রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫

শীতের বৃটেন, বরফঢাকা ইস্তম্বুল ও বসন্তের তায়েফ সফর

 শীতের বৃটেন সফরঃ

কবিড উনিশ মহামারির পর আমাদের বিদেশ যাওয়া আর হয়নি। লন্ডনবাসী আমার ভাই তাহমিদ চৌধুরীর কন্যা নওশিন চৌধুরীর বিয়ের তারিখ ছিল ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৪। এই বিয়েতে যোগ দিতে আমি সপরিবারে বৃটিশ দুতাবাসে ভিসা আবেদন করি। ভিসা আবেদনের সময় ছাত্রদের কোঠা আন্দোলনের ধমকা হাওয়া বইছিলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র‌্যাবের গুলীতে জনকয়েক ছাত্র জনতা নিহত হলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সারা দেশে আগুন জ্বলে উঠে। ভিসা চলে আসবে এমন এক সময়ে বৃটিশ দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটের দাদাপীরের মাজারের সামনে যে অফিসে বেশ কয়েকটি দেশের ভিসা প্রসেসিং হয়, সেই অফিসেও তালা পড়ে। শেখ হাসিনার ষোল বছরের সুদীর্ঘ শাসনের অবসান হল ৫ আগস্ট ২০২৪, দুই মেয়াদের তিনি বাইশ বছর বাংলাদেশ শাসন করেন। শেখ হাসিনা দক্ষিণ এসিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী, খুবসম্ভব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের নারী শাসিকা। 

শেখ হাসিনার বিদায়ের পরও অনেকদিন বিভিন্ন দেশের দূতাবাস অচল থাকে। অনেক অপেক্ষার পর আমি, জেফার ও ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী যখন ভিসা পেলাম তখন বিয়ের তারিখটা পার হয়ে গেছে। দুঃখ পেলাম, আমেরিকা ও কানাডা হতে অনেক আত্মীয়স্বজন লন্ডনে আসেন, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের হতভাগা আমরা দেশের অপরাজনীতির অস্থিরতায় যথাসময়ে যেতে পারিনি লন্ডন। 

অনেক অনেক দিন পর লন্ডনে বহুবছর ধরে অদেখা আত্মীয়দের সাথে মিলনের সুযোগ হারালাম, বিশেষ করে মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী সিদ্দিক ও বড়মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ছাদিককে লন্ডনে শেষবারের মত দেখার সুযোগ হারাই, তারা দুইজনই ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্তেকাল করেন। মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরীকে শেষবার দেখি ভার্জিনিয়ায় ২০১৫ সালে এবং বড়মামা আব্দুর রহমান চৌধুরীকে দেখি ২০১৮ সালে নিউইয়র্কে। সেই দিনগুলোতে ভাবতে পারিনি, এই দেখাই তাদের সাথে জীবনের শেষ দেখা হবে। লন্ডনে তাদেরে শেষবার দেখার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল, মহান আল্লাহ পাক তাদেরে জান্নাত দান করুন।    

বাংলাদেশে কখনো তুষারপাত হয়না। জীবনে এখনও তুষারপাত দেখিনি। আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা ইত্যাদি শীতপ্রধান দেশে আমরা বারবার গিয়েছি কেবল তাদের গ্রীষ্মকালে। তাই এসব দেশের শীতকাল ও তুষারপাত কোনটাই দেখার সুযোগ হয়নি। ভাবলাম, বিয়ের তারিখ যখন পেরিয়ে গেছে লন্ডনে শীতে যাবো। শীতের দেশে শীতের স্বাধ নেবো, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তুষারপাত দেখে নেবো।

এক ঢিলে তিনপাখি শিকারের আশায় বেগমের পরামর্শে আমরা তিনজনের জন্য উমরা হজ্জের ভিসা নেই। ইউকে ভিসা থাকায় সহজেই অনলাইনে তুরস্কের ভিসা পেয়ে যাই। বৃটেন, টার্কি ও সৌদি আরব, এই তিন দেশে ঝটিকা সফরের সিন্ধান্ত নেই। যাত্রার সাপ্তাহদিন আগে নূরজাহান বেগম বিদেশ সফরে অপারগতা জানান। বেশ গচ্চা দিয়ে তার রিটার্ণ টিকেট বাতিল করি। শেষমেষ বাপবেটা দুইজন মিলে আকাশে উড়াল দেই।

তারিখটা ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দুপুরে সিলেট থেকে বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছি। উবার ডেকে চলে যাই ঢাকা সেনানিবাসের বিমান বাহিনীর চন্দ্রিমা টাওয়ারে ভাগ্নি মুফতি দানিজা বেগম পলির বাসায়। ভাগ্নিবর কোয়ার্ডন লিডার ইসতিয়াক আহমদ চৌধুরী ভাদেশ্বরের জাতক। সেনানিবাসের ভিতর খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পুস্পসজ্জিত। সুইমিংপুল, উদ্যান, লেকপুকুর সব আছে চারপাশে। পুরো এলাকা উন্নত দেশের নেইভারহোডের মত সাজানো গুছানো। সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরুলে জেফার আলকসজ্জা দেখে বলল, সারাটা এলাকাই একদম আমেরিকার মত পরিপাটি করে সাজানো। যাক, বাংলাদেশে অন্তত কিছু কিছু জায়গা উন্নত দেশের মত সুসজ্জিত, ইস কেমন মজা হত, সারাটা বাংলাদেশ যদি এমন হত। 

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে বিমান ছাড়বে রাত ১ টা ৫০ মিনিটে। পলির বাসায় ডিনার সেরে উবারে রাত ১১ টায় সোজা চলে যাই ঢাকা বিমানবন্দরে। সৌদি এয়ারলাইনের প্লেন যথাসময়ে উড়াল দেয়। একটু পর খাবার আসে, বেশ মজাদার খাবার সাবাড় করে ঘুমিয়ে পড়ি। সৌদি ভোর সাড়ে ছয়টায় উড়োজাহাজ জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এসিয়ার সবচেয়ে বড় এই এয়ারপোর্ট আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে আবার ঘুরে ঘুরে দেখি। মাত্র দুইঘন্টা পর সাড়ে আট ঘটিকায় সৌদি এয়ার লাইনের সংযোগ ফ্লাইট জেদ্দা ছেড়ে লন্ডন যাত্রা শুরু করে। এবার মরক্কোর মজাদার খাবার কুসকুস চলে আসে। মাংস ও সবজি সজ্জিত গরম পোলাও। সাথে চকলেট, কেক, প্যেস্টি ও পানীয়। বিমানবালা আমাকে ইশারায় অনুমতি দিলে কম্বল মুড়ে নিদ্রা যাই পিছনের তিনটি খালি সিটের সংযুক্ত বিছানায়। বিমান ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ফ্রান্সে এলে আমার ঘুম ভাঙ্গে। নিচে ইংলিশ চ্যানেল পার হতেই লন্ডনের আকাশে চলে আসি। আমরা হিথ্রো বিমানবন্দরের চার নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বেরিয়ে আসতেই লন্ডন সময় ১৩ টা বেজে যায়। ব্যাগের সন্ধানে ব্যাল্টে এসেই দেখি আমার বড়ভাই তাহমিদুর রহমান চৌধুরী আগে থেকেই এখানে অপেক্ষায় আছেন। শীতের লন্ডনে এসেছি, তাই সোয়েটার পরাই ছিল। এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে দেখি চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন, কেমন যেন আবছা অন্ধকার, রাত নাকি দিন বুঝা যাচ্ছেনা। ভীষণ শীত যেন সোয়াটার বেদ করে ভিতরে চিমটি মারছে। লিফটে গ্রাউন্ড লেবেলে নেমে হিথ্রো বিমানবন্দরে পার্কিংয়ে রাখা মার্সিটিজ বেঞ্চ গাড়ির দরজা খুলে বড়ভাই দুইটি গরম জাম্পার এগিয়ে দেন। তা পরামাত্র শীত পালায়। 

লন্ডনে তখন এক অদ্ভুদ নীরবতা, পাতাঝরা গাছেরা জড়াজড়ি করে রাস্তার দুপাশে সামারের অপেক্ষায় অধির আগ্রহে দাড়ানো। কুয়াশার চাদরে মুড়ানো ঘুমন্ত লন্ডন শহর যেন তখনো জাগেনি। উত্তর লন্ডন হতে গাড়ি যাচ্ছে পুর্ব লন্ডনের ডাগেনহাম ইস্টে। এই তৃতীয়বার দেখা লন্ডন শহরকে এক ভিন্ন লন্ডন মনে হয়, যেখানে গাঢ় সবুজের জায়গা দখল করে নিয়েছে সারি সারি পাতাহীন মরাবৃক্ষের বনবীথি। শীতের দিবস যেন হয়ে গেছে রূপালি রাত। 

লন্ডনের বাড়িগুলোয় ঢুকেই জুতা রাখার স্থান। বাসায় ঢুকে অনেক বছর পর নয়নের সামনে পেয়ে যাই ভাবী বিলকিস বাহার চৌধুরী ও ভাতিজি নওসীন তাবাসসুম চৌধুরীকে। ঘরের বাহিরে ভীষণ ঠান্ডা, ভিতর নাতিশীতুষ্ণ। তিনতলা বাসায় পাঁচটি বেডরূম, তিনটি বাথরূম, দুইটি ড্রয়িংরূম, একটি অফিসরূম, বড় ডাইনিং কিচেন, বাগান বারান্দা এবং  সুন্দর বাগানে ছাতার নিচে গোলাকার সিটিং চেয়ার টেবিল সাজানো। বাসার সামনে রাখা আর দুইটি মার্সিটিজ ব্যঞ্চ, যার একটি ভাতিজা আজফারের, অন্যটি ভাতিজি নওসিনের। গাড়ির ব্যাটারি চার্জের যন্ত্রপাতি জুতাকক্ষে বসানো। 

এইদিন বিকেলে অনেক আত্মীয়স্বজনদের আগমন ঘটে। সন্ধ্যায় আসেন ভাতিজি নওসীনের হাজব্যন্ড নুরুজ্জামান খান, বেয়াই খাইরুজ্জামান খান ও বেয়াইন শিল্পী এ ওয়াহেদ। তাদের গ্রামের বাড়ি ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর নামক গ্রামে। বেয়াই বেয়াইন বেশ মিশুক সদালাপী মানুষ মনে হয়েছে। একে একে জাহেদ, লবিদ, হুদহুদ, তাইরান ও মামাতো ভাই আফজলের শুভাগমন ঘটে। সন্ধ্যা রাতে সারাটা বাসা মেহমানে জমজমাট হয়ে যায়। সারাদিন নওসীন ও ভাবী বেশ মজাদার অনেক ব্যঞ্জনের খাবার রান্না করেন।

অনেকদিন পর টিভি রুমে সবাই মিলে ক্যারম বোর্ডে খেলি। লন্ডনের নীরব পরিবেশে কৈশরের ক্যারম খেলার আনন্দস্মৃতি আবার জেগে উঠে মনে। অনেক রাত হলে সবাই আবার নিজ নিজ বাসায় ফিরে যান। ঘরের ভিতরে হিটার থাকায় তেমন গরম নেই। বাহিরে এত ঠান্ডা যে, মেহমানদেরে গড়িতে এগিয়ে দিতে বাহিরে আসার আগে জাম্পার পরে নিতে হয়। তারপরো যেন হিমঠান্ডা এসে খোলা নাকে মুখে ছুরিকাঘাত করে।  

পরদিন ব্রেকফাস্টে আছে কেক, বিস্কুট, চকলেট, ডিম, লুফ, কফি, কলা ও নানা জাতের ফলমুল ইত্যাদি। এমন সময় পাশের বাসার ওয়াল বেয়ে একটি খেকশেয়াল ছাদে বসে। দূরে লেকের উপর সিগ্যাল পাখির ঝাঁক উড়তে দেখা যায়। বড়ভাই বললেন আজ তার কোন কাজ নেই, তাই আমাদেরে নিয়ে ঘুরবেন।শীতের লন্ডন। সূর্যদেবতা যেন ডুমুরের ফুল। দিন খুব ছোট, রাত সুদীর্ঘ। দিনকে খেয়ে ফেলে রাত। রাত ও দিন, দুই মিলেই চলে এই শহরের ব্যস্ত মানুষের প্রাত্যহিক কাজ। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আমরা লন্ডনের অপরূপ সুন্দর ব্যবসা কেন্দ্র ক্যানারী অফে চলে যাই। ক্যানারী অফে আগেও গিয়েছি সামারে। আমাদেরকে নামিয়ে ভাই তাহমিদ চৌধুরী গাড়ি নিয়ে চলে যান।  

শীতের দিনে ক্যানারী অফ হেঁটে হেঁটে দেখতে বেশ ভাল লাগে। পৃথিবীর সব সেরা সেরা বহুজাতিক কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় এখানে। নদী ও হৃদের এক অপূর্ব সমম্বয় ক্যানারী অফ। শাপলা ফুটেছে, হাঁসেরা ছানা নিয়ে সাঁতার কাটছে। বড় বড় রাস্তার কিনারে কিনারে যথেষ্ট দূরে দূরে হাইরাইজ ভবনের সারি। ক্যানারী অফ আমাদের মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকার মত ব্যস্ত অফিসপাড়া, তবে একেবারে নীরব নিস্থব্ধ। এখানে নেই গাড়ির ভ্যাপুর শব্দ, মানুষের জটলা, হৈচৈ চেচামেচি, এটা শহর নাকি সুন্দরবন? দুইচার জন পর্যটক লেকের পারে পারে বাগানে বাগানে ঘুরে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। শীতল বাতাসে ওয়াকিং এবং জগিং দুইই খুব আনন্দদায়ক। রোদহীন কুয়াশাভেজা দিনে জেফার ও আমি ক্যানারি অফের লেক বাগানে ঘন্টাখানিক সময় হাঁটাহাঁটি ও দৌঁড়াদৌঁড়ি করে প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর পার্কিং রাস্তায় ফিরে আসি। হ্যাঁ, ঠান্ডা দেশে যতই ব্যায়াম করুন, যতই কাজ করুন না কেন, কোন ক্লান্তি আসেনা, উল্টো আরাম লাগে। এই প্রকৃতি এসব দেশের মানুষকে করে খুব পরিশ্রমী করে দেয়। এই পরিশ্রম এসব দেশকে সৌভাগ্য দান করে। 

ক্যানারি অফফ হতে বেরিয়ে কাছেই আমার সহপাঠী বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের বাসায় যাই। ছোট্ট নিরিবিলি বাসা, সামনে পার্কিং পিছনে শখের বাগান। ভাতিজা ইব্রাহিম স্কুলে, তাকে ছাড়া ভাতিজি সাকিবা, ভাবী ইভাঙ্কা ও সিদ্দিক নির্ঝরের সাথে দেখা হয়। এখানে নাস্তা সেরে ফটোসেশন করে বের হই। ইভাঙ্কা ভাবির শরীর বেশ ভারী হয়ে গেছে। তাই কেবল ঘুমান, আর দুশ্চিন্তায় ভোগেন। আল্লাহ তাকে নিরাময় করুন, আমিন।  

সিদ্দিকের পরামর্শে বাসার সামনে ভিন বাসার পার্কিং স্পেসে গাড়ি রাখা হয়। কিন্তু কখন যেন নিঠুর পুলিশ এসে আশি পাউন্ড মানে প্রায় তের হাজার টাকা জরিমানা গাড়ির সামনের গ্লাসে নোটিশ স্যাঁটে দেয়। এবার ফুফুতো বোন সেবি আপাকে দেখতে ছুটলাম তার একমাত্র কন্যা এনবের বাসায়। এনবের বিয়ে হয়েছে গোলাপগঞ্জ উপজেলার কদমরসুল গ্রামে। সবাইকে খুব স্নেহ করেন এমন মানুষকে সিলেটি ভাষায় বলে মায়াবি মানুষ। সেবি আপা সারাজীবন একজন মায়াবি মানুষ ছিলেন। অনেক বছর ধরে লন্ডনে একমাত্র মেয়ের সাথে নাতি নাতনি নিয়ে সুখেই ছিলেন।                      

সেবি আপার অনেক বয়স হয়েছে, তাই শ্রবণশক্তি নেই, স্মৃতিশক্তিও দূর্বল।  ভাগ্নি এনব বললেন, মা যা জানতে চাইবেন, কেবল হ্যাঁ বলবেন, না বলা যাবেনা। তাহমিদ চৌধুরীকে সেবি আপা সহজে চিনলেও আমি ও জেফারকে চিনতে বেশ বেগ পেতে হয়। আমরা পরিচয় দিলে চিনে নিয়ে স্নেহে জড়ায়ে ধরে জানতে চান তার মামারা ও মামীরা কেমন আছেন। তার নানা ও নানি অর্ধশতাব্দী আগে তিরোধান করলেও সেবি আপার ধারণা তারা জীবিত। তারা কেউ বেঁচে নেই, তবুও বললাম ভাল আছেন। এবার সেবি আপা তাদের বেশ স্মৃতিচারণ করে চোখের জল ফেললেন। বৃটেনের চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছে মনে আঘাত পাবেন এমন কিছু তাকে বলা বা শুনানো যাবেনা। 

১৩ ডিসেম্বর আমরা টাওয়ার হ্যামলেটে দিন পার করি। এখানে আসি ভূগর্বস্থ মেট্রো রেলে, তাই গাড়ি পার্কিংয়ের যন্ত্রণা নেই। টাওয়ার হ্যামলেট স্টেশনে অতীতেও দল বেঁধে এসেছি, বেরিয়ে টেমসের পারে হেঁটে হেঁটে অনেক আনন্দ করেছি। এবার দল নয়, মাত্র তিনজন এসেছি। একটি রেস্তোরায় আমরা দুপুরের খাবার খাই। ভিতরে সিট খালি নেই। বাহিরের বারান্দার টেবিলে খেতে বসে বেশ শীত অনুভব করি। লোহার যুগে লোহায় তৈরী লন্ডনের বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজ হেঁটে দেখি। টেমসের ঘোলা জলের দুইপারে অপরূপ সুন্দর লন্ডন দেখে আবার নয়ন ধন্য হয়। 

জীবনে এই প্রথম আমরা টাওয়ার অব লন্ডন মিউজিয়াম পরিদর্শন করি। অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী তিনটি টিকেট কাটেন। ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালালের(সঃ) সিলেট আসার আড়াই শত বছর আগে ১০৬৬ সালে নরমেন রাজাদের নির্মিত এই প্রাচীন দুর্গ দেখা সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার। ঢুকেই রিপ্লেতে দেখা যায় সেই আমলের রাজাদের ছবি, বিবরণ ও শাসনামল। ভিতরের আরেক রিপ্লেতে বিভিন্ন যুগের সেনাইউনিফরম পরিহিত বৃটিশ বাহিনীর প্যারেড দেখানো হয়। বিভিন্ন যুগের ব্যবহৃত অস্ত্র, যুদ্ধপোকরণ, ইউনিফরম, ঘোড়া, তীরধনুক, তরবারি, বন্দুক, কামান ও রাজরাজড়াদের ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্যাদি যেমন রাজমুকুট, রাজদন্ড, রাজসিংহাসন, রাজবাহন ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। 

ইতিহাসের প্রতি আমার অতি আগ্রহের কারণে আমি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রাচীন দুর্গ ঘুরে দেখি। গেটের ভিতরে মুল দুর্গে ঢুকার পর ধারাবাহিক একমুখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক সময় সামনে প্রস্থান গেট দেখা যায়। এই হাঁটার পথে পথে অনেকগুলো বড় বড় কক্ষে কক্ষে সাজানো অজস্র পূর্ত সম্পদ দেখে নেয় সবাই। 

দুর্গটি দুইতিন তলা, ভূগর্বস্থ বিশাল চত্বর, উঁচু উঁচু ধাপের পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দুইতলার বিভিন্ন হলরূম ও উঁচু ওয়াচ টাওয়ার ঘুরে দেখি। ওয়াচ টাওয়ার হতে দেখা যায় লন্ডন টাওয়ার ও টেমসের ঢেউ। জাহাজ চলছে, নদীপারে ভবনমালার সারী, সূদুরের সুউচ্চ লন্ডন আই বৃত্তপথে উপরে যাচ্ছে।  

প্রায় দুইঘন্টা হেঁটে এখানে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল হতে আনা এত পুরাকীর্তি দেখি যে তার বিবরণ লিখলে একটি বড় পুস্তক হয়ে যাবে। ভারত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কোহিনুর হীরক দেখে মুগ্ধ হই। বৃটিশদের দুশমন হিটলার ও মুসোলিনীর তাম্রমূর্তি ইউরোপের অন্য দেশ থেকে এনে এই যাদুঘরে সযতনে রেখে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা মিউজিয়াম অবলীলায় ধংস করে ইতিহাসের সাক্ষি প্রমাণ চিরতরে নষ্ট করে দেই। আজ পুরান ঢাকার শাহসুজার প্রাসাদ শেষ, বংবন্ধু জাদুগর শেষ। বৃটিশরা গড়তে জানে, আর আমরা সবকিছু ভাংতে জানি।

এই বিশাল মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে রাজাদের বাসস্থান রাজভবনে যাই। সেখানে ডিউটি করছেন সেই যুগের ঐতিহ্যবাহী ইউনিফরম পরিহিত দুইজন প্রহরী। তারা বেশ সুন্দর অভিনয় করে ডিউটি বদল করেন। শিশুরা অবাক চোখে দেখে। তারা দাঁড়িয়ে গেলে মনে হয় ভবনের দুইপ্রান্তে যেন দুইটি মোমের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। 

এই ভবনে ঢুকে নরমেন রাজা উইলিয়াম-১, উইলিয়াম-২, হেনরি ও স্টিফেনের আমলের অনেক অনেক ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শন দেখার সুযোগ পাই। এই দূর্গ প্রাচীনকালে সামরিক দূর্গ ও রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। বিভিন্ন যুগে এটি কারাগার, টাকশাল, এবং অস্ত্রাগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্য ধরে রাখতে বিভিন্ন যুগের মত এখনো এই দুর্গে রাভেন পাখি পালন করা হয়। 

১৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। শীতের সকালে নাস্তা করে আমি ও জেফার একসাথে দুটো প্যান্ট ও গরম জামা পরে হাঁটতে বের হই। লন্ডনে তাহমিদ চৌধুরীর বাসার পাশের একটি সুন্দর ন্যাচারাল পার্ক হল বিমভেলি কাউন্ট্রি পার্ক। এই পার্ক আমার এতই ভাল লাগে যে অতীতে লন্ডনে এসে বার বার এই পার্কে ঘুরে বেড়িয়েছি। সামারের বিমভেলি সবুজেঢাকা এক বনফুলের মেলা। শীতে সারাটা বনে পাতাহীন জঙ্গল দেখে মনে হয় এযেন এক মৃতভূমি। 

বৃটেনে বারমাস বৃষ্টিপাত হয়, কুয়াশা ঝরে। তাই ভিমবেলি কাউন্ট্রি পার্কের ঝরনা, খাল ও হ্রদ সামারের মত শীতেও জলে টইটুম্বুর। বাংলাদেশের মত খরা বৃটেনে হয়না। ভাবলাম, আমাদের দেশে যদি অনুরূপ বারমাস বৃষ্টি হত, তাহলে নদীর জল নিয়ে ভারতের সাথে এত দেন দরবার করতে হতনা। 

বৃটেন ভাগ্যবান দেশ, দেশটা পাহাড়ি, সমুদ্র সমতল হতে অনেক উপরে, তাই এখানে বন্যা ও সুনামী নেই। বৃটেনের ধারকাছে ভূগর্বস্থ টেকনোটিক প্লেটের ফাটল বা জোড়া নেই। তাই এখানে ভূমিকম্প বিরল ঘটনা। ইংরেজরা তাদের জাদুঘরে গিয়ে কৃত্রিম ভূমিকম্প ও অগ্নেয়গীরির অগ্নিউৎপাত দেখে আসে।     

রাতে মৃদু বৃষ্টির সাথে তুষার ঝরেছে। ভিমবেলি পার্কের রাস্তার নানা প্রান্তে জল জমেছে, জলের উপর ভেসে আছে কুচি কুচি সাদা বরফ। পাখি উড়ছে, শেয়াল হাঁটছে, তবে সামারে দেখা খরগোসের দেখা পাইনি। পার্কের সম্পর্ণ মানচিত্রসহ এই বিশাল নেচারপার্কে কি কি পশু, পাখি, মাছ ও প্রাণি আছে, সেগুলোর ছবি ও নাম একটি সাইনবোর্ডে লিখা আছে। বিমভেলি কাউন্ট্রি পার্ক এত বড় যে দুইতিন ঘন্টা হেঁটেও সব দেখা সম্ভব হয়না। এখানে কি নেই, আছে খাল, আছে ঝরণা, আছে বনময় জলাভূমি যেখানে জলচর পাখিরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সাঁতার কাটছে। বিশাল খেলার মাঠ আছে বহির্বনের এক পাশে। দুই একজন শ্বেতাঙ্গ নরনারী কুকুর নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন। দুই একটা ঘোড়াও চরে বেড়াচ্ছে। নীরব নিস্থব্দ পরিবেশ। পানির উপর ভাসমান বরফ তখনো গলেনি। রোদের দেখা নেই। এমন নেচার বাংলাদেশে নেই। এ এক সম্পর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

আজ রাতে ভাতিজি নওসীনের বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণ পাই। আমরা বেশ কয়েক গাড়ি মেহমান সন্ধ্যার আলোআধারে লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে বেয়াই আখতারুজ্জামান খানের বাসায় হাজির হই। বেয়াইন শিল্পী খানমও বেশ অমায়িক ও মিশুক মানবী। বেয়াই ও বেয়াইন এমন মধুর সাহ্নিধ্য উপহার দেন যে মনে হয়নি তারা নতুন আত্মীয়, যেন জনম জনমের পরিচিত। বেয়াই আখতারুজ্জামান সম্ভবতঃ সিলেটে অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর কলেজমেট ছিলেন। বর নুরুজ্জামান খানের ভাইবোন ও তাদের পরিবারের অনেক সদস্য এসেছেন। এখানে ক্যারমের আসর জমে। গল্পে গল্পে সময় দ্রুত ফুরায়।

খাবার টেবিলে অনেক অনেক আইটেম খুব যতনে রান্না করা হয়েছে। রাংঢাকা ডিসের পরিবেশনা বেশ চমৎকার। সিলেটি আদালেবু দিয়ে রান্না করা হরিণের মাংশ আমার কাছে সেরা ব্যঞ্জন মনে হয়েছে। 

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ভাগনি মুফতি লতিফা খানম পপির কেমবার্লির বাসায় দুপুর ও রাতের ভোজনের নিমন্ত্রণ পাই। আমি, তাহমিদ চৌধুরী, নওশিন ও জেফার একটি গাড়িতে যাত্রা করি। রাস্তার দুইপাশে পাতাঝরা বৃক্ষসজ্জিত কৃত্রিম টিলা, অনেকটা সিলেটের চাবাগানের রাস্তার দৃশ্যাবলীর মত অপরূপ। রাস্তাকে নৈসর্গিক সাজে সাজাতে দুপাশে টিলা ও সজল খাল তৈরি করা হয় এদেশে, কিন্তু পত্রহীন বৃক্ষতলায় কোন শুকনো পাতা ছিটেফুটো নেই, কেবল সবুজ ঘাসের পরিপাটি অস্তরণ। সব রাস্তাই চার, ছয় কিংবা আট লেইন, সেই সাথে দুইদিকে গাড়ি রাখার আলাদা দুইটি হাফ লেইন।

কেমবার্লি একটি সুন্দর অভিজাত আবাসিক এলাকা। টিলাময় বন্ধুর এই এলাকার বাড়িঘর বেশ বড়সড় ও অত্যাধুনিক। কুয়াশার হিমেল দিন, আবছা রোদে ভাগ্নিবর সামাদ চৌধুরী একটি ব্লাঙ্কেট জড়ায়ে নিরিবিলি জনশূন্য রাস্তায় হাঁটছেন। হ্যাঁ, তিনি স্বাস্থ্য সচেতন একজন আন্তর্জাতিক ব্যাংক নির্বাহী। আগে গায়ে মেদ ছিল, এখন স্লিম হয়ে গেছেন। সামার উইন্টার বারমাসই তিনি নিয়মমাফিক হাঁটেন, ব্যায়াম করেন। সামাদ একজন চার্টার একাউন্টেন্ট ব্যাংকার। বহুজাতিক ব্যাংকের নির্বাহী হিসাবে নিউইয়র্ক, দুবাই ও লন্ডনে দায়িত্বপালন করেন।  

তিনতলা অট্টালিকার গেটে এসে রিমুট দিতেই অটো গেট খোলে যায়। গাড়ি ভিতরে ঢুকতেই আমাদেরকে বরণ করতে আঙ্গিনায় চলে আসে ভাগনি পপি, তিন নাতিন মাহদিন, মাহরিন ও মাহজাবিন। নাতি মেহদি কলেজ হোস্টেলে থাকায় তার সাথে দেখা হয়নি। আভ্যন্তরীণ সিড়িসহ তিনতলা নিয়ে একটি বিশাল বাসা। নিচতলার সামনে অফিসকক্ষ ও পিছনে বড় হলরুম। বিশাল পাকঘর, ডাইনিং, সিটিং রোম ও টি ভি রোম। পাকঘরে ছয়টি বৈদুতিক চুলা, চুলার উপর গ্লাস, ঘাসের উপর ডেগসি রেখে দিলে রান্না হয়ে যায়। চুল্লিতে কোন ধূয়া নেই, তাই ঘর কাল হয়না। চুল্লির তাপে হিমঘর গরম থাকে। 

বাসার পিছনের অঙ্গিনা জুড়ে সুরম্য ফুল বাগান ও বসার সাজানো স্পেস। মাহরিনকে বললাম, তোমাদের বাসা খুব সুন্দর, এত সুন্দর বাসা একটু ঘুরে দেখাও, তাকে নিয়ে তিনতলা পর্যন্ত ভিডিও করি। বিকেলে বাসায় আসে ভাগনা মুফতি লবিদ ও তার পরিবার। বাসা বেশ জমজমাট হয়ে যায়। 

একসাথে ষোলজন বসে খাবার মত বড় ডাইনিং টেবিল। বাসায় ঢুকার পর থেকে অনবরত নানান জাতের নাস্তা কফি শরবত আসে। জোহরের নামাজ পড়ে আমরা খেতে বসি। হরিণের মাংশ, স্যালমন ফিস, শুটকি বুনা, ভেড়ার মাংশসহ নানাপদের রান্না। পপি সামনে রান্না করা আমড়ার বোল এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বোনের পাঠানো আমড়ামুকুল ডিপফ্রিজে রাখা ছিলো। বহুবছর ধরে মায়ের স্মৃতিটুকু না খেয়ে রেখে দেই। আজ তুমি আসায় রান্না করি। আমার বড়বোন আনিকা বেগম রেহা মারা যান ২০১৭ সালে। আজ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ইতিমধ্যে আট বছর কালের গর্বে হারিয়ে গেছে। বড়বোনের কথা মনে পড়ে। গোপনে চোখের কনে জল জমে।

মধ্যাহ্নভোজ শেষ হতেই সামাদ বললেন, রানির বাড়ি খুব কাছে, চলুন আপনাদেরে রানির বাড়ি দেখাব। আমরা সবাই রেডি হয়ে সামাদের দামি জিপে বসি। সামাদ চালক, বললেন, মামা সামনে বসুন। জিপে জেফার, ভাই তাহমিদ, হুদহুদ, পপি, মেহরিন উঠে বসি। অন্য দুইটি গাড়িতে লবিদের পরিবার ও অন্যরা উঠেন। লন্ডনের এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সড়ক দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যায়। রাস্তার একপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে রাজার ঘোড়াশাল ও ঘোড়দৌড় ময়দান। এখানে বৃটেনের রাজকুমাররা ঘোড়া চালান। 

রাস্তার দুপাশে ঘাসের সবুজ আস্তরণ দেখে মনে হয় হরিৎ গালিচা কেউ বিছিয়ে রেখেছে। ঘাসের আস্তরণের উপর পাতাহীন মরা গাছগুলো একে অন্যকে যেন অঙ্গে অঙ্গে আকড়ে ধরে আছে। মরা গাছের তলে কোন ঝরাপাতা নেই কেন জানতে চাইলে তাহমিদ ভাই বললেন, সামারের এই বিশাল সবুজ সাম্রাজ্য শীতের আগমনে প্রথমে হলুদ ও পরে লালবর্ণ ধারণ করে সবপাতা ঝরে যায়। পত্রঝরার যবনিকা হতেই সরকার হাইটেক ব্যবহার করে সব মরাপাতা নিমিশেই উদাও করে দেয়। গাছতলা হয়ে যায় সবুজ ঘাসের শ্যামল গালিচা।  

প্রায় আধাঘন্টা পর আমরা উইন্ডসর ক্যাসলের গেটে চলে আসি। সামাদ বললেন, এই প্রাসাদে কুইন্স এলিজাবেত তার সুদীর্ঘ জীবন কাটান। এই প্রাসাদ বর্তমান রাজা চার্লসেরও প্রিয় বাসস্থান। উন্ডসর প্রাসাদের সামনের পার্কিং স্পেসে গাড়ি রেখে আমরা অনেকগুলো ছবি তুলি। এদিকে রাত ঘনিয়ে আসে। উইন্ডসর ক্যাসল একটি বিশাল জাদুঘর, আমরা টিকেট কেটে ঢুকতে চাই। এধরনের একটি জাদুঘর দেখতে কমপক্ষে দুইতিন ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু জাদুঘর ত্রিশ মিনিট পর বন্ধ হয়ে যাবে। তাই টিকেট না কেটে ফিরে আসি। যদি মহান আল্লাহ পাকের হুকুম হয়, আবার লন্ডনে আসি, তবে সময় নিয়ে উইন্ডসর ক্যাসল জাদুঘর দেখে যাব। পরিখাবেষ্ঠিত উইন্ডসর প্রসাদদুর্গ পরিদর্শন শেষে আমরা পপির বাসা কেম্বার্লি ফিরে আসি। 

১৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, আজ রাতে আজফারের পানচিনি। আগের দিন বাসায় আসেন আজফারের ফুফুতো বোন নার্গিস ও নাদিরা। নার্গিস ও নাদিরার ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ছে। নাদিরার স্বামী ইংরেজদের মত সফেদ ও সুদর্শন। লন্ডনে বড় হওয়া এই প্রজন্মের সন্তানেরা মাশআল্লাহ দারুন উচ্ছল ও প্রাণবন্ত। 

গতরাতে সবাই আনন্দ করে অনেকগুলো বড় বড় ডালা সাজান। ডালাগুলো রঙ্গীন কাগজ ও রাং দিয়ে মুড়ানো হয়। প্রতিটি ডালায় ডালায় কারুকাজ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পানসুপারি, কনের শাড়ি, লেহেঙ্গা, কাপড়চুপড়, পাদুকা, গহনা, মিস্টি, চকলেট, বিস্কুট, ফলমূল আর কত কি। এসেছেন ভাগ্না হুদহুদ, নিপার পুত্র তাইরান, মামাতো ভাই আফজল, নওসিন, নুরুজ্জামান, আর অনেক অনেক মেহমান। বাসার সামনে অনেকগুলো গাড়ি প্রস্তুত। আজফারের শ্বশুর বাড়ি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত উদ্যান নগরি কেন্ট। 

রঙ্গিন ডালায় ডালায় একটি গাড়ি পূর্ণ হয়ে যায়। অন্য গাড়িগুলোতে যে যেমন খুশি আরোহন করেন। আমি তাহমিদ ভাইয়ের মার্চেন্টিজ ব্যাঞ্চের সামনের সিটে বসি, যেন মিড ইংল্যান্ডের সিনারি ভালভাবে দেখে নিতে পারি। তাহমিদ চৌধুরী ড্রাইভ করে করে আমাকে বৃটেনের নানা গল্প বলে যান। লন্ডন হতে বেরিয়ে একটু জ্যামে পড়ি, জ্যাম মানে বাংলাদেশের মত রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, জ্যাম মানে গাড়িগুলো ধীরে ধীরে আগানো। লন্ডন সিটির বাহিরে এসে আর জ্যাম নেই। গাড়িগুলো গন্তব্যের দিকে ভুদৌঁড় দেয়। আলাপচারিতায় তাহমিদ চৌধুরীর আলোচনার বিষয় হলো এখানকার রাস্তাঘাটের শৃংখলা, মানুষের সততা, রাজনীতিবিদের পবিত্রতা, নেতাদের ন্যায়পরায়নতা, পুলিশের দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি। 

বৃটেন আসলে কোন সমতল দেশ নয়। এখান ভুমিরূপ অনেকটা উচুনিচু ঢেউখেলানো পাহাড় টিলা ও মালভূমিতে ভরা। কিছুটা আমাদের সিলেটের পাহাড়ি এলাকার মত। 

বড় বড় মহাসড়কে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্য বৃটিশরা রাস্তার দুইপাশে তরঙ্গাকৃতির কৃত্রিম টিলা, সুরম্য খাল ও জলাভূমি তৈরী করে নেয়। বৃক্ষবন লাগিয়ে টিলা ও জলার সাথে তারা রাস্তার এমন সমন্বয় করে যেন গাড়িতে বসে মনে হয় এক সীমাহীন নিসর্গের মাঝ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। 

বাংলাদেশেও এভাবে অপরূপ সুন্দর রাস্তা করা যাবে। কিন্তু দূর্ণীতিবাজ আমলা ও লোভী রাজনীতিবিদদের এসব ভাবার কি সময় আছে? তারাতো কেবল চুরির ধান্ধায় আছে। অবশ্য আমি সবাইকে বলছিনা, তবে লোভী লুটেরার সংখ্যাই এখানে বেশি। এরা এত নিমকহারাম যে জনমমাটি বাংলাদেশের খায়-দায়-পরে, সারাজীবন সরকারি সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, তারপর বাংলাদেশের তলা ফুটো করে হরিলুটের সব মালামাল নিয়ে বিদেশে পালায়।

বিকেলে উদ্যান নগরি কেন্টে এলাম। শীতল শহর কেন্টের বনভূমিও পাতাশূণ্য। কেবলমাত্র হাতেগুনা কিছু হরিৎবৃক্ষ ও ক্রিস্টমাস ট্রি যেন কোনমতে সবুজ রঙ নিয়ে বেঁচে আছে। এই পর্যটন শহর আর দশটা পশ্চিমা শহরের মতই এক সুনসান নীরবতার চাদরে ঢাকা। আজফারের শ্বশুরবাড়ির সামনে আমাদের সবগুলো গাড়ি সারি বেঁধে থামে। ডালা হাতে আমাদের ক্ষুদে নবীনের দল নিঃশব্দ মিছিল নিয়ে এগিয়ে যান। ক্যামেরাম্যান ভিডিও করেন। 

আগেই মেহমানদের ভীড়ে ঘর গরম ছিল। আমদের আগমনে ঘরে তিলধারনের জায়গা রলো না। আমাদেরকে সিটিংরোমে বসানো হলো। ওয়ালের উপর পানচিনি লেখা একটি ব্যনার লাগানো। কনের পূর্বপুরুষদের বাড়ি সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর গ্রামে। পানচিনি অনুষ্ঠানে দেশ থেকেও কয়েকজন আত্মীয়স্বজন এসেছেন। নুতনাত্মীয়দের সেবাযত্নে আন্তরিকতার কোন কমতি ছিলনা। আমরা যেন কেন্টে আসা নতুন কোন আগন্তুক নই, যুগান্তরের পরিচিত কেউ। আমরা সিলেটিরা আসলেই এমন অতিথিপরায়ণ, যেমন সিলেটে তেমন পৃথিবীর সবখানে।

আমাদের দেশে চিনিপানে কাবিন, বিয়ের তারিখ, সোনাদানা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। কিন্তু এখানে এসব বিষয়ে কোন বাক্যালাপ নেই কেন জানতে চাইলে তাহমিদ কুরেশি বললেন, মোবাইলের এই যুগে সব আলোচনাই মোবাইলে হয়ে যায়। তাই এখন পানচিনি মানে নতুন আত্মীয়দের সাথে কেবল পরিচয়, মেলামেশা ও হৃদয় মেলানো।

পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি দীর্ঘ আজফারের গায়ের রঙ দুধফর্সা। সাদা সার্টে লাল টাই, কালো স্যুট, কালো চিকন জুতো। ভরাট গালে পাতলা মায়াবী দাড়ি তার স্মার্টনেস আর বাড়িয়ে দেয়। সেদিন মায়াবী চেহারার ভাতিজা আজফারকে আমার চোখে প্রাচীন পারস্যের একজন অপরূপ যুবরাজ মনে হয়।

বাসায় নারী ও পুরুষগণ আলাদা বসেন। বাসার পিছনের বাগানে তেরপাল টেনে খাবার রাখা হয়। ডাইনিং টেবিল ডিসে ডিসে ভরে যায়। চিংড়ি, মাছ, মাংশ, রোস্ট, পাখি, হরিণের কাবাব, পোলাও, নাস্তাসহ এত এত ব্যঞ্জন পলিপ্যাকে চমৎকার করে সাজানো যে কেবল দেখার ইচ্ছে হয়। রান্নার মান এত উন্নত যে ফাইভ স্টার হোটেলকে যেন হার মানাবে। খুব সম্ভব লন্ডনের বাঙ্গালী হোটেলের দক্ষ সেফরা রান্না করেছেন। বাংলাদেশী সাজে কনে সাজানো হয়। লাল শাড়ি পরা ঘুমটা টানা কনেকে দেখে আমার নিজ কন্যা কন্যা লাগে। দোয়া করি মহান আল্লাহপাক আমার প্রিয় আজফার-সাবিহা দম্পতিকে সুখ ও শান্তিময় ভবিষ্যৎ জীবন দান করুন, আমিন।

রাতের কনকনে ঠান্ডায় আমরা কেন্ট ছাড়ার উদ্যোগ নেই। বিদায় মূহূর্তে সামনে আসে কফি, মিষ্টি, চা, বিস্কট ও নাস্তার ডালা। এত খাবার কি আর খাওয়া যায়। একটু আধটু চেখে দেখে সবাই নিজ নিজ গাড়িতে চড়ে লন্ডন পানে দৌড়ান। বাহিরে রাতের আধার, পাতাঝরা বন, সেই একই পথ, একই দৃশ্য।

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ঠান্ডা রাতের ঘুমের পালা শেষ। লন্ডনের সকাল, সূর্য কখন যে দেখা যাবে কেউ জানেনা। নামাজ পড়ে আমি ও জেফার সোজা ডাইনিং টেবিলে যাই। সবাই নাস্তা ও কফি পান শেষে আজফারের অফিস কক্ষে ঢুকি। 

আজ আজফারের অফিস বাসায়। চার্টার্ড একাউন্টেন্ট আজফারের সাপ্তাহে দুইদিন ছুটি, ক্যানারি অফে চারদিন এবং বাসায় একদিন অফিস করে। কি মজার চাকুরি সাপ্তাহে মাত্র চারদিন অফিসে যেতে হয়। বাসার অফিস কক্ষে একটি কম্পিউটারের সাথে দুইটি মনিটর। এক মনিটরে অফিসিয়েল তথ্য আসে এবং অন্য মনিটরে এই তথ্য সন্নিবেশিত করে কর্ম সম্পাদন করা হয়। বৃটিশরা বাসায় অনলাইনে কাজ করার ব্যবস্থা করে অফিস খরচ, পথ খরচ, সময় অপচয়, রাস্তার জ্যাম ইত্যাদি হ্রাস করে। পরিবারের সাথে থেকে চাকুরীজীবিরাও বেশ মানসিক স্বস্তি ও শান্তি অনুভব করেন। পরিবারকে তারা সাপ্তাহে তিনদিনই সময় দিতে পারেন। ফলে সুখ বাড়ে, মানসিক যন্ত্রণা কমে।

এমন শীতল কুয়াশাভরা বাতাস, রাস্তায় জমা জলে ভাসা বরফের কুচি, পাতাঝরা বনের হাহাকার, শীতকাতুরে পশুপাখি দেখার কোন সুযোগ বাংলাদেশে নেই। আজ সারাটা সকাল ভিমবেলি উদ্যানে বাহিরের ভিন দেশের ভিন আবহাওয়া বাপবেটা বেশ মজা করে উপভোগ করি। 

বাসায় ফিরে এসে দেখি আমাদেরকে নিয়ে যেতে ভাগনা মুফতি রশিদ ওরফে হুদহুদ এসে হাজির। হুদহুদের বাসা ফরেস্টগেট। আমরা হুদহুদের বাসায় বৌমা তারভিন ও নাতিন হৃদার সাথে বহুদিন পর দেখা হয়। তারভিনের হাতের সুস্বাধু রান্নায় দুপুরের খাবার হয়। সালমন ফিসের আইটেম ভাল লাগে।  

বছর দুয়েক আগে ভাগ্না মুফতি তানভির বৃটেনে আসে। তানভির সাগরদিঘিরপারে আমার কাছে ছিল। এখন সে লন্ডনে হুদহুদের বাসায় আছে। সে বাহিরে থাকায় দেখা হলনা। বিকেলে বের হয়ে ফরেস্টগেটে এলে হুদ হুদ বলল, মামা খ্রিস্টানদের কবরগাহ দেখবেন। আমি হ্যা বলতেই গাড়ি সমাধি কমপ্লেক্সে ঢুকে যায়। বৃটিশরা তাদের সমধিক্ষেত্রকে সুরম্য উদ্যানে পরিনত করে। গাড়ি চালিয়ে বিশাল এই সমাধি এলাকা ঘুরে দেখা যায়। ভিতরে একটি বড় গীর্জা, বসার জায়গা, সুবিন্যস্ত বৃক্ষের সারি। প্রতিটি পাকা কবরে এপিটাফে মৃতের নাম ঠিকানাসহ জন্মমৃত্যুর তারিখ লিখা আছে। কবরে কবরে ফুলগাছ শোভা পায়। চারপাশে পুস্পগুচ্ছ ও পাপড়ি ছিটানো। নীরব এই সমাধি বাগান যেন দুনিয়ার এক শান্তি নিকেতন। এখানে আমাদের মত কবরের উপর কবর নেই। রাস্তাবিহীন জায়গায় এলোমেলো কবর নেই। সারি সারি কবর এমনভাবে সুশৃংখল করে সাজানো যেন সমাধিগুলো এক একটা পবিত্র পর্যটন ভূবন।   

আজ রাতে ভাগ্না মুফতি লবিদের বাসায় নিমন্ত্রণ। লবিদ এসে আমি ও জেফারকে তার পূর্ব লন্ডনের বাসায় নিয়ে যায়। তিনতলা পরিপাটি বাসা ঘুরে দেখি। দুই নাতি ----- ও --- তিন তলার দুই কক্ষে থাকে। অন্য কক্ষটি রিডিং রোম। বিকেলের শীতল রোদে আমরা সাত জন হেঁটে হেঁটে পাশের একটি ছিমছাম টার্কি হোটেলে যাই। হোটেলে তখন তেমন ভীড় ছিলনা। হোটেলের কর্মীগণ বৌমার বেশ পরিচিত। তারা একটি বড় টেবিলে খাবার সাজায়। অনেকগুলো টার্কিস ডিস আসে, প্রতি ডিসে পুলাও, নানরুটি, মাছ, মাংশ, চিংড়ি, ডিম, আলু, চিজ, সস ও সালাদ সজ্জিত।  

১৮ ফেব্রুয়ারি, আজ আমরা ইস্তম্বুল যাবো। প্যাগাসার এয়ারলাইন হতে জানানো হয় ইস্তম্বুলে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে তাই ফ্লাইট বাতিল। ইস্তম্বুল দেখার স্বপ্ন আমার সেই শৈশবের। স্বপ্নপূরণে বাঁধা এলে বেশ হতাশ হই। তবে লন্ডনের সেই দিনটি অযথা নষ্ট না করে কাজে লাগানোর সিন্ধান্ত নেই। সেদিন তাহমিদ চৌধুরী ও ভাতিজা আজফার  আমাদেরকে নিয়ে আগে দেখা হয়নি লন্ডনের এমন সুন্দর সুন্দর স্পটে ঘুরে বেড়ান।

আজ দুপুরে আমরা রাপিল পার্কে (Rapheal park)  ঘুরে দেখি। লন্ডনের প্রতিটি পার্কে লেক থাকে। অজস্র হাঁসভরা পার্ক জুড়ে বাংলাদেশের রাজহাঁস, পাতিহাঁস, টেপিহাঁসসহ নানাজাতের উড়ন্ত নাম না জানা বুনোহাঁস রাপিল পার্কের বিশাল লেকে সাঁতার কাটছে, ঝাঁক বেঁধে উড়োউড়ি করছে। এই পাখিরা মানুষকে একটুও ভয় পায়না। মানুষের ভালবাসা পেয়ে তারা মানুষকে বন্ধু করে নিয়েছে। জলাভূমির চারপাশের সুরম্য বনবীথি হতে উড়ে এসে জলে ঝাঁপ দেয়, আবার পতপত শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বনে চলে যায়। চৌচল্লিশ একর আয়তনের এই গার্ডেনের আসল সৌন্দর্য এই পাখি আর হাসের নিসর্গ মেলা। এধরনের নিসর্গে পাখিমেলা আমাদের সিলেটের চাবাগানের লেক ও বিলে দেখা যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহি ও সিলেটের মত বড় বড় ব্যস্ত শহরেও লন্ডনের মত জলচর পাখি ও হাঁসের অভয়ারণ্য তৈরী করা গেলে শহরের মানুষ, পাখি ও প্রকৃতির মধ্যে এক মায়ার বন্ধন রচনা করা যেতে পারে।

রাতে ভাতিজা জাহেদ কুরেশির বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ পাই। আমন্ত্রিত অতিথি অনেক। রাতে তিনটা গাড়ি পূর্ণ হয়ে টেমসের পারে জাহিদের বাসায় ছুটে যাই। গাড়ি একটু দূরে রেখে আমরা হেঁটে হেঁটে জাহিদের বাসায় উপনীত হই। লন্ডনের হিমশীতল চাঁদনি রাত। ধূয়ার মত কুয়াশা। গায়ে জড়ানো গরমের ডাবল পোশাক। এই পোশাক শীতের যন্ত্রণাকে আরামে পরিনত করে। 

আফজল, শুভ, জাহিদ, আজফার, জেফারসহ আমরা টেমস পারে হেঁটে হেঁটে লন্ডনের প্রথম পায়ে হাঁটা ট্যানেলে উপনীত হই। টেমসের দুইতীরে দুইটি প্রাচীন পাকা টাওয়ার, নদীর অনেক নিচ দিয়ে নির্মিত একটি ট্যানেল এই দুই টাওয়ারকে যুক্ত করেছে। আমরা টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে টেমসের অনেক নীচে নেমে যাই। তারপর নীরব নিস্থব্ধ ট্যানেলে প্রবেশ করি। বেশ রাত হয়েছে, ট্যানেলে লোকজন নাই। আমাদের জুতার পদধ্বনি গোলাকার ট্যানেলে সজুরে প্রতিধ্বনি তৈরি করে। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ সারা ট্যানেল কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ট্যানেলের অন্য প্রান্তে পৌঁছে ওপারের একই ধরনের আরেক টাওয়ারে প্রবেশ করি। এই টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে টেমসের ওপারে যাই। ওপারে ব্যস্ত লন্ডন জেটি, অনেকগুলো নৌকা, জাহাজ ও স্টিমার এদিক ওদিক নোঙ্গর করা। এই শতাব্দী প্রাচীন ট্যানেল দিয়ে আবার ফিরে এলাম জাহিদের বাসায়।

জাহিদের বাসা একটি তিনতলা ভবনের নিচের ফ্লাট। এই ভবনের সামনে ও পিছনে প্রচুর খালি জায়গা। পাশে টেমস নদী বহমান। সিটিং রূমে আমাদের সৌজন্যে বেশ বড় একটি কেক আসে। বেশ আনন্দের সাথে কেক কাটা হয়। তিন গাড়িতে করে আমরা অনেক মেহমান এসেছি। দুই নাতীন বেশ স্নেহপ্রবণ। আমি যেন তাদের প্রতিদিন দেখা নানা। তারা আমার কাছে কাছে সময় পার করে। জাহিদের স্ত্রী বেশ ভাল রাঁধুনী। তিনি সুনামগঞ্জের ধলগ্রামের কন্যা, যে গ্রামে বাউল আব্দুল করিমের জন্ম হয়। অনেক ব্যঞ্জন রান্না করেছেন। তার মধ্যে হরিণের মাংশের ব্যঞ্জন আছে। বহুদিন ধরে আমি প্রায়ই হরিণের মাংশ খাবার ইচ্ছে মনে মনে পোষণ করতাম। এবার লন্ডনে আল্লাহ পাক বারবার হরিণের মাংশ ভূরিভোজ করান। দয়াময় আমার মনের সব ইচ্ছে এভাবেই পূরণ করে দেন, শোকরিয়া, শোকরান।

ইস্তম্বুল হতে ফিরে ২৪ ফেব্রুয়ারি খুব সকালে আমরা বুটরেস পার্কে যাই। এখানে বুটরেস ক্লাবের সদস্য হলে সর্বদা বুটরেসে অংশগ্রহণ করা যায়। লন্ডনের এই নেচারেল পার্ক হাকালুকি হাওরের মত সুবিশাল জলাভূমি, যার চারপাশে বনভূমি ও মেঠোপথ। তারা প্রাচীন ঐতিহ্য হিসাবে কিছু মেঠোপথ রেখে দেয়। জলরাশির মাঝে মাঝে ছোট ছোট বনময় দ্বীপ। লেকের পারে একটি সুন্দর নৌকাঘাট ও জেটি। সিঁড়ি বেয়ে জলে নামা যায়। সুদূর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশিতে সারি সারি রঙ্গীন বল ভাসিয়ে নৌকা দৌঁড়ের রাস্তা নকশা করা। এত ভোরে ছোট ছোট প্লাস্টিকের খেইড় নৌকায় বসে শ্বেতাঙ্গ নরনারীরা বুটরেস করে তাদের নৈমিত্তিক ব্যায়ামের কাজ সেরে নিচ্ছে। লন্ডনের এই জলবাগানেও নানান জাতের পাখি ও বুনোহাঁস ঝাঁক বেঁধে উড়োউড়ি করছে, জলে সাঁতার কাটছে। শীত ওদের কাছে কুচ নেহি হ্যায়। বৃটেন সত্যিই এক চমৎকার দেশ। 

আমাদের দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ইত্যাদি শহরে বুটরেস ক্লাব ও লেক নির্মাণ করা গেলে মানুষ এখানে মহানন্দে বুটরেসে নেমে ব্যয়ামের কাজ সেরে নিত। সিলেট শহর হতে মাত্র দুই মাইল দূরে লোলাবিল কিংবা শহরের ছয় মাইল দক্ষিণে হাকালুকি হাওরের জলাভূমি খনন, দ্বীপমালা তৈরি ও সংরক্ষণ করে বুটরেস ক্লাবসহ জেটি ও বুটরেস নৌপথ সাজায়ে তাতে মৎসখামার ও পাখির অভয়ারণ্য করা হলে, একসময় তা দেশের স্থায়ী পর্যটন সম্পদে পরিনত হবে।    

এইদিন বিকেলবেলা আমরা লন্ডনের অন্য একটি সুন্দর প্রাকৃতিক পার্কে যাই। এই পার্কের নাম হাইকিং রক পার্ক। এই পার্কে বিশাল বিশাল অনেকগুলো প্রাচীন পাথর খন্ড রাখা। এই সুপ্রশস্ত পাথরগুলো দশ থেকে বিশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। পাথরগুলোয়  উপরে যাবার জন্য খাঁজ কাটা রাস্তা রয়েছে। এগুলোতে হামগুড়ি দিয়ে পাথরের চূড়ায় আরোহন করে কিশোররা পাহাড় ট্যাকিং শিখে নিচ্ছে। বৃটিশরা মজার মজার খেলার মাধমে তাদের শিশুদেরে অনেক কিছু শিখার ব্যবস্থা করে দেয়। তা সাধারণ বুটরেস বা পাথরচূড়া আরোহন হতে পারে।

বরফঢাকা  ঐতিহাসিক  শহর ইস্তম্বুল  সফরঃ   

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ গতকাল ইস্তম্বুলে প্রবল তুষারপাতের কারণে আমাদের ফ্লাইট বাতিল হয়। আজ ইমেইলে ফ্লাইট একই টাইমে যাবে নিশ্চিত করে প্যাগাসাস এয়ার। ইস্তম্বুল দেখার প্রবল ইচ্ছে আমার শৈশবের, কারণ ইতিহাস আমার খুব পছন্দের বিষয়। ইস্তম্বুল তিন তিনটি বিশাল বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই সাম্রাজ্যগুলো রোমান, বাইজেন্টাইন ও অটোমেন সাম্রাজ্য। তাছাড়া প্রাচীন উন্নত গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও মধ্যযুগের অটোমেন মুসলিম সভ্যতার গর্বিত কেন্দ্রও ছিল ইস্তম্বুল। 

এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে মহানগর ইস্তম্বুলের অবস্থান, বসফরাস প্রণালী এই শহরকে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বিভক্ত করে দিয়েছে। ভূমধ্যসাগর, মর্মরসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মাঝে তুরস্ক একটি উপদ্বীপ আকৃতির দেশ। বসফরাস প্রণালী এই দুই সাগরকে যুক্ত করেছে। এশিয়া ও ইউরোপের সংগমস্থলে তুরস্কের অবস্থান হলেও আফ্রিকা মহাদেশ খুব কাছাকাছি। তাই ইস্তম্বুলকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ এই তিন মহাদেশের কেন্দ্রস্থল ধরা হয়। তুরস্কের এশীয় অঞ্চলের আদিনাম ছিল এশিয়া মাইনর। এই এশিয়া মাইনর হয়ে মধ্যযুগে ইউরোপের ক্রসেডাররা যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান উদ্ধারে এসে তিনশত বছরের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী এক ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা কিছুকালের জন্য টার্কি, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট খ্রিস্টান রাজ্য স্থাপনে সফল হয়। বর্তমান টার্কি আয়তনে সাড়ে পাঁচটা বাংলাদেশের সমান। জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে আট কোটি। ইউরোপের কাছের এই দেশটির অর্থনীতি খুব সমৃদ্ধ, তাদের শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ইউরোপের মত উন্নত, সেইসাথে উদার ও সহনশীল।

১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী গাড়ি চালিয়ে লন্ডনের স্টেনস্টেড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যান। বিমানবন্দরের সামনে বিশাল পার্কিং অথচ ঠাঁই নাই অবস্থা। তাই বেশ কষ্ট করে গাড়ি পার্কিং করতে হল। হিথ্রো পৃথিবীর একটি প্রাচীন বিমানবন্দর, বৃটিশরা ঐতিহ্যপ্রিয় জাতি হওয়ায় তাঁরা প্রাচীন ডিজাইন সাধারণত বদল করেনা। তাই প্রাথমিক যুগের বিমানবন্দর পর্যবেক্ষণ করার জন্য হিথ্রো একটি সেরা কাঠামো। 

স্টেনস্টেড অনেক পরে নির্মাণ করা হয়, তাই এটি হাইটেক সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের কাজকর্ম যথেষ্ট দূরত্বে অবস্থিত দুইটি ভবন হতে পরিচালিত হয়। প্রথম ভবনটি অফিসভবন, এখানে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও চেকিং ইত্যাদি করা হয়। অনেক দূরের দ্বিতীয় ভবনের অসংখ্য গেট দিয়ে যাত্রীরা উড়ালযানে উঠানামা করেন। এই ভবনের কাছেই রানওয়ে, হ্যাংগার, বিভিন্ন এয়ারলাইনের অফিস ও বৈঠকখানা।  

স্টেনস্টেড বিমানবন্দরের এই দুই ভবনের দুইটি প্লেটফরমে মেট্রোরেল অনবরত চলাচল করে। আমরা পিছনের স্টেশনে দাঁড়াতেই ট্রেন হাজির, আট দশ মিনিট পর দুসরা ভবনের স্টেশনে নেমে যাই। আমাদের বর্ডিংপাস অনলাইনে সংগ্রহ করা ছিল। দ্বিতীয় ভবনের ভিতরে হেঁটে হেঁটে আমাদের ফ্লাইটের গেটে পৌঁছি, আমাদের প্যাগাসাস এয়ারের লোকজন সামনে বসা। ফ্লাইট ছাড়ার অপেক্ষায় পাশের সোফায় বাপবেটা দুইজন টানা দুইঘন্টা সঠান হয়ে বসে থাকি। কালো গ্লাস আবৃত বিশাল ভবনের দুতলায় যথেষ্ট হাঁটাহাঁটি করি। পাশের গেটগুলোতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এয়ারলাইনের অনেক উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। মালামাল লোড আনলোড হচ্ছে, যাত্রীরা উঠানামা করছে, দৃশ্য ভারী চমৎকার।                                                                    

শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

স্মৃতিতে পুবালী ব্যাংক আঞ্চলিক অফিস ও মহিলা কলেজ শাখাঃ

 

স্মৃতিতে পুবালী ব্যাংক আঞ্চলিক অফিস ও মহিলা কলেজ শাখাঃ

অবস্থানকালঃ ২৭ আগষ্ট ১৯৯০ সাল হতে ১ মার্চ ১৯৯৩ সাল সময়ঃ ২ বৎসর ৬ মাস ২ দিন।

২৭ আগস্ট ১৯৯০ সালে আমি চাকুরীতে যোগদান করতে ছূটলাম বন্দরবাজারে অবস্থিত পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, সিলেট আঞ্চলিক অফিসে। পুবালী ব্যাংকের নিজস্ব পাঁচতলা ভবনের চারতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে আঞ্চলিক অফিসে প্রবেশ করি। তখন পুবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন উপমহাব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ, যাকে আমি অনেকবার ইতিপূর্বে জনাব ই এ চৌধুরীর সাথে দাউদপুরের বাড়িতে যেতে দেখেছি। তিনি বললেন, আপনাকে মহিলা কলেজ শাখায় দিলে কেমন হয়। এই মহিলা কলেজ শাখা কোথায় আমার কোন ধারনা ছিলনা। মনে হল এটি হয়ত কলেজের ভিতরে হবে, তাই ভাবলাম মেয়েদের আড্ডাখানায় এক শিক্ষিত পরিবেশে কাজ করা যাবে

আমি উত্তর দিলাম স্যার আপনার ইচ্ছে হলে দিতে পারেন। মজিদ স্যার তখন বললেন আজ ও কাল দুইদিন এই অফিসে অবস্থান করবেন এবং ২৮ আগস্ট বিকেলে আপনি ছাড়পত্র নিয়ে পরদিন মহিলা কলেজ শাখায় যোগদান করবেন। দাউদপুর হতে ২৯ আগষ্ট আমি সিলেট মহিলা কলেজ শাখায় গিয়ে সকাল ৯ ঘটিকায় ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী স্যারের কাছে জয়েনিং রিপোর্ট পেশকরি।

হাসিখুশি রুস্তম আলী স্যার ছোটখাট হালকা পাতলা লোক। তার বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে, তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স ও মাস্টার্স। আমি পরিচয় প্রদান করলে তিনি আমাকে চাকুরিসংক্রান্ত কিছু উপদেশ দিয়ে বললেন আপনি তো একটু নিচের লেবেলে ঢুকে গেছেন, এখান হতে উপরে উঠা বেশ কঠিন। জুনিয়র অফিসারে ঢুকে ব্যাংকের আকাশছুঁয়া খুব কম মানুষের ভাগ্যে জুটে।

এইদিনই আমি বুঝলাম ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার, অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই তিন পদে অফিসার নিয়োগ করা হয়। ১৯৯০ সালে পুবালী ব্যাংকে যোগদানকারী ব্যাচটি একটি ভাগ্যহীন ব্যাচ। সেই বছর পত্রিকায় সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মতিন খান সিনিয়র অফিসার নিয়োগ বাদ দেন এবং সবাইকে কেবল অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই দুইপদে নিয়োগ দেন। ফলে প্রথমেই এক কিংবা দূই পদ নিশ্চিতভাবে নিচে নিয়োগপত্র পাই। অথচ ১৯৮৭,  ১৯৮৮ কিংবা ১৯৮৯ সালে ব্যাংকে ঢুকলে এই ধাক্কা খেতে হত না। তাছাড়া এই  ভাগ্যহীন ব্যাচের শিক্ষানবিশ কালও একের স্থলে দুই বৎসর করে দেওয়া হয়

যোগদানের প্রথমদিনই বুঝলাম পুবালী ব্যাংকে আমি এক শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে গেছি। মনে মনে ভাবি এখানে আমি কিছুদিন সময় কাটাতে এসেছি, সময়ে সুযোগ পেলেই পাততাড়ি গুটাবো। অথচ সেই শুভঙ্করের ফাঁকির চোরাবালিতে হাবুডুবু খেয়ে সারাটা চাকুরি জীবন পার করতে হল। তখন মনে হল বছর দেড়েক আগে গ্রিনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে সিনিয়র অফিসারে যোগদান না করে আমি কি ভূলটা করেছি। আমার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মালিকানাধীন পূবালীতে সারাজীবন পার করে আজ প্রৌঢ় বয়সে হিসেব করলে দেখি অন্যদের তুলনায় যেই লাউ সেই কদু ছাড়া কোন সুযোগ সুবিধা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এমন কি বাহিরের জগতের লোকজনে প্রচুর সম্মান এবং সহানুভূতি পেলেও এখানে আমাকে শেষদিকে সব ধরণের হেনস্থা ও অপমানের মুখোমুখি হয়ে কাজ করতে হয় ব্যাংকে থাকা আমার নিজের আত্মীয়সম্পর্কীয় লোকজনের নানা অন্যায় আচরণের কারণে   

দাউদপুর হতে আগের মত সকালে বের হয়ে ভূদৌঁড় দিয়ে ৯টায় এসে অফিসে ঢুকতাম। বিকেল ৫টার পর দাউদপুর ফিরতাম। ভাউচার চিনতে আমাকে প্রথমে টোকেন ইস্যুতে বসান হল। পাশে বসতেন কর্মচারী সাথী পাঠক দিদি। খুব ধৈর্যশীলা শান্তসুবোধ সাথীদি তার পদের চেয়ে বড়পদের কাজ অনায়াসে করে যেতেন, এমন কি প্রয়োজনে ক্লিনক্যাশও মিলাতেন। আমি ব্যাংকের প্রাথমিক কাজগুলো তাঁর কাছে শিখে নেই। সাথীদিদির স্বামী ছিলেন সিলাম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পুত্র বিনায়ক পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক।

সাথী দিদি আজ নেই। তার জীবনের শেষবেলায় পাঁচছয় বৎসর মরণব্যাধী স্থন ক্যান্সারের সাথে অতি মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করেন এবং সেইসাথে ব্যাংকের চাকুরিও চালিয়ে যান। অক্টোবর ২০১৮ তে তিনি চাকুরি জীবন পুর্ণ করে সিলেট স্টেডিয়াম শাখা হতে যথারীতি অবসর গ্রহ করেন। একদিন স্টেডিয়াম শাখায় তার বিদায় সম্বর্ধণা হয়। অল্প বয়সে চাকুরিতে ঢুকে সারাজীবন সংগ্রাম করে প্রশান্ত চিত্তে সাথীদি ফিরলেন ঘরে। কিন্তু তিনি আর বিশ্রাম নিতে পারলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই ঈশ্বর তাকে আদর করে তাঁর কাছে নিয়ে যান 

সহকর্মী শ্যামলী নন্দী ছিলেন মেঘবর কন্যা, লম্বা কাজল কালো চূল, মায়াবী চেহারা ও স্পষ্টসাধু বাচনঙ্গি তার বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্টনেস প্রকাশ করত। হিন্দুদের মধ্যে সেকেন্ড লাইন ভাইবোনের মধ্যে বিয়েসাদি হয়না। শ্যামলী নন্দী বলতেন মুসলমানদের সেকেন্ড লাইন ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে শুনলে আমার মনে কি যেন একটা কিত কিত করে। শ্যামলী দিদিও খুব ভাগ্যবতী, এসএসসি পাস করে টাইপিষ্ট পদে ব্যাংকে ঢুকে আজ লাখ টাকা বেতনের এসপিও।

নোয়াখালীর যুবক কবির আহমদ ছিলেন ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্কগৌরবর্ণ কবির আহদের অংক মেলানোর ব্রেন খুব একটা ভাল ছিলনা, তাই কাজে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হত। তিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইতেন, ‘বরের চাইতে কইন্যা বড়, ই বিয়ার কি ডেফ আছে। আর হুনলাম কইন্যার মা হ্যালদি উঠে তালগাছে’শুনেছি কবির সাহেব এক সময় ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে দেন ও অল্প বয়সে মারা যান।

কর্মপাগল হারাধন নাথের বাড়ি ছিল ছাগলনাইয়া, ফেনী তিনি ১৫/২০ বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে হাবুডুবু খাচ্ছেন, হেড অফিসে বদলির আবেদন করেছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত অথচ বাবা বছরের পর বছর সিলেটে। আমাকে ধরলেন আমার চাচাত ভাই ই এ চৌধুরীকে দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ফেনী যাবার যেন একটা উপায় করে দেই। এই কাজের অগ্রিম এনাম স্বরূপ আমাকে হাত করতে তিনি প্রতিমাসে আমার দুই একটা লেজার ব্যালেন্সিং করে দিতেন। 

একবার ব্যাংকের প্রশিক্ষণে ঢাকা যাই। এক ফাঁকে চেয়ারম্যান অফিসে গিয়ে চাচাতো ভাই ই এ চৌধুরীর সাথে দেখা করি ও আসার সময় হারাধনের আবেদনপত্র তার হাতে দিলে তিনি একটু বিরক্ত হয়ে হাতে নেন আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল কাজটা হবে তো? কিন্তু মাস দেড়েক যেতে না যেতেই হারাধন নাথের বদলির আদেশ আসে সিডিয়ে শাখা চট্টগ্রামে বদলির আদেশ পেয়ে হারাধন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন, কার তখন আঞ্চলিক বদলি আজকের মত এত সহজ ছিল না। তিনি আবেগ আপ্লুতকন্ঠে বললেন কোরেশী সাহেব, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি বললাম, বলুন কোরেশীকে নয়, আল্লাহ ই এ চৌধুরীর মঙ্গল করুন। জবাব দেন, ভগবান আপনারা দুনোজনের মঙ্গল করুন।  

এখানে ক্যাশ কাউন্টারে কাজ করতেন নোয়াখালীর বেখাপ্পা চেহারার ক্যাশ অফিসার ফরিদ আহমদ। ফরিদ আহমদ কাজে দক্ষ, ক্যাশে ভূল হত কম। ক্যাশ ইনচার্জ ছিলেন বয়স্ক হবিগঞ্জি লোক এম এ মন্নান, যিনি অংকে এতই কাচা ছিলেন যে তার পক্ষে তিন লাইনের একটা যোগ মিলানো ছিল অসম্ভবযোগ-বিয়োগের কাজ তুষামুদি করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিতেন। মনে মনে ভাবতাম এত দূর্বল গাণিতিক মস্তিস্ক নিয়ে তিনি সারাজীবন ব্যাংকে চাকুরি করলেন কেমন করে? শেষে বুঝলাম এই ধূর্ত মানুষটি টিকে আছেন কেবল চাপার জুরেবাকপটু এই চাপাবাজ মানুষটি কোন পরিশ্রম না করেই সারাজীবন ব্যাংকে কেবল উন্নতি করেন কোন টেবিলকাজ না করেও এসএসসি পাস এম এ মন্নান বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক হন এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে অবসর গ্রহ করেন। একেই বলে তৈলশক্তি। 

এই এম এ মান্নান সাহেব যতরপুরে এক হিন্দুবাড়ি ভাড়া নিয়ে নাকি দখল করে বসেন। তার একটা গু ছিল, নিজের অতীত অপকটে স্বীকার করে তিনি আমাকে বলতেন, ‘চৌধুরী সাব, আমি কোনমতে মেট্রিক পাশ করে লাঙল জোয়াল ফেলে শুন্যহাতে হবিগঞ্জ হতে পূবালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হয়ে সিলেটে আসি, আজ এই শহরে আমার গাড়ি বাড়ি সবই এই রত্নপ্রসবা পুবালী ব্যাংকে বসে হয়ে গেছে। মন্নান সাহেব বদলি হলে আসেন কুমিল্লার কাজি সফিক। সদাহাস্য কাজি সফিক ছিলেন কথাবার্তায় স্মার্ট কাজে দক্ষ সুদর্শন লোক। ফরিদা নামক একজন মহিলা সারাদিন পরিস্কার কর্ম ও ফুটফরমায়েশ কাজ করতেন।

প্রিন্সিপাল অফিসার রুস্তুম আলী স্যারের বাসা ছিল শিবগঞ্জ, তার দুই ছেলে। একদিন আমরা তার ছেলেদের খতনা অনুষ্ঠানে গেলাম। ধুমধাম করে খানাপিনা হল। আমরা কিছু প্রাইজবন্ড উপহার দেই। মজার ব্যাপার হল এই প্রাইজবন্ড হতে স্যার পঞ্চাশ হাজার টাকা লটারি জিতে যান রুস্তুম আলী স্যার ছিলেন ধার্মিক ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ। তিনি সিলেট জালালাবাদ হোমিও কলেজ হতে ডি এইচ এম এস ডিগ্রি নেন। ৭ মার্চ ১৯৯২ সালে রুস্তুম আলী স্যার মহিলা কলেজ শাখা হতে বদলি হয়ে ঢাকা চলে যান। পরবর্তীকালে প্রধান কার্যালয়ে উপমহাব্যবস্থাপক পদে থাকাকালে বারবার পদোন্নতি হতে বাদপড়ায় তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং চাকুরী ছেড়ে হোমিওপ্যাথি পেশায় চলে যান।

পরদিন ৮ মার্চ ১৯৯২, মহিলা কলেজ শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বভার গ্রহ করেন আমার অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ফরিদ উদ্দিন। তাঁর গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার গঙ্গাজল গ্রামে। ফরিদ উদ্দিন স্যার ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ লোক। তার আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি গরম মানুষ ও কোন ধরনের হাংকি পাংকি পছন্দ করতেন না। তিনি গর্বের সাথে বলতেন আমি সোনালী ব্যাংকের অফিসার ও সোনালী ব্যাংকের স্বনামধন্য প্রাক্তন মহাব্যবস্থাপক মুফতি বদরু উদ্দিন স্যারের কাছে ব্যাংকিং শিখে এসেছি এই মুফতি বদরু উদ্দিন ছিলেন দরগামহল্লার আমার আপন ফুফু্তো ভাই, যাকে আমরা ডাকনামে বলতাম ‘এখলাস ভাই’আমি ১৯ মার্চ ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এক বৎসর দুই মাস ফরিদ উদ্দিন স্যারের সহিত মহিলা কলেজ শাখায় কাজ করি।

ফরিদ উদ্দিন স্যার কারণে অকারণে হঠাৎ রেগে যেতেন, যা পরে তার জন্য ক্ষতির কার হয়ে যেত। শ্যামলী নন্দীর স্বামী একবার পত্নীর কাছে ফোন করলে ফরিদ স্যার ফোন ধরেন। শ্যামলীদিকে ডেকে না দিয়ে তার স্বামীকে বললেন, বউ চাকুরিতে দিছেন, এত ফোনালাপ কিসের? সে কাজ করছে, তাঁকে ডেকে দেওয়া যাবেনা। ফরিদ স্যার শ্যামলীর কর্তার সাথে ফোনে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। সেইদিন আমি শ্যামলীদিকে কাঁদতে দেখি। স্যারের নিষ্টুর বকুনী খেয়ে পরিস্কার কর্মী ফরিদাও মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদততবে ফরিদ স্যার ব্যাংকের স্বার্থে কঠোর হলেও কোনদিন কলম দিয়ে লোকের উপকার ছাড়া অপকার করেননি। ফরিদ স্যারের বেগমের একজন আত্মীয়া নারী নাকি সিলেট শাখায় কাজ করতেন। এই নারীকর্মী অফিসে আসতে প্রায়ই দেরি করতেন। একদিন এই অপরাধে স্যারের হাতে এই শ্যালিকা চরমভাবে অপদস্ত হন। তিনি মেডামের কাছে দুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে ছুটে যান ফরিদ স্যারের পিরমহল্লার বাসায়। বেগম সাহেবা সব অভিযোগ শুনে আত্মীয়াকে সান্তনা দিয়ে বললেন, বোন তুমি অফিসে নির্যাতিত, আর আমি বাসায় নির্যাতনের শিকার। আমি সারাজীবন ধর্য্য ধরেছি। কি আর করবা বোন, তুমিও ধর্য্য ধর, আল্লাহপাক ধর্যশীলদের সহায়। 

উপমহাব্যবস্থাপক ফরিদ উদ্দিন স্যার ছিলেন অতিমাত্রায় আত্মসম্মানি ও আত্মভিমানী লোক। ২০১০ সালে তার চাকুরি এক বছরের জন্য বর্ধিত হলে এইসময় কোন এক কারণে তিনি ব্যাংক পরিচালকদের কোপানলে পড়েন। খুবসম্ভব কতিপয় পরিচালক সিলেট এলে তিনি তাঁর মায়ের অসুস্থতার কারণে বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে পারেননি। কোন এক ওজর দেখিয়ে ক্ষমা চাইলেই অনেক সুযোগ সুবিধাসহ তিনি রক্ষা পেতেন। কিন্তু তিনি মাফ চাননি এবং সিলেটের অঞ্চলপ্রধানের আসন হতে বিদায় গ্রহ করেন। বিদায়কালে বিধিনুযায়ী ব্যাংকের তরফে একটি গাড়ি উপহার পেতেন, তাও হারান। শিখগুরু অর্জুনের মত ফরিদ উদ্দিন স্যার শির দিলেন তো শের দিলেন না।

১৯৯০ সালের ২৭ আগস্ট আমি চাকুরিতে যোগদানের পর ধীরে ধীরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধার করে নবেম্বর মাসে বিরোধীদলের সম্মিলিত হরতালে অফিস আদালত বন্ধ হয়ে আসে সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের কাছে ছিল শাখাটির অবস্থান। লাগাতার হরতালে জিন্দাবাজারে দুতলা অফিসের নিচে সারাদিন পুলিশ ও ছাত্রজনতার সংঘর্ষ চলত। জনতার ঢিলে বিমান অফিসসহ চারপাশের ভবনের গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তাই অফিসে লোকজন ঢুকানো ছিল খুবই বিপদজনকআবার হরতালে অনুপস্থিত থাকলে চাকুরি থাকবেনা। দাউদপুর হতে খানিকপথ যানবাহনে, খানিকপথ হেঁটে অনেক কষ্টকরে এসে অফিসে নিস্কর্মা সারাদিন বসে থাকতাম। ২৭ নভেম্বর ডাঃ মিলন ঢাকার শহিদ হলে আন্দোলনের আগুনে পেট্রোল পড়ে। শাখার নিচে শহিদমিনারে দাঙ্গাপুলিশ উপরে আমরা, কপাটবদ্ধ অফিসে তখন শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা সৃষ্টি হত

ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এরশাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় এবং একনায়ক হোসেন মোঃ এরশাদের পতন ঘটে দেশবাসী বহুদিনের এক দুর্বিসহ অচলাবস্থা হতে মুক্তিলাভ করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন এরশাদের পতনের পর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের অধীনে তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠিত হলে আমাদের বংশের চাচাত ভাই, সাবেক সচিব, ইমাম উদ্দিন চৌধুরী এই সরকারের বানিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে।

মহিলা কলেজ শাখায় অবস্থানকালে আমি ব্যাংকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ছয়বার ঢাকা গমন করি। কাষ্টমার সার্ভিস, ফরেইন এক্সচেঞ্জ, রিফ্রেসার কোর্স, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি নামের প্রতিটি প্রশিক্ষ দুই থেকে পাঁচ ছয় দিন পর্যন্ত সংঘটিত হত। চাকুরিতে যোগদানের পর ঢাকা সদরঘাটে ২৫ মে ১৯৯১ সাল হতে আমাদের ১৩ দিনের ভিত্তি প্রশিক্ষ অনুষ্ঠিত হয়।

পুরান ঢাকার সদরঘাটে ব্যাংকের নিজস্ব ভবনের পাঁচতলায় ছিল ব্যাংকের প্রশিক্ষ ইন্সটিটিউট। এখানে থাকারও বন্দোবস্ত করা ছিল। এখানে অবস্থান করে লালবাগের কেল্লা, পরীবিবির মাজার ও মোগল যাদুঘর, আহসান মঞ্জিল, বাহদুরশাহ পার্ক, হোসনি দালান, সদরঘাটসহ পুরান ঢাকার সব ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখি। ঝাকড়া চুলের ভাস্কর রাসার সাথেও একদিন দেখা হয় ব্যাংকের প্রশিক্ষ ইন্সটিটিউট পরে হেডঅফিসে চলে গেলে সেখানেও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। এসব প্রশিক্ষণে বিভিন্ন সময় আহমদ এনায়েত মঞ্জুর, অমল কান্তি দাস, জাহাঙ্গীর আহমদ, ওমর ফারুক, এফ এম আলমগীর হোসেন প্রমুখ আমার শরিক ছিলেন। আমার দাউদপুর গ্রামের সচিব ডঃ ক্ষণদা মোহন দাসের ভাই অমল কান্তি দাস রসায়নে মাস্টার্স করে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন এবং পরে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। তিনি ছিলেন ছোটখাট আবয়ব, আমি তাঁকে সহজে কোলে তুলে নিতাম। 

পুবালী ব্যাংক ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এম এ জলিল ছিলেন খুব রসিক লোক। তিনি নানা খুশগল্পে ক্লাস জমিয়ে রাখতেন। আমাদের প্রাক্তন এম ডি হেলাল আহমদ চৌধুরী যখন ক্লাস নিতেন, তখন তার আকর্ষণীয় জ্ঞানগর্ব বক্তব্যে ক্লাসে নীরবতা নেমে আসত। তিনি একটা কথা সব সময় বলতেন যা আমি কোনদিন ভুলে যাইনি। তিনি বলতেন Hardwork has no substitute. তিনি বড় বড় মানুষের উদাহর দিয়ে বলতেন তারা যে খুব মেধাবী ছিলেন তা নয়, বরং সততা, নিষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম তাদেরকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি এর ব্যতিক্রম দেখেছি, কেবল তার বর্ণিত এই গুগুলোর মাধ্যমে অনেকের পক্ষে উন্নতি করা সম্ভব হয় না, সাথে দাওয়ারও প্রয়োজন হয়। মামুর জুর কিংবা তৈলমর্দণের মত বলকারক ঔষধ যারা যথাযত মালিশ করতে জানেন তারাই সফলকাম হন। হেলাল স্যার প্রায়ই মাইন্ডসেটের কথা বলতেন। তিনি বলতেন কোন লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত হতে হলে আগেই বিষয়টি অর্জনে মনস্থির করে নিতে হবে।

হেলাল আহমদ চৌধুরী স্যার জকিগঞ্জ উপজেলার দুহাল নামক গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহ করেন। তাঁর সিলেট শহরের বাসা আমার কাছে সুবিদবাজার। তিনি ছিলেন একজন বিসিএস ক্যাডার। সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার তাকে সরকারি পুবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেন। তিনি দক্ষতার সাথে বহু বছর পূবালী ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখন সরকারি বাসিক ব্যাংকের চেয়ারমেনের দায়িত্বে আছেন। মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ঋণবিশেষজ্ঞ জ্ঞানী বক্তা, তিনি মোল্লা  নাসিরুদ্দিন হোজ্জার হাসির গল্প দিয়ে ক্লাস শুরু করতেন। পরে তিনি ব্যাংকের ডিএমডি হয়ে  অবসর গ্রহ করেন।

কোন এক প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি ছোটবোন মান্নার শাহজাহানপুরের বাসায় উঠি। মুন্না ও লিজা তখন ছোট শিশু। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে আমাদের পাশের গ্রাম শ্রীরামপুরের ডাঃ আলাউদ্দিনের কাছে বামকান দেখাই। তিনি আমাকে ভর্তি করে বামকানের পর্দা অপারেশন করেনপরে একদিন ঢাকা মেডিকেলে দেখাতে গেলে তাকে ছাত্র পরিবেষ্টিত পাই। তিনি ‘এই লোকটি, এই লোকটি’ বলে তাচ্ছুল্যে করে তার ছাত্রদের সাথে আমার রোগ নিয়ে আলাপ করলে আমি বেশ মনঃকষ্ট অনুভব করি আমি কোন পরিবারের লোক তিনি ভাল করেই জানতেন, তাছাড়া আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী তার মেডিকেল ছাত্রী ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসায় সিলেটের বাসায়ও যান। এরপর আমি আর কখনও তার কাছে যাইনি।

১৯৯১ সালের ৭ম সেপ্টেম্বর আমি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জীবন সদস্য হই। আমার জীবন সদস্য নং আ- ১৪৫০। 

১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দরগামহল্লায় শাহজালালের(রহঃ) দরগাহের মোতাওয়াল্লি এ জেড আব্দুল্লার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ স্থাপিত হয়। আমি ১৯৮০ সালে সিলেট মোবাইল পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা আমার এক দুলাভাই মনিরউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে মুফতিবাড়ি, দরগামহল্লা ফুফুর বাসা হতে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে যাই।

মনির দুলাভাই একজন আমোদে হাসিখুশি লোক ছিলেন। সব সময় তিনি তার পাশে লোকের আড্ডা জমিয়ে রাখতেন। এই জ্ঞানী মানুষটি প্রচুর লিখতেন ও মাইকে দাড়িয়ে সুন্দর ভাষ দিতে পারতেন। তার ইতিহাস বিদ্যা ছিল প্রখর। আমি দরগায় আসলে ইতিহাস জানতে আমার ফুফার ভাতিজি বর পাশের বাসার আলোর ফেরিওয়ালা মনির দুলাভাইয়ের কাছে প্রায়ই ধর্ণা দিতাম।

বাল্যকাল হতেই আমি একজন বইপাগল লোক। একদিন কিশোর আমাকে মনির দুলাভাই তার কর্মক্ষেত্র মুসলিম সাহিত্য সংসদে নিয়ে যান। মনির দুলাভাইয়ের সাথে হেঁটে হেঁটে দরগার পুর্বগেটে সংসদে ঢুকে এত বইয়ের সমুদ্র দেখে আমি অবাক হয়ে যাইবইয়ের এত বড় রাজ্য আমি জীবনে আর কোনদিন দেখিনি। মনের আবেগে এক তাকিয়া হতে অন্য তাকিয়ায় কিশোর আমি হেঁটে হেঁটে একটার পর একটা বই হাতে নিয়ে নাম ও সুচীপত্র পড়তে থাকি। মন চাইছিল সব মজার বই একসাথে পড়ে সাবাড় করে ফেলি।

সেই সময়ে বিটিভি ছাড়া আর কোন টিভি চ্যানেল ছিলনা। সারামাসে মাত্র একটি সিনেমা, একরাতে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘ঝিলিমিলি’ ও ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এরমত হাতেগুনা গুটিকয় অনুষ্ঠান হত। এসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানুষ দিনের পর দিন উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতেন। হাতেগুণা কয়েকজন নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকার মুখশ্রী দেখে দেখে মানুষ বিটিভি দেখার স্বাধ মেঠাত। শাসকশ্রেণীর লোকদের নানা গুণগান, স্থুতি বাক্য, তুষামুদির বন্যায় জনগণের কান জ্বালাপালা করত। এরশাদ, বেগম রওশন এরশাদ এবং চাটুকার মন্ত্রীদের একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে বারংবার দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে লোকে টেলিভিশনকে বলত ‘মিয়া বিবি গোলামের বাস্ক’বেতারের অবস্থাও ছিল তথৈবচ।

আজকের অনলাইন নেটওয়ার্কের এই মোহনীয় স্বর্গরাজ্যের অস্থিত্বও সেদিনের মানুষের কাছে ছিল কল্পনাতীতঅতএব মানুষ যাবে কোথায়? তাই সেদিনের মানুষের কাছে বই ই ছিল ধ্যান, জ্ঞান, আনন্দ, বিনোদন সব। এই আমার শুরু হল এক প্রজ্জলিত প্রদীপ মনির চৌধুরীর হাত ধরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামক আলোর ঘরে যাত্রা। আজও এই যাত্রা থামেনি। এই আলোর ঘরের আলোক বন্যায় আমি এত আলোকিত হই যে এই আলোতে আজও আমি পথ চিনে নেই।

এই ঘরের রংমঞ্চের হাজার স্মৃতি মনে পড়ে, এখানে  জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, লেখক রাঘিব হোসেন চৌধুরী, লেখক মনির উদ্দিন, সাংবাদিক আব্দুল হামিদ মানিক, আফতাব চৌধুরী, আজিজুল হক মানিক, সেলিম আউয়াল, আব্দুল মুকিত অপিসহ অনেক সুধীজনকে জ্ঞানের আড্ডায় বসতে দেখেছি। একদিন কলেজ সহপাঠি সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর এই মুসলিম সাহিত্য সংসদের নির্জন এক টেবিলে বসে বইপাঠে নিবিষ্ট আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে দেখিয়ে বলল, হেই সেফাক, এই দেখ সাবেক অর্থমন্ত্রী বসে বই পড়ছেন। নির্ঝর আর বলল, প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বিদেশ হতে ধরে বেঁধে এনে অর্থমন্ত্রী করেনকিন্তু এরশাদের সাথে তার মতের মিল না হওয়ায় পদত্যাগ করে আবার বিদেশে চলে যান। আমি এই প্রথম আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মুখ দেখি। এখানে সিলেটের আর অনেক বরেণ্য ব্যাক্তিত্বকে বিভিন্ন সময়ে একমনে বই পড়তে দেখেছি

আমি সংসদের আড্ডাখানায় খুব একটা বসতামনা। আমার হাতে সময় থাকত সীমিত, তাই বসে বসে বই পড়ে কিংবা দরকারি বইটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। কলেজ জীবনে একদিন দুপুরে সংসদে বসে মোঘলসম্রাট বাবুরের আত্মজীবনী ‘তুজুখে বাবুর’ হাতে নেই। বইটি আমাকে এতই আত্মনিমগ্ন করল যে কিভাবে দিন পার হয়ে রাত্রি নেমে আসে বুঝতেই পারিনি।

সাপ্তাহিক বৃহস্পতিবারের সাহিত্যসভায় অংশগ্রহ করার সৌভাগ্য সময়ের দন্যতায় খুব একটা সম্ভব হয়নি। একদিন কবি কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় আমার স্বরচিত কবিতা পাঠ করি। অন্য একদিন গল্পকার সেলিম আউয়ালের সভাপতিত্বে পরিচালিত সভায় আমার লিখা একটি ছোটগল্প পড়ে শুনাই। ২০১৩ সালে সংসদের বাৎসরিক সাধার সমাবেশে বক্তব্য রাখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমি সে বৎসর আমার লিখা ‘ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র’ এর পাচটি কপি উপহার প্রদান করি, যা এই সভায় সম্মানের সাথে স্মর করা হয়।

বেশ কয়েকবার ভোটের লাইনে দাড়িয়ে সংসদ কমিটি নির্বাচনে ভোট প্রদানের স্মৃতিও আমার বেশ মনে পড়ে। তখন প্রার্থিরা জনে জনে গিয়ে ভোট চাইতেন এবং সংসদ আঙ্গিনা ব্যানার পোস্টারে ছেয়ে যেত। সংসদের বইমেলা ও ভোট অনুষ্ঠানে এক উৎসবমুখর আবস্থা বিরাজ করত। সিলেট অঞ্চলের যতসব কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক লেখিকাদের হৈ চৈ, মঞ্চ বক্তব্য, কানাঘুষা, আনন্দব্যদনা, স্মৃতিচার কেমুসাসের বইমেলা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানকে এক প্রাবন্ত কিংবদন্তি অনুষ্ঠানে পরিত। আমার স্মৃতিময় এই প্রতিষ্ঠানের জীবন সদস্য হওয়া যতই তুচ্ছ ঘটনা হউক না কেন তা আমার কাছে একটা বড় ও মহৎ কিছু হবার মত আমার সাধার জীবনে ঘটা এক অসাধার ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই মনে হয়। 

পূবালী ব্যাংকে চাকুরী স্থায়ীকরণের জন্য ২৬ জুন ১৯৯২ সালে আমাদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৯২ সালে আমার চাকুরী স্থায়ীকর কার্যকর হয়। এই পরীক্ষায় অনেকে আটকাও পড়েন। শিক্ষানবিশ সিনিয়র অফিসার মইনুল হোসেন চোধুরী ও দিলদার আহমদ ভাইয়ের মত লোকও পরীক্ষায় আটকা পড়ে যান। এই শাখায় অবস্থানকালে  হতাশাগ্রস্থ আমি চাকুরী ছেড়ে লন্ডনে যেতে আবার সেখানকার একটি কলেজে ব্যাংকিং বিষয়ে ভর্তি হই। কিন্তু এবারও স্পন্সর দুর্বলতায় ভিসা পেতে ব্যর্থ হই।

চাকুরীতে যোগদান করেই আমি দাউদপুরের ঘরের কিছু পাকার কাজ করি। বড়ঘরের মেঝে সহ উত্তরের একটি কোঠা ও পাকঘর নির্মা হয়। আমাদের গ্রামের কোনারপাড়ার কুটই আলী মিস্ত্রি কাজ করেন। জুনিয়র অফিসারের কনসলিডেটেড বেতন ছিল ২৩৬৩/=টাকা। মনে পড়ে আমার এক মাসের বেতন এই ২৩৬৩/= টাকায় আমি তখন তিন হাজার ইট কিনি। এত বৎসর পর আজ আমি যখন হিসেব মিলাই তখন দেখি বারবার এত বেতন বৃদ্ধির পরও জুনিয়র অফিসারের বেতন এই তিন হাজার ইটের দামের সমানই রয়ে গেছে।

তখন রুস্তম আলী ব্যবস্থাপক স্যারের আমল, ছাতকের একজন লন্ডনি একদিন এসে তার হিসাবের স্থিতি বাইশ লক্ষ টাকা উঠাতে চানস্যার বললেন এত নগদ  টাকা আমাদের হাতে নেই। কালকে আসেন আমরা সিলেট শাখা হতে এনে দেব। পরদিন লোকটি আসলে তাকে ২২ লক্ষ টাকা পরিশোধ করা হয়। টাকা পেয়ে এই গ্রাম্যলন্ডনি অনেকক্ষ ধরে টাকাগুলো গুণেগুণে দেখে বললেন আজ আমার টাকা লাগবেনা আবার জমা করে দেন। লোকটি চলে যাবার পর ক্যাশ ইনচার্জ আব্দুল মন্নান স্যার বললেন, এই এতটাকা একসাথে উঠায়ে আবার জমাকরণের মুজেজা কি কেউ বলতে পারেন? ভদ্রলোক পরীক্ষা করলেন লন্ডন হতে পাঠানো তার টাকাগুলো একাউন্টে ঠিকঠিক আছে কিনা। টাকাগুলো গুণেগুণে যখন দেখলেন বাইশ লক্ষ ঠিক আছে তখন নিশ্চিত হলেন  নিশ্চয়ই কোন ধরনের খেয়ানত হয়নি। ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী খুশি হয়ে বললেন, শোকরিয়া, আল্লাহর রহমতে আমাদের ২২ লাখ টাকা ডিপোজিট চলে যায়নি।

ব্যাংকের পাশে মোতালেব ভিলা। এই ভিলার মালিক মোতালেব মিয়া একজন দাম্ভিক নিচমনা লোক। লাল মাতাল চোখের এই কাল লোকটা প্রতিদিন ব্যাংকে এসে দেশেবিদেশে তার টেলিফোন করার কাজ মাগনা সেরে নিতলোকটা বেতমিজ হওয়ায় ম্যানেজার শত বিরক্ত হলেও কিছু বলার সাহস করতেন না। রোজ রোজ এসে টেলিফোনটি সে তার বাপের সম্পদের মত ব্যবহার করতকালো এই লোকটার একটা অদ্ভুদ গর্ব ছিল যে, তার ভাই সামরিক শাসক এরশাদের গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের এমপি গৌছ, এই এমপি একজন খুনী, সে কদমতলীর আজাদ বখতকে গোলশান হোটেলে জুয়ার আসরে পিস্তল দিয়ে খুন করে।

মোতালেব মিয়া বেশ অহঙ্কার করে তার কীর্তিমান ভাইয়ের এই খুনের কাহিনি বলত যেন তার বাহাদুর ভাই একটা খুব ভাল সুনামের কাজ করেছে। মোতালেব মিয়া এই আত্মঅহংকারে নিমগ্ন থাকাকালেই একদিন তার কানাডা পলাতক এমপি ভাইয়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষিত হয়। অদ্ভুদ দেশ কানাডা, তাদের দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান না থাকায় তারা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পৃথিবীব সব ভয়ঙ্কর অপরাধীদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিত্ব দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী নুর চৌধুরীর মত অপরাধীকেও তারা জামাই আদরে আশ্রয় প্রদান করে। এরশাদের এই খুনী এমপি গৌছ কানাডা হতে এখন দেশে এলেই তাকে গলায় ফাঁসির দড়ি পরতে হবে। আমার ভাবতে অবাক লাগত এসব বাজে লোকেরা তাদের অপকর্ম লোকসমক্ষে প্রকাশ করাকে লজ্জার কাজতো মনে করতই না বরং মনে করত দশজনের কাছে বলিয়া বেড়ানোর মত দারু অহংকারের কাজ।

এই মহিলা কলেজ শাখায় অনেক নামী দামী লোকজনও আসতেন এখানে প্রায়ই বিচারপতি রনধীর শর্মা ও তার পত্নী রেবা সেন আসতেন সিলেট মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে রেবা সেন এই কলেজে অবৈতনিক প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় তিনি এখানে হিসাব খোলেন। তাদের জ্ঞানগরিমা ও শিষ্টাচার আমাদেরকে বিমুগ্ধ করত। আমাদের একজন অতিপ্রিয় ঋণগ্রাহক মোহাম্মদ জামান ভাই, যিনি ছাতক হতে হিজরত করে সিলেটে আসেন। সদাহাস্য জামান ভাইয়ের প্রকৃত নাম হুশিয়ার আলী। সিলেটে এসে ব্যবসা বানিজ্যে তিনি খুবই উন্নতি করেন, গাড়িবাড়ির মালিক হন। হুশিয়ার আলী ভাই খুব উদারমনের মানুষ, তিনি এফিডেভিট করে নিজেকে একটি  মানানসই নাম উপহার দেন, সুন্দর এই নামটি হলো মোহাম্মদ মাসুদ জামান।

আমার অনুজ নিশাত চৌধুরী ১৯৯০ সালে এসএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। আমি তাকে এম সি কলেজে ভর্তি করে দেই। একই পরিবার হতে আমার পিতা সফিক চৌধুরী ১৯৩৯ সালে, আমি ১৯৮১ সালে ও নিশাত চৌধুরী ১৯৯০ সালে এম সি কলেজের একাদশ(বিজ্ঞান) শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এম সি কলেজের হোস্টেলে সিট না পেয়ে তাকে টিলাগড়ের একটি মেছে পাঠিয়ে দেই। সে ১৯৯২ সালে এইচ এস সি(বিজ্ঞান) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে।

এই মহিলা কলেজ শাখায় থাকাকালে ১৯৯১ সালের কোন একদিন মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর বিদায় সম্বর্ধণা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি তার সুদীর্ঘকালের শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। ১৯৯০ সালের ২৭ আগষ্ট ব্যাংকের চাকুরিতে ঢুকেই আমি তাকে অবসর গ্রহণে পাঠাই। বহুদিন কোন খবর নেই হঠাৎ স্কুল হতে একদিন জানান হল তার বিদায় সম্বর্ধণা হবে। তখন প্রধানশিক্ষক ছিলেন সবার প্রিয় শ্রীগুনেন্দ্র চক্রবর্তী স্যার। স্কুলের রাস্তাপাশের উত্তরের ঢালাই ভবনে সম্বর্ধণা অনুষ্ঠান হয়।

রি-ইউনিয়নের মত এই অনুষ্ঠানটি আব্বার নতুন ও পুরাতন ছাত্রদের এক বিশাল মিলনমেলায় পরিত হয়। বড় হলঘর পুর্ণ হয়ে অনেকে বাহিরে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকেন। অনেক বক্তা আব্বার অনেক গুণাগু বর্ণনা করে অনেক স্মৃতিচার করলেন। তারা বক্তব্যে নিজেরা কাঁদলেন, অন্যদেরকেও কাঁদালেন। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে হন আমার আদর্শ শিক্ষক, এমসি কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান ডঃ শফিউদ্দিন। বক্তব্যে  ডঃ শফিউদ্দিন স্যার বললেন, আমি বিষ্মিত মফস্বলের একজন হাইস্কুল শিক্ষক ছাত্রদের কাছে যে এত জনপ্রিয় হতে পারেন, এত শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন, এখানে না এলে তা আমার বিশ্বাসই হতনা।

অজস্র অজস্র মানপত্র, পুষ্প্যমাল্য ও উপহারে ঘরের একটি কো ভরে যায়। এসব শ্রদ্ধাঞ্জলি বিতর করে করে হেডস্যার গুনেন্দ্র চক্রবর্তী ও শফিউদ্দিন স্যার হাঁফিয়ে উঠেন। কেউকেউ বক্তব্যে বললেন মানুষের ভালবাসাই তো জীবনের সার্থকতা। স্যারের জীবন সার্থক, তিনি জীবনভর মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে আব্বা সফিক চৌধুরীকে নিয়ে রাতে যখন ঘরে ফিরি, তখন বারবার মনে পড়ে কবি জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কাব্যের কয়েকটি লাইন “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন,/ সন্ধ্যা আসে, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।/ পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন,/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ্গে ঝিলমিল,/ সবপাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এজীবনের সব লেনদেন”

১৯৯২ সালে এই শাখায় থাকাকালে ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে। সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শতশত নিরিহ মানুষ নিহত হন। এর কিছুটা উত্তাপ বাংলাদেশে এসে পড়ে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে একদিন পূবালী ব্যাংক মহিলা কলেজ শাখার সামনের রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল জঙ্গি মিছিল বয়ে যায়। মিছিলটি এত বড় ও জঙ্গি ছিল যে এধরনের মিছিল আমি সিলেটে আর কখনও দেখিনি। 

সিলেটের হিন্দু মন্দিরগুলোয় কিছু উশৃংখল মিছিলকারী লোকজন হালকা অগ্নিসংযোগ, ডিল নিক্ষেপ ও ভাংচুর করে। চারদিকে পুলিশ ও ফায়ার সার্বিসের গাড়ি উচ্চশব্দে হর্ণ বাজিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। জানালা দিয়ে এই বিশাল জঙ্গি মিছিল দেখে আমাদের হিন্দু সহকর্মী শ্যামলীদি ও সাথীদি ভয়ে কাঁপতে শুরু করেন। আমরা দরজা জানালা সব শক্তভাবে বন্ধ করে দেই ও তাদেরকে সাহস দিয়ে বলি কোন ভয় করবেন না, আমরা জীবিতাবস্থায় আপনাদেরকে কেউ কিছু করতে পারবেনা। 

শ্যামলী দিদির দুলাভাই বি কে দাস বাবু পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী। তাঁরা দুইবোন কালীবাড়িতে একই বাসায় থাকেন। শ্যামলী দিদি তাঁর বোনের দুই তরুণী কন্যাকে নিয়ে ভীষণ উদ্ভিগ্ন। আমি শ্যামলী দিদিকে অভয় দিয়ে বললাম, সিলেটের হিন্দু মুসলিম সবাই ভালমানুষ, তাঁরা এত বদ হতে পারবেনা, এত নিচে নামতে পারবেনা, নিশ্চিত থাকুন দিদি। আমার কথায় শ্যামলী দিদির চোখেমুখে বেশ প্রশান্তির ছায়া দেখা গেল। আমার কথাই সঠিক হল, এত অরাজকতার পরও সেদিন সিলেটে কেউ কারো গায়ে হাত তুলেনি, কিংবা কোন মহিলাও লাঞ্চিত হতে শুনিনি। 

সন্ধ্যারাতে সিলেট শহরের ভূতুড়ে পরিবেশ যথেষ্ট শান্ত হয়ে গেল, সারাদিনের উত্তেজনাময় ঝড়তুফানের পর সিলেট শহর জুড়ে এক থমথমে নিস্থব্ধতা নেমে এলো। ফরিদউদ্দিন স্যার তখন বিশ্বস্থ লোক মারফত শ্যামলীদি ও সাথীদিকে তাঁদের নিজনিজ বাসায় পৌঁছে দেন। আমি সেদিন অনেক রাত করে দাউদপুরের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই। বিশাল জমিদার বাড়িটায় পা রেখে মনে হল সব ঠিকঠাক, কেমন যেন সুনসান নীরবতা, শান্তির নিস্থব্ধ ঘুমে সবকিছু, উত্তাল শহরের অশান্ত গরমের কোন ছিটেফুটো নেই এখানে, যেন দেশে আজ কিছুই ঘটেনি।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে দাউদপুর চৌধুরীবাজারে কোন এক শুক্রবার বিকেলে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় আমি বক্তব্যে বলি ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা নিঃসন্দেহে একটি চরম নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ, যারা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে তাঁরা গুরুতর অন্যায় কাজ করেছে কিন্তু এই ঘটনায় আমাদের বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন লোকজন জড়িত নন। এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ভারতে সংঘটিত কিছু দুবৃত্তের এই অপকর্মের দ্বায়ভার আমাদের দেশের সাধার নিরীহ হিন্দু লোকজনের উপর কোনমতেই চাপানো যায়না। ইন্ডিয়ার এই ঘৃণ্য ঘটনায় আমাদের দেশের শান্তি শৃংখলা যেন বিনষ্ট না হয়। আমরা এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করি, কিন্তু তা যেন শান্তিপুর্ণ হয় এবং কোনমতে হিংসাবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত না হয়। আমাদের দেশে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা রক্ষা করা আমাদের সমাজের সকলের মানি দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে আমরা যেন সদা সচেষ্ট থাকি। অবশ্য কিছুদিন পর উগ্রবাদীদের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে কমে শীতল হয়। দেশে সুখ ও শান্তি ফিরে আসে।

ব্যবস্থাপক ফরিদউদ্দিন স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার তিনি জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকদিন অফিসে আসতে পারেন নি। আমি তখন ফাজিলচিস্ত মহল্লার সর্বশেষ বাসাটিতে গিয়ে তাকে দেখে আসি। তার পাশের বাসায় তখন থাকতেন আমাদের আরেকজন ব্যবস্থাপক বড়লেখার বর্নি গ্রামের এম এ মান্নান ডিজিএম স্যার