পথে একটি মার্কেটে গাড়ি থামানো হয় ও বিশাল বিপনীবিতান পরিদর্শন করানো হয়- যেখানে কাপড়, গহনা, হেন্ডিক্রাফটসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী রয়েছে। পথে গাড়ি হতে ৩৩০ একর জমি জুড়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি ভবন দেখে নেই। এখানে কৃত্রিম পাহাড়, বাগিচা, ঝরণা ও জলাশয়ের ১৩০ হেক্টরব্যাপ্ত মোগল উদ্যানটিও রমনীয়।
রাতে পরদিন আগ্রা ভ্রমণের জন্য বুকিং দেই। খুব ভোরে গাইড এসে আমাদেরকে নিয়ে যায়। আমরা পনের বিশজন একটি শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে উঠি। দিল্লি শহর হতে বেরিয়ে আসতে একটু জামের কারণে ঘন্টাখানেক পার হয়ে যায়। দিল্লি হতে আগ্রার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। মধ্যভাগে একটি হোটেলে উত্তরপ্রদেশীয় বিচিত্র স্বাধের রান্না করা তুন্দুর রুটি ও বুটভাজা খাই। তরল পানিয় পরিবেশন করা হয়। একটা নাগাদ আগ্রা শহরে প্রবেশ করি। দিল্লি শহরের মত বিরাট না হলেও আগ্রা ভারতের রাজধানীর মর্যাদায় বিভিন্ন সময় অধিষ্ঠিত ছিল। এখানে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম তাজের অবস্থান। মোগল স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের লীলাক্ষেত্র ছিল এই আগ্রা। বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিব (১৭৯৭ইং-১৮৭০ইং) ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আগ্রা ঘরানার জনক ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের জন্মও এই আগ্রায়।
মোগল শাসনামলে ২/৩ বার রাজধানী বদল হলেও শেষপর্যন্ত আগ্রাই মোগল সম্রাটদের মূল আবাসস্থলের মর্যাদা লাভ করে। আমাদের গাড়ি আগ্রা দূর্গের সামনে এসে থামে। আগ্রা শহরের কেন্দ্রস্থলে ১৫৬৫-৭৩ সালে লাল বেলেপাথরে আকবরের হাতে দুর্গটি তৈরি হয়। দূর্গটির মেঝে ও ছাদ লালপাথরের তৈরি। ৪০ পিলারে ভর করা মর্মরে অলংকৃত প্যাভিলিয়ানে সুসজ্জিত সিংহাসনে বসে সম্রাট প্রজাদের কথা শুনতেন। ১৬০৯ সনে এই দরবারে এসে ইংলিশ প্রতিনিধি উইলিয়াম হকিন্স সম্রাট জাহাঙ্গিরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন।
তৎকালীন যুগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ভারত সম্রাটগণ দেখা করতেন দেওয়ান এ খাসে। বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনটিও দেওয়ান এ খাসে স্থাপিত ছিল। যাহা পরবর্তীকালে ইরানের শাসক নাদির শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। দেওয়ান ই খাসের ঝরোখা ও লতার কাজও সুন্দর। দক্ষিণ সিড়ি নেমেছে তেহখানায়, যেখানে গ্রীষ্মকালে মাটির নিচে ঠান্ডা ঘরে থাকতেন সম্রাট। বিপরীতে বাগিচা ও পূর্বে শিশমহল অর্থাৎ বেগমদের গোসল ঘর। তুর্কিশ শৈলীতে তৈরি মহলের দেওয়াল ও ছাদ এমনভাবে কাঁচে মোড়া যে একটি বাতি সহস্র বাতি হয়ে দেখা দেয়।
দেওয়ান ই খাস সংলগ্ন বেগম মমতাজের জন্য শাহজাহানের তৈরি মনিমানিক্য খচিত দ্বিতল অষ্টকোণী টাওয়ার। ভাতৃঘাতক পুত্র ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দী পিতা শাহজাহান জীবনের শেষ আট বছর (মৃত্যু ১৬৬৬ সন) যমুনায় তাজের প্রতিবিম্ব দেখে কাটিয়ে দেন এই টাওয়ারে। দক্ষিণে রয়েছে খাসমহল- সম্রাটের বিশ্রাম তথা শয়ন কক্ষ। অদূরেই মোগল দরবারের মহিলাদের জন্য তৈরি শ্বেতমর্মরের নাগিনা মসজিদ। শিরে তিনটি গোলাকার গম্বুজ। মীনাবাজার বসত সেকালে দুর্গের মেয়েদের জন্য নিচের প্রাচীরঘেরা চত্বরে। এখানে ক্রেতা বিক্রেতা সবাই ছিলেন মহিলা।
অগ্রাদূর্গ দেখা শেষ হলে আমাদের গাড়িটি একটি হোটেলে গিয়ে থামে। বিরাট দুতলা হোটেলটিতে রয়েছে নানান নামের উত্তর প্রদেশীয় খাবার। মেনু হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। খাদ্য তালিকায় নিরামিষ/ পনির/ সবজি ইত্যাদির প্রাধান্য। শেষপর্যন্ত খাবার দেখিয়ে অর্ডার দেই। এখানে বাথরুম ব্যবস্থাও ভাল। খাবারদাবার শেষ হলে আমাদের ভারত ভ্রমণের সেরা আকর্ষণ তাজমহলের দিকে গাড়িটি ধাবিত হয় ও কিছুক্ষণের মধ্যে তাজমহলের বহিগেটে থামে। বহিগেট হতে তাজমহলের দূরত্ব অনেক। এখান হতে প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ি অথবা ছোট্ট পর্যটক গাড়িতে চড়ে তাজের মূলগেটে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে টিকেট করে লাইন ধরে অসংখ্য দেশীবিদেশী পর্যটকের সহিত মূল তাজমহল চত্বরে প্রবেশ করি।
মোগল সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। সম্রাট তাঁর প্রধান বেগম মমতাজের সমাধির উপর তৈরি করান প্রেমের এই সৌধ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইন্ডোপারসিক স্থাপত্যে গড়া শ্বেতমর্মরের তাজ দেখতে বছর জুড়ে পর্যটকের ভীড় লেগে থাকে। পূর্ণিমার রাতে তাজ আলো বিকিরণ করে চাঁদের মত সজীব হয়ে উঠে। নক্ষত্রখচিত কালো রাতে বা উষাকালে তাজের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে মানুষকে। ক্ষনে ক্ষনে রঙ্গের বদল ঘটে উষাকালে। দুগ্ধধবল রূপালী রঙ্গ নেয় উষায়, তারপর রূপালি থেকে গোলাপি লালে। চাঁদের আলোয় দূর হতে মনে হয় জাহাজ হয়ে তাজমহল ভাসছে যমুনার জলে, আর বিদায়ী চাঁদের পান্ডুর আলোয় তাজকে মনে হয় এক চলমান প্রাসাদ। সোনারঙ্গ ধরে তাজ সূর্যাস্তে। তেমনি বৃষ্টিতে তাজের যেন রূপ বেড়ে যায়। স্বর্গসম তাজের এই সুষমা মোহিত করে দর্শককে।
৫৮০X৩০০ বর্গমিটার পরিব্যাপ্ত তাজের নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লাগে ২২ (১৬৩২-৫৪) বছর।
২০ হাজার কর্মী একটানা কাজ করে যান এবং খরচ পড়ে তখনকার দিনে ৪০ লক্ষ পাউন্ড। টিটানস নামক এক স্থপতির নকশায় পারস্য হতে আসা ওস্তাদ ইসা তৈরি করেন এই তাজ। বাগদাদ, পারস্য, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া হতে বিশেষজ্ঞরা আসেন তাজ তৈরিতে। জনশ্র“তি রয়েছে পরবর্তীকালে দ্বিতীয়টি গড়ার ভয়ে মূল নির্মাতাদের হাত কেটে চোখ অন্ধ করে দেন সম্রাট শাহজাহান।
১৬৪৮ সালে ২১১২x৬ ফুটের লাল বেলেপাথরে তাজের প্রবেশ তোরণ নির্মাণ করা হয়। অষ্ঠকোণী প্রবেশ দ্বারের শিরে ২২টি মিনার হয়েছে তাজ তৈরির ২২ বছরের স্মারকরূপে। পশ্চিমদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বায়ে তাজমিউজিয়াম। ইসলামি প্রথায় গার্ডেন অব প্যারাডাইজ হয়েছে। বয়ে যেত সেকালে বেহেস্তের নদীপ্রবাহ জল, দুধ, মদ ও মধুর মিশ্রণে। চলতে চলতে ফোয়ারার জলধারে তাজকে দেখে নেওয়া যায় প্রতিবিম্বে। যমুনাপারে প্রথমে মার্বেল পাথরে মোড়া এক বিশাল চত্বরে অবর্তন করি। যাহা তাজের ২২ ফুট উঁচু প্যান্ডেলটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে লাল বেলেপাথরের বিরাট দুইটি এবাদতখানা। এখানে আমরা যোহর, আসর ও মাগরিবের কছর নামাজ আদায় করি।
তারপর সামনের দিকে এসে ২২ ফুট সিঁড়ি বেয়ে তাজের বহির চত্বরে আরোহন করি। প্যান্ডেলটির চারকোণে চারটি বিশাল মিনার। এখানে যমুনার অপরূপ দৃশ্য ও ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করি। দেশীবিদেশী অসংখ্য কপোতকপোতী এখানে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এখন মূল তাজগৃহে সামনের দিকে ঢুকে পড়ি ও ফটো উঠাই। ঠিক মধ্যভাগে বামে শাহজাহান ও ডানে মমতাজের কবরের রিপ্লেকা দৃষ্টিগোচর হয়।
আসলে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর প্রকৃত কবর এই রিপ্লেকার ২২ ফুট নিচে রয়েছে। আমরা কবর দুটি জিয়ারত করি। ভারতের বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষকে কবরের কাছে এসে নমস্কার জানাতে দেখি। তাজের ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। ১৫/২০ মিনিট পর যেখান দিয়ে তাজে ঢুকি আবার সেখানে এসে উপনীত হই। আমার তাজমহল দেখার স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ায়, মহান আল্লাহর দরবারে শোকরানা আদায় করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন