সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মৌলভীবাজার শহরের একজন পিরানী আম্মাজানের খানকা শরিফে একদিন

 

মৌলভীবাজার শহরের একজন পিরানী আম্মাজানের খানকা শরিফে একদিন

আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী মৌলভীবাজারে চাকুরীরত থাকাকালে আমার শ্বাশুড়ি এই শহরের একজন পিরানীর কাছে মুরিদ হন। তারা এই পিরানীকে ডাকতেন আম্মাজান। আমার শ্বাশুড়ি মলিকা খাতুন এই আম্মাজানের একজন অন্ধভক্ত। আম্মাজানের স্বামী বদরুউদ্দিন সলিমি ছিলেন ফর্সা সুদর্শন লোক। আম্মাজানের নাম কেউ জানেন না। তিনি বেগম তাইয়্যেবা বদরুউদ্দিন সলিমি নামে পরিচিত। তিনিও নাকি চিশতিয়া তরিকার একজন পীর। আম্মাজান ও তার পীর স্বামী দুইজনই উচ্চশিক্ষিত এমএ ডিগ্রিধারী। আমি বুঝলাম এক ছাদের নিচে বসবাসকারী দুইজনের এই সুখী পীরদম্পতি তাদের শিষ্যশিষ্যাদের কাছে ছিলেন এক ঘরমে দুইজন পীর ও পীরানী, অর্থাৎ একটি যোগল আদর্শ পীরদম্পতি। তারা দুজন অবাঙ্গালি পশ্চিমের উত্তরপ্রদেশের লোক। এক সময় আদমজি জুটমিলে চাকুরি করতেন। পরে আধ্মাত্মিক শিক্ষা বিতরণে মৌলভীবাজার শহরে এসে আস্থানা স্থাপন করেন এবং এখানকার প্রচুর নরনারী তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বছরের বিভিন্ন সময় উরুশ উপলক্ষে আম্মাজানের তরফ থেকে আমাদের বাসায় প্রায়ই নিমন্ত্রণ পত্র আসত। আমি একজন অতি আগ্রহী লোক, শ্বাশুড়ির ও বউয়ের মুখে আম্মাজান এবং তার পীর স্বামীর গল্প শুনেশুনে আমার স্বাদ জাগে, একবার এই খানকায় উরুশ মোবারক দেখে আসলে কেমন হয়। শৈশবে আশপাশের কিছু পীরবাড়ির গল্প ও আলৌকিক কাহিনি শোনে কান জালাপালা করত।  

একবার দাওয়াতপত্র পড়ে জানলাম দিল্লি হতে একজন বুজুর্গ ওলি আসবেন, যিনি সবার কাছে দিল্লির হুজুর নামে বিখ্যাত এবং তার আগমন উপলক্ষে এই উরুশের আয়োজন। আমন্ত্রণ পত্রে এই ওলি আল্লাহের নামের আগেপিছে একগাদা লকব ও উপাধির বর্ণনা পেলাম। এই লকবগুলো হচ্ছে শায়খুল মাশায়েক আলহাজ্ব হজরত খাজা গরিব নেওয়াজ চিস্তি শাহ মুহাম্মদ আব্দুস সমদ সাহেব কিবলা ফরিদি ফখরি সলিমি রহমতুল্লাহে আলায়হি। এক মাইল লম্বা এই উপাধিমালার কোন অংশটা যে পীর সাহেবের প্রকৃত নাম তা বের করতে হলে কোন সদ্য মুরিদ লোককে আতশি কাচ নিয়ে গবেষণায় নামতে হবে। এই লকবগুলোর মানে জানতে হলে তাকে রীতিমত কিছুদিন স্টাডি করতে হবে আবশ্যই। এধরণের লকব বাংলাদেশের প্রায় সব পীরহুজুররা নিজ নিজ নামের সাথে ব্যবহার করে থাকেন। এইসব উপাধি হয়ত স্বঘোষিত কিন্তু আশেকান অনুমোদিত।

২০১২ সালের প্রারম্ভে কোন একদিন এই উরুশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি ছিল সরকারি ছুটির দিন। আমার বাহনটি নিজে চালিয়ে পিতা পুত্র ও গিন্নী আমরা এই তিনজন সাত সকালে সিলেট হতে মৌলভীবাজার পানে ছুটলাম। জেলাশহরে ঢুকে শ্রীমঙ্গলরোড গিয়ে মোস্তফাপুর রাস্থায় ঢুকলাম। কারটি অনেক ভিতরে যাবার পর ধানক্ষেতের মধ্যে পাকা ওয়ালঘেরা অনুমানিক পাচচল্লিশ বিঘা আয়তনের একটি বিশাল পীরানীবাড়ির সন্ধান পেলাম।

বাহিরের মাঠে আম্মাজানের মুরিদদের বেশ কয়েকটি গাড়ি পার্কিং করা আছে। আমাদের কার ওখানে রেখে আমরা গেটে ঢুকতেই বামদিকে মধ্যযুগীয় দিল্লির ডিজাইনে নির্মিত একটি মসজিদ ও ডানদিকে পীরবাড়ির একটি বড়পুকুর। আমাদের আত্মীয় দেওয়ান জহির মামু আম্মাজানের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। সামনে তাকে পেয়ে গেলাম। তিনি এই সওয়াবের কাজের সব আঞ্জাম দিতে দারূণ ব্যস্ত সময় পার করছেন। আগত মেহমানদের খেদমত, খানাপিনা, আম্মাজানের সাথে বাহিরের যোগাযোগ রক্ষা এসব দায়িত্ব তার কাঁধে চেপে আছে।

যথেষ্ট বয়স্ক দেওয়ান জহির মামু ছিলেন বেকার, একবার আম্মাজান তার মুরিদা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর পত্নীকে তার অতি ভক্ত মুরিদ দেওয়ান জহির মামুকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেন। দেওয়ান জহির মামুর না আছে তেমন লেখাপড়া তদুপরি বয়স পাঁচ চল্লিশ কবে যে পার হয়েছে কেউ তা বলতে পারেনা। এই ধরনের একজন লোককে একটা টেকসই চাকুরি দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এবার দেওয়ান জহির মামুর বয়স কমিয়ে যুবক সাজিয়ে তাকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যানবাহন রাজ্যের ব্যবস্থাপক করে দেওয়া হল।

জহির মামু চাকুরি হল কিন্তু মৌলভীবাজার হতে সিলেটে এসে থাকবেন কোথায়? এবার আম্মাজানের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পেয়ে যান বেশ জায়গা সহ বাসা। জহির মামু সব সময় পান চিবাতেন, বেশি বেশি কথা বলতেন। তার হালকা পাতলা চিকন বডি হেলিয়ে দুলিয়ে সিলেট শহরে আম্মাজানের মুরিদ মুরিদাদের বাসায় বাসায় গিয়ে দাওয়াত কাজ পরিচালনা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি সর্দারি এবং আম্মাজানের খেদমতি কাজ তিনি একসাথে সমান তালে চালিয়ে যান।   

এবার আমি পিরানীবাড়ির পুকুরঘাটের পাকা আসনে বসতেই একজন মুরব্বী দৌড়ে এসে বললেন, আপনি এই কি করছেন? জুতা নিয়ে ঘাটে উঠে গেছেন। আমি বললাম কেন, কোন ভুল হয়েছে নাকি?  জিঞ্জেস করতেই তিনি আর রেগে গিয়ে বললেন সেন্ডেল নিয়ে পুকুরঘাটে উঠতে আম্মাজানের নিষেধ আছে। যাক তখনই আমি জুতা খোলে ঘাটের নিচে রেখে দিলাম। একদিকে আম্মাজানের টিনের একটি বড়সড় পাকঘর, সেখানে মুর্শেদদের নিয়ে আসা পণ্য সামগ্রী দিয়ে বড়বড় ডেগে শিরনি রান্না করা হচ্ছে।

পুকুরঘাট হতে নেমে একটু এগুলেই পুকুরপারে একটি মাজার, এই মাজারটি একটি গম্বুজওয়ালা সুন্দর পাকাভবনের মধ্যে রয়েছে। ভবনের ছাদে ঝুলে আছে ঝাড়বাতি, পুষ্পঝাড়, পুষ্পমাল্য, রঙিন বেলুন ইত্যাদি। এক সময় আসলেন মৌলভীবাজারের তিনবারের সাংসদ বেকামুরা গ্রামের আমার বেয়াই গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। এমপি সাহেব তখন বয়সের ভারে জর্জরিত। তিনি উচু ডিবি করে নির্মিত পাকা গিলাফ ছড়ানো মাজারের কবরটির কাছে দাঁড়িয়ে জেয়ারত করতে লাগলেন। তার দেখাদেখি আমিও জেয়ারত করলাম। মোনাজাত শেষ হলে তার কাছে জানতে চাইলাম আমাদের জেয়ারত করা মাজারটি কোন সে ওলি আল্লাহের? তিনি জবাব দিলেন মাজারটি কোন মানুষের নয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে কিসের মাজার? তিনি বললেন দাতের মাজার। এখানে নাকি কোন একজন পীরের দান্দান মোবারক দাফন করা হয়েছে। তাই এটি মাজারে দান্দান শরিফ।

খুব সম্ভব আম্মাজানের পীরস্বামী এই দাত সুদূর দিল্লি হতে নিয়ে এসে এখানে পুতে মাজার তৈরি করেছেন। তারপর শোনলাম এখানে এই দাতের মাজারের ভিতর বসে কাওয়ালি গানের আসর। শোনে আমার মনে হল এসব হয়ত দিল্লি আজমিরের ধর্মীয় মাজার সংস্কৃতির এক মিনি সংস্করণ হতে পারে। মৌলভীবাজারের সহজ সরল জনতা সহজেই এই পীর দম্পতীর ধর্মীয় শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নেয়। এই সুরম্য মাজার ভবনের ভিতর আরেক পাশে দেখলাম একটি কবর, সবাই বললেন আম্মাজানের জীবন সহচর বদরু উদ্দিন সলিমী পীর সাহেবের জীবনের ইতি হলে তাকে এই কবরে চিরশায়িত করা হয়। তখনই ভাবলাম ভবিষ্যতের কোন একদিন হয়ত আম্মাজানও তার ভবলীলা সাঙ্গকরে এইখানে পীরস্বামীর সন্নিকটে এই ভবনে ঘুমিয়ে যাবেন।

পীর সাহেব মারা যাবার পর আম্মাজান বেশ দক্ষতার সাথে এই পিরাকী সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হল আম্মাজানও বুড়ো হয়ে গেছেন। তিনি আল্লাহের বাড়ি চলে গেলে এই এত মুরিদ মুরিদাদের দরবার শরিফ পরিচালনা করবে কে? কারণ এই অতি সুখী পীরদম্পতির একটিই দুঃখ যে তাদের কোন সন্থান সন্ততি নেই। মুরিদদের বিশ্বাস আম্মাজানের দোয়ায় অনেকের সন্তান হয় অথচ আম্মাজান সন্তানহারা। নিঃসন্তান আম্মাজান সুদূর দিল্লি হতে নিজ ভাইপোকে এনে কয়েক বছর লালন পালন করেন। এক দঙ্গল শিষ্য শিষ্যরাই যেন তাদের সন্থান সন্ততি। কিন্তু ওরা তো বাহিরের লোক, তারা এই উত্তরভারতীয় পীরপিরানীর রক্ত সম্পর্কের কেউ নয়। তাই সুদূর দিল্লি হতে ভবিষ্যতে এখানকার পীর পদে গদীনশীন হতে প্রতি বছর মহড়া দিতে আসেন আম্মাজানের আপন পোষ্য ভাইপো এই দিল্লির পীর সাহেব। আম্মাজানের পর তিনিই হবেন এই দরবার শরিফের ধর্মগুরু পীরানে পীর হুজুরেকেবলা দিল্লির হুজুর।

এক সময় আমি বিষ্মিত হয়ে দেখলাম, আমার ফুফুতো ভাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী এসে সপত্নীক হাজির। শোনলাম তিনিও সস্ত্রীক আম্মাজানের ভক্ত মুর্শিদ। বারান্দাসহ সামনে একটি লম্বা টিনের ঘর। এই ঘরটিতে হোটেল কক্ষের মত বেশ কয়েকটি কোঠা রয়েছে। আম্মাজানের প্রধান ঘরে না তুলে সম্মাণিত ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবকে সেই মুরিদঘরের একটি কক্ষের মেঝে পাতা বিছানায় বসানো হল। অবশ্য এই টিনের ঘরটি বেশ ঝকঝকে তকতকে।

সিলেট হতে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আসলেন, যাদের বাড়ি মৌলভীবাজার। মৌলভীবাজারের যে সব গরিব মেধাবী ছাত্ররা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেত, আম্মাজান তাদেরকে লেখাপড়ার খরচ দিয়ে সহায়তা করতেন। চিকিৎসক হয়ে এখন তাদের প্রতিদান দেবার পালা। অনেক অনেক গাড়ি চালিয়ে এত মেহমানরা আসলেন যে, কারপার্কিং স্পেসটা একদম পূর্ণ হয়ে গেল। এবার প্রচুর টাকা জমা হল। লন্ডন হতে কে একজন সওয়াব হাসিলের জন্য একলক্ষ দশ হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছেন। আর পাঁচ, দশ, পনের, বিশ হাজার করে টাকা আসতেছে বেশুমার।

এবার কে কতবার করে তাছবিহ পড়েছেন, দুরুদ পড়েছেন, জিকির করেছেন, কোরান তেলাওত করেছেন, নফল নামাজ পড়েছেন, হিসাব করে সব সাদা কাগজে লিখে লিখে আম্মাজানের দরবারে পাঠিয়ে দেন। সকল মুরিদ মুরিদার এইসব সওয়াব একত্রিত করে বিশাল স্থুপিকৃত আকারে মহান আল্লাহ তায়ালার পাক দরবারে একসাথে পেশ করবেন পিরানী আম্মাজান। তারপর আল্লাহপাকের কাছে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে সবার জন্য রহমত বরকত ও নিয়ামত প্রার্থনা করবেন তিনি।

ভক্তদের মনে আম্মাজান ও তার পীর স্বামীর প্রভাব অপরিসীম। ভক্তরা তাদের সন্তানদের বিয়ে সাব্যস্ত করার আগে পীরবাড়ি আসতেন। পীরসাহেব ইস্তেখারা করে রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখতেন এই সম্মন্ধ ভাল হবে কিনা। তারপর তিনি স্বপ্নের তাবির করে সিন্ধান্ত দিতেন এখানে বিয়ে দেওয়া যায় কিনা। তার দেখা স্বপ্নের নেতিবাচক ফলাফল হলে বিয়ের এই আলাপ এখানেই পরিসমাপ্ত, আর ইতিবাচিক হলে এই বিয়ে ঠেকায় কে? শিষ্যরা তাদের নবজাতকের নামকরণেও পীরবাড়ির স্মরণাপন্ন হতেন। আম্মাজান কিংবা আব্বাজান নবজাতকের নাম রেখে দিলে তারা এই নামটি খুব কল্যাণকর মনে করত। শিষ্য শিষ্যাদের সদ্যজন্মা নবজাতকদের নাম রাখা এবং বিয়ে দেবার মত জটিল সিন্ধান্ত গ্রহণের কাজটাও পীর দম্পতি সহজেই সেরে দিতেন।   

ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ভিতরের মহিলাদের অজু খানায় অজু করতে নিজের অজান্তে একটি বেয়াদবী ধরণের কাজ করে ফেলেন। বেয়াদবীটা হল তিনি খালিপায়ে না গিয়ে স্যান্ডেল পায়ে অজু করতে থাকেন। আম্মাজানের একজন মুরিদা তেড়ে এসে বললেন, হেই বেটি, হেই বেটি, তুমি এই কি করছ? যাও, তাড়াতাড়ি বাইরে স্যান্ডাল রেখে এসো। ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী এই মুরিদার এধরনের আচরণে রাগ সামলাতে পারলেন না। তিনি ধমক দিলেন, চুপ হও? আমি সিলেটের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক, তোমাদের আদব কায়দা বলতে কিছুই নেই। আমাকে বেটি বেটি করতেছ? আমারে কি মনে করছো? আমি কি কারো ঘরের কাজের বেটি?

বিকেল হবার আগে আমাদের সিলেট ফেরার তাড়া আছে। ডঃ সদরুউদ্দিন ভাই এবং আমরা অনেকে তাই পীর সাহেবের সাথে দেখা করার আবেদন পেশ করলাম। অন্দরমহল হতে জবাব পেলাম, দিল্লির হুজুর এখন মোরাকাবায় আছেন তাই কারও সাথে তিনি দেখা করবেন না। জোহরের নামাজ পড়তে তিনি যখন বেরুবেন, তখন মোলাকাত করতে হবে।

মহিলা মুরিদাগণ ভিতর বাটিতে চলে গেলেও পুরুষরা বাহিরে জমে জমে ভক্ত জনতার এক এলোমেলো জটলায় পরিণত হয়। সবাই দিল্লির হুজুরের দেখা পেতে উসখুস করছেন। কেউবা তাকে একনজর দেখে খয়েরে বরকত হাসিলে জানালার ফাঁক দিয়ে উকিঝুকি দিচ্ছেন। হঠাৎ পীরবাড়ির মসজিদ হতে  জোহরের আজানের ধ্বনী ভেসে এল। আজান শুনে ভক্তদের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল, এবার দিল্লির হুজুর বেরুবেন। অন্দরঘরের সদর দরজার সামনে ভক্তদের ভীড় জমে গেল। হুজুরের হাঁটার রাস্থা খোলা রেখে দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে ভক্তরা দাঁড়িয়ে যান। এই সারি মসজিদ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সদর দরজার একপাশে হুজুরের বডিগার্ড হয়ে মাথা নিচু করে দাড়ান আমাদের দেওয়ান জহির মামু ও জনকয়েক তরুণ ভক্ত।            

এবার সদর দরজা ফাঁক হল। বেরিয়ে আসলেন মহামান্য ওলিয়ে কামেল আম্মাজানের পালিত ভাইপো দিল্লির হুজুর। একদম সাদামাটা একজন মোল্লাহ মানুষ। গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, গালভরা পাতলা লম্বা দাড়ি। সবার মাথা নিচু হয়ে আছে এই অল্প বয়সী হুজুরের প্রতি এক অজানা ভক্তিশ্রদ্ধায়। হুজুর ছূটলেন মসজিদের পানে, পিছনে পিছনে পঙ্গপালের মত ছুটে গেল ভক্তের ঝাঁক। তিনি মসজিদের ডান দরজা দিয়ে ঢুকলেন। লোকরা কেউ এই দরজা দিয়ে না ঢুকে অন্যান্য দরজা দিয়ে মসজিদে ঢুকলেন। কেবল আমি প্রথা ভেঙ্গে দিল্লি হুজুরের দরজা দিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়লে সবাই এমনভাবে আমার পানে খিটমিট করে তাকালো যেন আমি গুরুতর কোন অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। সুউচ্চ ছাদের গোলাকার খুটির সুরম্য মসজিদ। দিল্লির হুজুর ঈমামতি করলেন। নামাজ সমাপ্ত হলে হুজুরের পা ছুঁয়াছুঁয়ি করার জন্য তীব্র ঠেলাঠেলি লেগে গেল। ভীড় ঠেলে এতসব লোকের কনুইয়ের গুতো খেয়ে সাংসদ গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এবং ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সদরুদ্দিন চৌধুরী দিল্লির পীরের পবিত্র অঙ্গ ছুয়ে জীবনধন্য করলেন। আমি এই ধাক্কাধাক্কি হতে নিরাপদ দূরে সরে রই এবং পিরানীবাড়ির উত্তরপ্রদেশীয় ধাঁচে রাঁধা মজাদার তবররুখ খেয়ে সন্ধ্যারাতে ফিরে এলাম সিলেট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন