দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- এগার
চিড়িয়াখানা দেখে আমরা বিচদ্বীপে যাই।
সেতু পার হয়ে এই মনমুগ্ধকর দ্বীপ। এখানে বাগান আর বাগান, ফুল আর ফুল, সুন্দর সুন্দর
বিদেশী ছায়াবৃক্ষ। হাঁটুজলের জলাশয় জুড়ে ফোয়ারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জনক-জননীকে নিয়ে
কিশোর-কিশোরী ও শিশুরা জলকেলী করছে। গোলাপবর্নের অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েরা জলে ভিজে
স্বর্গের হুর-পরী হয়ে আছে। সোনালী চুল, রক্তিম গাল, নীল নয়ন দেখে হয়
এরা যেন প্রাচীন মিশরের বিশ্বসুন্দরী গ্রিক রানী ক্লিওপেট্রা কম্বলের ভাঁজ হতে
উলঙ্গ বের হয়ে রোমান সেনাপতি এন্টোনির সামনে নিরাভরন দাঁড়িয়ে আছেন। জলে সিক্ত নীল
চোখের শিশুরা যেন এক একটা মোমের পুতুল।
হাসি-খুশি ও আনন্দের দেশ ক্যানাডা।
সামারে কানাডাবাসী আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়। সামনে একটি সেতু পার হয়ে লেকের
ভিতর নির্মিত হাওয়াখানায় যাই। উদ্যম বাতাসে দাঁড়িয়ে নিচের বিচের দিকে চোখ ফেরাই।
লেক সৈকত জুড়ে বাচ্চাদেরে নিয়ে স্নান করছে অনেক অনেক সুদর্শন ও সুদর্শনা নরনারী।
প্রায় বিবস্ত্র হয়ে সাঁতার কাটছে, ঢেউয়ে তালে তালে জলক্রীড়া করছে তারা।
যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল স্বর্গের হুর গেলমান। মানব-মানবীর এত রূপ দেখে চোখ ঝলসে
যায়। বিখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং হাওয়াই সি-বিচে অনিন্দ্যসুন্দরী নরনারী দেখে
শোকরানা স্বরূপ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। কিন্তু আমাদের ধর্ম ওদিকে তাকাতে নিষেধ
করে। তাই চোরা-চোখে একটু একটু দেখে নিলাম এবং আল্লাহকে বললাম প্রভূ আমাকে ক্ষমা
কর।
লেকজুড়ে কেউ স্পিড-বোট, কেউ বৈঠা-বোট, প্লাস্টিক-ভেলা, কেউবা বায়ুভর্তি
রাবার-বোটে শুয়ে বসে জলে ভেসে আছেন। এখানে ক্ষনস্থায়ী জীবনটাকে ভোগ করে নেওয়ার
প্রতিযোগিতা চলছে। পানীয় ও ফাস্টফুডের বন্যা বইছে। মানুষগুলো কি হৃষ্টপুষ্ট। তাদের
যে কোন দুঃখ আছে তা বুঝার কোন উপায় নেই।
দুঃখিনী বাংলাদেশের কথা তখন মনে পড়ল। এই
বাংলা মুল্লুকে সামান্য ডাল-ভাতের জন্য মানুষ কি যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ যন্ত্র হয়ে রিকশা টানছে, ঠেলাগাড়ি ঠেলছে, রোদে পুড়ে
বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের মাটে গলদগর্ম হচ্ছে। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও তেমন কোন ফলাফল
পাচ্ছেনা তারা। তাদের জীবনটা ভোগ-বিলাসহীন এক অনিশ্চিত দারিদ্রের ঘুর্নাবর্তে পাক
খাচ্ছে।
আমাদের ঘরে অনিশ্চয়তা, বাহিরে অনিশ্চয়তা, কর্মে অনিশ্চয়তা, ব্যবসায় অনিশ্চয়তা, রাস্থায় অনিশ্চয়তা। আমরা জীবনটাকে পার করি অনিশ্চয়তার এক কূলহীন সমুদ্রে সাঁতার কেটে। ১৬ কোটি মানুষের জন্য জায়গা বরাদ্ধ মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। অথচ সাড়ে তিন লক্ষ কানাডাবাসী সাড়ে আটত্রিশ লক্ষ বর্গমাইল জায়গার মালিক। বনজঙ্গল, লেক জলাভূমি, আলুক্ষেত, গমক্ষেত, চেরি, পিচ, আঙ্গুর, আপেল বাগান, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনি, বায়ুশক্তি কি নেই ক্যানাডায়। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে টুডো ইমিগ্রেসন আইন অনেকটা শিথিল করেছেন। আগামী বছরগুলোতে তারা কয়েক লক্ষ মানুষকে ইমিগ্রেশন ভিসা দেবে। আপনারা আবেদন করুন, চেষ্টা করুন। আপনিও হতে পারেন এই ভাগ্যবান দেশের ভাগ্যবান নাগরিক।
সেন্টারপার্ক দ্বীপে ঘন ঝাউগাছ দিয়ে তৈরী লোকচুরি খেলার বন মেইজি(Mage)। বনটি একটি গোলকধাঁধা। বনের মধ্যভাগের মাটে পৌছা বেশ কঠিন কাজ। বয়স্ক লোক ও শিশুরা দিকভ্রান্ত হয়ে ভুলপথে চলে যায়। ঘন বনপথে মাথা খাটিয়ে বহুকষ্টে সফল হতে হয়। ইতিহাসে লোকচুরি খেলার অনেক রাজমহলের কাহিনী পড়েছি। আদিকালের রাজারা এধরনের ভবনে তাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাদের সাথে লুকোচুরি খেলতেন। আর এই মেইজী ঘন ঝাউবনের প্রাকৃতিক লোকাচুরি খেলার মাট। এই ঝাউবনে কেউ লুকিয়ে গেলে তার কন্ঠ শুনে কাছে পৌছা কিংবা খুঁজে বের করা বেশ আনন্দদায়ক। কানাডার এই মেইজি বনে ছুটাছুটি করে রবি ঠাকুরের দু’টি লাইন মনে হল- “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি। পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন বনেতে ছুটে বেড়াই, সকল বালক জুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি”।
এধরনের লোকচুরি বন বাংলাদেশেও তৈরী করা খুব সম্ভব। কেবল দরকার কোন একজন উৎসাহী মানুষের উদ্যোগ গ্রহন। হ্যাঁ এধরনের একটি ছোট লোকচুরি বন আমি হবিগঞ্জের প্যালেস রিসোর্টে দেখেছি অনেকদিন পর।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন