সপরিবারে নেপাল সফর- কাটমন্ডু, পুখারা, নগরকোট, এভারেস্টশৃঙ্গ দর্শন ও আকাশে প্যরাস্যুট গ্রাইডিং পর্ব- তিন
৮ মে ২০১৪ সাল। খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের পুখরা দেখার লোভ আমি সামলাতে পারিনি। তাই একাকি বেরিয়ে পড়ি। রাস্থায় কোন লোকজন নেই। কোকিল ঘুঘুসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি ডাকছে। নেপালের ভদ্র ও স্বাস্থ্যবান কুকুরগুলো হাঁটতেছে। নেপাল শান্তির দেশ। এখানে চোর ডাকাত বাদমায়েশ বা হাইজ্যাকারের ভয় নেই। ভোরের পুকরা লেক নয়নাভিরাম। ওপারে পাহাড়ের গাঁ ঘেষে ঘেষে দলবদ্ধ হলুদগলা সাদাবক উড়ে উড়ে যাচ্ছে। লেকের মধ্যে ভাসমান পাহাড়ের রেস্তোরা। এখানে নৌভ্রমনকারীরা চা-নাস্তা করে থাকে। লেকপারের বাগানে নানা জাতের ফুল ও ফলের সমারুহ। নীলফুল, লতাফুল, পামগাছের মত বৃক্ষ আর কত কি। এখানে একা মাঠ পেয়ে মনভরে জগিং করি। সেতু দিয়ে লেকের মাঝের টাওয়ারে যাই। দুই জাপানি স্বল্প বয়সি কপোত-কপোতী একাকি বসে বাক বাকুম করছে। দূরে জেলে নৌকায় বসে জেলেনীরা মাছ ধরছেন। এদেশে কৃষিকাজ, মাছধরা ও হোটেল পরিচালনায় পুরুষ ও নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহন করেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ ও কুয়াশা জমে রয়েছে।পাহাড়ের বাড়িঘরে মেঘের বাষ্প ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ পুকরা লেকের অন্যপারে সূর্যের লাল মুখটি ভেসে উঠে। চেয়ে দেখি সাদা ফুলের মত লেকপারে বাশবনে অজস্র বকেরা বসে আছে। পুকারার এই স্বর্গীয় সুন্দরের মালিক মহান আল্লাহকে অশেষ প্রশংসা জানাই। ফিরে এসে আমাদের হোটেলে ব্রেকফাস্ট করি। নানাপদের খাবার- চাপাতি, ডিম, সবজি, দুধ, কুকারিজ, শরবত, কফি ও টুস্ট মাখন জেলি ইত্যাদি। ধর্মীয় কারণে মোরগ খাওয়া হতে বিরত থাকি। সকাল ১০টায় একটি এসি মাইক্রোবাসে এসে আমাদেরকে সাইট সিয়িংয়ে নিয়ে যায়। কি কি দেখা হল এবার তা পাঠকদের কাছে ধারাবাহিক বর্ণনা করব। প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে যায় Seti river gorge বা সেতু জলপ্রপাতে। দুই সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যভাগ দিয়ে তীব্র শব্দে জল নামছে। একটু নিচে নেমে দেখি দুটি পাহাড়কে একটি সেতু দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। ও সেতুর নিচে তীব্র নিনাদে জলপ্রপাত বয়ে যাচ্ছে। সেতুর মধ্যভাগ দিয়ে একটি ক্যানেল নির্মাণ করে জল অন্যপারে নেওয়া হচ্ছে। সেইপারে একজন সাধুসন্থ গঙ্গার পবিত্র জল মানুষের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। খুবসম্ভব হিমালয়ের উপর হতে নেমে আসা এই বরফগলা পানি পুকরা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তারপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ডেভিডফলস জলপ্রপাতে। সিড়ি বেয়ে বেয়ে অনেক ভিতরে যাই। এই জলপ্রপাতের বৈশিষ্ট্য হল পানি উপর হতে নিচে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা আবার কিভাবে সম্ভব? আসলে ঐ পানি পতনস্থলে গর্ত খুড়ে এক সুড়ং পথে আড়ালে চলে যায়।
এবার আমাদেরকে Cave of Pukra বা পুকরা গোহায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ হাজার বছরের পুরানো মহেন্দ্র গোহা বা সুড়ঙ্গ। অজস্র সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমরা ভূগর্বে নামতে শুরু করি।প্রথমে গনেশ ও গাভীর মূর্তি প্রদক্ষিণ করি। তারপর আবার স্যেঁতস্যেঁতে সুড়ং পথে বৈদ্যুতিক আলোয় আর নিচে নামতে থাকি। পথে এক বিশাল কাটের কালো নাগমূর্তির (সর্প) দেখা পাই। একটু পরে আমার ছেলের পায়ের কাছে ছোট্ট একটি সাপ দেখতে পাই। ডাঃ নূরজাহান ভয়ে গর্তে ঢুকা হতে বিরত থাকেন। আমরা গর্ত বেয়ে প্রায় তিন শতাধিক সিড়ি বেয়ে অনেক নিচে নেমে যাই। ভীষণ ভয় লাগছিল। কবরের গর্ত বেয়ে বেয়ে আর কত নিচে যাব। হঠাৎ নিচে প্রাকৃতিক আলোর রেখা ফুটে উঠে। দুই পাহাড়ের ফাটল দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো ঢুকছে। এবার ফেরার পালা। সিড়ি বেয়ে বেয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে উপরে উঠে আসি। এবার ড্রাইভার আমাদেরকে নিয়ে আসে পুকরা লেকের পারে মূল শহরে।
এখানে এসে এক দুঃসাহসী অভিজানের নেশা জিন্নুন ও আমাকে পেয়ে বসে। দেড়মাইল উঁচু পাহাড় হতে প্যারাস্যুট গ্রাইডিং করে ঈগলের মত উড়ে উড়ে পুকরা লেকের তীরে আসা। সুযোগ পেয়ে যাই, প্রতিজন ১০৭০০/= নেপালি রুপি করে খরচ হবে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং ফি ৯০০০/= রুপি এবং ভিডিও করার খরচ ১৭০০ রুপি। টিকেট করে হোটেলে ফিরে সামান্য সময় রেস্ট নেই। তারপর চলে আসি প্যারাস্যুট গ্রাইডিং অফিসে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং করতে আমরা স্বেচ্ছায় গিয়েছি এবং আমরা আহত বা নিহত হলে তারা দায়ী নয়, এমন এক অঙ্গিকারনামায় আমাদের স্বাক্ষর নেয়। আমরা সাতজন কাস্টমারের সাতজন প্যারাস্যুট চালক একটি মাইক্রোবাসে করে আসেন। কোম্পানিয় মালিক একজন রূমানিয়ান শ্বেতাঙ্গ। তিনি চারটি ছোট ছোট লাটি একটির পর একটি শূন্যে উড়ায়ে হাতে এনে খেলা দেখাচ্ছেন। দুইটি লাটি দু’হাতে এবং দুইটি লাটি শূন্যে ঘুরছে। তার মাথায় লম্বা চূলের চুটি বাঁধা। রুমানিয়ানকে নিয়ে আমরা সাতজন গ্রাইডার মাইক্রোবাসে উঠার পর আর সিট খালি নেই। তাই জেফার ও তার মা ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমাদের সাথে সারাংকোট পাহাড়ে যেতে পারেননি। তারা প্যরাস্যুট গ্রাইডিং অফিসে বসে আমরা ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকেন। গাড়িতে উচ্চশব্দে ইংলিশ ব্রেন্ড সঙ্গীত বাজতে থাকে। আমরা দু’জন বাংলাদেশী, বাকী সবাই চীনা ও জাপানিজ। প্যারাস্যুট পাইলটও কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ অনেপালি। শহর হতে বের হয়েই গাড়িটি একটি সুউচ্চ পাহাড়ে উঠতে থাকে। চালক গাড়িটিকে এক ভীতিকর উচ্চতায় নিয়ে যায়। শুনলাম আমরা মাটি হতে সাত হাজার ফুট উচ্চতায় এসেছি। জায়গাটির নাম সারাংকোট। এবার গাড়ি আর উপরে উঠার রাস্থা নেই। আমরা পাহাড় বেয়ে আর পাঁচ/সাত শত ফুট উপরে উঠি। সেখানে চূড়ায় একটি টাওয়ার। চূড়ায় খানিক নিচে পাহাড়ের ঢালু মাঠ। ঐ মাঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণ। নিচের দিকে বৃক্ষ দেখা গেলেও এখানে কোন গাছপালা নেই। এখান থেকে সারাটা পুকারা শহর লেকসহ সূদূরে দেখা যাচ্ছে। এটা পুকারা শহরের সন্নিকটের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া- সুপ্রসিদ্ধ সারাংকোট। গাড়িটি আমাদেরকে নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড় বেয়ে এতই উপরে উঠে যে ভয়ে গা শির শির করছিল। তারপর বেয়ে আর হাজার ফুট উপরে উঠার সময় মনে হল এই জল্লাদের দল যেন আমাদের মৃত্যুদন্ড কার্য্যকরের জন্য উপরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাচ্ছে। প্যারাস্যুট সুন্দরভাবে মাঠে বিছানো হল। একটা ব্যাল্ট দু’পাসহ কোমর প্যাচিয়ে তিন জায়গায় লক করা হল। তারপর লক আবার পরীক্ষা করা হল। আমার মনে কিছুটা ভীতি এসে যায়। আমি প্রথমে আয়াতুল কুরসি পড়ি, তারপর ইসমে আজম। খোদার পাক দরবারে ‘সাহস’ প্রার্থনা করি। প্রভূকে বলি তুমি আমাকে হার্টের এক সামান্য ভাল্বের মাধ্যমে ৪৭/৪৮ বৎসর জীবন্ত রেখেছো, নিশ্চয় এবারও বাঁচিয়ে রাখবে। আমার পিছনে প্যারাস্যুট পাইলট পিঠে একটি ব্যাগ ও হাতে ভিডিও করার ক্যামেরা ধরে আমাকে সামনে দৌড়াতে বলে অথচ সামনে দেড়মাইল গভীর গীরিখাদ। ভয়ে থেমে যাই ও প্যান্টে কাদামাটি লেগে যায়। দাঁড়িয়ে সাহস করে গিরিখাদে ঝাঁপ দিতেই দেখি আমরা দু’জন প্যারাস্যুট নিয়ে বাতাসে ভেসে গেছি। শৈশবে স্বপ্নে বহুদিন বাতাসে পাখির মত নিজেকে উড়তে দেখেছি। বেশ কিছুদিন আগেও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখছি আমি বাতাসে শূন্যে উড়ছি। সেদিনের স্বপ্নটি মহান আল্লাহ পাক নেপালের পুকরার সারাংকোটে বাস্তবে পরিণত করলেন। মনে মনে প্রায়ই গাইতাম 'এমন যদি হত, আমি পাখির মত, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ'।
প্যারাস্যুট চালক একজন স্লিমবডি স্মার্ট ইংরেজি দক্ষ লোক। সুদর্শন এই যুবকের বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবেনা। নাম জিজ্ঞেস করি তাকে। নাম বলল- কাজি। নাম শূনে ভাবলাম সে মুসলিম। Are you a Muslim? বলতেই উত্তর দিল- No, I am Buddhist. আবার প্রশ্ন করি- How long time you drive pursuit? সে জবাব দিল- More than five years. আবার বলি-Do you fall any accident? উত্তর দিল- Only one time, when I was learning and fall down safely in pukara lake. কাজি এবার বলল- Do not fear, We are now fully safe. We are flying now like as Eagles. তাকিয়ে দেখি কাজি প্যারাস্যুটের সুতার গুচ্ছ ধরে টান দিচ্ছে, সেই টানে বাতাসে শন শন আওয়াজ করে প্যারাস্যুট চিলের মত এপার ওপাশ করে বৃত্তাকার পথে চক্কর মেরে উপরের দিকে বেয়ে উঠতেছে। আশপাশে মেঘ উড়াউড়ি করছে, যেন মেঘ ছুঁয়ে ফেলব আমরা। পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ার উপরে উঠে চারপাশে চিলের মত বাতাসের স্থম্ব ধরে অনেক চিল-চক্কর দেই। কাজি জানতে চায় আমি কি করি। বলি বাংলাদেশের একটি ব্যাংকে চাকুরী করি। সাথে ছোটখাট ব্যবসায় জড়িত আছি। সবশেষে বলি, আমি একজন লেখক। আমার এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পত্রিকায় লিখব। কাজি খুবই অনুপ্রাণিত হয়। ও খুব মনযোগ দিয়ে ভিডিও করে। সে আমার পারসেপশন জানতে চায়। আমি বলি- Thanks to God, he gives me an excellent experience to fly like as bird in the sky of Pukara, Nepal. কাজিকে জিঞ্জেস করি- Your believe please? সে বলল- I belive only one God has created the universe. আমি বললাম- My belive is same as you.
হাজার ফুট নিচে পাহাড়ের ধাপে ধাপে নেপালের জনপদ, বৃক্ষ,
শস্যক্ষেত্র দেখা যাচ্ছে। কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে, গরু চরাচ্ছে। নিচে বৈদ্যুতিক
খুঁটি ও তার দেখা যাচ্ছে। দূরের পুকরা লেক ও শহরটাকে আকাশ থেকে অপূর্ব মনোরম লাগছে।
প্যারাস্যুট পুকারা শহরের কিনারায় চলে আসে। নিচে গাড়ি, লোকজন ও তিনচার তলা পাকাবাড়ি
দেখা যাচ্ছে। আমাদের সাথে জাম্পকরা অন্য প্যারাস্যুটগুলোও এই একই উড়াল রাস্থা দিয়ে
একে একে উড়ে আসতে থাকে। হঠাৎ একটি বিশাল পাহাড়ের পাশঘেষে আমাদের প্যারাস্যুট পুকরা
লেকের উপরে চলে আসে। নিচে লেকের জলে বিদেশীরা নৌভ্রমণ করছে। দূরে লেকের ওপারে একটি
সবুজ মাঠ দেখা গেল। মাঠটি পুকরা মধ্যে একটা উপদ্বীপ হয়ে ঢুকে গেছে। কাজি ধীরে
ধীরে আকাশ হতে প্যারাস্যুট নিচে নামিয়ে আনছে। এবার কাজি বলল- Sir,
now we will be land. সে আমাকে পা’দুটি সামনের দিকে সোজা করতে বলল। একটু পর
লক্ষ্য করি চিল যেমন শিকারে ছুঁ মারতে মাটিতে নেমে আসে আমাদের প্যারাস্যুটি আমাদের
দু’জনকে নিয়ে তেমনই ভূমিতে নেমে আসছে। একটি হালকা ধাক্কা খেয়ে মাটিতে যখন পা
রাখলাম তখন ১টা ৩৪ মিনিট। আমরা ১২টা ৩০ মিনিটে সারাংকোট পাহাড় চূড়া হতে প্যরাড্রপ
করে ৬৪ মিনিট পর মাটিতে অবতরণ করি। আট হাজার ফুট উচ্চতা হতে চিলের মত চক্কর মেরে
উড়াউড়ি করে চার মাইল দূরের পুকরা লেকপারের মাঠে নেমে আসি। ধন্যবাদ আল্লাহকে, তিনি
আমাকে উড়ন্ত ঈগল হবার বাসনা পূর্ণ করে দেন।
এবার পুকরা শহর নিয়ে আলোচনা করব। ইহা
আমাদের কক্সবাজারের মত নেপালের প্রধান পর্যটন শহর। পুকরা শহরের আয়তন ১৮০ বর্গমাইল,
যেখানে প্রায় চার লক্ষ লোক বসবাস করে। কাটমন্ডুর চেয়ে আয়তনে বড় হলেও এই শহর
কিন্তু জনসংখ্যায় নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। উঁচু পাহাড় ও লেকঘেরা এক অপূর্ব
সুন্দর ৫৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি মালভূমিতে এশহর গড়ে উঠেছে। এটা আয়তনে আমাদের
সিলেট শহরের সমান বা একটু বড় হতে পারে। শহরটির সমৃদ্ধির কারণ হল হাজার হাজার
বিদেশী পর্যটকের আগমন। এই শহরটি পর্যটনের স্বর্গরাজ্য। পর্যটক আকর্ষণের সব
ব্যবস্থাই এখানে রয়েছে। প্যারাস্যুট গ্রাইডিং, পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, নদীতে বোট
চালানো (রাফটিং), পর্বতারোহন (ট্রেকিং), বরফের পাহাড় দর্শন, ছোট্ট ফ্লাইং মেশিনে উড়া উড়ি, পুকারা লেকে নৌভ্রমণ, নেপালি নাচগান সংস্কৃতি উপভোগের ব্যবস্থা। এখানে
আছে বিশ্ববিখ্যাত জলপ্রপাত, পার্বত্যগোহা, হিমবাহ বেয়ে আসা গঙ্গার পবিত্র জল, আর
কত কি। নেপালের আর একটি মূল্যবান সম্পদ রয়েছে তাহল এখানকার ভদ্র সুসভ্য নেপালি জনগোষ্টি। এখানে মৃদু বৃষ্টি হয়। সব সময় শীতল ও নাতিশীতুষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ
করে। সত্যিই পুকরা একটি আরামদায়ক ভাগ্যবান শহর। এইদিন সন্ধ্যায় আমি ও জিন্নুন
লেকপারে যাত্রীবাসে চড়ি। এই শহরে কোন রিকশা বা ঠেলাগাড়ি নেই। মানুষ কারে কিংবা
প্যাসিঞ্জার বাসে চলাফেরা করে। ফলে পুকারার রাস্থায় কোন যানজট নেই। আমাদের লক্ষ্য
পুকরার প্রধান বানিজ্য এলাকা মহিন্দ্রপুর পরিদর্শন। বাসের হেলপার যুবকটি একটু
বাচাল। প্রথমে ক্রিকেট ও আশরাফুল, তারপর কিছুদিন আগের রাজনৈতিক দাঙ্গাহাঙ্গামা।
ভাবলাম অনেক নেপালি বুঝি বাংলাদেশের খবর রাখেন। সে বলল-পুকরার পর্যটন এলাকায়
পণ্যের গলাকাটা দাম। যদি কিছু কিনতে হয় মহিন্দ্রপুরে কিনুন। অর্ধেক মূল্যে পণ্য পেয়ে যাবেন। মহিন্দ্রপুরে অনেক বড় বড় বিপনিবিতান রয়েছে। দোকানে নেপালি, ভারতীয় এবং
চীনা পণ্যের ছড়াছড়ি। বড় বানিজ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে তরিতরকারী, মসলাসহ সব ধরনের
পণ্যসামগ্রী একত্রে পাওয়া যায়। পণ্যের গায়ে Fixer price স্টিকার লাগানো
থাকে। এরমধ্যে আবার বৃষ্টিপাত শুরু হল। সবগুলো ভবনের ছাদ হতে সামনের রাস্থায় পানি
পড়ছে। আমাদের মত ছাদের পানি পাইপের মাধ্যমে নামিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা নেই। বাস
নাপেয়ে আমরা একটি ছোট্ট কার ভাড়া করে হোটেল সেন্ট্রাল লেকে ফিরে আসি।
৯ মে ২০১৪ সাল। খুব ভোরে উঠে পুকরা লেকপারের পার্কে জগিং করি। কোকিল, ঘুঘু, চড়ুই ডাকছে। হলুদ গলা বকেরা খেক খেক করছে।
পাশের বাশবনে এত বক বসে আছে যে মনে হচ্ছে এগুলো বাশবনের বাঁকে বাঁকে শত সহস্র
সাদা-হলুদ ফুল ফুটে আছে। কাছে যেতেই টের পাই বকের গায়ের ও বিষ্টার গন্ধে জায়গাটি
সয়লাব। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে বরফের পাহাড়ের উপর সূর্যোদয় দর্শন করি।
সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে বরফের পাহাড় পূর্ণিমার চাঁদের রংধারণ করেছে। এই রঙ্গ
দিনে হালকা হয়ে আসে ও অনেকটা আমাদের সাদা মেঘের মত হয়ে যায়। মনে হয় এজন্যই কাটমন্ডু
হতে Mount Everest এর mountain flight কেন খুবভোরে
পরিচালিত হয়। পর্যটকরা যেন সর্বোত্তম সময়ে পূর্ণিমার চন্দ্রসম বরফাবৃত হিমালয়
পর্বতমালার সৌন্দর্য্য দেখে বিমুগ্ধ হন। একটু পর হোটেলের ডাইনিং হলে মালপত্র
সহকারে নেমে আসি। এখনও খাবার তৈরি হয়নি। আমাদেরকে তারা কনফ্লেক্স, কুকারিজ ও দুধ
দেয়। সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে বাস ছাড়বে। দ্রুত বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে উঠি। একজন
ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ২৫০ নেপালি রুপিতে ৫টি নেপালের পাহাড়ি দৃশ্যের চিত্রকর্ম ক্রয়
করি। বাস ছেড়ে দেয়। অপরূপ নগরী পুকরাকে বিদায় জানাতে মনটা ভারী হয়ে আসে। প্রিয় শহর
পুকরা গুড বাই। একই রাস্থা দিয়ে আবার কাটমন্ডু ফিরছি। পথে সেই মহাসড়ক হোটেলে গাড়ি থামে। এবার নদীতীরে বসে বুফে খাবার। মোরগ খাওয়া হলনা ধর্মীয় কারণে, আবার মাছেরও
দেখা নেই বহুদিন ধরে। নেপালে এই প্রথম ও শেষবারের মত মাছ খাবার পাই। একটি ছোট
বাটিতে করে আমাদেরকে বাছা মাছের মত ছোট ছোট এক ধরনের মাছ দেওয়া হয়। ঘন মশলাযুক্ত
ঝোল। খেতে মন্দ লাগেনি। এইরাস্থা দিয়ে যাবার সময় দু’পাশের বিবরণ দিয়েছি, তাই এবার
বিরতি দিলাম। দুপুর ২টায় আমরা কাটমন্ডু পৌঁছি। আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট নির্ধারিত
সুন্দর একটি এসি মাইক্রোবাস এসে হাজির হয় এবং আমাদের চারজনকে নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য
নগরকোট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ‘নগর’ শব্দের অর্থ শহর এবং ‘কোট’ শব্দের অর্থ
‘উঁচু বা চূড়া’ তাই নগরকোট হচ্ছে উঁচু চূড়ার শহর। বাস একটু অগ্রসর হয়ে জাপানের
আর্থিক সাহায্যে নির্মিত একটি চারলেনের রাস্থা দিয়ে অগ্রসর হয়। তারপর আমরা নেপালের
হাজার বছরেরও আগে নির্মিত প্রাচীন রাজধানী ভক্তপুর অতিক্রম করি। এবার বাস রাস্থা
বেয়ে উপরে উঠা শুরু করে। ধাপে ধাপে বাস উপরে উঠতে থাকে। মনে হল আমরা বুঝি পৃথিবীর
ছাদে আরোহন করতে যাচ্ছি। দু’দিকে পাহাড়ি জমিতে রূপালি গমক্ষেত। কৃষক ও কৃষাণীরা
দল বেঁধে গম কাটছেন, খড় সংরক্ষণ করছেন। বাতাসে কুলা দিয়ে কৃষাণীরা গমের খড় অপসারণ করছেন যেন রূপালি গমের রাজ্য। এত উপরে গাড়ি উঠছে যে বায়ুচাপের অভাবে কানের পর্দা
পট পট করছে। মাইল, দুই মাইল, তিন মাইল নিম্নদিকে দেখা যাচ্ছে গ্রাম, বাড়িঘর, ফসলক্ষেত, পাইন গাছের সারি। এবার চালক বললেন হোটেল আরও বহুত উপর মে রয়েগা। নুরজাহান
ভয় পেয়ে বললেন, নামিয়ে দিন আমরা হেঁটে উঠব। আমরা দারূণ সুন্দর পাইন বনে প্রবেশ
করি। পাইনের বনে অতি মনোরম শন শন সুর তুলে বাতাস বইছিল। নিচে পাইনের পাতা জমে
অপূর্ব খয়েরি রঙ্গের গালিচার তৈরী করেছে। কিছু কিছু ভবন, হোটেল, রিসোর্ট, দোকান-পাঠ
পাহাড়ের ধাপে ধাপে দেখা যাচ্ছে। আমরা নগরকোট শহরে প্রবেশ করি। তিন চারটি উঁচু
পাহাড় একস্থানে এসে মিশেছে। তিনদিকে তিন পাহাড় বরাবর তিনটি রাস্থা চলে গেছে। গাড়ি
সংকীর্ণ পাহাড়ি রাস্থা বেয়ে এক অপূর্ব সুন্দর রিসোর্টে প্রবেশ করে। রিসোর্টের নাম
‘চৌতারি’ চৌতারি একটি নেপালি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘বৃক্ষচ্ছায়া’। সামনের পাহাড়ি
ধাপে একটি একতলা টালি ছদের বিশাল ভবন। ভবনটি চৌতারি রিসোর্টের রেসিপশন, ডাইনিং ও
অফিস। রিসোর্টটির হোটেল লবিও এখানে অবস্থিত। গাড়ি হতে নেমে রেসিপসনে উঠামাত্র
হোটেল কতৃপক্ষ নেপালি কায়দায় জুস দিয়ে আমাদেরকে বরণ করেন। কয়েক সিঁড়ি বেয়ে নিচে
নেমে পাহাড়ের ধাপ দিয়ে কয়েকটি লতাফুলের গেট পার হই। আবার সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠে
একটি সবুজ বাগানের সামনে দু’টি কক্ষ। প্রতিটিতে দুইজনের থাকার সব ব্যবস্থা রয়েছে।
এই রিসোর্টটি সৌরবিদ্যুতের আলোয় চালিত হয়। ছাদে প্রচুর সৌর প্যানেল রয়েছে। এখানে
আবহাওয়া সব সময় শীতল থাকায় এসি কিংবা ফ্যানের কোন ব্যবস্থা নেই। সন্ধ্যার পর শীত
হতে আত্মরক্ষার জন্য দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। সৌরবিদ্যুতের মৃদু আলো
পরিবেশকে ছন্দময় করে দেয়। এখানে পানি গরম করার কাজও সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সম্পন্ন
হয়। আমরা রূমে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে বেরিয়ে আসি। চারজন হেঁটে
হেঁটে অর্ধমাইল দূরের এক পর্বতচূড়ায় গমন করি। আমি ও জেফার এখানকার শীত হতে বাঁচার
জন্য দু’টি সার্ট একসাথে পরে নেই। কারণ জুনের গরমে আমরা শীতের কাপড় সাথে নিয়ে
নেপাল যাইনি। আমাদের শেষ ডিসেম্বরের মত ঠান্ডা বাতাস বইছিল। সামনে বিশাল গীরিখাদ।
গীরিখাদের অন্যপ্রান্তে হয়ত সাত আট মাইল দূরে একটি চারপাঁচ তলা ভবন দেখা যাচ্ছে।
ভবনটি এত দূরে যে মনে হল ছোট্ট খেলনা বাড়ি। হাত প্রসারিত করে ফটো উঠাই ফটোতে
ভবনটিকে দেখে মনে হল ইহা আমার হাতের উপরে বসানো ছোট্ট ভবনের মিনিয়েচার। আমাদের মত
সমতল দেশে এধরনের দৃশ্য বিরল। দূর দিগন্তে লাল গোলাকার সূর্য অদ্ভুদ রূপ ধারন করে
নিচে নেমে যাচ্ছে। নানা দেশের নানা ধর্ম ও বর্ণের লোকেরা ফুরফুরে মেজাজে আনন্দ
করছে। সূর্যকে হাতে নিয়ে, বুকে জড়ায়ে, মাথার উপর দু’হাতে ধরে নানা ভঙ্গিমায় ছবি
তুলছে। নিস্পাপ শিশুরা মহানন্দে লাফালাফি করছে। জন কয়েক চীনা ও জাপানি পর্যটক
ধ্যানে বসে সূর্যের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করে নিচ্ছে। চোখের সামনে হিমালয়ের বরফ রাজ্যে এক সময় আমাদের প্রিয়
নক্ষত্র সূর্যদেবতা ডুবে গেল। সেইসাথে আমাদের জীবনের এই সেরা সুন্দর সন্ধ্যাটিও
হারিয়ে গেল। ভূতুড়ে রাস্থা দিয়ে হেঁটে হেঁটে রিসোর্টে ফিরছি। চোর ডাকাতের ভয় হল।
জিন্নুন একটি দোকানে এই শহরের নিরাপত্তার বিষয় জানতে চাইলে মেয়েটি বলল- কোন ভয়
নেই, এখানে ডলার, ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে ২৪ ঘন্টা নির্ভিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন। আমরা
এখানে কোনদিন চুরি কিংবা ছিনতাই হতে দেখিনি। আসলে এই সুন্দর নিরাপত্তার জন্য শত শত
বিদেশী এখানে শঙ্কাহীন মনে ঘুরে বেড়ায়। রাতে এক নেপালি মেয়ের হোটেলে ঢুকে আমরা তিনজন
চৌমিন খেয়ে নেই এবং গিন্নীর জন্য খাবার নিয়ে আসি। পিছন দিকে একটি ইকোপার্ক দেখা
পাই। দু’চার পা অগ্রসর হয়ে ভয়ে এই নির্জন স্থান হতে ফিরে আসি। আবার ফিরে আসি
চৌতারি রিসোর্টে।
পরদিন সূর্যোদয় দেখার স্পট নির্ধারণে আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করি। চৌতারি কতৃপক্ষ জানালেন তাদের ডাইনিং হলের লবি হতে নাস্তা করে করে সূর্যোদয় দেখা যাবে। আমাদের রূমের উপরে পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে হোটেলটি নির্মিত। আমরা বেয়ে ছাদে উঠি। এক ভূতুড়ে পরিবেশ। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চা-বাগানের মত যেন এক নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ। রিসোর্টটির চারপাশে চাঁদ তার মিষ্টি আলো বর্ষণ করছে। নানা প্রজাতির বৃক্ষপত্র বাতাসে মৃদু দুলছে। নেপালি তক্ষকের আওয়াজ শুনি। আমার নানাবাড়ি পাতারিয়ার গৃহের কাটের ছাদ হতে নির্জন দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় ভেসে আসত ককার (তক্ষক) আওয়াজ। সিলেটি তক্ষকেরা চৌদ্দ পনের বার ‘কক্ষা, কক্ষা’ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু নগরকোটের তক্ষকের মিষ্টি আওয়াজ এত তাড়াতাড়ি বন্ধ নাহয়ে বহুক্ষণ বাজতে থাকে। তারপর নির্জনতা বেদ করে কানে বাজে লক্ষিপ্যাচার গান।
সারাটা রিসোর্টে সৌরবিদ্যুতের মৃদু আলোর অজস্র বাতি মনোরম
ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমরা বের হয়ে জিন্নুনের কোঠায় ঢুকলাম। জিন্নুন বলল-
মামা এই জায়গাটা জ্বীনে ভরা। বললাম কেনরে? সে বলল- আমার সামনের এই সিঁড়িতে একটি
জ্বীন বসেছিল, আমি তাকে মানুষ মনে করে পাশে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার কেন যেন
মনে হল তার এ কথাটি সত্যও হতে পারে। কারণ এখানে অসংখ্য বিকট মূর্তির মন্দির রয়েছে।
নানা দেও দানবের পূজা হয়। তাছাড়া নিচের পাহাড়ি গোহা, জনহীন গীরিখাদ, বনজঙ্গলে
জ্বীনভূত থাকতেই পারে। হয়ত এখানে বহুযুগ জ্বীনের আস্থানাই ছিল, পরে হয়ত বনবাদাড় সাফ
করে এই পর্যটন শহর গড়ে উঠেছে। আমার পুত্র জেফার তার দাদার কাছে শুনা জ্বীনের গল্প
বললেন নেপালের এই নির্জন ভুতুড়ে শহরে। শীতল সন্ধ্যারাতে সৌরবিদ্যুতের মৃদুমন্দ আলোয়
ভূতের গল্প শুনে ভয়ের সাথে খুব ভালই লাগছিল। আমি বলি আমার মায়ের কাছে শুনা ভুতের
কাহিনি। আমার নানারা ছিলেন চার ভাই। নানা ছোট সন্থান হিসাবে তার পিতার বড়
দিঘিওয়ালা বাড়িটি পান। সামনে ও পিছনের অন্য দুই বাড়ির মালিক হন অন্যরা। নানার এক
ভাইয়ের ছিল একমাত্র কন্যা। কন্যাকে বিয়ে দিয়ে আম্মার চাচি কয়েকজন বুয়া নিয়ে একাকি
বসবাস করতেন। একদিন রাতে বাইরে এক ভূতুড়ে পাখির ডাক শুনে বিরক্ত হয়ে বললেন-শালার
পাখি, দিনে এভাবে যন্ত্রণা দিলে লাটি দিয়ে তাড়া করতাম। বলতেই ঘরের টিনে অজস্র
ইস্টক বর্ষণ শুরু হয়। সবাই ভয়ে এক কোঠায় জড় হয়ে এক বিছানায় আশ্রয় নেন। শেষে ঘরের
ভিতরও মাটির ঢিল আসতে থাকে। এভাবে আমার মায়ের চাচি এক দুর্বিসহ রাত অতিবাহিত করেন।
মনে মনে ভাবলাম নেপালে এসে এভারেস্টের চূড়ায় উঠলাম, প্যারাস্যুটে পাখির মত উড়লাম,
এবার বুঝি জ্বীনও দেখা হয়ে যাবে। বাহিরে গিয়ে অনেকক্ষণ জ্বীন দেখার আশায় ঘুরাঘুরি
করি। দূরের সুউচ্চ রিসোর্ট হতে কিছু বাংলাদেশী শিশুর গলার আওয়াজ শুনলাম। এখানে
হারমোনিয়ামের তালের সাথে নির্জনতা বেদ করে কিছু বাংলা গানের সুর কানে আসে। কিন্তু
কোন জ্বীনের দেখা পেলাম না। আমার কক্ষে গিয়ে আমরা ডাঃ নুরজাহান বেগমকে বলি এখানে
তো প্রচুর জ্বীন এদিক ওদিক একা একা বসে আছে। তোমার কক্ষে এসে কোন যন্ত্রণা করে
নাইতো। বললেন না আমাদেরকে কোন জ্বিন এসে যন্ত্রণা করে নাই। এবার তিনি জ্বীন দেখতে
উৎসুখ হয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে আসেন। জিন্নুন অন্ধকার ডালের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে
বলল- মামী ঐ দেখুন ডালে জ্বীনেরা বসে আছে। বলতেই ভুদৌড়ে কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন।
বালকবেলার রাতে আমরা সবাই বসে ভুতের গল্প শোনে শোনে ভয়ে শিহরিত হতাম। আমরা তখন বিশ্বাস
করতাম ভূতের কাহিনি মিথ্যা কিছু নয়। আজ পৌড় বয়সে নেপালের পাহাড়ি ভূতুড়ে নগরকোট শহরের
চৌতারি রিসোর্টে আবার সেই ভুতের গল্প আমাদেরকে রুমাঞ্চিত করে।
নগরকোটের সূর্যোদয় দেখতে খুব ভোরে ঘুম
হতে উঠি। একজন মাত্র প্রহরী হাঁটছেন। চারপাশে কোকিল, ঘুঘু, প্যাচা, তক্ষকসহ নানা
প্রজাতির পাখির কলরব। আমরা সিঁড়িবেয়ে আমাদের হোটেলের ছাদে যাই। কিন্তু সুবিধে
হচ্ছেনা দেখে নেমে আসি। সামনে আরেক পাহাড়ের এক ভবন বারান্দায় যাই। ঐ স্থান আমাদের
ভবনের ছাদের উপরে অবস্থিত। একটি খাড়া গীরিখাদের কিনার ঘেষা আঙ্গিনা। নানা প্রজাতির
ফুল ফুটে আছে। সামনের ভবনের ছাদে আরোহন করি। অনেক দূরের বরফ পাহাড় আলোকিত হয়ে উঠে।
মাইল দেড়েক নিচে পাহাড়গুলো ধাপে ধাপে উঠে আট দশ মাইল দূরে আকাশ ছুঁয়েছে। কি অপূর্ব
দৃশ্য। সেইসাথে ফাগুনের শীতল হাওয়া। ঘন্টাখানিক ছবি তুলি। সেখানে এক ভারতীয়
যুবকের সাথে দেখা হয়। সে আমাদের ফটো তুলে ও আমরা তার ফটো তুলে দেই। তারপর নেমে এসে
চারপাশে বাগানে। ফ্লাওয়ার বক্সে ফোটে থাকা ফুলের রূপ সৌন্দর্য্য পর্যবেক্ষণ করি। ফ্লাওয়ার
কক্সে ফোটা এক জাতের ফুলের ছয় পাপড়িতে একদম একটি প্রজাপতির ছবি অঙ্কিত রয়েছে।
অন্য আরেক প্রজাতির ফুলের পাপড়িতে প্যাচার মুখ ভেসে রয়েছে। প্রকৃতিতে এই বিস্ময়কর
ফুল দেখে স্রষ্টার সৃষ্টির মহিমা হৃদয়ে জাগরিত হয়। পাশের হোটেলের সাদাফুলের গাছটা শত শত প্রজাপতিতে ছেয়ে আছে। ব্রেকফাস্ট করে বের হই। পাশের ইকোপার্কে প্রবেশ করি। পাইনসহ
নাম নাজানা নানা প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। জায়গাটি এতই নির্জন যে আমরা তিন জন ছাড়া কোন
লোক নেই। নিরাপত্তার জন্য আমরা তিনজনের হাতে তিনটি গাছের ডাল নেই। বনটি
ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। আমরা বুনো রাস্থা বেয়ে অনেক নিচে নেমে যাই
কিন্তু নিচ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তার কোন হাদিছ নেই। আমাদেরকে ভয় পেয়ে বসে। বুনো
পশু কিংবা ডাকাত যদি এসে পড়ে, তবে কে এসে রক্ষা করবে। তবে নেপালে ডাকাত নেই।
নেপালিরা দারূণ ভদ্র ও অতিথি পরায়ন। তবে বাঘ-বালুকের হামলা হলে কেউতো বাঁচাতে
আসবেনা। বনটি হয়তো আর দুই তিন মাইল নিচে চলে গেছে। নিচে নামা খুব সহজ কিন্তু উপরে
উঠে আসা এত সহজ নয়, তাই আবার আমরা উপরের দিকে ফিরে আসা শুরু করি। বিকেল ৩টায়
কাটমন্ডু ত্রিভূবন বিমানবন্দরে আমাদের ফিরতে হবে। শেষবারের মত এই সুন্দর জায়গাটি
দেখতে বের হই। ডাঃ নুরজাহান তার মক্কা হতে নিয়ে আসা হেজাব পরে বের হন। তিনজন ইংরেজ
নারী সিগারেটে সুখটান দিয়ে রাস্থায় হাঁটছেন। একটু পার হয়েই একজন বলছে এ মুজলেম
ওউমেন। জিন্নুন বলল- মামী এখানে আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন। নেপালে মুসলিম
নরনারীর দেখা মেলা ভার। তারা হয়ত এই প্রথম কোন মুসলিম নারীকে নেপালে দেখেছে ও সাথে
সাথে চিনে ফেলতে পেরেছে- এ মুজলেম ওউমেন।
আমরা নেপালের প্রাচীন রাজধানী ভক্তপুর দেখার জন্য সকাল ১১টায় বের হই। পথেই ভক্তপুর। ট্যুরের ড্রাইভার রাজি হন। ঘন্টা দেড়েক পর এই প্রাচীন রাজধানী শহরে এসে আমাদের গাড়ি থামে।(চলবে)
কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন