দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা
সফরপর্ব- দশ
১০ জুলাই ২০১৬ সাল। ঐ দিন আমরা ভূগর্বস্থ
ট্রেনে টরেন্টো শহরের অন্টারিও লেকপারে যাই। আমাদের আবাস ক্রিসেন্ট টাউনের হাইরাইজ
ভবনমালার কাছেই মেট্রোট্রেন স্টেশন। খানিক হেঁটে স্টেশনে গিয়ে লিফটে স্টেশনে নেমে
ট্রেনে উঠি। পথে টরেন্টোর ডাউন টাউন দেখা হয়। কাঁচ নির্মিত অসাধারন শহর। এখানে আছে
বিখ্যাত C N Tower (Canadian National Tower) যার উচ্চতা ১৪৬৮
ফুট। টরেন্টো যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটের চেয়ে অনেক উন্নত শহর। ডেট্রয়েটে রেলপথ নেই, অথচ এখানে মানুষ
নিজ বাসে কিংবা পাতাল রেলে নির্বিঘ্নে সারাটা টরেন্টো ঘুরে বেড়াতে পারেন। টরেন্টো
মহানগর পুরোটাই সবুজে ঢাকা ম্যাপল, উইলো, পাইন বৃক্ষে ছাওয়া
এক নিরব উদ্যান। কানাডার এই শহর বন জঙ্গল জলা, বৃক্ষলতা ঘেরা
কাটবিড়ালি, বুনোহাঁস ও পাখিদের এক স্বর্গরাজ্য।
সড়কের দুইপাশে সারি সারি ডুপ্লেক্স ও
ত্রিপ্লেক্স বাসা। প্রতিটি বাসায় সুসজ্জিত বাগান ও দামি গাড়ি। প্রতিটি বাসার পাশে
রয়েছে শিশুপার্ক কিংবা নেচার পার্ক। এযেন পৃথিবীর এক স্বপ্নপুরী। এখানে মানুষ বেশ
সুখ-শান্তিতে কর্মব্যস্ত জীবন পার করেন। আমরা ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনে ট্রেনে
উঠি। গন্তব্যে পৌঁছে আমরা টরেন্টোর বিখ্যাত পর্যটন দ্বীপ সেন্টারপার্কে যাবার জন্য
টিকেটের লাইনে দাড়াই। আমাদের সাথে ছিলেন ভাগনা রুহুল, বৌমা ছিদরাত, ভাগনি মুন্নী ও
নাইম। মুন্নির সুদর্শন তিনজন পুত্ররত্ন ওয়ামি, ওয়াজি ও ওয়াফি।
আবার লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি। দু’তলা পর্যটন জাহাজ।
কুলকিনারাহীন অন্টারিও লেকের অথৈ জলে সাঁতার কাটে। ঢেউ ভেঙে অসংখ্য দ্রুতগামী
জলযান লেকে ছুটাছুটি করছে। আমাদের জাহাজ ভর্তি চার পাঁচ শত নানা জাতি, ধর্ম, বর্ন, ভাষা ও নৃতাত্বিক
লোকজন। তাদের পোষাক আষাক সবই বিচিত্র। বিচিত্র গাত্রবর্নের সাথে বিচিত্র চুলের
স্টাইল। মনে হল মহান আল্লাহ বৈচিত্র পছন্দ করেন। এই বৈচিত্রের খেলা তিনি তার সেরা
সৃষ্টি মানুষের মধ্যেও প্রয়োগ করেছেন। জাহাজ হতে পিছনে তাকাই। চেয়ে দেখি টরেন্টো
শহরকে ক্যালেন্ডারের ছবির মত অপূর্ব লাগছে। প্রতিদিন দুইটি জাহাজ এভাবে লোকজন নিয়ে
অনবরতঃ সেন্টারপার্কে যাতায়াত করে থাকে।
সেন্টারপার্কে আসতে জাহাজের প্রায় ৪০/৪৫
মিনিট সময় পার হয়। সেন্টারপার্ক হতে লেক সৈকতে টরেন্টো সিটি দেখা গেলেও অন্য কোন
দিকে উপকূল দেখা যায়না। অথৈ লেকে নৌকা বেয়ে দক্ষিনে এগিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে পৌছা
যাবে। চোখের সামনে অথৈ সাগরের মত সীমাহীন জলরাশির উপর উর্মিমালা খেলা করছে।
সেন্টারপার্ক হল অন্টারিও লেক-সাগরে
ভাসমান বেশ কয়েকটি ক্ষুদে দ্বীপের নিকুঞ্জ। এই চরগুলোর মাঝে মাঝে আছে অগভীর
জলাভূমি। এই দিঘীসম জলাভূমির উপর দিয়ে নির্মিত সেতু দিয়ে দ্বীপগুলোকে একসুতায়
বেঁধে ফেলা হয়েছে। এই অগভীর জলাভূমি আমাদের ভাটি অঞ্চলের বিলের মত। তরঙ্গহীন
পানিতে মুখ মেলে তাকিয়ে আছে জলপদ্ম, শাপলা ও ভেট জাতীয়
জলজ লতাগ্লুগ্ন। পুরো জলাভূমি জলচর হাঁস ও পাখির অবাধ বিচরন ভূমি।
সারা চরাঞ্চলে সবুজ ঘাসের পরিপাঠি গালিচা, হাঁটতে মনে হয়
সবুজ ইরানী মখমলের গালিচার উপর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের মাথার উপর সারি সারি ম্যাপল, পাইন, উইলো, খৃস্টমাস ট্রি
সেদিন ছাতা মেলে সামারের উজ্জল দুপুরে ছায়া বিতরন করে। নাস্তা সারতে আমরা একটি বড়
ম্যাপল গাছের নিচে গোলাকার হয়ে বসি। বাদ সাধলো পাশে একজোড়া শ্বেতাঙ্গ কপোত-কপোতি।
তারা পরস্পর জড়িয়ে ধরে লীলামত্ত। একসময় আমাদের গ্রামের বাড়ির ছন-ছাদের বাংলোয় শুয়ে
শুয়ে ছাদের চেপ্টা তীরের উপর চড়ুইদের প্রকাশ্য কাম-উম্মাদনা দেখতাম। আজ তাই দেখছি
পাশের ম্যাপল তলার সবুজ মাঠটায়। আমাদের দেশের চড়ুই কিংবা কবুতরের দল সবার সামনে যা
করে এখানে দিবালোকে তাই করে তরুণ তরুনীরা। কোন রাখডাক নেই, একেবারে
নির্ভিঘ্নে ও প্রকাশ্যে।
ক্যানাডায় কেউ কারো দিকে তাকায়না। পরস্পর
সম্মতিতে নরনারীরা স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে। ও কাজে আমাদের মত তাদের কোন
পাপবোধ নেই, বাঁধা নিষেধ নেই। আসলে নৈতিকতা ও পাপবোধ
ধর্মে ধর্মে এবং জাতিতে জাতিতে ভিন্ন হয়, এমন কি বিপরীত
হতেও দেখা যায়। আমাদের নারীদের শরীর না ঢাকা পাপ, কিন্তু ওদের তা
নেই। আমাদের প্রকাশ্য ওরালসেক্স পাপ, ওদের কাছে এতে
আবার পাপের কি? এটা তো জীবজগতের প্রাকৃতিক ব্যাপার
স্যাপার। তখন আমার মনে হল পবিত্র কাবাঘরের দিকে পা রেখে অসংখ্য মানুষকে আমি বসতে
দেখেছি। একজন কালো মানুষকে এটা ঠিক নয় বললে সে জবাব দেয় এতে আবার সম্মান অসম্মানের
কি আছে। আল্লার ঘরের দিকে আপনি সেজদা দিবেন, মুখ রাখবেন, চোখ রাখবেন, হাত রাখবেন, সবগুলো অঙ্গ
রাখবেন। আর পা রাখলেই পাপ হয়ে যাবে, অসম্মান হয়ে যাবে।
এখন বলুন তো পায়ের দুষটা কিসের। আমি কাবার দিকে পা রাখা লোকের যুক্তি শুনে ভাবি
আসলে তাইতো।
ভাগনা নাইম বললো- এখানে বসা যাবেনা, অন্যত্র চলে যাই। আমি বলি দরকার নেই। ওদিকে না তাকালেই হল। আমরা সবাই গোল হয়ে ঘাসের মাঠে খেতে বসি। ওয়ানটাইম প্লেটে নানা উপাদেয় উপাদানে তৈরি রসনাদার গম-পাউরুটির বার্গার আসে। এক বার্গারেই শুন্য পাকস্থলী ভরে যায়।
টরেন্টোর কাছে অন্টারিও লেকের পর্যটন চরাঞ্চল সেন্টারপার্ক নানা প্রজাতির পাতাঝরা বৃক্ষশোভিত, শীতদেশীয় নানা অজানা ফুলের এক সুসজ্জিত বাগান। সোয়ান ড্রাইভে নেমে দেখি পাতিহাঁসের মা-দেরে কচি ছানাদেরে নিয়ে সাঁতরাত কাটছে। সারাটা দীপাঞ্চলে জুড়ে প্রচুর সাদা গাংচিল ও ফ্লেমিঙ্গরা উড়াউড়ি করছে। দ্বীপগুলোর মধ্যবর্তী অগভীর জলাভূমি শান্ত নদীর মত। তীরে তীরে বন, বসার ও জলে নামার ঘাট, সামনে স্ফটিক স্বচ্ছ জল, মাছ, জলচর প্রানী, সবই অপূর্ব। ছোট ট্রেনে চড়ে দ্বীপের অনেক জায়গা ঘুরে আসি। কোথায়ও লেক-পার, কোথায়ও সুড়ঙ্গ পথ। পথে পড়ে একটি চিড়িয়াখানা। এখানে গরু, ছাগল, শুকর, খরগোস, ময়ুর, ঘোড়া, ভেড়া, মোরগ, টার্কিস সব ধরনের প্রানীর সমাবেশ রয়েছে। এক টিকেটে অনেক রাইড চড়ি।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন