রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

সপরিবারে নেপাল সফর- কাটমন্ডু, পুখারা, নগরকোট, এভারেস্টশৃঙ্গ দর্শন ও আকাশে প্যরাস্যুট গ্রাইডিং পর্ব- চার


সপরিবারে নেপাল সফর- কাটমন্ডু, পুখারা, নগরকোট, এভারেস্টশৃঙ্গ দর্শন ও আকাশে প্যরাস্যুট গ্রাইডিং     পর্ব- চার

নেপালের সুপ্রাচীন রাজধানী ভক্তপুর অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত শহর। শহরটি বারশত বছর আগের স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ। শত শত বছর কাটমন্ডুর সন্নিকটবর্তী এই শহরটি ছিল নেপালের রাজনীতির কেন্দ্র। নেপালিরা সাহসী পাহাড়ি জাতি। অকুতভয় গোর্খারা কুকড়ি চালিয়ে শত্রুদেরে সব সময় রুখে দিত। দুর্গম পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে দিল্লির হতে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে নেপাল আক্রমণ করা এত সহজ ছিলনা। কেউ কেউ নেপাল রাজকে শায়েস্তা করার জন্য অভিযান পরিচালনা করলেও তেমন সফল হননি। নেপালের রাজমালা হতে জানা যায় কেবলমাত্র বাংলার শ্রেষ্ট স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চৌদ্দ শতকে একবার কাটমন্ডু আক্রমণ করে শহরটি পুড়িয়ে দেন। কিন্তু তিনি দেশটি দখলে রাখতে পারেননি।

আমরা টিকেট কেটে ভক্তপুর রাজবাড়িতে প্রবেশ করি। ভিতরে একটু উঁচু স্থান বেয়ে উপরে উঠি। প্রথমে পাই দরবার স্কয়ার। ইস্টকে নির্মিত উঁচু গৃহ। ছাদ টিন নির্মিত। জানালা ৫৫টি। পশু, পাখি ও জীব জন্তু আকৃতির নানা কারুকাজ। সর্বত্র বিশাল বিশাল বাঘ ও সিংহ মূর্তি। তারপর তামাদি স্কয়ার। এখানে অসংখ্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটি দ্বি-ছাদ চতুস্কোন ঘর। সবশেষে পটারি স্কয়ার। এখানে প্রাচীন নেপালিদের অবিস্মরণীয় কাটের কারুকাজ। প্রাচীন স্থাপত্যের আশপাশে দোকানীরা নানা ধরনের সামান বিক্রি করছেন। সময় অল্প তাই বেশী ঘুরাফেরা নাকরে গাড়িতে ফিরে আসি।

১০মে ২০১৪ সাল। বিকেল ২টায় আমরা ত্রিভূবন বিমান বন্দরে চলে আসি। মালয়েশিয়াগামী প্রচুর নেপালি যাত্রী নিয়ে বিমানটি বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে উড্ডয়ন করে এবং ৫টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আমার সমন্দিক আজিজ আহমদ চৌধুরী এবং ভাবী আনিকা চৌধুরী তাদের গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হন। তাদের সাথে নেপালের নানা বিষয়ে গল্পগোজব করে করে ধানমন্ডি লেকপারের বাসায় চলে যাই।

এখন আমি নেপাল এবং নেপালের জনগণ নিয়ে আলোচনা করব। দেশটি আয়তনে বাংলাদেশের সমান হলেও জনসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৭০ লক্ষ। জনতার ৭৯% হিন্দু, ২০% বৌদ্ধ এবং ১% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বহুযুগ ধরে দেশটিতে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র বিদ্যমান ছিল। ধনী ও গরীবের বৈষম্য ছিল প্রবল। পাহাড়ি দুর্গম দেশ হিসাবে এখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অল্পই সংঘটিত হয়। রাজা ও সামন্ত প্রভূরা হিন্দু ধর্মকে নিজেদের শাসন ও শোষণ বহাল রাখার কাজে ব্যবহার করে। বুকের প্রচুর রক্ত ঢেলে মাওবাদীরা রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার পুরাপুরি অপসারণ করতে সমর্থ হয়। যে নেপাল যুগের পর যুগ রাজতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র ছিল তা এখন একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আট দশ বছর আগে জিন্নুন যখন নেপাল সফর করে তখন সেনাবাহিনীর গাড়ি আগপিছ কর্ডন করে বিদেশিদের ট্যুরিস্টবাস পুকরা নিয়ে যায়।

এখন নেপালে পুরাপুরি শান্তি বিরাজ করছে। নেপালের হিন্দু ধর্ম ভারতের চেয়ে যথেষ্ট ভিন্ন। বুদ্ধের মত একজন মহাপুরুষ যে একজন নেপালি, তা নিয়ে নেপালের প্রতিটি মানুষ গর্বানুভব করে এবং প্রতিটি নেপালি গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আসলে নেপালের ধর্ম হল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের এক সম্মিলিত মিথষ্ক্রিয়া। নেপালে এই দুইধর্মের এক অপূর্ব সম্মিলিত সহাবস্থান রয়েছে। দুই ধর্মের বিশ্বাসে জন্মান্তরবাদ আছে। বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ লাভ ও হিন্দু ধর্মের বৈকুন্ঠলাভ মূলতঃ একই জিনিস।  বৌদ্ধরা প্রার্থনা করেন বৌদ্ধমূর্তি সামনে রেখে, আর হিন্দুরা তা করেন নানা দেবদেবীর মূর্তি সামনে রেখে। আমার মনে হয়েছে এযুগের নেপালিরা ধর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। খুবভোরে পুকরা মন্দিরে মাত্র একজন নারী পূজারীর দেখা পাই। যিনি মন্দির ঝাড়ু দিয়ে দেবতার সামনে কিছু ফুল রেখে দেন ও হাতজোড় করে মাথা একটু নিচু করেন। মনে হল মাওবাদীদের বিজয় নেপালকে ক্রমান্বয়ে ধর্ম হতে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। নেপালিদের জীবনে ধর্মের প্রভাব ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। 

নেপালে নারীর অবস্থান বেশ সম্মানজনক। মাছ ধরা, কৃষিকাজ, হোটেল ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, পর্যটন সংস্থা সর্বত্র নারীরা সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। পুকরা লেকে জাল ফেলে মাছ ধরা, সাংসারিক কাজের সহিত গৃহপালিত পশুপাখি লালনপালনের কাজ মেয়েরা অবলীলায় করে যাচ্ছেন। নেপালি মেয়েরা পশ্চিমা নারীদের মত নগ্ন নন, আবার আরবদের মত আবৃত নন। অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী শ্রম দেয়ে যান। 

নেপালিরা আমাদের চেয়ে গড়ে অনেক সুদর্শন ও ফর্সা। তারা হালকা পাতলা গঠনের অধিকারী। চীন সীমান্তের লোকজনকে চাইনিজ মনে হয়। প্রায় নেপালি নামের শেষে বাহাদুর, থাপা, নরগে এধরনের শব্দ রয়েছে। এই বাহাদুরেরা মাঝে মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। সেপ্টেম্বর অক্টোবরে প্রচন্ড বর্ষায় হঠাৎ পাহাড় ধ্বসে পড়ে। অসংখ্য জনপদ মাটির গভীরে তলিয়ে যায়। শত শত মানুষ মারা যায়। তাদের বাড়ি মাটি ও ইস্টক নির্মিত কিন্তু দ্বিতল। মই বেয়ে ছাদে উঠে তারা ঘুমায়। খুবসম্ভব হিংস্র প্রাণী ও সাপবিচ্ছু হতে রক্ষা পেতে তারা এভাবে বাড়ি-ঘর বানায়। দেশটি উন্নয়নে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দেশটির প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। নেপাল হল পর্বত টেকিং (পর্বতারোহন), প্যারাস্যুট গ্রাইডিং, রাফটিং (খড়স্রোতা নদীতে নৌকা চালানো) ইত্যাদির জন্য এক স্বর্গরাজ্য।

নেপাল কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এখানে শস্য ফলানো খুবই কঠিন কাজ। নেপালের পূর্বদিকে চা-চাষ হয়। অন্যান্য অংশে ভুট্টা, গম, কলা ও ইক্ষু জন্মে। শস্যচাষে নেপালিরা আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী পরিশ্রম করে। নেপালের অনুন্নয়নের আরেক কারণ তাদের সমুদ্র নেই। তারা আমদানি ও রপ্তানির জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসার পর ভারত হতে অস্ত্র না কিনে চিন থেকে অস্ত্র আমদানি করায় ভারত নাখোশ হয় এবং নেপালে জ্বালানী তৈল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। নেপাল একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থায় আপতিত হয়।

নেপাল ও ভারত এই দুই দেশের যাতায়াতে কোনপক্ষের ভিসার প্রয়োজন হয়না। ভারতীয় রুপিতে নেপালে লেনদেন করা যায়। এমন কি নেপালের লোকেরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টে চাকুরীও করতে পারেন।

নেপালের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমার মনে হয়েছে ভারতের আগ্রাসনের শিকার। নেপালিরা  নেপালি এবং হিন্দি এই দুই ভাষায় অভ্যস্থ। নব্বুই ভাগ নেপালি ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেখেন। আমি দুইটি নেপালি ইংরেজি পত্রিকা পড়ি- ‘The Himalayan’ ‘The Katmondu post’ দুটি পত্রিকাই নেপাল ও ভারতের সংবাদে ঠাসা রয়েছে। তাদের মূল আকর্ষণের দেশ তিনটি- ভারত, চীন এবং পাকিস্তান। খেলার খবরে শ্রীলঙ্কার রমরমা অবস্থান। বাংলাদেশকে তাদের পত্রিকার পাতায় খুঁজে না পেয়ে বেশ মনঃক্ষুন্ন হই। কারণ আমরা তো সার্কের সদস্য ও তাদের নিকট প্রতিবেশী। নেপালের অনুন্নয়নের অন্যতম কারণ হল দুর্গম পর্বতমালা, এখানে রাস্থা নির্মাণে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী টাকার প্রয়োজন। আমাদের মত সরলরেখায় রাস্থা নির্মাণ সম্ভব নয়। বিশ মাইল দূরের কোন জায়গায় হয়ত চল্লিশ মাইল ঘুরে যেতে হয়। ফলে পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াত আমাদের দেশের চেয়ে অনেক ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। তবে নেপালের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কুশি, নারায়নি, কর্ণালি হতে স্থানে স্থানে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

নেপালের জনশক্তির ৭৬% কৃষি, ১৮% সার্ভিস এবং মাত্র ৬% ম্যনুফ্যাকচারিং কাজে নিয়োজিত আছেন। দেশটি এখনও কৃষি নির্ভর। প্রতি বৎসর দেশটিতে গড়ে ছয় সাত লক্ষ বিদেশী পর্যটক আসেন। ২০১২ সালে নেপালে পর্যটক আসেন ৫,৯৮,২০৪ জন, যেখানে আমাদের দেশে ৫০০০০ জন পর্যটকেরও আগমন ঘটেনি। 

নেপালের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল দেশটির বর্তমান দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। দেশটির আমলাতন্ত্র অন্য দশটি স্বল্পন্নোত দেশের মত তেমন দক্ষ না হলেও সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবের সম্পদের তালকা তৈরি করতে যেয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের কর্মচারীরা তার ব্যাংক হিসাবে কোন টাকা পাননি। কাটমন্ডু শহরে তার কোন বাড়ি নেই। তিনি ভাড়া বাসা ছেড়ে এসে প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকেন। প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালারও কোন দুর্নীতির ইতিহাস নেই। তাই একসময় নেপাল যে অনেক উপরে উঠে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

নেপাল আমাদের চেয়ে দরিদ্র দেশ অথচ আমাদের মত এত ভিক্ষুক নেই। নেই আমাদের মত রিকশা ও ঠেলাগাড়ি জাতীয় অযান্ত্রিক যানবাহনের আধিপত্য। খুবসম্ভব উঁচুনিচু ভূমিরূপের করণে এধরনের পরিবহনের প্রচলন নেপালে হয়নি। ফলে নেপালের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অধিক যানজটমুক্ত ও আধুনিক।

আমি ‘The Katmondu post’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যুহারের একটি পরিসংখ্যান পাই। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ১০/১৫ জন লোক নেপালে মারা যান। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ জন। অথচ ঢাকায় এসে খবরে দেখি এক লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৫৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যা নেপালের ২০১৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সংখ্যার ৪ গুণেরও বেশী। এত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও নেপালের সড়ক আমাদের চেয়ে অনেক বেশী নিরাপদ।

নেপাল ভ্রমণকারী একজন বাংলাদেশী হিসাবে আমি এই প্রতিবেশী দেশ এবং দেশটির খুব অল্পে সন্তুষ্ট জনগণের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে এই লেখার ইতি টানলাম।

কবি লেখক ব্লগার পর্যটক ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
                

                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন