আমরা পাঁচজন এবার ছুটে যাই কোহিনূর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে, মজা করে রাঁধা চিকেন রাইস সাবাড় করি। ফুকেট নিরিবিলি পর্যটন শহর। গেস্ট হাউস গুলোর ছাদ ডালু ও রঙ্গীন টালী বসানো। এখানে সর্বত্র আনন্দের বন্যা বইছে। ব্যবসাপাতি ব্যাংককের মত মেয়েদের দখলে। সন্ধ্যায় পাশের পাতং সি-বিচে যাই। কক্সবাজারের মত উম্মাদ বাতাস ও উত্তাল ঢেউ। দুচারজন লোক জলে নামছেন। সি-বিচের দু’দিকে দুইটি পাহাড় ভারত মহাসাগরে ডুকে গেছে। এই দুই পাহাড়ে রয়েছে অফিস, বাড়িঘর ও গাছপালা। দুই পাহাড়ের ফাক দিয়ে তরংমালা এসে বালুর সৈকতে আছড়ে পড়ছে। সত্যিই এক বিচিত্র সৈকত পাতং সি-বিচ। ৩রা জুলাই ২০১৩। ফুকেটের একটি বাজারের সামনে কিছু ছেলেমেয়েকে জিমন্যাস্টিক জাতীয় ক্তীড়া প্রদর্শন করে জনতাকে আনন্দ দিয়ে টাকা রোজগার করতে দেখি। থাইল্যান্ডে ছেলে ও মেয়ে আলাদা করে দেখা হয়না। অর্ধনগ্ন ছেলেমেয়েরা জড়াজড়ি করে নানা কসরত প্রদর্শন করছে, যা আমাদের দেশে কল্পনা করা যায়না। বিকেলে জল্বেষ্টিত একটি মার্কেটে ডুকি, পাশে পানির সুন্দর ফোয়ারা। এখানেও দ্রুত বোতল ছোড়া ও ও ধরার খেলা দেখে মুগ্ধ হই। পর্যটকরা অভাব বিষ্ময়ে এসব ক্রীড়ানৈপুন্য দেখে অর্থদান করছেন। ফুকেটের একটি হোটেলে অসংখ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভাস্কর্য্য, প্রথম ও দুতলায় বাঘগুলো শিকারে উদ্ধত। এই ভবনের খুটিগুলো বৃক্ষের মত ডালপালা ও পত্রশোভিত। এই আরসিসি বৃক্ষগুলো ভবনের ভার বহন করছে। বাঘ ও বনের আড়ালে খাবারের চেয়ার টেবিল পাতা। এযেন এক অনন্য ও বিচিত্র খাবার হোটেল। রাতের আগমনে পাতং সি-বিচ আতশবাজির আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে যায়।
৪জুলাই ২০১৩সাল, বৃহস্পতিবার। গতকাল আমরা জনপ্রতি ১১০০বাথে ফুকেটের পাঁচটি ক্ষদ্র পর্যটন দ্বীপের ৭টি সাইট ভ্রমনের প্যাকেজ ক্রয় করি। প্যাকেজে স্পীডবোট ভাড়া এবং দুপুরের খাবার অন্তর্ভুক্ত। সকাল ৭টায় একটি ট্যুরিস্ট বাস এসে বিভিন্ন হোটেলের নানা ভিনদেশী লোকদেরে নিয়ে ভারত মহাসাগরের তীরে একটি স্পীডবোট ঘাটে নিয়ে যায়। জটলা বাঁধা লোকজনকে বিভিন্ন স্পীডবোটে উঠানো শুরু হয়। প্রতিটি স্পীডবোট বেশ বড়সড় এবং যাত্রি ধারন ক্ষমতা ৫০/৬০ জনের কম নয়। আমাদের স্পীডবোট পরিচালনায় চালকের সাথে দুইজন হেল্পার ছিলেন। একজন হেল্পার গাইড হিসাবে কাজ করেন। আমাদের গাইড ছিলেন একজন দক্ষ কৌতুক অভিনেতা কালো লোক। চীনা জাপানি ৯/১০ বছর বয়েসী মেয়ে শিশুরা তার ডার্লিং এবং বালকেরা বয়ফ্রেন্ড। সাগরে সাতার কাটার সময় মাছের লেজাকৃতির এক ধরনের নরম জুতা পরে সাতার কাটতে বেশ আনন্দ লাগে। আমাদের জৌকার গাইড সাগরে মাছ, পোকা ও সাপের কামড়ের ভয় দেখিয়ে অনেক জুতা ভাড়া দেন। সাপ ও পোকার কামড় খেলে উফ বলে ঢলে পড়ার অভিনয় এমন আকর্ষনীয় করে দেখায় যে বিদেশীরা ১০০বাথ ভাড়ায় অনেক জুতা ভাড়া করে এবং সে প্রচুর অর্থ কামাই করে নেয়।
ভারত মাহাসাগরের বুক চুরে ৮/১০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের পর ঢেউ ভেঙে স্পীডবোট তীব্রবেগে দু’দিকে পানির সুউচ্চ ফোয়ারা তৈরী করে অগ্রসর হতে থাকে। চারপাশে সীমাহীন জলরাশির বুকে কেবল উঁচু উঁচু ঢেউয়ের খেলা। বড় ঢেউয়ে আঘাত লেগে স্পীডবোট বারবার তীব্র ঝাকুনি খায়, সাগরের জলের ঝাপ্টা এসে গায়ে লাগে। ঢেউয়ের বিরামহীন দোলায় ব্যামো না হওয়ার জন্য একসময় সবাইকে টেবলেট দেয়া হয়। আমরা সবাই এই বমি আটকানোর টেবলেট মুখে পুরে দেই। কিছু ফলমূল হাতে হাতে পরিবেশন করা হয়। এই অথৈ মহাসাগরে বোট নিমজ্জিত হলে সলিল সমাধি ছাড়া ভাগ্যে আর কিছু জুটবেনা। কাছে লাইফ জ্যাকেট আছে বটে তাই অনবরতঃ পরম করুনাময়ের নাম জপতে থাকি। কিন্তু এই লাইজ জ্যাকেট পরে আট দশ ফুট উঁচু ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকবে কতক্ষন। প্রায় আড়াই ঘন্টা উল্কাবেগে মহাসগরের বুক চুরে অগ্রসর হবার পর আচমকা আমরা মহান আল্লাহর এক অপরূপ সুন্দর সৃষ্টির সামনে এসে যাই। স্পীডবোট দুইটি সামুদ্রিক পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে গিয়ে এক ঢেউহীন শান্ত সমুদ্রে এসে পড়ে। শক্ত শিলার পাহাড় সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে ভেঙে নিচের দিক যেন সুড়ুঙ্গের মত হয়ে গেছে। আহ কি অপূর্ব দৃশ্য সাগরের জলরাশির উপর ঝুলন্ত শিলার ছোট্ট পাহাড়ি দ্বীপ। সম্ভবতঃ এই দ্বীপটির নাম জেমস বন্ড আইল্যান্ড। একটু পর স্পীডবোট পাশের গাড় সবুজ দ্বীপে যায়। এখানে ছোট বালুকা সৈকতে অসংখ্য বানরের দল এবং পানিতে নানাবর্নের মৎস্য ঝাকের ছড়াছড়ি। পর্যটকরা বোট থেকে মাছ ও বানরদের দিকে পাউরুটি ছুড়ে দেন। সৈকতে বানরের দল এবং পরিস্কার সাগরজলে মাছের ঝাঁক লাফালাফি করে খাবার খায়। এই সুন্দর দ্বীপটির নাম মাংকি আইল্যান্ড। শিলার এই দ্বীপটি কলসের মত ভেসে আছে সাগরে যা বেয়ে উপরে যাবার উপযোগী নয়। উপর থেকে নিচে ঝুলে আছে লতানো সবুজ বন।
মাংকি দ্বীপ হতে হাজার ফুট দূরে স্পিডবোট আমাদেরকে একটি ধবল বালির দ্বীপে নিয়ে আসে। দ্বীপটির নাম করাল রাচা দ্বীপ। এই দ্বীপের সৈকতে কেঊ জলে সাঁতরাতে নামেনা। সুন্দর এই সৈকতের উপরের ধাপে এক শিল্পময় খাবার হোটেল। টিলার উপর প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশি বিদেশি মজার মজার খাবারে সাজানো কয়েকটি টেবিল। এক টেবিলে রুটি, পরোটা, পোলাও এবং নুডুলস। পরের টেবিলে রান্না করা ঝাল ফ্রাই, সামুদ্রিক মাছফ্রাই, চিংড়ি ও সবজি। অন্য টেবিলে ফিন্নি, দৈ ও নানা ধরনের ফল-মূল, একদিকে চা-কফি সহকারে বিস্কুট। চীনা, থাই, ভারতীয় খাবারের ছড়াছড়ি। বুফে খাবার, এত খাবার কত আর খাওয়া যায়।
একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে দেখে আমরা ছাতা কিনতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে অপূর্ব সুন্দর রিসোর্টে গমন করি। ছোট্ট দ্বীপের নিরিবিলি রিসোর্ট ফুলে ফুলে সুসজ্জিত। পাশের ট্রেড সেন্টারে গিয়ে ২৫০বাথে আমরা পাঁচটি রেইন কোট ক্রয় করি। এই দ্বীপে খাবারদাবার সমাপ্ত করে গাইড আমাদেরকে স্পীডবোটে ফেরার ডাক দেয়। স্পিডবোটের দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের জৌকার গাইড বুকে নারীর সুউচ্চ স্থনওয়ালা বক্ষবেষ্টনী পরে কৌতুক করে সবাইকে ডাকছে। বিদেশি নরনারীরা দেখে হাসছে, কেউ কিছু মনে করছেনা। কিন্তু বাংলাদেশে এধরনের কৌতুক করলে খবর হত। নিশ্চিত এই গাইড মানুষের চপেটাঘাত খেত। অথচ থাই নগ্ন সমাজে এটা একটা নিছক কৌতুক মাত্র। এসমাজে নগ্নতা ও যৌনতায় কোন পাপ নেই, লজ্জাও নেই।
এবার প্রায় দেড়-দুই হাজার ফুট দূরে আমাদেরকে এক অবর্ননীয় সুন্দর পীপী দ্বীপে নিয়ে আসে স্পিডবোট। পার্বত্য দ্বীপটির সৈকতে অজস্র হলুদ ছাতার নিচে ইজিচেয়ার পাতা। সেখানে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। জাপানি, চীনা, কোরিয়ান, বৃটিশ ও আমেরিকান শত শত অনিন্দ্য সুন্দর মানব-মানবীরা নিজ নিজ বস্ত্রহরনে লিপ্ত। দশের পুড়ি হতে আশীর বুড়ি। সবার অঙ্গে লেগে আছে কেবল একটা ন্যাংটি ও ক্ষুদে বক্ষবেষ্টনী। আমরা মামু ভাগনারা লজ্জায় অন্যদিকে পালাই। আমরা চোখ-মুখ-কানে স্নরকলিং মেশিন লাগিয়ে পিপির কাছের সাগরে ঝাপ দেই। ধবল স্বচ্ছ গোলাপি বালির সৈকত পেরিয়ে পরিস্কার নীলজল। পানিতে ডুব দিয়ে দেখি তলায় সাতার কাটছে লাল-হলুদ-সবুজ-সোনালি- বাসন্তি নানা রঙের মাঝের ঝাঁক। মাছেরা পাঁচ আঙ্গুলের ভিতর চলে আসে অথচ ধরা যায়না, সটকে পড়ে। মেশিনে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ে প্রবালের সাদা গর্ত এবং খাদের উপর হাঁটতে থাকি। গর্তে বাইন মাছের মত সর্পাকার মাছ দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে চিংড়ি, তারামাছ ইত্যাদি। পিপি দ্বীপের এই এলাকা স্নরকলিঙ্গের জন্য নির্ধারিত। হলুদ ছাতার সামনে স্বচ্ছ গোলাপি বালির সৈকত, এই সৈকতে বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এখানে আমাদের কক্সবাজার সৈকতের মত ময়লা বা ঘোলাজল নেই। এই সৈকতের জলরাশি বৃষ্টির জলের মত পরিস্কার। এই অপূর্ব সুন্দর বিচের বালিতে আচড়ে পড়া পানিকে পাতলা সবুজ দেখায়। আবার দূরের পানির রঙ্গ গাড় নীল দেখায়। ঢেউগুলো কক্সবাজারের ঢেঊয়ের চেয়েও উত্থাল মনে হয়েছে। হাফপ্যান্ট ও গ্যাঞ্জি পরে লাইফ জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে আমরা এই ভারত মহাসাগরে ঝাপ দেই। লাইফ জ্যাকেট আমাদেরকে নিয়ে ঢেউয়ের সাথে হাসের মত ধুলতে থাকে। চারপাশে অসংখ্য ভিনদেশি নরনারী ঢেউয়ে দোলে জীবনকে ভোগ করছে। জীবনের সত্যিই এক আনন্দের দিন, বিচিত্র অভিঞ্জতার দিন ৪ঠা জুলাই ২০১৩ এভাবে ধীরে ধীরে ভারত মহাসাগরের পিপিদ্বীপে হারিয়ে যায়। স্পিডবোটে এবার যাত্রি গুনে গুনে উঠানো হয়। পিপি হতে স্পিডবোট খুব দ্রুতবেগে ফুকেটের পানে ধাবমান হয়। সামনে পর্যটন নগরী ফুকেটের অনন্যসুন্দর পর্বতমালা দৃশ্যমান হয়। আমরা গাইডদের হাতে কিছু বখশিস গুজে দিয়ে ফুকেট সমুদ্রঘাটে নেমে পড়ি। বাংলারোডের স্টানবু গেস্টহাউসে এসে আমরা হালকা নাস্তা সেরে ভাড়া-কারে ফুকেট আন্তর্যাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওয়ানা হই। ফুকেটের বিশাল সাতলেনের রাস্থা দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই, পিছনে পড়ে রয় অনিন্দ্যসুন্দর শহর ফুকেট। রাত ১১টায় স্টার এসিয়ার বিমানটি ব্যাংককের উদ্দেশ্যে ফুকেট ত্যাগ করে।
৫ম এবং ৬ষ্ট জুলাই ২০১৩সাল। ব্যাংকক শহরে ঘুরাঘুরি করি, নৌকায় সাম্পাইং বাজারে গিয়ে মালামাল কিনি। উড়াল ট্রেনে ব্যাংককের বিখ্যাত এম.বি.কে মার্কেটে যাই। একশত বাথ ভাড়া দিয়ে বিগ. সি. টেসকো লেটাস সুপার সেন্টারে প্রবেশ করি।
মশামাছিহীন খালের শহর ব্যংককের তাপমাত্রা সিঙ্গাপুর- মালয়েশিয়ার চেয়ে খানিকটা বেশী মনে হয়েছে। এখানেও নাকি ঋতু বৈচিত্র নেই, আবহাওয়া সমভাবাপন্ন। এখানে হোটেলে লকার আছে এবং ঘুম হতে জাগানোর জন্য এলারাম মেশিন রয়েছে। বৃষ্টির আধিক্যের জন্য সমগ্র দেশটি সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে। থাইরা দুইহাত জোড় করে মাথা খানিক নুয়ায়ে পরস্পরকে অভিবাদন করে। সুখী থাইরা আমাদের চেয়ে ধনে জনে শান্তিতে অনেক বেশী সৌভাগ্যবান বলে আমার ধারনা হয়েছে। আমি থাইল্যান্ডের আর উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে থাইভ্রমনের ইতি টানলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন