এক দামী প্রতিষ্টান হতে অর্থনীতিতে অনার্স সম্পন্ন করে একটি প্রতিষ্টানে সদ্য চাকুরী নিয়েছে। সাথে মাস্টার্স পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নওসীন মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনের ছাত্রি।


এখন লন্ডনের সামার। দিনের দৈর্ঘ্য ১৭/১৮ ঘন্টা এবং রাত মাত্র ৫/৬ ঘন্টা। শীতপ্রধান দেশসমূহে গ্রীষ্মকালের কদর খুব বেশী। তারা আরামদায়ক গ্রীষ্মকে প্রানভরে উপভোগ করে। সেদিন দ্রুত সেহরির সময় এসে যায় এবং আমরা সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। পাখির কলকাকলি শুনে ঘুম ভাঙ্গে। পিছনের জানালা দিয়ে বিভিন্ন বাসার বাগানের নানান জাতের ফুলগাছ ও লতাপাতার বনে চেয়ে দেখি চড়ুই ও ঘুঘুর মত হরেক রকমের পাখির বিচরন ও তাদের সুমিষ্ট গান। চড়ুইরা দুনিয়ার সব পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে। মদীনার তপ্ত মরুভূমির খেজুর বাগানেও চড়ুইদেরে আমি কিচির-মিচির করতে দেখি। লন্ডনেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মত বাসাবাড়ির আশপাশ জুড়ে নানান ফুলের সমারোহ। বৃটেনে দিবস সুদীর্ঘ্য হলেও গরম তেমন হয়না। কারন রোদে তেমন উষ্ণতা নেই। এয়ার টাইট কক্ষে একটু গরম অনুভূত হলেও বাহিরে বাতাস ঠান্ডা ও সহনীয়। জানালা একটু ফাঁক করে দিলেই কক্ষ ঠান্ডা হয়ে আসে।

এখানে নানা ধরনের অজানা পাখির ডাক শুনি যা বাংলাদেশে কখনও শুনা হয়নি। আসলে পাখির গানও দেশে দেশে ভিন্ন হয়। সামারের লন্ডন গাড় সবুজে একাকার। মনে পড়ে যায়, বিখ্যাত ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ারের একটি সনেটের নাম- Grabed age and youth. কবি এখানে যৌবনকে ইংল্যান্ডের গ্রীষ্ম ও বার্ধক্যকে শীতের সাথে তুলনা করেছেন। সামারের ইংল্যান্ড ফল, ফুল, পাখি ও সবুজের এক অপূর্ব মিলনমেলা। কবুতর, চড়ুই এবং চাইনচড়া দলবেঁধে বাতাসে সাতার কাটছে। গোলাপ, ডালিয়া, গাঁদা, টিউলিপ, লিলি সর্বত্র মুখমেলে তাকিয়ে আছে।         

অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট আজফার বলল- বৃটেন বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও জার্মানির পর তার অবস্থান। ভারত, রাশিয়া, ক্যানাডা ও ব্রাজিলের মত জায়ান্ট দেশগুলোর মোঠ জাতীয় আয় বৃটেনের চেয়ে পিছনে রয়েছে। এইসব দেশ বৃটেনের চেয়ে কয়েকগুণ বড় ও জনবহুল। আমি জিঞ্জেস করি, তোমাদের দেশের প্রকৃত নাম কি? আমরা তো দেশটাকে UK, Great Britain, England ইত্যাদি নামে ডেকে থাকি। আজফার বলল,UK বলতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড এই চারটি রাজ্যকে নির্দেশ করে, যার কেন্দ্রীয় রাজধানী লন্ডন এবং মোঠ আয়তন ৯৩,৬২৮ বর্গ মাইল। গ্রেটবৃটেন হল বৃহত্তর বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ যেখানে উত্তর আয়ারল্যান্ড বাদ দিয়ে বাকি তিনটি রাজ্য রয়েছে। আসলে উত্তর আয়ারল্যান্ড বাদ দিয়ে বাকী তিনটি রাজ্য হল গ্রেট বৃটেন। বৃটেন হল ইউরোপের সবচেয়ে বড় দ্বীপ যার আয়তন ৮০,৮২৩ বর্গ মাইল। যুক্তরাজ্যের মোঠ লোকসংখ্যা ৬ কোটি ৫৬ লক্ষ ৪০ হাজার। ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের সর্ববৃহত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজ্য। এই রাজ্যের আয়তন ৫০,৩১০ বর্গ মাইল ও রাজধানী লন্ডন। যুক্তরাজ্য ধনী রাষ্ট্র। এখানে মানুষের মাথাপিছু আয় (Per capita income)  ৩৯৯০০ মার্কিন ডলার।

১৮ জুন ২০১৭ সাল। সুন্দর ভোর। আকাশ মেঘমুক্ত ও পরিস্কার। জানালা খোলে দেই। ঠান্ডা বাতাস এসে ঘরটাকে সুশীতল করে দেয়। তাই একটু গরম গরম অবস্থা চলে যায়। সারিবদ্ধ বাসাগুলোর পিছনের বাগানে দুএকজন শ্বেতাঙ্গ লোকজন বিচরন করছেন। তারা বড় মগে কফি পান করে বাগানের হালকা কাজ করছেন। পাশের বাগানের পাতাবাহার ও ফুলগাছের ফাঁকে ফাঁকে পুতুল, প্যাচা, পাখি, কুকুর ইত্যাদির মূর্তি ও ভাস্কর রয়েছে। দেখতে ভালই লাগল এই শিল্পগুলো। পাশের বাগানে ইংরেজ বুড়োবুড়িকে শান্তভাবে নাস্তা করতে দেখি। মনে হল তারা সুদীর্ঘ্য জীবনকাল পরস্পরের ভালবাসায় জড়িয়ে একত্রে কাটিয়ে দিয়েছে। ফুলে ফুলে বিভিন্ন ধরনের প্রজাপতি ও পতঙ্গের উড়াউড়ি করছে। মৌমাছির গুনগুন সুরও কানে বাজে। সামারের লন্ডন পাখি সম্পদেও সমৃদ্ধ। পাশের বাগানে শ্বেতাঙ্গ বুড়ো বুড়ি ফুলবাগানে নল দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে। তাদের বাগান বেশ সুন্দর ও সমৃদ্ধ। আসলে পাটচুলের এই নীল নয়না সাদারা সৌন্দর্য্যপ্রিয় ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সামারের লন্ডনে দুএকটা মাছিরও সাক্ষাত পাই।

আফজাল এখনও কুমার। লন্ডনের উপকন্ঠে নতুন বাড়ি কিনেছে। গতকল্য তার বাসায় খাবার নিমন্ত্রন পাই। সবাই বললেন, আফজাল তুমি একা একা থাক, বউ নেই ঘরে কিভাবে রান্না বান্না করবে। কিন্তু সে নাছুড়বান্দা। ঐদিন আমরা দুই গাড়ি পুর্ন হয়ে ছুটলাম। প্রথম বিশ্বের উন্নত রাস্থায় ভাবী বিলকিস চৌধুরী কার চালিয়ে ঘন্টা খানেক পর গন্তব্যে নিয়ে যান। জিপিএস ব্যবহার করে গাড়িটি সহজে বুনো রাস্থা ও উঁচুনিচু টিলা অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। দুপাশে অজানা বৃক্ষমালা ও ফুলের সমারোহ।

আফজালের বাসা নির্জন গ্রামে। সামনে সমতল মাঠজুড়ে নানা রঙের টিউলিপের বন্যা বইছে। একটি গাছের ডালে ডালে নাশপাতি ঝুলে আছে। আমরা পাড়ে পাড়ে সুমিষ্ট নাশপাতি খাই। আফজালের বাসায় এক বিরাট স্বজন সমাবেশ ঘটে। ভাতিজা জাহেদের পত্নী খুব সকালে এসে রান্না বান্না শুরু করে। পড়ে নিপা এসেও যোগ দেয়। পনের বিশ জন আত্মীয় পরম আনন্দে সময় কাটাই।

ঐ দিন এক মেঘাসপে যাই। মার্কেটের কয়েক তলা বিশিষ্ট পার্কিং। কাপড়, জুতা ইত্যাদি কেনা হয়, নানা বর্ন ও জাতির বিচিত্র ক্রেতাদের সাথে এখানে দেখা হয়। রাতে আবার মামাতো বোন নিপার বাসায় দাওয়াত। সেখানে বাদশা ভাই কয়েক পরিবার আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। এখানেও এক সমৃদ্ধ খাদ্য সমাবেশ লক্ষ্য করি। নিপা ও বাদশা ভাই দম্পতির দুইপূত্র তাইরান ও ইব্রাহিম। তাইরান এখন নিউইয়র্কে আছে। ইব্রাহিম ছোট্ট শিশু কিন্তু খুব স্নেহপ্রবন। মেহমানদের বিদায়বেলায় সে কান্না জুড়ে দেয়। (চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন